সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি আমার পড়া নেই। তবে এই উপন্যাস নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হিসেবে বেশ সমাদৃত। বিটিভি থেকে শুরু করে সব প্রাইভেট চ্যানেলেই এটি বহুবার দেখানো হয়েছে এবং এখনো দেখানো হয়। এই ছবিতে একটা বিশেষ দৃশ্যে দেখি যে অভিনেত্রী সুচরিতার বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর তাড়া খেয়ে দুজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নেয়। সুচরিতা মুক্তিযোদ্ধা দুই কিশোরকে তার ঘরের বড় বড় দুটো মটকাতে লুকাতে সাহায্য করে। কিন্তু পাকবাহিনী ততক্ষণে দরজায় বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করছে আর দরজা খুলতে বলছে। সেই ঘরেই ঘুমিয়ে ছিল সুচরিতার প্রতিবন্ধী কিশোর ছেলেটি। অনেক শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায় সে বিছানায় উঠে বসে। এ-রকম একটি মূহূর্তে সুচরিতা ছেলেটির হাতে মুক্তিযোদ্ধা কিশোরদের স্টেনগান ধরিয়ে দিয়ে তাকে দরজার বাইরে নিয়ে আসে এবং বলে ‘এই নে তোদের মুক্তি।’ এরপর ছেলেটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী আর যাবার আগে সেই মাকে বলে যায় এই ভালো কাজের জন্য তার অনেক ইনাম মিলবে।
এই বিষয়টি আমাদের এখানে বহুকাল প্রশংসা পেয়ে এসেছে জাতীয়তাবাদী চেতনার জায়গা থেকে। মা হিসেবে সুচরিতা গর্বের কাজ করেছে বলে আমরা সাধারণ দর্শকরা এতকাল ভেবে এসেছি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, একজন প্রতিবন্ধী এক্সপার্ট এই ইস্যুটি কিভাবে দেখছেন আজ এই ২০২৪ সালে? এটি আসলেই কি গর্বের বিষয়? মানবিক জায়গা থেকে দেখলে এটি কি নির্মমতা বলে মনে হয় কারো? তার কারণ সেই শিশুটি অবলা এবং তথাকথিত সমাজের কোনো কাজে সে আসবে না বলে মায়ের গর্বের প্রয়োজনে সে বেঘোরে মারা পড়তেই পারে। এটাই কি স্বাভাবিক? অথবা বলা যায় একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা যাকে জাতির খুব দরকার তার জীবন বাঁচাতে একজন ‘অকেজো কিশোরকে’ বলি দিয়ে দেয়া যেতেই পারে। প্রতিবন্ধী ছেলেটি স্বাভাবিক হলে চলচ্চিত্রের এই দৃশ্যটি এ-রকম দেখানো হতো কি না এই জিজ্ঞাসা আমার বহুদিনের। আর একজন মানুষ শহিদ হতে চায় কি না সেটার অনুমতি ছাড়াই তাকে উৎসর্গ করা হলো দেশমাতৃকার জন্য এটাই-বা কেমন ব্যাপার? আমার মাথায়ও হয়ত এই ভাবনা কোনোদিনই আসতো না যদি-না আমার একজন চাইল্ড উইথ অটিজম শিশু থাকত।
আমরা আমাদের সমস্ত সেক্টরে এভাবেই নিজেদের ক্ষমতা আর জাতিবাদী উত্তেজনার বলে নানাবিধ ফাঁকফোকর তৈরি করে রেখেছি, যেসব স্বীকার করে না নিলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তাচর্চায় জটিলতা বাড়বে, যদি-না আমরা আমাদের ক্ষুদ্রতা আর বিশালতাকে একইসাথে ক্রিটিকালি দেখতে পারি।
শিবু কুমার শীল রচনারাশি
গানপার ম্যুভিরিভিয়্যু
- আমাদের গ্রামের নাম আমাদের নদীর || কাজল দাস - November 19, 2025
- লোককবি মনির নূরী ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 19, 2025
- উপন্যাসে শহুরে জীবনের ক্লান্তি ও বিপন্নতার বোধ || হারুন আহমেদ - November 16, 2025

COMMENTS