বিদায় সুবীর নন্দী || শিবু কুমার শীল

বিদায় সুবীর নন্দী || শিবু কুমার শীল

বিদায় সুবীর নন্দী! আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। আপনার সঙ্গে কোনোদিন কথা হয়নি আমার তবে সর্বশেষ দেখলাম এই তো সেদিন বিউটি বোর্ডিং-এ সপরিবার। আমিও দুপুরের খাবার খেয়ে বেরোচ্ছি। আপনাকে আপনার ভক্তরা ঘিরে ধরেছে ছবি তোলার জন্য। পড়ন্ত দুপুর ছিল তখন এটুকু মনে আছে। বিউটি বোর্ডিং-এর প্রহ্লাদের ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কথা মন পড়ছিল আমার। পুরোনো ক্ষয়ে-যাওয়া হলুদ দালানের ফাঁকে ফাঁকে নাম-না-জানা গাছের ডালপালায় রোদ এসে পড়েছে। আপনি করমর্দন করছেন এর-ওর সঙ্গে। আপনার স্বভাবসুলভ শান্ত চেহারা দেখে বিউটি বোর্ডিং-এর তারকনাথের পক্ষে কোনোভাবেই বোঝার কথা না এর কিছুদিন পর আপনি এভাবে অচেতন হয়ে যাবেন। এবং চলে যাবেন আমাদের বাংলা গানের বর্ণিল এই জগৎ ছেড়ে।

গানের দুনিয়া আজ প্রায় পাল্টে গেছে, আপনার জীবদ্দশায় আপনি তা দেখে গেছেন। শিল্পী রয়্যালিটি পায় না, গান আর কেউ কেনে না, শিল্পী আর শিল্পীর ভাবধরা মানুষরা কীভাবে একাকার হয়ে গেছে আজ। আপনার নিশ্চইয় অনেককিছু বলবার ছিল এসব নিয়ে। আপনি নিশ্চয়ই এমন এক পৃথিবীর কথাই ভাবতেন যেখানে পাখির কণ্ঠের সুরও মানুষ তাঁর কণ্ঠে ধারণ করবে। মানুষ মানুষের জন্য গাইবে প্রেম ও মুক্তির গান। কতটূকু কি হলো তা আপনিই ভালো বলতে পারবেন। আজকে এমন একটি কণ্ঠস্বর হারালাম যা এরপর আর কোনোদিন আমরা চাইলেও ফিরে পাবো না। কেবল আপনার রেখে-যাওয়া রেকর্ডগুলোই সম্বল। আধুনিক বাংলা গানে এবং প্লেব্যাক সিঙ্গিঙে আপনার অবদানের কথা আমরা ভুলব না। এমন স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর, বাচন, ধ্রুপদী গানের ঢঙে আপনি একেকটা গান গেয়ে গেছেন তা আমাদের বহুকাল আপনার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে শ্রোতাদের মনে।

তবে মরবার আগে একটা দামি কথা বলে গেছেন আপনার দেয়া এক সাক্ষাৎকারে যে : “আমাদের রিয়্যালিটি-শোগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিত।” এই শোকের মধ্যেও এই দামি কথাটা আমার বারবার মনে পড়ছে। আপনি ঠিকই সনাক্ত করতে পেরেছিলেন গান কীভাবে কলুষিত হয়, কারা করে, কোন প্রক্রিয়ায় করে। তাই বলতে পেরেছিলেন এই কথা। রিয়্যালিটি শো-এর মধ্য দিয়ে যে তোতাপাখি আমরা তৈরি করছি তা কেবল অনুকরণসর্বস্ব কিছু মিমিক্রি শিল্পী তৈরি করবে, এই প্রক্রিয়ায় কোনোদিন কোনো জাতশিল্পীকে আমরা খুঁজে পাবো না। অথবা কোনো আত্মমর্যাদাবান শিল্পী নিজেকে এই নোংরা প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলবেও না।

রিয়্যালিটি-শো প্রথমেই যা করে তা হলো একজন উদীয়মান শিল্পীর নিজস্বতাকে ছেঁটে ফেলে দেয়। তাকে উপুর্যপরি বিচারের মধ্য দিয়ে গানের চেয়ে তাকে বিচারকের গোলাম বানিয়ে তোলা হয়। আর সবশেষে সে হয় সাবান-সোডা বিক্রির পাত্র মাত্র। সে সান্ধ্যকালীন টিভির দর্শকদের খোরাক হয় কেবল। তাতে গানের বা গানসম্পর্কিত কিছু থাকে না। কিছু গিমিক অবশ্য আছে এদের, যেখানে তারা বোঝাতে চায় যে এই রিয়্যালিটি-শো একজন রিকশাচালককেও সামনের সারিতে এনে দাঁড় করায়, তাকে গাইবার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই সেই শুভঙ্করের ফাঁকি আমরা টের পাবো। হালের ক্লোজআপ তারকা নোলক বাবুকে বা রাজীবকে এখন দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন আরও বহু নাম আমরা নিতে পারব যারা বুদবুদের মতো প্রকাশিত হয়ে আবার উবে গেছে।

মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অখিল বন্ধু ঘোষের মতো শিল্পীদের পরম্পরায় বাংলা আধুনিক গানে আপনি নিজেকে স্বতন্ত্র সত্তায় হাজির করেছিলেন। তবে একটা আফসোস রয়েই গেল, আপনার একটা আত্মজীবনী থাকলে আমরা আপনার সাংগীতিক জীবনভ্রমণ সম্পর্কে আরো বিশদ জানতে পারতাম। তার আর সুযোগ থাকল না। এই পোড়া দেশে কেউ আপনার গানভাবনা রেকর্ড করেও রাখবে না তা আপনিও ভালো করেই জানতেন। বঞ্চিত হলাম আমরা কেবল। তবুও দিন তো চলে যায় কিন্তু সুর বা কথা তো থাকেই, নানাভাবেই থাকে ইথারে, মানুষের হৃদয়ে, আবেগের চোরাগলিতে। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you