তেজী বাইসনের গান || মাহমুদুর রহমান নাহোল

তেজী বাইসনের গান || মাহমুদুর রহমান নাহোল

আগুনের কথা বন্ধুকে বলি
দু’হাতে আগুন তারও
কার মালা হতে খসে-পড়া ফুল
রক্তের চেয়ে গাঢ়।।

যার হাতখানি পুড়ে গেল বধূ
আঁচলে তাহারে ঢাকো
আজও ডানাভাঙা একটি শালিক
হৃদয়ের দাবি রাখো।।

সঞ্জীব চৌধুরী  সংবেদনশীল অবয়বে বোহেমিয়ান,  প্রথাবিরোধী  প্রকৃতিদত্ত কবিপ্রতিভা এবং ভেতরে ভেতরে এক ডানাভাঙা শালিক!   নিজস্বতায়-ঋদ্ধ নাগরিক সুরে নৈঃসঙ্গ্য, যন্ত্রণা, প্রেম, দ্রোহ  আর বিচ্ছিন্নতাবোধের কঙ্কাল ছিল তার  প্রতিটা গান। সুর সংক্রামক এবং বিষাদী, ফিকে বাতাসের মতো উড়ে বেড়ায় আশেপাশে! আমরা ধরি সেই সুর হাওয়া থেকে, বিষাদিত হই, ঘাই মারে বুকে। সেকো বিষের মতো আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায় আর চোখের জলের উপর ছায়া ফেলে গানের ভেতরকার অনুভব, অন্তর্গত বাক্যালাপ গেঁথে যায়  এক পদ্মফুল যার বয়ান দেয় এইভাবে — “আমার চোখে রাত, তোমার চোখে আলো!” অথবা “পূর্ব বুঝি না, পশ্চিমও না, সীমানা এঁকেছে কে?” এইসব সীমানা আঁকে কে? তার গানের ভিতর , সুরের ভিতর টুকরো টুকরো উল্লাস চিৎকার করে মুদ্রিত করে যেন নৈঃশব্দ্যের নৈর্ব্যক্তিক উপস্থিতি!

এই পঁচা-গলা পোশাকি সিস্টেম এবং শ্রেণিবৈষম্যের সমাজের বিপরীতে সঞ্জীব চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিলেন একরোখা তেজী বাইসনের  মতো, স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্যবাদী সমাজের, পা বাড়িয়েছিলেন আলোকিত পথে,  — নিরন্নের অন্ন, বেঁচে থাকার কথা বলার  জন্য  রাজপথে ছিলেন বামরাজনীতির হাত ধরে।  মানুষের প্রতি ভালোবাসাই ছিল তার রাজনীতির উৎসমুখ। তার লেখা কবিতা-গানেও প্রতিফলিত হয়েছে  জীবনমুখী চেতনা, ঘোষণা দিয়েছিলন দৃঢ়চিত্তে, স্ফুলিঙ্গের মতো স্বপ্নের কথা, শান্তির কথা : “একজন কর্নেল তাহের — পৃথিবীর সমান বয়সী স্বপ্ন নিয়ে আলিঙ্গন করেন ফাঁসির রজ্জু, পৃথিবীতে শান্তি রক্ষিত হোক, আকাশে শান্তি, বাতাসে শান্তি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীকে ধরিয়ে দিন” … অথবা “তবুও আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধান করিয়া / স্বপ্নেরই পাখি ধরতে চাই / আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই / আমার অন্তরের কথা বলতে চাই” …

০২
ইংরেজিতে একটা শব্দগুচ্ছ  আছে জানি ‘ফেলো-ডি-সি’। যদ্দুর জানি সে-ই হলো ‘ফেলো-ডি-সি’ যে নিজেকে পোড়াতে ভালোবাসে। সঞ্জীব ছিলেন আত্মবিধ্বংসী বোহেমিয়ান। তার ব্যক্তিগত বিষণ্ণতা, বোহেমিয়ান সত্তা সূর্যগ্রহণের মতো গ্রাস করেছিল তার গানকে; একজন বোহেমিয়ান, প্রকৃত নিঃসঙ্গ মানুষের ব্যবচ্ছেদ করেছেন তার গানে যেন মর্গের দমবন্ধ ঘরে; কেঁদে উঠেছেন এইভাবে — “ঘরে ফিরব না, ঘরে ফেরার কিছু নেই / রাখব না ধরে যে আর / ধরে রাখার কিছু নেই”; “কালা পাখি শোন তোর চোখ-কান কিছু নেই / মনের ভিতরে মাঝি তোর রাঙা নাও বাই”; “গল্প ভাঙে তবু গল্প জমে, এই চোখে রাত্রি নিঝুম; একলা এ-ঘর একলা প্রহর, থমকে দাঁড়ায়!” এই বোহেমিয়ান জীবনের ভিতরে  ভ্রমণে  একাকী ড্রাগনের শ্বাসে  পুড়ে যায় সঞ্জীবের চোখ, তিনি গেয়ে ওঠেন : “চোখটা এত পোড়ায় কেন / ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও / সমুদ্র কি তোমার ছেলে, / আদর দিয়ে চোখে মাখাও!” যেন সঞ্জীব নিঃস্ব রাজসন্তান! বুকভাঙা রোদ্দুরের বুকে শূন্যতার শিস বাজিয়ে গেয়ে গেছেন মানুষের আজন্ম দহনের কথা! গেয়েছেন :

ওই কান্নাভেজা আকাশ আমার ভালো লাগে না
থমকে-থাকা বাতাস আমার ভালো লাগে না
তুড়ির তালে নাচতে থাকা ভালো লাগে না
এই মরে মরে বেঁচে থাকা ভালো লাগে না …

০৩
তার গান শুধু গানই ছিল না, যেন এক-একটা কবিতা! কবিতাগুলোকে তিনি নিপুণ মায়েস্ত্রের মতো গানে কনভার্ট করতেন! দেশের অনেক পত্রিকায়ই তার কবিতা ছাপা হয়েছে। ‘রাশপ্রিন্ট’ তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থের নাম। তার একমাত্র একক অ্যালবাম ‘স্বপ্নবাজী’ … তিনি বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন এবং ‘আজকের কাগজ’, ‘ভোরের কাগজ’ এবং ‘যায় যায় দিন’-এ কাজ করতেন … নব্বইয়ের দশকের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

সঞ্জীব দেখিয়ে গিয়েছিলেন জীবনে কত বঞ্চনা, যা কেউ দেখাতে পারেনি, এর আগে গানের ভিতর। শ্রেণিবৈষম্য আর রাষ্ট্রের তথাকথিত উন্নয়নের ভিতর যে-বঞ্চনা তা বলেছেন তীব্র ক্রোধে, করুণ ব্যাঙ্গাত্মক সুরে এইভাবে : “রেডিওতে খবর দিছে দেশে কোনো অভাব নাই / নাইল্লার ঘরে, কাইল্লার ঘরে আনন্দের আর সীমা নাই / চেয়ারম্যানসাবে বগল বাজায়, আমরা কিসু দেখসি না!” অথবা “আসতিছে পরিবর্তনের হাওয়া … এদিকে তহবিল জমে, ওইদিকে চোখের পানি!” …

সঞ্জীব সময় এবং জীবনকে দেখেছেন গভীরভাবে, আপন খেয়ালে, বেঁধেছেন গান, তুলেছেন সুর! আমরা সেখানে খুঁজে পেয়েছি বিষণ্ণ ম্যান্ডোলিন!

সঞ্জীব গেয়েছেন, “পাগল রাগ করে চলে যাবে ফিরেও পাবে না / পাগল কষ্ট চেপে চলে যাবে ফিরেও আসবে না।” কাকে বলছেন ‘ফিরে আসব না’, জীবনকে? যাবেন কোথায়? মৃত্যুর দিকে? এ ধরনের লাইনের মুখোমুখি হয়ে অসহায় লাগে আমাদের, বিমূঢ় হয়ে পড়ে সমস্ত বোধ, বাতাসে কান্না লুকাই আর ব্যক্তিগত গল্পঘরে জেগে থাকি ভয় নিয়ে চলে যাওয়ার, সকল নশ্বরতার আড়ালে!

উনি গেয়েছিলেন শুদ্ধতম ভালোবাসার গান : “আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ / আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল চাঁদ / আমার চোখ গেল ধরেছে সুন্দর / মেয়ে তুমি এভাবে তাকালে কেন / এমন মেয়ে কি করে বানালে ঈশ্বর? / বুঝি না এমন মেয়ে কি করে বানালে ঈশ্বর?” … এ-রকম গান শোনার পর এক-ধরনের নিঃস্ব বোধ অনুভূত হয়, — সুন্দর, ঈশ্বর  এবং চাঁদের মতো মেয়ে লিখে দেয়  প্রগাঢ় বিষাদ !

০৪

এক পলকেই চলে গেল
আহ্ কী যে তার মুখখানা!
রিকশা কেন আস্তে চলে না!
 
বাতাস লেগে উড়ছে যে চুল,
উড়ছে আঁচল, সাদা সাদা ফুল!
রিকশায় দ্রুত চলে গেলে,
কেন আমার হলে না!
রিকশা কেন আস্তে চলে না?

কত সহজ, অথচ তীব্রভাবে বলে দিয়েছেন ‘এক পলকেই চলে গেল, রিক্সা কেন আস্তে চলে না’। আদ্যোপান্ত যেন প্রেমময় আকুতি কোনো গলির মোড়ের দাঁড়িয়ে-থাকা নিরীহ কিশোরের! সত্যি কি তাই? সঞ্জীব কি এমনই বলতে চেয়েছিলেন? নাকি প্রেম এবং জীবনকে একই  সুতায় মালা গেঁথেছেন সাদা সাদা ফুলে! আসলে এতসব প্রেম আর মায়ার আড়ালে একটি ধ্রুব সত্য ছুঁড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে সঞ্জীব, “সহসাই জীবন ফুরিয়ে যায়” হাহাকারের  জ্যামিতিতে,   জাদুকরী গায়কীতে। গানে।

তার গানের কাছে গেলে মনে হয় — কে না ভালোবাসা এবং জীবনের কাঙাল! সঞ্জীবের গানে মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি, প্রেম-দ্রোহের প্রতি ভালোবাসা ভাবলেশহীন! এইসব হৃদয়গ্রাহী গান সঞ্জীবের আত্মার ডায়েরি থেকে বাংলার হাওয়ায়, মাঠে, সবুজে, মানুষের মাঝে মিশতে চাওয়ায় … মিশেও যেতে পেরেছেন মানুষের হৃদয়-দরজায় তীব্রভাবে, তার সুরের প্রতিমা তাই সবসময় নৃত্যময়, জাজ্জ্বল্যমান! সঞ্জীব তাই থাকবেন সবসময় কিংবদন্তি হয়ে, তার  লিরিক আর কবিতা জ্বলে রবে অবিনাশী নক্ষত্রের মতো!

০৫
যখন সঞ্জীব গেয়েছেন — “দোলো ভাটিয়ালী / এ নদী রূপালি / ঢেউয়ের তালে / নৌকা বাজাও!” … তখন আমরা দেখি জীবননৌকার মাঝির  ভাটিয়ালী গাইতে গাইতে ভ্রমণ — সুরের মানচিত্রে, এঁকে যায় স্মৃতির ক্যালিওগ্রাফ বোধিবৃক্ষের নিচে!

খোলা আকাশ, একটি গাছ
সবুজ পাতা, একটি গাছ
স্মৃতির বৃক্ষ, পাতারা জানে নিজের চাষবাস।
কত যে কথা, এইটুকু গাছ
কত যে কান্না, এইটুকু গাছ
একটা সময়ের কিছু চিহ্ন
দাগ কেটে যায়, কোথায় যেন!

সময়ের ডাইনোসরের পিঠে চড়ে জীবনের এতসব বিচিত্র ভ্রমণের কথা সঞ্জীবই শিখিয়েছিলেন আমাদের তার গানের মাধ্যমে। এই তো সারি সারি কান্না, কথা … উড়ে যায় সমুদ্রের দিকে, প্রিয় মানুষের চোখের দিকে, তাই উনি গেয়ে উঠেছিলেন — “আমার মনেতে নাই সুখ / চোখের মাঝে বসত করে অন্য লোকের চোখ!” অথবা “আমি তোমাকেই বলে দেবো / কী যে একা দীর্ঘ রাত / আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে / আমি তোমাকেই বলে দেবো / সেই ভুলে-ভরা গল্প / কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায় / ছুঁয়ে কান্নার রঙ ছুঁয়ে জোছনার ছায়া!”

চাপ চাপ কষ্ট, ফালি ফালি বেদনা গানের ভিতর, দীর্ঘ রাতের বুকের প্রান্তে আমাদের ফেলে দিয়ে সঞ্জীব হেঁটে যায় বিরান পথে, কবির হাজার বছরের পথে! তিনি গানের মধ্যে বলে যান সম্পর্কের অভিজ্ঞানের ভুল ইতিহাস, কান্নার রঙ আর জোছনার ছায়ার ভিতর  দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়!

হাতের উপর হাতের পরশ র’বে না
আমার বন্ধু, আমার বন্ধু হবে না, হবে না
হাতের উপর হাতের পরশ র’বে না
শিশির ঝরবে সকালবেলা
আমাকে তুমি করবে হেলা
আমাকে ভালোবাসবে ঠিকই কিন্তু আমার হবে না …

হাতের উপর হাতের পরশ র’বে না, হাতের উপর হাতের পরশ র’বে না! … কত অবলীলায় কত সহজে পৃথিবীর দুরূহতম দুঃখগাথা গেয়েছিল সঞ্জীব চৌধুরী! পোড়াচোখ জুড়ে কার, — কার জন্য — গোপন দীর্ঘশ্বাস! শিশিরভেজা সকালবেলা, রাখালের বাঁশি, সোনালি ডানার চিল, প্রেম, মায়া … সব কোথায় যায়! যখন ইথারে ভেসে আসে হাতের উপর হাতের পরশ র’বে না, তখনই সঞ্জীব চৌধুরী নামক হলুদপাখি গান গাইতে থাকে আমাদের বুকের ভিতর, নিরবচ্ছিন্নভাবে!

 

[এই লেখাটা  ‘লাল জীপের ডায়েরী’ পত্রিকায় আগে একবার প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১২ অক্টোবরে এইটা ছাপা হয় বিজয় আহমেদ ও অর্পণ দেব কর্তৃক সম্পাদিত/সঞ্চালিত ওই পত্রিকায়। সেইখান থেকে গানপারে পুনর্প্রকাশের কারণ আর-কিছুই নয়, লালজীপ প্রায় দুইবছর হয়ে গেল প্রকাশবন্ধ, লেখাটা পাঠকের নাগালে রাখা গানপারপ্রকাশের একটা কারণ হতে পারে, দেড়-দুইজন নয়া পাঠকও জুটে যেতে পারে এই রচনাটার ভাগ্যে। লেখকের সঙ্গে আমাদের কোনো সংযোগ নাই, কাজেই লেখককন্সেন্ট নিতে পারা যায় নাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। তবে লালজীপের সঞ্চালকদের একজন বিজয় আহমেদ তাদের সাইট থেকে লেখাটি নিয়ে পুনর্প্রকাশের ব্যাপারে অনাপত্তি দিয়া আমাদেরে বাধিত করেছেন। — গানপার]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you