গুরুদক্ষিণা || শামস শামীম

গুরুদক্ষিণা || শামস শামীম

২০০১ সাল। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র আমি। টুকটাক ছড়া কবিতা লেখার কারণে ভেতরের তাগিদ থেকেই শিল্পসাহিত্যের লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হই। নমস্যজন ইকবাল কাগজীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আ স ম মাসুমের সঙ্গে বাড়ে হৃদ্যতা। শুরু হয় নতুন পাঠ — সাংবাদিকতার। পথপ্রদর্শক উজ্জ্বল মেহেদী ভাই।

উজ্জ্বল মেহেদী তখন সাপ্তাহিক সুনামগঞ্জ সংবাদ-এর নির্বাহী সম্পাদক। জাতীয় পত্রিকার ডাকসাইটে সাংবাদিক তিনি। সমীহ-জাগানিয়া স্থান নেন। আমি সংবাদের শিশুকিশোর পাতায় লেখালেখি শুরু করি। এলাকার টুকটাক নিউজও পাঠাই। সম্পর্কের সেতুবন্ধন দৃঢ় হয়। ধিরে ধিরে যাতায়াত বাড়ে। পৌরবিপণির নিচতলায় সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস-এর অফিস ঘেঁষে একটি কক্ষে আসাযাওয়া করি, যেখানে উজ্জ্বলভাইরা ব্সতেন। সুবর্ণ প্রেস  উকিলপাড়ায় লেখা নিয়ে যাতায়াত করি। বন্ধুসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত হই। এর মধ্যে ২০০১ সালের জুলাই মাসে সাপ্তাহিক সুনামকণ্ঠ  বেরোলে আমি শ্রদ্ধেয় বিজন সেনরায় দাদার সঙ্গে কাজ শুরু করি। পৌরবিপণি নিচতলায় তার অফিস। প্রথম সংখ্যা থেকেই জড়িত হই। এতে সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ে। নতুনভাবে অনেকের সঙ্গে পরিচিত হই। সিলেটের মূলধারার সাংবাদিকদের সঙ্গেও সখ্য সৃষ্টি হয়।

২০০৪ সাল। ভয়াবহ বন্যা সুনামগঞ্জে। তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। মোবাইল কম্পিউটার সহজলভ্য ছিল না। গ্রামীণ ফোন-এর পল্লীফোন  থেকে উজ্জ্বলভাইর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি বন্যায় ভুক্তভোগী মানুষকে নির্দিষ্ট প্রশ্ন করার ধরন শিখিয়ে বক্তব্য ও তথ্য সংগ্রহ করে দেওয়ার কথা বলেন। আমি তা-ই করি। বিবিসির সাংবাদিক হাসান মাহমুদ, ডেইলি স্টার-এর ডাকসাইটে রিপোর্টার পিনাকী দের সঙ্গে ফিল্ডে পাঠিয়ে দেন। তাদের কাছ থেকে শিখি।

একদিন সাপ্তাহিক সুনামগঞ্জ সংবাদে আমার একটি ছোটগল্প বের হয় ‘যুবক পাখি হয়ে গেছে’ শিরোনামে। একজন গ্রামীণ পাগল এবং একজন উঠতি যুবকের সংলাপের উপর ভর করে গড়ে ওঠে এই গল্প। যুবক ও পাগলের মাধ্যমে আমি গ্রামীণ সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরেছিলাম। এরপর থেকে উজ্জ্বলভাই আমাকে ‘যুবক’ ডাকতেন। আমাকে না-দেখলে বলতেন, যুবক পাখি হয়ে গেছে!

২০০৪ সাল। উজ্জ্বলভাই সিলেটের প্রখ্যাত সাংবাদিক আল আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আজাদভাইর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাচীনতম পত্রিকা দৈনিক সংবাদ  পত্রিকার সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। এভাবে মূলধারার সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়া। ২৫০ টাকা মাসিক রিটেইলার, ৫০ পয়সা লাইনেজ ও ছবি ৫০ টাকা। এই বিল মাঝেমধ্যে পেতাম। টেংরাটিলায় যখন আগুন লাগে তখন উজ্জ্বলভাইর মোটরসাইকেলে একাধিকবার যাতায়াত করি। শিখি সাংবাদিকতার ধারাপাত। এ-সময় দেখি সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে সাংবাদিক হওয়ার জন্য উজ্জ্বলভাইর কাছে কত লোক ধর্না দিতে আসে। তাদের কেউ কেউ এখন মস্ত বড়ো সাংবাদিকও।

২০০৬ সালে যখন বাজার তোলপাড় করে দেশের নামযশখ্যাতির শীর্ষে থাকা সাংবাদিকদের নিয়ে দৈনিক যায়যায়দিন  পত্রিকা বের হয় তখন উজ্জ্বলভাই সহ সুনামগঞ্জের আমার ঘনিষ্ঠজনরা পরিচয় করিয়ে দেন রমেণ বিশ্বাস দাদার সঙ্গে। এভাবে যায়যায়দিন  পত্রিকার প্রতিনিধি হই। তবে যাযাদিতে প্রতিনিধি হতে গিয়ে প্রয়াত সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী ও প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব(এষ)দারও অবদান আছে। সংবাদে কাজ করার কারণে ধ্রুবদা আমাকে সঞ্জীবদা আর আবিদা নাসরিন কলি আপার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে যায়যায়দিনে কাজ করার জন্য সঞ্জীবদার কাছে পাঠিয়েছিলেন। যাযাদিতে আরেকজনের প্রতিনিধিত্ব কনফার্ম ছিল। সঞ্জীবদার কারণে আমি প্রতিনিধি মনোনীত হই।

পেশাদার সাংবাদিকদের সঙ্গে থাকার কারণে নিজেও পুরোদস্তুর সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ি। আরেকবার বাজারে হৈচৈ করে আসা দৈনিক কালের কণ্ঠ  পত্রিকায় আহমেদ নূর ভাইর মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পাই। এখনো এই হাউসে আছি।

কথা হচ্ছিল উজ্জ্বলভাইকে নিয়ে। মফস্বল সাংবাদিকতা কীভাবে ঢাকার সাংবাদিকতাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে প্রথম পাতা ও বিশেষ আইটেম উপস্থাপন করে নিজের নাম প্রোজ্জ্বল হরফে দেশবাসীকে পরিচিত করানো যায় তার উদাহরণ হিসেবে অন্যতম তিনি। ব্যতিক্রমী আইডিয়া, সংবাদ ও ফিচারের বৈচিত্র্যময় উপস্থাপন তার রিপোর্টিঙের সৌন্দর্য ও শক্তি। ডেস্কের লোকজনও তার স্টোরি কাটছাঁট করে না — কেবল সম্পাদকীয় নীতিমালা ছাড়া।

সুনামগঞ্জ ছেড়ে যখন সিলেট চলে যান তখন সেখানে গিয়েও তিনি আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। প্রতিদিনই বিশাল বিশাল রিপোর্ট করেন। সততা, সাহস ও আপোসহীনতার কারণে তার শত্রু বাড়ে। এই শত্রুদের মধ্যে কেবল বাইরেরই নয়, বিভীষণও তৈরি হয়। এটা দেখে একদশক আগে আমি উনাকে সতর্ক করেছিলাম।

আজ আমার সাংবাদিকতার গুরু উজ্জ্বল মেহেদী ভাইর জন্মদিন। মুখবইয়ে শুভার্থীদের অভিনন্দনবার্তা দেখার পর এই ক্ষুদ্র স্মৃতিচারণ। জন্মদিনে আমার সাংবাদিকতার গুরু উজ্জ্বল মেহেদী ভাইকে নিয়ে কিছু কথা।

শুভ জন্মদিন, ভাই! সাহসে, সংকল্পে থাকুন। আমি আশাবাদী আপনার সাংবাদিকতা ‘বেহাত বিপ্লব’ হবে না।


শামস শামীম রচনারাশি

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you