আজমপুর স্টেশনে সিলেটগামী ট্রেন থামে। আমি উত্তরার পরের আজমপুরের কথা বলছি না। আজমপুর রেলস্টেশন, জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সিলেটগামী ট্রেন সেখানে কেন থামে? আমার কাছে মনে হয়েছে সেখানে থামে আখাউড়ার প্রক্সি হিসেবে।
আখাউড়ার নাম শুনলেই শৈশবের স্মৃতি ভেসে ওঠে। ‘ডাব, ডাব…’ আর আরও যতসব ডাকাডাকি শুনেই আমরা বুঝতাম আখাউড়া পৌঁছে গেছি। গুরুজনেরা হাফ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেলতেন এই ভেবে যে নিদেনপক্ষে ট্রেন মধ্যামধ্যি এসে গেছে। সেইসময় ট্রেনের ইঞ্জিন বদল হতো। পাক্কা আধঘণ্টা বিরতিতে তারা ছা, সপ, শিংগারা, ছমুছার কারিগরদের খুঁজতেন।
ছা, সপ, শিংগারা, ছমুছার কারিগর বলতে আমি আসল কারিগরদের কথা বলছি। ঢাকাভিত্তিক ছা, সপ, শিংগারা, ছমুছার কথিত কারিগররা অবশ্য গতকাল একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন আমি তাদের কথা বলছি না। আগেকার দিনগুলোতে যখন ইয়াবার জন্ম হয়নি, আখাউড়ার ব্রেকে অবশ্য বখাটেরা ডাইল খেতে নেমে পড়ত। ডাবওয়ালারাই না-কি এগুলোর যোগান দিত। তাই বুঝি সাইফুর রহমান আখাউড়ার দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে বিকল্প রাস্তা চালু করলেন।
আমরা আজমপুরকে নতুন করে চিনলাম। বিমানবন্দর স্টেশনের পর ট্রেন লম্বা এক ছুট দেয়। তারপর, আজমপুরে থামে। কেন থামে? সে এক আলাদা প্রশ্ন। এই বিরতিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কেমন রাজস্ব আয় হয়? ঢাকাফেরত যাত্রীদের যাদের কাছে টিকেট নেই তাদের কাছ থেকে টিটিরা কেমন বখরা নেয়? দুরগামী যাত্রীরা এতে কি হয়রানিতে পড়ে? সেটা আলাদা প্রশ্ন।
আমি এক বৃহস্পতিবারে সিলেট যাবার নিয়তে কালনির টিকেট করি। তখন চাকরি বদলিয়ে একটি নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি। বেটারহাফকে বলেছি আগেই কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে আসন গ্রহণ করতে, আমি বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেনে উঠব। ট্রেন ছাড়ার তখনও প্রায় একঘণ্টা আগে রাওয়া থেকে এক সহকর্মীর সাথে বেরোলাম। তিনি অফিসের কাজে এসবি অফিসে যাবেন। আমি তার সাথে উবারে যাব। সহকর্মী গন্তব্যে পৌঁছালে সেখান থেকে আমি নিজের জন্য কমলাপুর যাওয়ার ব্যবস্থা করব, এই ছিল প্ল্যান। কমলাপুর গিয়ে ধীরেসুস্থে আসন গ্রহণ করতে পারলে, ঝামেলা কমবে। কিন্তু, সেই আশার গুড়ে বালি!
মহাখালিতে উবারে উঠেই জ্যামে পড়লাম। গাড়ি মোটেই এগোচ্ছে না। হাঁটি হাঁটি পা পা করে তেজগাও অফিসার্স মেসের সামনে যেতেই দেখলাম বিধি বাম। অপরদিক থেকে কোনো গাড়ি আসছে না। উবারের চালক পর্যবেক্ষণ করে জানালো যে ভিআইপি ম্যুভমেন্ট আছে। রাজধানীর বাসিন্দামাত্রই ভিআইপি ম্যুভমেন্টের প্যাড়া সম্পর্কে সম্যক অবগত। যাত্রীদের ট্রেন বা বিমান ছুটা থেকে শুরু করে রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সেই প্রাণত্যাগ যে-কোনোকিছুই ঘটতে পারে। কপালের ফাঁড়া।
সহকর্মী থেকে চালক কেউই অভয় দিতে পারছিল না। কমলাপুর থেকে ট্রেন ছাড়ার তখনও আধাঘণ্টারও উপর সময় বাকি ছিল। উবারের চালক তবুও আমাকে কার থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে পাঠাও বাইকে সোজা বিমানবন্দর স্টেশনে যেতে বুদ্ধি দিলো। তার বুদ্ধি নিলাম। তখনও জানি না সামনে যে আরো দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে।
বাইকের ড্রাইভার ভিআইপি ম্যুভমেন্ট-এর সুযোগে বাইক নিয়ে পুলিশের নাকের ডগায় এক টান দিলো। ভাগ্যিস পুলিশ আটকায়নি। নাহলে এখানেই প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনেই আরো সময় নষ্ট হতো। পাঠাও-এ চড়তে আমার অনেক ভয় লাগে। পাঠাও অনেককে পঙ্গুতে আর কিছু যাত্রীকে সোজা কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে। বেপরোয়া বাইকচালকে রাজধানিবাসীরা এমনিতেই অতিষ্ঠ।
বিমানবন্দর স্টেশনে গিয়ে নতুন টেনশন। লোকজনের অনেক ভিড়। উপরন্তু এইখানে ট্রেন অল্প সময় দাঁড়ায়। পাছে না ট্রেন ছুটে যায় এই ভয়ে দুই লিটারের এক বোতল পানি কিনে বগির নম্বর না মিলিয়েই ধাক্কাধাক্কি করে চেয়ারকোচের একটি কামরায় উঠে পড়লাম। উঠেই টের পেলাম কী বড় ভুল করেছি!
স্ট্র্যান্ডিং ও টিকেটবিহীন যাত্রীদের ভিড়ে ট্রেনে ত্রাহি মধুসূদন দশা। সময় গড়ানোর সাথে সাথে ভিড় বাড়তে লাগল। অন্য কামরা থেকেও স্ট্র্যান্ডিং যাত্রীরা এসে ভিড় বাড়াচ্ছে। অন্ধকূপের মতো বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম।
পরাজিত হলওয়েল অভিযোগ করেন যে নওয়াব সিরাজ ইউরোপীয় বন্দিদের একটিমাত্র ক্ষুদ্র জানালাবিশিষ্ট ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থবিশিষ্ট একটি কক্ষে আটকে রাখেন। ইউরোপীয় ও ইংরেজদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, জুনের প্রচণ্ড গরমের সে-রাতে ইউরোপীয় ও ইংরেজ বন্দিদের ওই অন্ধকূপে ঠাসাঠাসি করে থাকতে বাধ্য করা হয়। ফলে সকাল পর্যন্ত শ্বাসরূদ্ধ হয়ে এবং যুদ্ধাহত অবস্থায় অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ১৪৬ জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ১২৩ জন বলে ইউরোপে প্রচার করা হয় এবং স্বীকৃত হয়। চন্দননগরে পলাতক কিছু ইংরেজের গল্পকাহিনিতে মৃতের সংখ্যা ১২৩ থেকে বাড়িয়ে ২০০ পর্যন্ত বলা হয়।
আমি কিন্তু মোটেই বাড়িয়ে বলছি না । গালাগালি ও চিৎকারে ট্রেনের ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ হচ্ছিল। মহিলারাও ভিড়ের চাপে পিষ্ট হচ্ছিল। যারা টিকেটধারী ও সিটে বসে ছিল তারা ক্রমেই অধৈর্য্য হয়ে উঠছিল। অধৈর্য্য হওয়ারই কথা। পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে মুখের উপর এত লোক দাঁড়ানো থাকলে বিরক্ত হবারই কথা। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে আমিও সাংঘাতিক বিরক্ত হই। কিন্তু, বিধি বাম। স্ট্র্যান্ডিং ও টিকেটবিহীন যাত্রীরা রেলের দায়িত্বশীলদের কল্যাণে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আমার মোবাইলে ই-টিকেট ছিল, কিন্তু আমি জায়গা থেকে কোনোমতেই নড়তে পারছিলাম না। মাঝেমাঝেই আমার মনে হচ্ছিল যে বিমানের টিকেট না করে কেন রেলের টিকেট করতে গেলাম। লোকের ঠ্যালায় যখন কোণঠাসা, তখন বোকামির জন্য নিজেকেই শাপ-শাপান্ত করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। এদিকে ট্রেন থামার কোনো লক্ষণই নেই।
অনেক কষ্টে এক পুলিশের পেছন পেছন লোকদের ধাক্কা মেরে মেরে পরবর্তী কামরায় পৌঁছলাম। পৌঁছে দেখি এটা ইঞ্জিনের কামরা। ইঞ্জিনের আওয়াজে কান ঝালাপালা হলেও একটু শ্বাস নিতে পেরে কিছুটা হাল্কা বোধ হলো। ইঞ্জিনের পাশের সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে কামরার অপর অংশে পৌঁছে চক্ষু চড়কগাছ। কুল ডি সেক (Cul de sac)…
ফার্স্টক্লাস বগির সাথে ট্রেনের এই অংশের সংযোগ কাটা। বেটারহাফের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে বেহাল দশার কথা জানালাম। ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি / মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলো যায়’ — গাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর ছিল না।
কুলাউড়া থেকে সিলেট ট্রেনে একঘণ্টার রাস্তা। সিলেট থেকে ট্রেন ছাড়ার আধাঘণ্টা পর মাইজগাওয়ে পৌঁছে ট্রেন থামাতে আমি যারপরনাই বিরক্ত বোধ করি। কুশিয়ারা নদীর উপর ব্রিজ হওয়ার পর সিলেটের সাথে ফেঞ্চুগঞ্জ তথা মাইজগাওয়ের যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতির পরও মাইজগাওয়ে ট্রেন থামার যৌক্তিকতা সম্পর্কে অনেকবার সহযাত্রীদের সাথে আলাপ করেছি। পক্ষান্তরে, এখন মনে হচ্ছে ট্রেন কেন থামছে না। ট্রেন অল্প সময় থামলেই তো আমি নেমে গিয়ে একদৌড়ে রিজার্ভ কামরায় উঠে পড়তে পারি।
সময় যেন ফুরোয় না । আরবিতে না-কি প্রবাদ আছে, অপেক্ষার প্রহর কিয়ামত থেকে কঠিনতর। আমার তা-ই অনুভূতি হচ্ছে। ট্রেন চলছে তো চলছেই।
অবশেষে আজমপুর এসে ট্রেন থামল। নেমেই একদৌড়। রিজার্ভ কামরায় নির্ধারিত আসনে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সহযাত্রী দম্পতিরা মেয়েশিশু সহ সিলেট ভ্রমণে যাচ্ছেন। তাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম। তাদের সাথে আলাপচারিতা শুরু করতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো।
এই সাইটে লেখকের অন্যান্য লেখা
বাঞ্চ || ওলি মো. আব্দুল্লাহ চৌধুরী
- আপেলের মতো শরীরগড়ন ও সব্জিকড়চা || ওলি মো. আব্দুল্লাহ চৌধুরী - February 19, 2021
- কোভিডময় শীতের বিদায়বেলায় || ওলি মো. আব্দুল্লাহ চৌধুরী - February 13, 2021
- ট্রেন টু আজমপুর || ওলি মো. আব্দুল্লাহ চৌধুরী - February 7, 2021
COMMENTS