বরফপাহাড়ে গোত্তা খাইয়া সাগরে ডুবিয়া যাইবার মুসিবত লইয়াই কি নির্মিত হয়েছে ক্যামেরনের টাইটানিক (Titanic)? সর্বকালের সিনেমাব্যবসায় সাক্সেসফ্যুল একটা কাজ ‘টাইটানিক’ দেখতে যেয়ে এই খটকাটা মাথায় ঘাই মারে। কেউ যদি খেয়াল করে দেখে বিশেষ সেই মুহূর্তটা, যে-মুহূর্তে জাহাজডুবির গজবটা নামল, তাইলেই ক্লিয়ার হবে ব্যাপারটা। ক্যাটাস্ট্রোফিটা সংঘটিত হয় লিয়োনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়ো ও ক্যাইট উইন্সলেট অভিনীত প্রণয়ার্দ্র যুগলের অবৈধ অভিসারের চূড়ান্ত পর্যায়ে আসঙ্গলিপ্সু যৌনঘটনা সাঙ্গ হবার সঙ্গে সঙ্গে, যখন তারা দুইজনে সেই সঙ্গমস্থল নিচুছাদ গাড়িটি থেকে ঘর্মাক্ত উজ্জ্বলদেহে বেরিয়ে এসে জাহাজডেকে দাঁড়ায়। কিন্তু ঘটনাধারার সূত্রপাত যে এইখানেই, — না, ব্যাপারটা তা নয়; এইটাই যদি হতো, বড়জোর বিপর্যয়টা তাইলে বলা যেত অদৃষ্টের বিড়ম্বনা বা সীমালঙ্ঘনের শাস্তি, — সীমালঙ্ঘন দুইটা জায়গায় — এক, অবৈধ যৌনমিলন এবং দুই, সমাজনির্ধারিত শ্রেণি ডিঙানো।
গুরুতর ব্যাপার এ-ই যে, সেই জাহাজডেকে স্বেদবিন্দুঝলমল প্রশমিত শরীরের উচ্ছ্বল ক্যাইট তার সদ্য-দেহবিচ্ছিন্ন প্রেমিক ডিক্যাপ্রিয়োরে জানায় যে নেক্সট মর্নিং জাহাজ যখন নিউইয়র্ক বন্দরের ঘাটে ভিড়বে সে তখন গরিব প্রণয়ী ডিক্যাপ্রিয়োর হাত ধরে তার ধনী বাগদত্তার বাহুডোর থেকে ভাগবে; সে আরও বলে, দরকার নাই বাবা এই-সমস্ত দুর্নীতিঝকমকানো দৌলতের, তার কাছে সত্যিকারের প্রেমের ছায়ায় গরিবি জিন্দেগিই শ্রেয়। এবং এই সেই মুহূর্ত, সংলাপটা চালানোর মাঝখানেই, গোত্তা খায় আইসবার্গের সঙ্গে সেই-সময়কার সর্ববৃহৎ জাহাজ টাইটানিক।
হোয়াই? শিপ গোত্তা খাইলই যদি হিমবাহপর্বতের সঙ্গে, এই সংলাপিকা চালাইবার সময়েই খাইতে হইল কেন? সত্যিকারের বিপর্যয়টা আদতে এই সংলাপ মুখনিঃসৃত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দেয়, এবং সেইটা সামলানোর মরিয়া ট্রাই থেকেই দি শিপ হিটিং দি আইসবার্গ; সত্যিকারের বিপর্যয় আসন্ন, যখন পরবর্তী সকালে নিউইয়র্ক বন্দরঘাটে জাহাজ নোঙর করার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্রিয়ো-ক্যাইট যুগল দুইপয়সার প্রেমের লাগিয়া একে অপরের বগলদাবা ভাগবে, এবং যখন নিউইয়র্কে দেড়টাকার বস্তিঘরে তাদের লাইফ শুরু করবে; যে-কেউ অনুমান করতে পারবেন অভাবের উপস্থিতিতে কেমন করে প্রেম খিড়কি দিয়া পালায়া জান বাঁচায়। কাজেই, বিপর্যয়টা ঠেকাতে হয় এবং অনিবার্য হয় জাহাজডুবি। তীরে এসে তরী তো ডুবাইতেই হয়, তীর যদি হয় সাগরের চেয়েও অনিশ্চিত বিপদসঙ্কুল তবে এছাড়া আর উপায়ই-বা কী! বিপর্যয়টা ঘটাতেই হয় প্রেমিকজুটির প্রেমটারে নিরাপদ ও অমর রাখিবার তাগিদে; যেন বিভ্রমটা জাগায়ে রাখা যায় যে এই জুটি নিরাপদে নিউইয়র্কবন্দরে পগারপার হবার সুযোগ পেলে ম্যে-বি ‘অতঃপর তাহারা সুখেশান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ বাগধারাটা জয়যুক্ত হইত।
ঘটনা এইখানেই খতম হয় না; আরেকটা ক্লু রাখা হয় সিনেমায় ডিক্যাপ্রিয়োর ফাইন্যাল মোমেন্টগুলোর ভিতর দিয়া। হাড্ডিতে-হিম-ধরা ঠাণ্ডা সাগরপানিতে জ্যাক চরিত্রে রূপায়ণকারী ডিক্যাপ্রিয়ো জমে যেতেছিল, মরে যেতেছিল, অথচ রৌজ চরিত্ররূপী ক্যাইট তখন সহিসালামতে একটা কাঠখণ্ডে বেশ-বড়সড়ভাবে ভেসে থাকতে পারছিল; রৌজ/উইন্সলেট ষোলোআনা ঠাহর করতে পারছিল যে সে তার প্রেমিকটারে হারাতে চলেছে, ফুঁপিয়ে কান্দাকাটির আওয়াজের সঙ্গে ক্যাইটের গলায় এই কথাটাও শোনা যায়, “আমি তোমারে যাইতে দিতাম না জানু!” বলছিল, আর, আশ্চর্য, ঠেলছিল, লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে ক্যাইট তার কাঠখণ্ডের কোণা আলতো ধরে থাকা জ্যাক বেচারারে একটু একটু করে ঠেলছিল কাঠছাড়া হবার জন্যে, ঠেলছিল দূরে, ক্যাইট তার নিজের হাতে এই কাজ করছিল লক্ষণীয়। হোয়াই? কেন?
প্রণয়প্রীতির মিঠিমিঠি কিসসাকাহনগল্প বলবার তলা দিয়া টাইটানিক আমাদেরে আরেকটা গল্প বলিয়া যায়, সেই গল্পটা ধান্দায়-বিৎলা হাইসোসাইটির আইডেন্টিটি-ক্রাইসিসে ভোগা একটি মেয়ের, যে কিনা কনফিউজড, নিজেরে নিয়া তার কী করণীয় ভেবে পায় না, শান্তি পাবে কোথায় যেয়ে কার সনে কথা কয়ে সে জানে না, তার প্রেমিক বেচারাও ভবঘুরে চালাচুলোহীন ছিন্নমূল, — শিল্পীমানুষ, ছবি আঁকে সে, দুনিয়া তাকিয়ে দেখার আনন্দে মশগুল — যদিও মেয়েটার হালত তার প্রেমিকের চেয়েও সঙ্গিন এই-বাবতে, প্রেমিক ডিক্যাপ্রিয়ো অনেকটাই মিডিয়েটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ক্যাইটের লাইফে, এক-ধরনের ‘ভ্যানিশিং মিডিয়েটর’, যে-মধ্যস্থতাকারী ধনাঢ্য ঘরের বাগদত্তা ক্যাইটের সেন্স অফ আইডেন্টিটি ফিরাইয়া আনার কাজ করে, ক্যাইটের পার্পাস অফ লাইফ খুঁজিয়া বাইর করতে হেল্পারের ভূমিকায় ফাংশনরত, মেয়েটার সেল্ফ-ইমেইজ/আত্মমুখাবয়ব ধরিয়ে দিতে হেল্প করে (যেমন আক্ষরিক অর্থে, কথোপকথনে, এবং মুখপ্রতিকৃতি অঙ্কনের মধ্য দিয়েও); কর্মসমাধা হইলেই সে ভ্যানিশ হয়ে যাবে এমন ভাবখানা, তাই-ই হয়, ভ্যানিশ হয়ে যায় শেষমেশ। এই কারণেই, লক্ষ করবেন, ডিক্যাপ্রিয়ো নর্থঅ্যাটল্যান্টিকে বরফ-জমাটবদ্ধ অন্তর্হিত হবার আগে ক্যাইটকে যে-কথাগুলো বলে যায় সেগুলো যতটা-না মৃত্যুপথযাত্রী প্রেমিকের তারচেয়ে বেশি প্রিচারের, ক্যাইটকে সে হিমে-শাদা কাঁপতে কাঁপতে পইপই করে বলে যায় জিন্দেগি জিনে ক্যে লিয়ে, কেমন করে নিজের প্রতি বিশ্বস্ত ও সৎ থেকে জিন্দেগি যাপন করতে হবে এইসব পইপই করে বলে যায় জ্যাকরূপী ডিক্যাপ্রিয়ো রৌজরূপী ক্যাইটেরে।
এসবের পিছনে একটা মানে বের করা আদৌ কঠিন হয় না। মানেটুকু সোজা। ক্যামেরনের স্যুপার্ফিশিয়্যাল হলিউড-মার্ক্সিজম। এই জিনিশটা আদতে কেমন জানেন? এই স্যুপার্ফিশিয়্যাল হলিউড-মার্ক্সিজম মালটা? ক্যামেরন তার কাজে দেখবেন নিচুশ্রেণির গরিবগুর্বাদেরে বেশি বেশি সুযোগসুবিধা দিয়া রাখছেন, এখানে এই সিনেমায় যেমন থার্ডক্লাসের প্যাসেঞ্জার জ্যাক ডসন চরিত্রে রূপদানকারী ডিক্যাপ্রিয়োকে ফার্স্টক্লাসে অবাধ বিচরণ এবং প্রায় প্রিন্সেসের সঙ্গে প্রেম-দেহমন করবার মওকা হাতে তুলে দেয়া, আরেকদিকে পেটমুটকো ধনিক শ্রেণির নিষ্ঠুর অহং ও সুবিধাবাদ চিহ্নায়কগুলোরে একটা হাল্কাপাৎলা হাস্যপরিহাসের ছলে ক্যারিক্যাচারাল এঁকে দেখানো। স্যুপার্ফিশিয়্যাল হলিউড-মার্ক্সিজম মালটা ক্যামেরনের টাইটানিকে অ্যাট-লিস্ট এইভাবে পাওয়া গেল। ছবিটা আমাদেরে করে না বঞ্চনা, আমরা হান্ড্রেড পার্সেন্ট বুঝতে পারি জেইমস ক্যামেরনের ভাবগতিক, আমরা আমোদিত হয়ে ক্যামেরনের আইসবার্গ-হিটিং অভিসন্দর্ভ স্যুপারহিট করে দেই বিশ্বব্যাপী।
কিংবা ক্যামেরনের এই সিনেমাকাহনে ব্যক্ত সহমর্মগল্পের তলায় আরেকটা ন্যারেটিভ পাওয়া যায়, সেইটা সাংঘাতিক রিয়্যাকশন্যারি মিথ একটা, ন্যারেটিভটা ফার্স্ট ডেভেল্যপ করেন বহুকাল আগের কিপ্লিং সাহেব — রুডিয়ার্ড কিপ্লিং — তার ক্যাপ্টেইন কারেইজিয়্যাস আখ্যানের সেই হিম্মতি কাপ্তানের দূতিয়ালি দিয়া, আখ্যানভাগে এক ধনকুবেরের ক্রাইসিস নিরসন হতে দেখা যায় জ্যান্ত রক্তমাংশের রগরগে এক গরিবের ঘনিষ্ঠ মধ্যস্থতায়। এইসব গরিবের লাগিয়া মায়াকান্নার পিছনে যে-জিনিশটা চাপা থাকিয়া যায়, সেইটা দানখয়রাতি-ভানপটু ধনী পিপলের রক্তখেকো শোষণ, সেই প্রোডাক্টের মুখচোরা নাম ধনিক শ্রেণির ভ্যাম্পায়ারিক এক্সপ্লোয়েটেশন।
Film Title: Titanic ।। Released Year: 1997 ।। Genre: Drama, Romance ।। Duration: 3h 14min ।। IMDb Score: 7.8/10 ।। Director: James Cameron ।। Stars: Leonardo DiCaprio, Kate Winslet, Billy Zane, Kathy Bates, Frances Fisher, Bernard Hill, Jonathan Hyde, Danny Nucci, David Warner, Bill Paxton ।। Music Score: James Horner ।। Net profit approximately $ 2.187 billion
অ্যা পার্ভার্ট’স্ গাইড টু ফ্যামিলি থেকে বাংলায় জাহেদ আহমদ
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS