আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়ের প্রায় একসঙ্গে প্রয়াণের ঘটনা কাকতালীয় হলেও আমাদের বুদ্ধিজীবিতার এই আকালদশায় নতুন শূন্যতা যোগ হলো তাতে সন্দেহ নেই। আনিসুজ্জামান, অকপটে স্বীকার করছি, আমার খুব বেশি পড়া হয়নি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, অশ্রুকুমার সিকদার, কাজী আব্দুল ওদুদ, আবদুল হক, আহমদ শরীফ, মোহাম্মদ এনামুল হক, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখদের তুলনায় তাঁকে যৎসামান্য পড়েছি বলা যায়। তাঁর পাণ্ডিত্য এবং শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে জাতীয় জীবনের নানামুখী সংকটে তাঁর ভূমিকা, বলতে পারেন আনিসুজ্জামান সম্পর্কে আমার জানাশোনার পরিধি এটুকুই। তরুণ বয়সে আমাদের সংবিধান তিনি বাংলায় ভাষান্তরিত করেছেন, বাংলায় আইনি পরিভাষা তৈরি ও তথ্যকোষ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, রবীন্দ্রবিরাগের বাংলাদেশী ট্রেন্ডসেটে তাঁর আপত্তি ছিল, সর্বোপরি যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচারকর্য সহ বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল সংস্কৃতির সপক্ষে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি … মিডিয়াসূত্রে পাওয়া এইসব খুঁটিনাটির বাইরে তাঁকে নিবিড় করে জানার আগ্রহ কেন-জানি কখনও হয়নি।
আমার কাছে আনিসুজ্জামান ছিলেন সেই সজ্জন মুখপাত্র যিনি জাতীয় জীবন ও তার মানসগঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোয় অনুপ্রেরণা সঞ্চালনের ক্ষমতা রাখতেন এবং সেখানে তাঁর নিজের মতো করে পরিমিতিবোধের ছাপ ছিল। গ্রামশীয় বুদ্ধিজীবীর ছকে তাঁকে Traditional না Organic কোন ধারায় ফেলা হবে সে আমার জানা নেই। জাতীয় জীবনের নানা কর্মকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা প্রচলিত বা পন্থানুগ মনে হলেও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পটভূমির মধ্যে প্রগতি নিয়ে যেসব জটিল দ্বন্দ্ব ও সাংঘর্ষিক ধারণা বিরাজিত, তার সাপেক্ষে এই প্রথাগত পন্থাকে এক লহমায় খারিজ করা মুশকিল। সাহিত্যের ছাত্র হলেও তাঁর গবেষণাকর্ম ও সাহিত্যিক ভূমিকা ছাপিয়ে বাঙালিচেতনার বিনির্মাণ কেমন হতে পারে, মানবিক বোধ থেকে শুরু করে ধর্মচর্চা, সংস্কৃতিচর্চা, ভাষা শিক্ষা ও রাজনীতির জটিল সব আবর্ত বা বিরাজমান দ্বান্দ্বিকতাকে সে কীভাবে মোকাবিলা করবে তার সামগ্রিক ধারণাটি পাওয়ার ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামানের এই Activism ভীষণভাবে সাহায্য করে। এটি প্রকারান্তরে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মানসগঠন বুঝতেও সহায়ক মনে করি।
যেমন ধরুন, তাঁকে বুদ্ধির মুক্তি আন্দালনের প্রণেতা ‘শিখা’ গোষ্ঠীর পুরোধা ও অগ্রণীদের সঙ্গে গড় করা কঠিন। বাঙালি মুসলমানের চিন্তার স্বকীয়তার জন্য উনারা লড়াই করেছেন একসময়। আনিসুজ্জামান সেই লড়াইয়ের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু তাঁর জীবনচরিতের প্রতি ছত্রে সে-লড়াই গভীর ছাপ ফেলেছে বলে মনে হয়নি। যার মৌন ছাপ এমনকি আহমদ শরীফের মতো কট্টর প্রগতি-পন্থার পরিপোষকের মধ্যে আমরা মাঝেমধ্যেই ফুটে উঠতে দেখেছি। ছফার মধ্যে তো ওটা সবসময় কমবেশি ছিলই। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে আনিসুজ্জামান কিন্তু বুদ্ধির মুক্তিকে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার জের ধরে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী চেতনার জায়গা থেকে পাঠ করেননি। তিনি ‘বাঙালি’ ও ‘বাংলাদেশী’ এই দুইয়ের মধ্যে বিভাজনরেখা তৈরির বদলে মিলনের প্রয়াসী ছিলেন। তাঁর কাছে বাঙালি তাই সবসময় হাজার বছরের ইতিহাসসূত্রে ‘বাঙালি’ এবং পাকিস্তানী শাসনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসা ‘বাংলাদেশী’ উভয় পরিচয়ে সমান গুরুত্বপূর্ণ হতে পেরেছিল। যেটি আবার তাঁর প্রতি বিরক্ত এবং বিরোধী মত পোষণকারীদের কাছে তাঁকে ভারতপন্থী ছাপ্পায় দাগাতে উৎসাহী করেছে। কিন্তু সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বাইরে যাওয়ার নিশানা যদি পেতে হয়, আমার কেন জানি মনে হয়, আনিসুজ্জামানকে আমাদের ভবিষ্যতে পড়তে হবে।
না, আমি তাঁর মধ্যযুগের মুসলিম মানস বা এ-সংক্রান্ত কাজের কথা এখানে বলছি না। ওটা হয়তো তাঁর ম্যাগনামওপাস, তবে এখনও ভালো করে পড়া হয়নি বলে মন্তব্য সমীচীন বোধ করি না। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সূত্রে পাওয়া ভাণ্ডারের বদৌলতে মধ্যযুগের সাহিত্য ও মানস নিয়ে আহমদ শরীফের কাজ বহুধাবিস্তৃত ও প্রভাবসঞ্চারী ছিল এবং এখনও আছে মনে করি। আমরা অনেকে সে-সময় তাঁর ‘বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য’-র পাঠে মুগ্ধভাবে নিমজ্জিত ছিলাম। কিংবা ধরুন মোহাম্মদ এনামুল হকের সুফি ও মুসলমান সাহিত্য নিয়ে ভাবনাসঞ্চারী রচনাগুলোর প্রভাবে আনিসুজ্জামানকে ম্লান মনে হতো তখন। যে-কারণে তাঁকে নিবিড়ভাবে পাঠ করা হয়ে ওঠেনি। এখন হয়তো পড়া প্রয়োজনীয় হলেও হতে পারে। তবে না-পড়লে মারাত্মক ক্ষতিবৃদ্ধি হবে কি না সে-সম্পর্কে আমি আসলে নিশ্চিত নই। যেহেতু আনিসুজ্জামান যতটা লেখক ও গবেষক, তারচেয়ে নিজের পাণ্ডিত্যকে তিনি একটি জাতির মানবিক বোধ ও মানসিক গঠন তৈরির জন্য যেসব Activism প্রয়োজন হয়, সেদিকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
সংবিধানের ভাষান্তর, আইনকোষ প্রণয়ন, শব্দার্থ অভিধান রচনায় অবদান, যুদ্ধাপরাধের বিচারে সাক্ষ্যদান, রাজনৈতিক গণ্ডি ছাপিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্যের মানবিক আবেদন অনুভবের সপক্ষে তাঁর লড়াই, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস নিয়ে গোলযোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রতি পক্ষপাত, এবং এ-রকম আরও বহুবিধ Activism-এর প্রতীকী মূল্য বাংলাদেশের বাস্তবতায় অস্বীকার করা কঠিন। এগুলো প্রগতির প্রচলিত বা Traditional Frame-এ ভাষা পেলেও এবং বৈপ্লবিক বা যুগান্তকারী মনে না হলেও, আমরা এখন অবধি জাতীয়তাবাদের যে-সংকীর্ণ কারাগারে কাস করি এবং সেখানে বসে গ্রামশি কপচাই, অন্তত তার সাপেক্ষে আনিসুজ্জামানের সজ্জন কিন্তু অবিচল সক্রিয়তাকে অনুধাবন করা জরুরি মনে করি। বছরের পর বছর ধরে দেশজুড়ে তার সভাপতিত্ব ও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের ঘটনাবলিকেও সেই প্রতীকী আবহে পাঠ করা যায় এবং করা উচিতও হয়তো।
আনিসুজ্জামানকে বাংলাদেশে সম্প্রতি নতুন করে তীব্র হয়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের ডামাডোলের পটভূমিতে নিজের মত ও পন্থায় অবিচল এক মানুষ রূপে দেখা প্রয়োজন। মানবিকতা বহুভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তিনি এর সপক্ষেই দাঁড়ান। মনে রাখতে হবে আমাদের এখানে হেগেল, নিটশে বা হাইডেগারের মতো যুগন্ধর চিন্তানায়কের আবির্ভাব আজও ঘটেনি। উনারা ইউরোপীয় জাতির মানসগঠন কিংবা খ্রিস্টীয় মূল্যবোধের সাপেক্ষে মানবসভ্যতা ও মানবতাবাদকে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে মানবিকতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছেন, — আমাদের জাতীয় জীবনে সে-রকম ঘটনার নজির এখনও সুলভ নয়। অথবা ধরুন, শঙ্কারাচার্য, মাধবাচার্য, রামানুজ, পাণিনি, কৌটিল্য, ভর্তৃহরী থেকে শুরু করে শ্রীচৈতন্য প্রমুখরা আমাদের ধর্মচর্চা, ভাষা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ ও সামগ্রিক জীবনধারা সম্পর্কে যেসব ভাবনাজাগানিয়া কৌতূহলের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন তা মূল্যবান হলেও এর এক দশমাংশও আমরা কালের ধারায় নিতে পারিনি। যে-কারণে আনিসুজ্জামান-পন্থী ও বিরোধী সকলেই পশ্চিম থেকে ধার করা চিন্তার অনুকৃতির মধ্যে জাতীয় চেতনার বাহাসে লিপ্ত।
এই সীমাবদ্ধতার কারণে এখানে গবেষণা বা অ্যাকাডেমিক স্কেলের কাজগুলোর কোনো ছাঁচ গড়ে ওঠেনি। আমরা অনুমানমূলক ভাবনাকে ‘চিন্তা’ বলে বুঝি। সেই অনুমানের পেছনের ইতিহাস এবং তাকে অতিক্রম করে (নিটশে বা হাইডেগার যে-কাজটি সক্রেটিস-প্লেটো তথা পশ্চিমা বিদ্যালয়-শাসিত দার্শনিক কাঠামোকে খারিজ করার মাধ্যমে করে দেখিয়েছেন) নতুন ডিসকোর্স তৈরির ঘটনা বঙ্গে একপ্রকার দুর্লভ। যে-কারণে আহমদ শরীফরা যে-যজ্ঞে হাত দিয়েছিলেন পরে সেই ধারা ক্ষীণতর হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সারওয়ার ভাইয়ের ভাষা বিষয়ক একটি লেখার সূত্রে তাঁর সঙ্গে কিছু কথা চালাচালি হয়েছিল (সারওয়ার চৌধুরী, সাহিত্যিক)। সেটা এখানে উদ্ধৃত করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তাঁকে লিখেছিলাম :—
‘গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মতো বিদূষী কলকাতার এক অনুষ্ঠানে কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন, দেশে থাকতে পরীক্ষা কী করে পাশ দিতে হয় সেটা জানতাম, কিন্তু চিন্তা কী করে করতে হয় সেটা এখানে (আমেরিকা) না এলে শিখতে পারতাম না। আফসোস! দেরিদার নমস্য অনুবাদক নিজের ঘরের খবর নিজের দেশে বসে পাননি কখনও! Subaltern নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকলে সেই খবর পাওয়া কঠিন হয় বটে। কারণ Subaltern কেন Subaltern হয়ে ওঠে সেইসব ইতিবৃত্ত তিনি ভারতবর্ষের কোনও ভাষার সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে ও ভাবতে অপারগ। পশ্চিমের ভাষারূপের আদলে উপমহাদেশের লোকায়ত সমাজের মানসিক গঠনকে তাঁর ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে। গায়ত্রীর ক্ষেত্রে দূরত্বের কারণ কিন্তু সংস্কৃত জানা কিংবা না জানার মধ্যে নিহিত ছিল না। ওটা নিহিত ছিল সংস্কৃত ভাষাকে ‘উপরতলার’ তল্পিবাহক ভাষারূপ হিসেবে প্রত্যাখ্যানের মধ্যে। নিম্নবর্গের জগৎ সন্ধানে সংস্কৃত যায় না, — এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে তিনি মুক্তি দিতে পারেননি। যদিও সংস্কৃত, পালি ও আরবি-ফারসি থেকে জাত চিন্তনকণারা কালক্রমে এই উপমহাদেশ তথা বঙ্গের লোকায়ত মানসগঠনের ভিত্তি রচনায় ভূমিকা রেখেছিল। হয়তো বিক্ষিপ্ত, বিকৃত বা প্রক্ষিপ্ত রূপে সংস্কৃত সেই ছাপটি রেখেছিল। কিন্তু সেটাই জীয়নকাঠি হয়ে নিচুতলার ভাষাকে আরও নবীন রূপে নিজেকে গড়ার শক্তি দিয়েছিল। যেভাবে পরে নিচুতলার ভাষার রস উঁচুতলার রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছে তাঁর নিজের ভাষার ওজন ও স্বরে নতুন তূণ জুড়তে। এই সত্যটি আলোচনায় আনা দরকার। যেটা দুই বাংলার ভাষাচিন্তক ও ভাবুকদের মাঝে অনুপস্থিত মনে হয়।’
আনিসুজ্জামান (হয়তো-বা তাঁর মতো আরও অনেকের) পরিপূর্ণ গবেষক ও তাত্ত্বিক রূপে মহীরুহ না হয়ে ওঠার পেছনে উপরে যে-কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছি তার ভূমিকা গৌণ নয়। তাঁর নানামাত্রিক Activism তাঁকে আলোচনায় রাখলেও এইসব সীমাবদ্ধতার দোষে গবেষণা ও তত্ত্বে যুগান্তকারী হওয়ার পথে নিজেকে সচল রাখেতে পারেননি। তবুও বলব, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিচারে তিনি প্রয়োজনীয় মুখপত্র ছিলেন। তাঁর Activism চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো বৈপ্লবিক হয়তো নয়, কিন্তু মানবিক বোধির কারণে জাতীয় জীবনে এর মূল্য থেকেই যায়। আমাদের মাপের অনুপাতে তাঁকে বাতিল করার মধ্যে তাই কোনও কৃতিত্ব দেখি না। কারণ যারা বাতিল করছেন তারা নতুন কিছু কি বিকল্প হিসেবে যোগ করতে পেরেছেন সেখানে? যেটি করছেন সেটি প্রকারান্তরে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চর্চা আর সাম্প্রদায়িকতার ভাড়া খাটছে ইদানীং। আনিসুজ্জামান অন্তত এই দোষ থেকে মুক্ত ছিলেন। প্রগতির প্রচলিত ঘরানার কামলা খাটলেও অন্য অনেকের মতো সংস্কারান্ধ ছিলেন না। কেন জানি মনে হয়, তাঁর জীবনযাপনের মধ্যে যে-Activism প্রতিফলিত হয়েছে সেটার ভালোমন্দ দিকগুলো মিলিয়ে আমাদের তাঁকে পাঠ করা উচিত। আগামীদিনের বাংলাদেশের জন্য সে-কাজটি নিশানা তৈরির রসদ যোগাতেও পারে।
আপাতত এটুকই। দেবেশ রায় নিয়ে অন্তরকথন পরের মেইলের জন্য তোলা থাকল। তাঁকে নিয়ে বলার মুহূর্তে বাঘারু চোখের সামনে ভাসছে। লেখালেখির জায়গাজমি নিয়ে তাঁর ভাবনা ও কাজের প্রবাহও স্রোতের মতো বইছে নয়নে। সব একসূত্রে গেঁথে কথামালা না-হয় পরের মেইলেই বলি।
- জিমেইলে লেখকের সঙ্গে তাৎক্ষণিক আলাপের একাংশ গদ্যাকারে এই ট্রিবিউটে রাখা। — গানপার
তাৎ ক্ষ ণি কা : গা ন পা র ভা ষ্য
নতুন একটা বিভাগ তাৎক্ষণিকা, যেখানে লেখকের সঙ্গে মেইল চালাচালি কিংবা ফেসবুক-হোয়াটস্যাপ চ্যাটের তাৎক্ষণিক কথাবার্তাগুলো শুধু প্রুফসংশোধনপূর্বক গোছগাছ করে গদ্য হিশেবে পড়ার জন্য তুলব আমরা। আলাপের খোঁচায় ব্যক্ত কথা যেহেতু, ‘সুচিন্তিত মতামত’ বা আদবমতো শতরঞ্জি বিছিয়ে লেখা নয়, শুধু এই কারণে লেখাটাকে আমরা সরাসরি প্রবন্ধভুক্ত করব না। তাতে লেখকের অসতর্ক অবিন্যাস্ত ভাবনারাশি, বিস্রস্ত কথাচূর্ণ বা রাগবিরাগের সম্মার্জনী মন্তব্য তোপের মুখে ফেলতে পারে লেখককে, লেখকের অবমাননা হতে পারে তার পাঠকের কাছে, এই কথাগুলোই তিনি রীতিমানা প্রাবন্ধিকগদ্যে লিখতে বসলে অভিপ্রেত উপায়ে লেখাস্থিত যুক্তিবিস্তার পাঠকনাগালে এগিয়ে দেবার প্রয়াস পেতেন হয়তো।
তবে এই কথাটা নিশ্চয় স্বীকার করব যে হররোজ আমরা হাজারেবিজারে ব্যাপার নিয়া ভাবি, চিন্তা করি, চিল্লাইপাল্লাই, ইয়ারবখশিদের লগে গুলতানি-ইয়ার্কি দিতে যেয়ে বেজায় ইঙ্গিতগভীর ইশারানিবিড় সংকেত উৎপন্ন করি, সংকেত ছুঁড়ি, কিন্তু রচনায় সেসবের থোড়াই প্রিন্ট রাখতে পারি। ‘লিখতে বসা’ বাগচিহ্নটার ভিতরেই কিছু অপ্রাকৃত কৃত্রিমতার নিবাস পাওয়া যায়। সেই কারণেই জিন্দেগিভর আমরা হাজারেবিজারে ব্যাপার নিয়া মাথা ঘামাই, চিল্লাই, লিখি বড়জোর দশ-পঞ্চাশটা ব্যাপার নিয়া। যার ফলে আমাদের চিন্তাভাবনার বড় অংশটাই ডকুমেন্টেশনের বাইরে থেকে আপনাআপনি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই ঘটনা মুহুর্মুহু ঘটে চলেছে। এমনকি সোশ্যাল সংযোগ মাধ্যমের এই বড়াইয়ের যুগেও বলতে পারব না আমাদের উপর্যুপরি চিন্তা দলিলায়নের অকৃত্রিম কোনো পথঘাট বার করতে পেরেছি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস-কমেন্ট ইত্যাদির ভিতর দিয়া আমরা সাধারণের তুচ্ছাতিতুচ্ছ চৈতন্য দলিলায়নের যে-একটা দাঁড়াদিশা পাবো বলে ভেবেছিলাম, অঙ্কুরেই মৃত্যুবরণ করেছে সেই আশা। নায়কোচিত প্রদর্শনকামের তোড়ে ফেসবুক থেকে ড্যাটা আহরণপূর্বক আর কিচ্ছুটিই করবার নয়। আস্তিকদের আখাম্বা আল্লাবিল্লা আর নাস্তিকদের নাখারা ঠাট্টাতামাশা ছাড়া সামাজিক সংযোগের পরিমণ্ডলে এখন আর কিচ্ছুটি পাবার জো নাই।
চিঠিযুগে এই বিপদ, মানে প্রদর্শনের বাইরে থেকে কারো সঙ্গে নিজের চিন্তা আগায়ে নেবার সুবিধা না পাবার বিপদ, কমই ছিল বলব। কনভেনশন্যাল জর্নাল বা ডায়েরি ইস্তেমাল করে এই কাজটা করা যেত। অর্থাৎ নিজের চিন্তাটা ওয়ার্মআপ করে নেবার মওকা পাওয়া যেত চিঠিতে, জর্নালের বা ডায়েরির এন্ট্রিতে। লেখকের গোছানো প্রোজেক্টেড রচনারাজির বাইরে একটা আলগ অন্তরঙ্গ চিন্তার জগৎ মিলত তার দিনলিপি-চিঠি ইত্যাদিতে। এখন গোছানো কোনো চিন্তা নাই, চিন্তানায়কেরা আছে ফেসবুকে বেশুমার কাতারে-কাতার। আর আছে চিন্তানায়কদের চ-বর্গোচ্চারণকামী বিপ্লব। ইনবক্সে বেশিক্ষণ কথা চালানো যায় না কারো সঙ্গে, প্রেম ও পরকীয়া ছাড়া, সেলিব্রেটি হতে চাই সবাই, লাইভে যেতে চাই। ইমেইল কি ইনবক্সে একনাগাড়ে একটাকিছু নিয়া ‘ভাবা প্র্যাক্টিস করা’ ধাতে নাই।
তাৎক্ষণিকা বিভাগে লেখকদের কনভিনিয়েন্স অনুসারে আমরা আলাপ করব। তাৎক্ষণিক চাপানউতর পরে স্রেফ প্রুফচেকপূর্বক আপ্লোড করব গানপারে। যেমন সদ্যপ্রয়াত আনিসুজ্জামানকে উসিলা করে লেখক আহমদ মিনহাজের সঙ্গে মেইলে যে-কথাগুলো হয়েছিল, অবিকল সেই কথাগুলো দিয়া গানপারের নতুন বিভাগ তাৎক্ষণিকা স্টার্ট করা গেল। এই কিসিমের ঝটিতি আলাপে যে-বহুধা আঁকাবাঁকা খানাখন্দ উঁকি দ্যায় আমাদের পঠন-গড়নের, গুছিয়ে লিখতে বসলে কেবল প্রতিপাদ্য বিষয় বা উপজীব্য ব্যক্তিটিকেই পাওয়া যায়। লেখকের গোছানো চিন্তার চেয়ে বিক্ষিপ্ত-প্রক্ষিপ্ত মস্তিষ্কবুদবুদগুলোই দিশা দ্যায় আমাদেরে, জাম্প দিতে হেল্প করে। অবশ্য কবুল করে রাখি যে আমরা খুব কম লেখকের কাছেই জিগ্যেশ করার এই রিস্ক নেব বোধহয়, কেননা আমাদের চারপাশের লেখকদের আঁটঘাট বেঁধেছেঁদে লেখালেখির যা ছিরি, সাহস হয় না তাদের রাফখাতার দিকে তাকাইবার। সাক্ষাৎকারফ্রিক লেখালেখির এই দেশে সাক্ষাৎকারে লেখকদের যেই চিন্তার গতর ও বহর দেখতে পাই, মনে হয় না তারপরে থাকতে পারে আর-কোনো বক্তব্য। যা-হোক, আনিসুজ্জামান নিয়া আহমদ মিনহাজের কথাগুলো অবিকল গ্রহণ করে একটা তাৎক্ষণিক আলাপের দাগসম্বলিত প্রয়াণোত্তর শ্রদ্ধাগদ্য গানপারে রাখলাম। রচনান্তে এই আলাপপ্রক্রিয়ার তথ্যটাও জুড়ে রাখলাম দ্রষ্টব্যমতন।
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS