আইয়ুব বাচ্চু বলতেই মিউজিশিয়্যানদের কাছে — সেই নাইন্টিসের অ্যাপ্রেন্টিস্ মিউজিকপ্র্যাক্টিশনার পার্ফোর্মারদের কাছে — ভোক্যাল বাচ্চু যতটা না তারচেয়ে বেশি গিটারিস্ট বাচ্চুই ঈর্ষণীয়। কথাটার মানে এ নয় যে বাচ্চুর ভোক্যাল আন্ডারএস্টিমেইট করছি। ইন-ফ্যাক্ট ওই সময়টায় হার্ডরক গাইবার ভোয়েস কোয়ালিটি কয়জনের মধ্যে ছিল? ‘ওয়ারফেজ’ সবেমাত্র এসেছে তখন, ওয়ারফেজের পয়লা অ্যালবাম বেরোনোর ঠিক পরেই ‘এলআরবি’ নিয়া আইয়ুব বাচ্চু শুরু করেন তার মিউজিক্যাল মর্দানা দেখাইতে। এইসব ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে — এই একটামাত্র সুখস্মৃতি আমাদের দৈনন্দিনে বেশুমার অসুখ-অসহনের মধ্যে।
ব্যান্ডসংগীতের/রকসংগীতের শিল্পী হিশেবেই শুধু নয়, মিউজিশিয়্যান হিশেবে এবি ছিলেন কমপ্লিট একটা ইন্ডাস্ট্রিই — এই কথাটা বারবার না-আওড়ালেও চলে; এইটা আমরা সকলেই জানি এবং স্বীকার করি। গিটারধ্যানী আইয়ুব বাচ্চুর অরিজিন্যালিটি নিয়া বাংলাদেশের রক/ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানরা যেইভাবে উদ্দীপিত হয়েছে, এবিকে যেভাবে কেব্লা মেনেছে এবং এবি দ্বারা ইন্সপায়ার্ড হয়েছে, এমনটা বোধহয় পৃথিবীর খুব কম শিল্পীর বরাতেই জোটে। দেশের রাজধানীর খবর হয়তো-বা রাখেন অনেকেই, কিন্তু মফস্বলে এবি গিটারমায়েস্ত্রো হিশেবে সেই শুরুর দশকেই কীভাবে সাড়া জাগায়েছিলেন — এই খবরটা জানাতেই নিবন্ধ মুসাবিদা করতে লেগেছি।
স্মৃতিই চারণ করব মূলত। নব্বইয়ের গোটা দশক জুড়ে — অ্যাক্টিভলি নাইন্টিফাইভ থেকে টু-থাউজ্যান্ড-থ্রি পর্যন্ত — সিলেট শহরের লোক্যাল স্টেজে ব্যান্ড পার্ফোর্ম্যান্সের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েইটেড থাকার সুবাদে এবির ইম্প্যাক্ট ও তাকে নিয়ে ক্রেইজ দেখেছি গিটারমত্ত তরুণদের মধ্যে। এবং নিজেও শামিল ছিলাম ওই গিটারমত্ত এবিভক্তদের দলে। একেবারেই নিজের ইচ্ছার জোরে সেইসময় লিডগিটারটায় আঙুল বুলাতে শুরু করেছিলাম বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। বেশ কিছুদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাজিয়ে গেছি সিলেটের মিউজিশিয়্যান বন্ধুদের সঙ্গে জ্যামিং বা খ্যাপ ইত্যাদিতে, এই গিগে সেই গিগে, একদম শহরসংলগ্ন অনুষ্ঠানাদির স্টেজগুলোতে। বেশিরভাগ ব্যান্ডই বিয়াশাদি-বার্থডে ইত্যাদি প্রোগ্র্যামগুলোতে শো করত। সেইসময় বাংলাদেশের যে-কোনো জেলাশহরের মতো সিলেটেও গড়ে উঠেছিল প্রচুর ব্যান্ড। লোক্যাল ব্যান্ডগুলোর মধ্যে ‘টাফ বয়েজ’ তখন টেলিভিশনশো এবং অ্যালবাম করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। এক ব্যান্ডের ক্রু আরেক ব্যান্ডের সঙ্গে খ্যাপ মেরে বেড়ানো ছিল কমন ঘটনা। এক্সচেঞ্জ হতো ইন্সট্রুমেন্টের। ‘প্রমিজ’, ‘এসএবি’ (সাউথ এশিয়ান ব্যান্ড) এবং ‘পিজিয়ন’ — এই তিন ব্যান্ডের সঙ্গে আমি লিড বাজিয়েছি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে। এই সমস্তই আজ মিষ্টি স্মৃতি হয়ে আছে আমার কাছে।
সেইসময় ব্যান্ডের গানবাজনায় আধিক্য ছিল সিন্থেসাইজারের। কিবোর্ডসের। গিটার ছিল নানান সাউন্ডের ভিড়ে একটা সাপ্লিমেন্ট সাউন্ড মাত্র। রকগানে গিটার বাজত পল্লিগীতির মতো দূরাগত অস্পষ্ট স্বরে যেন। যদিও বিদেশি/ইংরেজি রকগানে দেখতাম তখন গিটার বাজানো কাকে বলে। দেশের ব্যান্ডগুলোর মধ্যে কিবোর্ডস্ দিয়াই সর্ববাদ্যি বাজানো হতো। দুম করে তেড়েফুঁড়ে একজন এলেন গিটার বাগিয়ে, ‘এলআরবি’ নামে একটা ব্যান্ড নিয়ে, এবং আমরা হা হয়ে দেখলাম গিটারের তুজুর্বা আর জোর কাকে বলে।
একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে সেইসময় গিটার মানেই ছিল হাওয়াইন গিটার, অ্যাট-লিস্ট লোকের মনে তা-ই ইম্প্রিন্টেড ছিল, ফলে হাওয়াইন গিটার দিয়ে এক-দুইটা গানের পরিচিত ধুয়া বাজিয়ে অভিভাবকদের হাততালি পাবার শিশুতোষ ইচ্ছাটা ইয়াং জেনের মধ্যে একেবারেই ছিল না। প্যারেন্টদের পীড়াপীড়িতে গ্যুডবয়-গ্যুডগার্লরা শিখত বেতারে বা টেলিভিশনে রাগলহরী অনুষ্ঠানে বাজাইবার ম্যাড়মেড়ে স্বপ্ন নিয়ে। অ্যাক্যুস্টিক গিটারটাও অতটা হাটেমাঠে অ্যাভেইল করা যেত না আজকে যেমনটা যায়। ব্যান্ডগুলোই গিটার ইন্সট্রুমেন্টটাকে, স্প্যানিশ গিটারটাকে, তরুণদের মধ্যে পুশ করতে থাকে। এই-রকম একটা সময়ে এবি ইলেক্ট্রিক গিটারে চেপে এলেন ভুবাংলা জয় করার জজবাতি নিয়ে। এলেন, গাইলেন বাজাইলেন, এবং জয় করলেন। জয়ের সেই রথ তিন দশক ধরে ছুটিয়ে গেছেন তিনি নিরবচ্ছিন্ন অনবদ্য।
চূড়ায় থাকার সময় আইয়ুব বাচ্চুর একেকটা অ্যালবাম বাজার-উপচানো ব্যবসা করেছে, স্টেজে এবির পার্ফোর্ম্যান্স লক্ষ শ্রোতাদর্শকেরে টেনে এনেছে দর্শনীর বিনিময়ে, এবিকে নিয়ে বাংলাদেশের ছোটখাটো মিউজিকমার্কেটে ব্যবসাটা আসলে হয়েছে গিটারকেন্দ্রী। গিটার ইম্পোর্ট দেশে ব্যাপক হারে বেড়েছে এতে একবিন্দু সন্দেহ নাই। ফিগারটা বা পার্সেন্টেজটা আমি জানি না। কিন্তু এবির উপর ভর করেই দেশে গিটারের বিজনেস গড়ে উঠেছে, বেড়েছে, এক-সময় দেশের হাজার হাজার তরুণের হাতে গিটার উঠেছে একদম পোষা প্রাণীর মতো স্বতঃস্ফূর্ত সহজতায়। গিটারবিজনেস মানে কেবল গিটার তো নয়, গিটারের এক্সেস্যরিস্, অ্যাম্পস্, প্রোসেসর্স ইত্যাদি বিচিত্র পার্টস্। গানের বাজনার সংগীতের বাজারে গ্র্যাফ উঠানামা করেছে, কিন্তু গিটারের ব্যবসায় গ্র্যাফটা ঊর্ধ্বমুখে গেছে। এই বিজনেস চিরদিন এবিকে মনে রাখবে।
এবির আগে ব্যান্ডগানগুলোতে লিড বাজাইবার সুযোগ খুব-একটা পাওয়া যেত না। মাইলস বলি কিংবা সোলস বা ফিডব্যাক, মোটামুটি কিবোর্ডস্ দিয়াই তোলা যেত এবং লোকের তালিয়াও জুটত। আইয়ুব বাচ্চু ও ‘এলআরবি’ আসার পরে লিডগিটারিস্টদের বিক্রম বাড়তে থাকল মঞ্চে এবং স্টুডিয়োঅ্যালবামে। সেইসঙ্গে ‘ওয়ারফেজ’ ছিল লিডে এম্ফ্যাসিস দিয়া বাংলায় মারদাঙ্গা হার্ডরক গান গাইবার ও বাজনা বাজাইবার পথিকৃৎ। তবু লক্ষ করলে দেখা যাবে যে সেইসময় লাইভ লোক্যাল কন্সার্টগুলোতে এলআরবি-ওয়ারফেজ ব্যান্ডের কমন কয়েকটা নাম্বারের বাইরে বেশি পার্ফোর্ম করা হতো না। কারণ ছিল কমন কয়েকটা গান করার এবং বাকি গানগুলা না-করার। সংক্ষেপে সেইসব কারণের কয়েকটা আমরা খানিকটা দেখতে চেষ্টা করি নিচের অনুচ্ছেদে।
একটা কারণ তো এ-ই যে সেইসময়, সেই বিরানব্বই/তিরানব্বই থেকে দুইহাজার পর্যন্ত সময়টায়, গিটার মোটামুটি বাজাইতে জানত গুটিকয় মাত্র। অন্তত সিলেটে সেইসময় হাতের আঙুলে গুনে বলা যেত কে কে লিড বাজায়। এখন অবশ্য উল্টো ছবি। সিলেটে দুর্ধর্ষ লিড বাজায় এমন অনেকের সঙ্গেই বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দেখা হয়। তরুণ সব তুখোড় গিটারিস্ট সবাই। ভীষণ কনফিডেন্ট বাদন। তবে সেইসময় ছিল অপ্রতুল গিটারিস্ট। ছিল মঞ্চের অভাব। ছিল রিহার্স করার জায়গার অভাব। অ্যাম্প স্কার্সিটি ছিল। প্রসেসর ছিলই না বলতে গেলে। এবং সর্বোপরি গিটারের অভাব।
গিটারের অভাব ছিল — কথাটা আরেকটু সবিস্তার বলি। গিটার বলতে দেখতাম তখন জ্যাপানি আইবানেজ ফেন্ডার। খুব এক্সপেন্সিভ। ষাইট থেকে সত্তইর হাজারে এইটা হাতবদল হতো। ফলে কে কিনবে? এইটা আমি বলছি নব্বইয়ের গোড়ার দিককার সিলেটের খবর। একটা গিটার তখন সারা শহরে খ্যাপে খেটে ফিরত। পরে একটা চায়না গিটার বাজারে আমদানি হলে গিটারের সংখ্যা বেশ-কয়েকটা বাড়ে অবশ্য। চৈনিক গিটারটা হাজার-বাইশেক টাকায় পাওয়া যেত। পরে গিবসন ইন্ডিয়ান ভার্শন বাজারে এলে প্র্যাক্টিসপ্যাডে গিটার নিয়া কাড়াকাড়িটা থামে। সাত থেকে দশ হাজারে একেকটা ভারতীয় গিটার বন্ধুদের অনেকেই কিনতে থাকে এবং আমাদের বাজানোর সুবিধা হয়। এই-যে এক্সপ্যানশন, বাজারের সম্প্রসারণ ও ক্রেতাবান্ধব গিটার বিপণন, এর পেছনে এবি দাঁড়ানো — কথাটা ভুলে গেলে চলবে না।
আরেকটা ঘাটতি ছিল প্রসেসরের। ওই সময়ের প্রসেসর দেখলে এখনকার লিডগিটারিস্টরা হাসাহাসি করবে। এবি ইন্ট্রোর পরে খেয়াল হয় আমাদের যে এই সাউন্ড পুরাটাই হচ্ছে মেধাবী এবির প্রসেসরজাত। তবে এবির প্রসেসরের খোলনলচে জানতে এবং নাগাল পেতে আমাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। খোঁজ করতে হয়েছিল রাজধানীর রাস্তাধারের দোকানগুলোতে। সেইটা আলাদা গল্প। আপাতত বলি যে, সেই একবগ্গা প্রসেসরের যাতনা সয়ে সাতানব্বই/আটানব্বইয়ের দিকে বোধহয় হাতে পাই প্রসেসর ফাইভ-জিরো-ফাইভ। জ্যুম ফাইভ-জিরো-ফাইভ গিটার ইফেক্টস্ পেড্যাল। মাল্টি ইফেক্টের প্রসেসর। সমস্যা আর একটাই। এবির প্রসেসরগুলোতে যে-সাউন্ড, সেইটা আমাদেরে কে ক্রিয়েট করে দেবে? এই অভাব ঘুচাইতে ব্যবসা জমে উঠল আরেকটা, যারা চাহিদামতো ব্যান্ডের সাউন্ড-ক্রিয়েট-করা প্রসেসর সাপ্লাই দিত বা প্রসেসর তাদের দুয়ারে নিয়ে গেলে সাউন্ড বানিয়ে দিত, মোস্টলি এবির এবং ওয়ারফেজের, পয়সার বিনিময়ে এই সেবা বাংলার চৌষট্টি জেলার গানপাগলা তারুণ্য তখন নিয়েছে, এখনও রোজ নেয়।
এবির অজস্র গান এখনও মঞ্চে কেউ গায় নাই বা গাইতে পারে নাই এইসব সমস্যার কারণে। একদিন যখন এই সমস্যাগুলো উৎরে উঠবে, বাংলার আনাচেকানাচে স্টেজে-আড্ডায় এবির গানের ধুনে মাতোয়ালা হবে বাংলা আবারও, কথাটা বাড়িয়ে বলা হয়ে যায় কি? বোধহয় না। আমরা সেইসময় এবির যে-গানগুলো মঞ্চে ঘুরিয়েফিরিয়ে বারেবারে করেছি, সেগুলো হচ্ছে ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘ঘুমভাঙা শহরে’, ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট’ অ্যালবামের কিছু গান, ‘চাঁদমামা’, ‘সুখের এই পৃথিবী’, ‘হাসতে দ্যাখো গাইতে দ্যাখো’ ইত্যাদি। কিন্তু আজকাল তো অনেকটাই সুগম হয়েছে গিটারপ্র্যাক্টিসের ব্যাপারটা। চাইলেই পারা যায় ইউটিউবে যে-কোনো সংগীত সম্পর্কে তালিম নিতে। আগে আমরা একটা ক্যাসেটপ্লেয়ারে শুনে একটা গিটারপিস্ তুলতে যেয়ে রিওয়াইন্ড-ফরোয়ার্ড-প্যজ্ দিয়ে প্লেয়ারেরই বাপদশা ঘটিয়ে ফেলতাম। এখন তো ওই সমস্যা নাই। ইউটিউবে বা নেটের যে-কোনো পছন্দসই সোর্স থেকে একটা গিটারকাজ তোলা যায় ইফেক্টিভ প্রক্রিয়ায় এবং নিখুঁতভাবে। একদম পিনপয়েন্ট করে নোট সিলেকশন, তারপর রিপিট দিয়া দাও, ওই সিলেক্টেড জায়গাটাই দিনভর বাজতে থাকবে, তালিমকালে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি দ্বিতীয় কিছুই হতে পারে না। আগে তো কল্পনাতেই ছিল না এইসব সুবিধা আসবে একদিন দুনিয়ায়।
গিটারে এবির ইন্সপিরেশন নিয়া বাংলাদেশের এতগুলা প্রজন্ম বড় হয়েছে, এবি দীর্ঘদিন বাঁচবেন এই গিটারের বাংলা তারের ঝঙ্কারে।
- গিটারওয়ালা || উসমান গনি - October 26, 2018
COMMENTS