“আসলে সাহিত্যে বুদ্ধির সঙ্গে অনেক পরিমাণে অবুদ্ধি থাকা চাই। একভাগ যদি বুদ্ধি থাকে তবে সেটাকে মানানসই করতে তিনভাগ অবুদ্ধি মেশাতে হবে। তোমরা বুদ্ধি নিয়ে জন্মেছ ভাবতে পারো, অবুদ্ধির সাধনা করোনি তাই ভাবনা ভুলিয়ে দিয়ে খুশি করবার দিকে তোমাদের ঝোঁক নেই।” — লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে, ঢের আগে ১৯৩১ সালে, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। এখনও কি প্রাসঙ্গিক নয়, এই কথাগুলো, বহুবাচনিক সম্বোধনে ব্যক্ত রবীন্দ্রকথামৃতটুকু?
বুদ্ধিবিটকেলে ব্যাপক বিরাট এক সাহিত্যবাজার আমরা গড়ে তুলছি রোজ, প্রত্যেকে সেই বাজারে আমরা ব্যবহৃত হচ্ছি, যদিও প্রত্যেকেই মনে মনে বাদশা হয়ে ভাবছি যে আমিই তো একচ্ছত্র বাজারকন্ট্রোলার, আসলে তা না, আমরা প্রত্যেকে এই বাজারের গ্রিপের ভেতর বন্দী, ক্রীড়নক প্রত্যেকে এই রিজনিং ও রেশন্যালশাসিত বুদ্ধিলিট্রেচারমার্কেটের, মণ্ময় লিট্রেচার প্রণয়নের নামে স্রেফ মতামত দিয়ে চলেছি পাতার পর পাতা — গ্রন্থের ওপর গ্রন্থ শুধু মুর্গি ভার্সাস ডিম বিষয়ক তর্কবিতর্ক — কোটি কোটি গিগাবাইট বকে চলেছি গরিলা-শিম্পাঞ্জি-ওরাংওটাঙের গলা আর বাচন ধার করে, মতামত প্রদানে উদগ্রীব আর মতামত দিতে দিতে মুমূর্ষু এক সাহিত্য হচ্ছে সেটা, চুন থেকে খসেছে পান তো দে দিয়ে ওপিনিয়ন একখান ডাঁশা পেয়ারা বা ঝুনা নারকেল, চতুর্দিকে দে গরুর গা ধুইয়ে আওয়াজ কেবল, দুর্ধর্ষ সব ট্রুথ ও বিউটির ব্যবসাবিজনেস দেশজুড়ে! এ যে ভারি বিপদ জাদু, এ যে বেজায় জঙ্গ, বসে বসে সকলে ও প্রত্যেকে আমরা কেবল জঙ্গনামা লিখিয়া চলেছি। এ যে ব্যাপক সম্পদ, সোনাভান, তোমার লাইগা রাইখা যাইছি নিদারুণ এই বোখারা-সমরখন্দ!
বুদ্ধির সম্পদ সম্পর্কে নেসেসিটি নাই বলবার। কেননা আমরা প্রত্যেকেই বুদ্ধিমান, উত্তরোত্তর বুদ্ধিবিবর্ধমান উন্নত প্রাণ, প্রত্যেকে প্রতিমুহূর্তে বুদ্ধি নিয়ে ঘর করছি বুদ্ধি পকেটে ভরছি ধুন্ধুমার। সকলে প্রত্যেকে আমরা যার যার হাতের মাপে সাড়ে-তিনহাত বুদ্ধির বেওসাদার। অতএব বুদ্ধি নিয়া তেমন দড় বলবার নাহিকো দরকার। বলছি না যে বুদ্ধির দরকার নাই, বরঞ্চ উল্টোটাই। ভীষণভাবেই দরকার বুদ্ধির, কিন্তু বুদ্ধিনির্ভর — অধিক স্পেসিফিক বুদ্ধিসর্বস্ব হলেই বিপত্তি। যে-বুদ্ধির বিফাই আজকে করছি, সেই বুদ্ধি রিডিক্যুলাস হয়ে যায় আগামীকাল আসার আগেই। কিন্তু অবুদ্ধি থাকে, থেকে যায়, ভালো অথবা মন্দ কোনো-না-কোনোভাবে মানুষের সংসারে থেকে যায়ই। নিছক বুদ্ধি, কিংবা খালি নির্বোধ অবুদ্ধি, উভয়েই ইকুয়্যালি পরিত্যাজ্য। দুয়ের মিলনমিশন হলো সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ বলছেন তা-ই, কিংবা ঠাকুর না-ও যদি বলতেন তবু ঘটনা তা-ই। বুদ্ধির সঙ্গে অবুদ্ধি মেশাবার এই রন্ধনপ্রণালিই তো সাহিত্য। অন্তহীন এক খেলা, অনুপম অভিযান এক, মনোরম ভ্রমণ। জগৎ চিরযৌবনা আর অজর সবুজ করে রাখা, সাহিত্য তো ও-ই, খেলার নাম সবুজায়ন।
বুদ্ধি তো বোঝা গেল, অথবা না-বললেও বুদ্ধি তো বোঝারই জিনিশ, বুদ্ধিসুদ্ধি থোড়া-বেশ সকলেরই তো আছে। পাগল, শিশু ও নিরপেক্ষ সকলেই যার যার দরকারমতন বুঝমান। মাথাওলা কথাবলা মানুষে তো দুনিয়া থৈ থৈ। কিন্তু, হাজিরান-এ-মজলিশ, অবুদ্ধি জিনিশটা নিয়া দুইচাইর লোকমা বাড়ানো যায় কথাবাত্রা। কি এই অবুদ্ধি? সংজ্ঞা জানি না, আবছা-আবছা বুঝতে পেরেছি ব্যাপারটা বুদ্ধি দিয়ে। এই অবুদ্ধিরই অন্য নাম, সম্ভবত, রস। রসের ভিয়েন না-দিয়ে সাহিত্য হয় না। আবার রসের ভিয়েন দিতে যেয়ে জটিল জিলিপির প্যাঁচ দেওয়া সবসময় জরুরি না-ও হতে পারে। মোদ্দা কথা, ব্যক্তি ভেদে ব্যাপারটা ভ্যারি করে। কেউ প্যাঁচের মধ্য দিয়ে রস যোগাতে পারেন, কেউ-বা প্যাঁচপয়্জারহীন, নিপাট শাদাসিধা কায়দায় বিপন্ন বিস্ময় রচনা করার লোকও দুর্লক্ষ নন দুনিয়াবি সাহিত্যদরিয়ায়।
‘কেন লিখি’ — এই প্রসঙ্গে বাংলার প্রায় সমস্ত বড়-ছোট-মিডিয়ম লেখকেরই একটা কৈফিয়ৎ পাওয়া যায় তাদের রচনাজীবনের কোনো-এক পর্যায়ে। কেউ খুব শৌখিন ও চমক-লাগানো সুরে উত্তর খাড়া করেন, কেউ রেগেমেগে একফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে খোদ প্রশ্নটাকেই, কেউবা খানিকটা আন্তর তাগিদ থেকে। এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে এ-প্রাসঙ্গিক অমিয়ভূষণ মজুমদার ও জয় গোস্বামীর কৈফিয়ৎ। ধূর্জটিপ্রসাদ পড়বার সময় চমকে গেছিলাম তাঁর এ-প্রাসঙ্গিক একটা ছোট্ট রচনার শেষপ্যারায় যেয়ে।
কেন লিখি প্রশ্নের উত্তরে কে কি বলেছেন রথী-মহারথীরা, বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে, জানবার একটা ঝোঁক এসেছিল আমার মধ্যে বেশ কয়েকবছর আগে। একটা কাজ করব বলে প্ল্যান ছকে রেখে বেশ এগিয়েও গিয়েছিলাম, গ্যুগল ঢুঁড়ে আটলান্টিকের দুইতীরের নামজাদা আংরেজি লেখক-কবিদের বেশকিছু লেখাপত্র পড়ে — হোয়াই আই রাইট বা এর কাছাকাছি কিছু-একটা লিখে পছন্দতালিকার লেখকনাম জুতে সার্চ দিলে ভালো ফল পেয়েছিলাম মনে আছে — সেগুলো ওয়ার্ডপেজে জমিয়ে রেখেছিলাম এবং আজোবধি জিনিশগুলো আমার আপিশের যন্ত্রগুদামে স্টোর করা আছে। ধূর্জটিবাবুর প্রবন্ধগুচ্ছ পড়তে যেয়ে মনে হয়েছিল, এই রাগ, এই শিরদাঁড়া, এই রিপ্লাই আমার খুব চেনা। তার মানে এইটাই যে আমার উত্তর, মনে করার কোনো কারণ নাই। তাছাড়া এই প্রশ্নের উত্তর লেখার রাইটও আমার এস্ট্যাব্লিশ হয় নাই, জিগায়ও নাই কেউ আমারে এইসব এঁচড়ে-পাকামির নেপথ্য অথবা সম্মুখভাগ নিয়া।
যা-হোক, নিজমনে রচে যাই নিজের পাঁচালি। টুকি ধূর্জটিপ্রসাদ আপাতত : “লিখি দম্ভের জন্য, আত্মসম্মানের জন্য, রাগ প্রকাশের জন্য প্রধানত। কখনও কখনও নিতান্ত অল্পক্ষেত্রে লিখি নিজের মনোভাব সাজাতে, বাকিটা ব্রিজ না-খেলে সময় কাটানোই উদ্দেশ্য।…পরের উপকারের জন্যও লিখিনি, প্রেরণার জন্যও নয়, এটাই সত্য উত্তর।…”
— জাহেদ আহমদ ২০০৯
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS