মমতাজউদদীন আহমদ ও মনোরম মেলোড্রামা || শিবু কুমার শীল

মমতাজউদদীন আহমদ ও মনোরম মেলোড্রামা || শিবু কুমার শীল

ভাষাসৈনিক মমতাজউদদীন আহমদের অভিনয় দেখেছি টিভিতে। মঞ্চ দেখিনি কোনোদিন। উনার অভিনয় দেখে অবাক হতাম এ-কারণে যে অভিনয়ের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট ম্যানারিজম ছিল তাঁর। যেমন ফরীদি, নানা পাটেকর, ভিভেক আনান্দ এদের অভিনয়ে খেয়াল করি। যদিও প্রত্যেক অভিনেতারই একটা নিজস্ব ম্যানারিজম থাকে কিন্তু কারো ক্ষেত্রে তা প্রকট মেলোড্রামাটিকও বটে। মমতাজউদ্দিন আহমদ সেই ধারার অভিনেতা ছিলেন। এটাকে কেউ টাইপড বলতেও পারেন। খুব পুরনো ধাঁচের অভিনয় ছিল তাঁর। মেলোড্রামা খারাপ বা ভালো এটা বলে কোনো অবস্থান নিতে চাই না। ঋত্বিকের সব কাজেই মেলোড্রামা। তিনি মেলোড্রামাকে তাঁর হাতিয়ার করেছিলেন। আবার তারেক মাসুদের অভিনেতারা ব্রেসোয়াইট। তারা রোবোটিক অভিনয় করে। এটা যার যার চয়েজ।

তবে মমতাজউদদীন তাঁর অভিনয়ের মধ্য দিয়ে যে বিশ্বাসযোগ্যতায় পৌঁছাতে পারতেন তা ছিল অবিশ্বাস্য। এটা শৈশব থেকেই অনুভব করি। কো-অ্যাক্টরকে মা বা কন্যা যে সম্বোধনই করছেন দর্শক তা বিশ্বাস করছে। ফলে তার মেলোড্রামাটিক কান্নার সাথে দর্শক একাত্ম হতেন প্রবলভাবেই। কখনও কখনও আমারও চোখে জল এসেছে তাঁর স্যাড সিনগুলো দেখে। তিনি বেছে বেছে এমন চরিত্রই করতেন যার একটা মেলোড্রামাটিক ফিউচার আছে। যা দিয়ে দর্শক কাঁদানো যাবে। এবং সফলতার সাথে তিনি পর্দায় সেই কাজটি করতেন।

‘থিয়েটার’ ভেঙে দু টুকরো হলো, একটা ‘থিয়েটার বেইলি রোড’ অপরটি ‘থিয়েটার আরামবাগ’। তিনি নেতৃত্ব দিলেন থিয়েটার আরামবাগের। থিয়েটার আরামবাগের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রযোজনার কথা মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে তবে তাঁর থিয়েটারকীর্তির চেয়ে অভিনয়কীর্তিকে আমি সামনে এগিয়ে রাখব।

বেশকিছু সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন। ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’-র মতো আর্টহাউজ ফিল্মেও তিনি তাঁর অভিনয়ের অনবদ্য স্বাক্ষর রেখেছেন। মজার ব্যাপার হলো, যে ম্যানারিজম তিনি টিভিক্যামেরার সামনে থ্রো করতেন সেই একই মানুষ অনেক মিনিম্যালিস্টিক অভিনয় করতেন সেলুলয়েডে। মানে টিভি এবং চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুক্ষ্ম তফাৎবোধ তাঁর ছিল এবং যা তিনি মেনে চলতেন। । বেশিরভাগের ক্ষেত্রে যা হয় তার উলটো। টিভিতে রিয়্যালিস্টিক অভিনয়ের কোনো যুক্তি তিনি খুঁজে পাননি।

তিনি মূলত বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্যাকেজ নাটকের পূর্বের যুগের দাপুটে অভিনেতা। বাংলা অ্যাকাডেমি এবং একুশে পদকের মতো সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক তিনি পেয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, পত্রিকার জন্য কলাম লিখতেন নিয়মমাফিক। ক্রিকেটের এই ডামাডোলের মধ্যে প্রায় নীরবেই তিনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আমাদের শিল্পসংস্কৃতি যেসব গ্যুড সৌলদের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে মমতাজউদদীন আহমদ সেই ‘গ্যুড সৌল’ তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। খুব মিস করব তাঁর মনোরম মেলোড্রামা। আপাতত বিদায়।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you