কাঁটালতা বেয়ে ওঠা গিটারের তার || হিজল জোবায়ের

কাঁটালতা বেয়ে ওঠা গিটারের তার || হিজল জোবায়ের

‘এফডিসি’ নামে কচি খন্দকারের পরিচালনায় একটা ধারাবাহিক নাটক ’১০/’১১ সালে প্রচারিত হয় আরটিভিতে। সে-সময় নাটকটার টাইটেল স্যং লেখার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। কচি ভাইয়ের ফরমায়েশে টাইটেল স্যং-এ যা যা দরকার মিশিয়ে শেষমেশ একটা গান লিখে ফেললাম আমি। নাটকের গল্প ও আবহের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত হলো গানটা মমতাজকে দিয়ে গাওয়ানো হবে।

কিন্তু সংগীত আর সুর কে করবে! কচি ভাই শেষমেশ আইয়ুব বাচ্চুর ব্যাপারে আগ্রহী হলেন। আমরা একদিন সময় করে গেলাম এবির স্টুডিওতে। আমার সেই প্রথম বাচ্চুদর্শন। কিন্তু দেখলাম তাঁর মধ্যে কোনো স্টারডম নাই। তিনি পূর্বপরিচিত আত্মীয়ের মতন বরণ করে নিলেন। স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে অনেক গল্পগুজব করলেন। গানের প্রসঙ্গ যখন এল, বাচ্চু ভাইকে বলা হলো গানটার একটা দারুণ সুর আর সংগীত করতে। আমরা আসলে খুবই উত্তেজিত ছিলাম। তাঁকে এটাও জানানো হলো যে, আমরা চাই মমতাজ গানটা গাইবেন।

বাচ্চু ভাই মমতাজের নাম শুনে খুব-একটা উত্তেজনা দেখালেন না। পরে বললেন, আমি সুর আর মিউজিকটা রেডি করি, তোমরা পরে আরেকদিন আইসা দেখো কেমন দাঁড়ায়। মমতাজ তো থাকলই, আর-কেউ  ভালো গাইলে সেটাও আমরা দেখব।

সপ্তাহখানেক পর উনি ডেকে পাঠালেন সবকিছু রেডি করে। গিয়ে দেখি, এ কী! — উনি গানটার শুধু সুর আর সংগীত করেই ক্ষান্ত হননি, কোথায় আমরা সেটা মমতাজকে দিয়ে গাওয়াব, তা না, উনি নিজেই সেটা গেয়ে ফেলেছেন! মানে হলো, আর কেউ না, উনিই গাইবেন গানটা। পুরাটাই ওনার!

কচি ভাই ও আমি দুইজনই একটু বেজার হলাম। কিন্তু দুই-একবার গানটা শোনার পরে আমাদের  মনে হলো যে, এর চেয়ে দারুণ আর কেউ গাইতে পারত না। আমরা যে স্পিরিট, ফুর্তি, উত্তেজনা চাইতেছিলাম রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু দারুণভাবে সেটাই ঢেলে দিছেন ওইখানে। পরবর্তীতে গানটা আমাদের পুরা টিমের এতই পছন্দ হইছিল যে, আমরা নাটকটার শ্যুটিং, এডিটিং শুরু করতাম গানটা দুই তিনবার শোনার পরে।

এই হলেন কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু। আমি খুব লাকি ফিল করছিলাম যে আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত গানটা উনি গাইছিলেন। সেইদিন নিজে নিজেই যে উনি গানটাতে কণ্ঠ দিছিলেন সেটার মধ্যে কোনো স্থূল চাওয়াপাওয়া ছিল না। যেটা ছিল সেটা এই যে, সংগীতের ব্যাপারে উনি ছিলেন পাগল, শিশুর মতো নির্দোষ একটা অধিকার বোধ করা মানুষ। আর তাঁর ছিল চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সহজাত প্রবৃত্তি। উনি পারবেন, এবং উনি পেরেছেন। তাঁর সংগীতক্যারিয়ারের দিকে তাকালেও এই ব্যাপারটাই লক্ষণীয়। কীভাবে কীভাবে একজন গিটারবাদক পরবর্তীতে হয়ে উঠলেন বাংলা গানের কিংবদন্তি। এজন্যই তিনি রকস্টার!

ভালোবাসা আইয়ুব বাচ্চু। আমরা অনেকের সাথে সাথে আপনাকে শুনতে শুনতেও বড় হইছিলাম। বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো আমরা, সেইসব বখাটে কিশোরেরা কাঁটালতার মতন বেড়ে উঠছিলাম আপনাদের গিটারের তারে বেয়ে বেয়ে। আমাদের স্বপ্নের ভেতর এখনো মন্থর হয়ে ঘুরছে সেই সব ক্যাসেটের ফিতা। নিজের জীবনকে, সেই জীবনের স্মৃতিকে ভালোবাসি বলে আপনাকেও ভালোবাসি। সালাম!

*

যে-গানটা টাইটেল স্যং হিসেবে বাচ্চু ভাই গাইছিলেন, সেটার পুরা উদ্ধার করতে পারিনি। আমার কাছে উপস্থিত কোনো নমুনা নাই। যেটুকু পাওয়া গেল সবার উদ্দেশ্যে তা তুলে দিলাম :

এফডিসি, এফডিসি
এফডিসি এরই নাম এফডিসি।।

হাজারও রঙের স্বপ্নে গড়া,
রঙেরও নেশায় পাগল করা,
রঙের কারখানা এই এফডিসি,
এফডিসি এরই নাম এফডিসি।।

রূপালি নেশার এই যে দুনিয়া
কত তারকা, হিরো-হিরোইন নিয়া,
কত সিনসিনারি, ভিলেনি-জোকারি
ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা কান্না-হাসি,
এফডিসি, এরই নাম এফডিসি।।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you