পূর্ণদৈর্ঘ্য নদীর মতো বয়ে যেতে চাওয়া শাহেদ শাফায়েত || সুমন রহমান

পূর্ণদৈর্ঘ্য নদীর মতো বয়ে যেতে চাওয়া শাহেদ শাফায়েত || সুমন রহমান

খুব সম্ভবত শাহেদ শাফায়েত ঢাকায় এসেছিল ১৯৮৮ সালের দিকে। ‘কোরপাটেলিক’ নামে একটা কবিতার বই নিয়ে। ওর কবিতা পড়ে আমাদের তো পাগল হওয়ার দশা! আমাদের বিনম্র, ক্রুদ্ধ, কৌশলী আর সুষমামণ্ডিত কবিতাশেখার দিনে শাহেদ হাজির হলো একটা ধূমকেতুর মতো। ওর উপমার অভিনবত্ব, অনুভবের বিচিত্র ক্ষমতা, আর কবিতার প্রথাগত কৃৎকৌশলের ওপর সহজাত দখল — সব মিলিয়ে শাহেদ শাফায়েত হয়ে উঠল শাহবাগের টক অব দ্য টাউন! সবখানেই ওকে দেখা যায়। টিএসসি, শাহবাগ, কাঁটাবন, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, তেজগাঁ গ্লাস সিরামিক হোস্টেল — কোথায় সে নাই! এসব জায়গার কোনোটাতেই সে কিন্তু আগন্তুকের মতো থাকত না। সবখানেই জাঁকিয়ে বসতো সে। সেটা আজিজ মার্কেটের নির্মীয়মাণ দোতলায় শাটার ফাঁক করে আধো অন্ধকারে কবিতা লেখার দোকানঘরই হোক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বা সিরামিক হোস্টেলে বন্ধুদের হোস্টেলই হোক। অচিরেই গৃহকর্তা হয়ে উঠত শাহেদ। আমি বাড়ি চলে গেলাম হয়তো, শাহেদ থেকে গেল আমার রুমে। দুদিন পরে এসে দেখি অচেনা সব মানুষজনকে নিয়ে সে তার আগন্তুকের জীবন থেকে অতি স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে এসেছে। এমনকি আমার বন্ধুরা অবলীলায় ওর বন্ধু হয়ে গেছে। মিডিয়াম হিসেবে আমার আর জরুরতই হচ্ছে না।

আর কি করছে সে? নিজের মনে কবিতা লিখছে, পড়ে শোনাচ্ছে, আর সস্তা বিড়ি টানছে।

আমরা তখন পড়াশোনা শেষ করে কাজের জগতে ঢুকছি। শাহেদই আমাকে ইচক দুয়েন্দের অফিসে নিয়ে গেল। আমরা কাজ করতে শুরু করলাম। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই শাহেদ আউট। কাজে মন নাই তার। কবিতা লিখল, “আমি বিশ্বাস করি না কাজ, আমি কথাজীবী মানুষ” — এমন একটি কবিতা।

মফস্বল থেকে আগত উন্মুল সাহিত্যিকদের জন্য কতটা নির্মম ছিল আশির দশকের ঢাকা? আজকে হয়তো সেটা বোঝা যাবে না। মনে পড়ে, রাত নয়টার দিকে একদল সাহিত্যিক অপেক্ষা করত শাহবাগে, কখন কবি বদরুল হায়দার আসবে! বদরুল হায়দারের সাথে পদব্রজে তারা রওয়ানা দিত তালতলা মার্কেটের দিকে। সেখানে একটা রুম ছিল বদরুলের মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে, সবাই মিলে থাকত তারা। শাহেদও যেত মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে আমার মালিবাগের বাসাটায় থাকত। মাঝে মাঝে হয়তো নকীবের বাসায়। কিংবা কফিলভাইয়ের সাথে। কখনো কখনো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে রাত কাটিয়েছে। কখনো ঘুমিয়েছে নজরুলের মাজারে। পাবলিক লাইব্রেরির সাইকেলস্ট্যান্ডে। পিজির পেছনে। আর্ট কলেজের ছাদে। বাবুপুরা বস্তিতে। কোনো পিছুটান নাই। কোনো ধরনের দ্রব্যে অরুচি নাই। কোনো ধরনের খাদ্যে অনীহা নাই। ক্ষুধায় কাতরতা নাই। সারাক্ষণ হাতের মধ্যে ধরা ঠোঙার কাগজ বা ছোট নোটবইয়ে নিবিষ্ট। লিখছে।

ওকে দেখলে আমার মিগুয়েল হেরনেন্দেজের কথা মনে হতো। এ-রকমই ছিল। তীব্র। উদ্বাস্তু। উন্মূল। ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’ নামে একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করত। সেটা নিয়ে কত কাহিনি হলো! দল-উপদল, মন কষাকষি, কোন্দল। নানারকম দেয়াল তৈরি হলো, কিন্তু শাহেদ এসব দেয়াল ভেদ করে চলাচল করতে পারত। শিশুর মতো ছিল সে। সবকিছুই একইরকম সারল্য নিয়ে গ্রহণ করত : বিষ হোক বা চকলেট।

আশির দশকের লিটলম্যাগগুলো যখন একে একে চরাঞ্চলে পরিণত হচ্ছিল, শাহেদ তখন সেসব চরের মধ্য দিয়ে একটা ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’ নদীর মতোই এঁকেবেঁকে বয়ে যেতে চাইত। এসব উপদলীয় রাজনীতির ছকে আটকে থাকতে চাইত না। ফলে শাহবাগের সব সাহিত্যিক অর্জুনেরাই ওরে কোনো-না-কোনোভাবে চাঁদমারি বানাত। এভাবেই সে, ধীরে ধীরে, আমাদের গোচরে বা অগোচরে, একটা নীরব রক্তগঙ্গায় পরিণত হয়ে গেল।

তার পরের শাহেদ শাফায়েতের গল্পটা কেবলি মৃত্যুর দিকে তরিয়ে যাওয়ার। গতকাল এটারই আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হলো মাত্র।

০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩


সুমন রহমান রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you