সরোজ মোস্তফা নি র্বা চি ত রানা নাগের ক বি তা
ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ মার্চ ২০২৪ সকাল ০৯.০০ টায় কবি রানা নাগ অনন্তলোকে প্রস্থান করেছেন। যে-শহরের মাটি-হাওয়ায় কবি বেড়ে উঠেছেন সেই নেত্রকোনায় কবিকে লাশবাহী গাড়িতে রেখে মামুন খান, বারীণ ঘোষ ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন। সন্ধ্যা সাতটায় শহিদ মিনারে মগড়াতীরের নাগরিকসমাজ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে ০৭:৩০ মিনিটে শ্মশানের স্নান থেকে অগ্নিসজ্জায় বসিয়ে দিয়েছে। কবির ছোটভাই সানা নাগ ঘুরে ঘুরে দাহকাজ শুরু করলো। আগুন নিভিয়ে শ্মশানবন্ধুরা রাত ১১:৩০ নাগাদ বাসায় ফিরলো।
মগড়ার তীরে লীন হয়ে গেল কবি। শোক প্রকাশের কোনো ভাষাই জানা নেই। ১৯৭৮ সালে ২ জানুয়ারি মগড়ার একপাড়ে কবি রুবাইয়াত আহমেদ অন্যপাড়ে কবি রানা নাগ জন্মেছিলেন। একবন্ধুর কান্না শুনতে শুনতে আরেক বন্ধু পৃথিবীতে এসেছেন। বন্ধু চলে গেলে শোকে ভারী হয়ে যায় বন্ধুর চোখ।
স্বার্থে নয়, সুসময়ে-দুঃসময়ে সবার পাশেই নিশ্চুপে ছিলেন রানা নাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৬-’৯৭ শিক্ষাবর্ষের বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী হয়ে জগন্নাথ হল ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক (১৯৯৮-২০০২), কার্জন হল ইউনিটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন যা-কিছু করেছেন সিরিয়াসলি করেছেন। সাপ্তাহিক সময় ও পূর্বাপর পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব ও পুরাণ বিষয়ে গভীরভাবে আগ্রহী রানা নাগ প্রগতিমনস্ক ও যুক্তিবাদী লেখক। এর মধ্যে তার লেখা গ্রন্থ ‘অদ্ভুত মানুষের গল্প’ (বিজ্ঞান), ‘রহস্যময় মহাবিশ্ব’ (বিজ্ঞান), ‘ফিবোনাক্কি’ (কবিতা) এবং ‘ধ্যান’ (কবিতা) , ‘ক্ষুদিতা’ (কবিতা) নজর কেড়েছে সুধী পাঠকের।
২.
কবি রানা নাগ আমাদের হাতে তুলে দেন পঙক্তির নতুন কুঁড়িতে সমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘ধ্যান’। ‘ধ্যান’ নিছক শব্দ নয়; ‘ধ্যান’ সমসময়ে বেঁচে থাকা একজন আত্মমগ্ন, প্রতীক্ষাতুর বাঙ্ময় মানুষের দার্শনিক উপলব্ধি। ‘ধ্যান’ বাঁচার ঐশ্বর্য।
জীবনের গতানুগতিক একঘেয়ে বর্ণনা রানা নাগের এই কাব্যগ্রন্থে নেই; নির্মাণের স্বাধীনতায় আছে বাঁচতে চাওয়ার প্রাঞ্জল অকুণ্ঠ উচ্চারণ। এই কবিতাগুলো হৃদয়কে, মননকে একটা উচ্চতায় রাখে। বারবার পাঠেও পুরনো হয় না ‘ধ্যান’। সময়চিহ্নের সবটাকে ধারণ করে ‘ধ্যান’ কাব্যগ্রন্থটি অন্তর্জীবনের অতল গাথা।
রানা নাগ এমন কবিতা লেখেন না যে আদুরে ধ্বনিতে শ্রোতাদের জমায়েত করবে কিংবা বাচিক শিল্পীরা জমিয়ে আবৃত্তি করে হাততালি আদায় করে নেবে। জীবনানুভবে, মানবানুভবে রানার কবিতা মগ্ন উপলব্ধির ছায়াতল। শান্ত হয়ে বসে থেকে জীবনকে যে দেখা লাগে, ছোঁয়া লাগে — প্রত্যক্ষ সন্ধিৎসায় কবি সে-কথাই প্রকাশ করেন। দৃষ্টি ও প্রজ্ঞায় তিনি একটি কেন্দ্রীয় চিন্তাকেই ধারণ করেন। সেই চিন্তার কেন্দ্রে আছে মানুষ।
কবির জীবনের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায় যাপিত জীবনে, আপনময়তায় কিংবা কাব্যচর্চায় তিনি ধ্যানী ও অন্তর্মগ্ন। দেশ-কাল, সময়চিহ্নকে অতিক্রম করে তাঁর কবিতা ভাবায়। তাঁর কবিতা চঞ্চল করে না, স্পর্শ করে, ব্যথিত করে, সত্য ও শমে বসিয়ে রাখে। মানবসংসর্গ, ভিড়, ঘাম, ক্লান্তি, কর্মময় একাকিত্বের সত্য রূপটাই তিনি লেখেন। নাগরিক পরিতাপের শুষ্ক সত্যতাকে তাঁর কবিতা প্রশ্ন করে।
৩.
কবি রানা নাগ ছিলেন বিরল প্রকৃতির মানুষ। উদার, দরদি, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ঘরানার এক সহজ মানুষ। যারা তাঁকে চেনেন, তারা জানেন কত বড় হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি! সবার জন্যই ছিলেন সহযোগী। তাঁর কাছাকাছি কোনো মানুষ বিপদে আছেন, অথচ তিনি সহযোগিতা করেননি — এমন ঘটনা বিরল প্রায়!
ভালোবাসা দিতেন, ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন। শারীরিক অনিয়মের ভিড়ে শরীর বিদ্রোহ করেছে বারবার! শেষে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে কেনিয়া সফরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে ল্যাবএইডে ভর্তি হয়েছেন। আর ফেরেননি। কোনোদিন ফিরবেন না।
৪.
পৃথিবীর ‘প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস’ আপনি লিখেছেন। আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে এখন সেই লেখা আর কে লিখবে?
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
কবি রানা নাগ স্মরণপত্র
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS