মধুর, তোমার শেষ যে না পাই… || তুষার কর

মধুর, তোমার শেষ যে না পাই… || তুষার কর

তিনি নেই। এখন জড়িয়ে আছেন স্মৃতি-সত্তায়, চিরকাল থাকবেন। মাসিমা বলে সম্বোধন করতাম কিন্তু মায়ের মতো ছিলেন। একদিন এক অনুষ্ঠানে মাথায় হাত রেখে, মাতৃস্নেহের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন এইসময়ের প্রবীণ গুণী শিল্পী চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ। সেই সন্ধ্যা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। আমার সকল কাজে তাঁর আশীর্বাদের ধারা ঝরে পড়ছে, আমি তাঁকে অন্তরে অনুভব করছি। এই বন্ধন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ছিঁড়ে যাবার নয়।

কতজনেরই তো বয়স হয়, তাঁরও হয়েছিল। কিন্তু এভাবে কাউকে কিছু না বলে চলে যাবেন, আমরা কেউই ভাবিনি। জীবনকে কেউ ধরে রাখতে পারে না, আকাশের কোনো নিমন্ত্রণে, তিনি পূর্বাচলের দিকে হঠাৎ পাড়ি জমালেন? তাঁর গানের খাতাটি খোলা রইল, কত গান সেখানে, কত সুর সেখানে। সকলেই চন্দ্রাবতীকে লোকগানের বড় শিল্পী হিসেবে মান্য করেন। এই শিল্পীর কণ্ঠে সহজ প্রসন্নতায় লোকায়ত বাঙলা ঝলমল করে ওঠে। আঙিনায় কত-যে শস্যের সম্ভার! লোকগানের অসামান্য সংগীতভাণ্ডারের শুদ্ধ রূপটি তিনি তাঁর পরিবেশনায় আজীবন ধরে রেখেছেন। যান্ত্রিকতা কিংবা কৃত্রিমতায় কখনো আক্রান্ত হননি। কোথাও বিকৃতি ঘটেনি।

গ্রামীণ বাঙলার শাশ্বত রূপ তাঁর তো জানা ছিল। মাটিতেই তাঁর পা। ধামাইল, পদ্মপুরাণ, সূর্যব্রত ও কীর্তন — প্রায় হারিয়ে যাওয়া বাঙলার আত্মার সম্পদকে পরম মমতায় কণ্ঠসৌকর্যে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন, সেইসঙ্গে ভালোবেসেছেন চণ্ডীদাস, রাধারমণ থেকে শাহ আবদুল করিমের গান। রাধারমণ তাঁর বড় প্রিয় ছিলেন। রাধারমণের গান তাঁর মতো শিল্পীর কণ্ঠেই সত্য হয়ে ওঠে। কতজনই তো গাইছেন কিন্তু চন্দ্রাবতী একজনই। চন্দ্রাবতী রাধারমণের গান পরিবেশনের জন্য বারবার রাজধানীতে ছুটে গেছেন। বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক অনুসঙ্গ, বিশেষত পরিবেশনার অকৃত্রিম উপস্থাপনার জন্য নাগরিকজনের যোগসূত্র স্থাপনে, তার আজীবন অঙ্গীকার সকল লোকগানের শিল্পীর কাছে শিক্ষণীয়। কলকাতা থেকে শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক এজন্য ছুটে এসে পেয়ে যান তাঁর আরাধ্য ধন চন্দ্রাবতীকে, আর তাঁকে পায় কে? সব পেয়েছির দেশটি পেয়ে মৌসুমীর আনন্দ ধরে না। এমনটিই তো তিনি চেয়েছিলেন। বাণীবদ্ধ করে নিয়ে গেলেন চন্দ্রাবতী রায়বর্মণের গান। কলকাতায় বাউল-ফকির উৎসবেও মাসিমা গেছেন। আবৃত্তিকার অম্বরীষ দত্তেরও এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা আছে। তিনি ছিলেন কলকাতাÑসিলেটের যোগসূত্র। মৌসুমী ভৌমিকের সৌজন্যে এই শিল্পীর একটি অডিওসিডি বেরিয়েছে।

চন্দ্রাবতী রায়বর্মণের গান পরিবেশনের দৃশ্যটি অপূর্ব। তাঁর শুভ্র-সমুজ্জল রূপটি মুহূর্তে সমগ্র পরিবেশ পাল্টে দিত। হাসিমুখে ধীর পায়ে মঞ্চে এসে বসতেন। যন্ত্রীরা দুই পাশে। যন্ত্রের আধিক্য নেই। হারমোনিয়ামে সুর তুলতেই, মিলনায়তনে নীরবতা। আমরা চন্দ্রাবতীর কণ্ঠে আবহমান বাঙলাকে পেতাম। বয়সের ভারে তিনি ন্যূব্জ ছিলেন না। যখন গান করতেন দৃঢ়, সাবলীল এবং সতেজ তাঁর কণ্ঠ। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেও তিনি গান করেছেন। জীবনকে তিনি গানের ভিতর দিয়ে দেখেছেন। জীবন তাই মৃত্যু শেষে পূরবী তান হয়ে বেজে উঠেছে। এই শিল্পী লোকগানের মঞ্চে দীপশিখা হয়ে জ্বলবেন। শান্ত, নীরব অথচ তাৎপর্যবাহী ছিল তাঁর উপস্থিতি। মিড়ের সৌন্দর্য, সমে এসে সুরের মাধুর্য, সংগীতবোদ্ধারা কী করে ভুলবেন?

চন্দ্রাবতী একটি যুগকে ধারণ করেছিলেন। মানুষ চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ একবারে গায়িকা চন্দ্রাবতীর মতো। কারো প্রতি কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই। কোনো মালিন্য নেই। অপরিসীম স্নেহ সবার জন্য। তাঁর গায়কী সার্থকতা পাবে সেদিন, নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের গলায় যদি তা শিল্প সুষমায় ধরা দেয়।

ছোট বড় সবার ডাকে চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ নানা অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন, উদ্বোধন করতে এসেছেন। সাতাশে আগস্ট অপরাহ্নে, আমাদের সম্মিলিত আহ্বানে শেষবারের মতো একটি গাড়িতে শুয়ে শহিদ মিনারে এলেন। ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন মিনারপ্রাঙ্গণে, তাঁর প্রিয়জনেরা অশ্রুসজল চোখে দেখলেন তাঁদের মাসিমাকে। কী অপরূপ রূপ তাঁর! আজ আর কোনো কাজের তাড়া নেই।  উদার বৈরাগ্যময়, বিশাল বিশ্রাম। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, সূর্যের প্রখর তাপে তাঁর শ্রীমণ্ডিত মুখখানি আরও দীপ্তিময়। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে মাসিমার ছোট্ট দেহখানি। শুধু মুখটিকেই যাবার বেলায় আমরা দেখেছি। মন বললো, মাসিমা জেগে উঠে হয়তো বলবেন, — এত ফুল কেন তোমরা নিয়ে এসেছো?

না, তিনি আর জাগবেন না। কুসুমে কুসুমে তাঁর চরণচিহ্ন রইল। বাসা বদলের ডাকে এবার সাড়া দিয়ে চন্দ্রাবতী মাসিমা চলে গেলেন। একটি শেষ শান্ত পবিত্রতায় তিনি চিরসুন্দর। তাঁকে শেষ প্রণাম। তাঁর মাধুর্যের শেষ নেই, শুধু যাত্রার সমাপ্তি আছে।

  • লেখাটি বিমান তালুকদার সম্পাদিত ‘মেঠোসুর’ পত্রিকার সৌজন্যে পাওয়া।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you