কথাসাহিত্যের কড়িবর্গা  || শেখ লুৎফর

কথাসাহিত্যের কড়িবর্গা  || শেখ লুৎফর

১. কেন লিখব
নিজেকে প্রকাশের মাধ্যমে মানুষ ব্যক্তি হয়ে ওঠে। অনন্যতা অর্জনের এই কঠিন তপস্যা সেই গুহাযুগ থেকেই চলছে। সৃষ্টিশীলতার এই কস্তুরি মানুষগণ তার রক্তে পৃথিবীর শেষদিন তক বয়ে চলবে। এ সম্ভাবনার ব্যতিক্রম নাই। প্রজন্মে প্রজন্মে কিছু মানুষ এমনিতেই ভিন্ন ধাতের তৃষ্ণা নিয়ে সংসারে আসে। একটু একটু করে একান্ত নিজের একটা জগৎ নিজের মাঝে তৈরি করে নিতে দু-হাতে খুন্তি-কুড়াল চালায়। বুড়ো ঠাকুরের একলা চলার নীতিকে নিজের নিয়তি বলে নিচ্চুপে মেনে নেয়। এতে তাদের একটুও মনস্তাপ থাকে না। অবশ্য আশপাশের অনেকেই এটাকে ভালো চোখে দেখে না। তারা আদর করে এর নাম দেয় ‘গ্রহের ফের।’ আবার অনেকেই ম্যালা বুদ্ধি খরচ করে হয়ে ওঠে রাজনৈতিক পশু, ঘুষখোর আমলা, ভূমিদস্যু, ঋণখেলাপি, তস্কর। তাদের খাতিরে হাটে-বাজারে বক্তৃতা হয়। জোশের বকাবকিতে কখনও কখনও বাচ্চাদের কাঁচা ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে শিশুরা চিৎকার দিয়ে জেগে ওঠে। তখন উন্দাল থেকে মা ছুটে এসে শিশুকে বুকে তুলে নিয়ে গীত জোড়ে, সুর করে ছড়া কাটে। সুরের ওম ও বুকের নিরাপত্তায় শিশু ফের ঘুমিয়ে পড়ে। তাই লেখালেখি আগের দিনে যেমন চলছিল, পরের দিনগুলিতেও তেমনি চলবে। আপনি-আমি লিখি বা না লিখি কেউ কেউ অবশ্যই লিখবে।

২. কি লিখব
প্রসবের সপ্তাখানেক আগে কোনো কোনো মহিলার চোরা বেদ্না ওঠে। কয়েক ঘণ্টা পরে বেদ্নাটা আপনাতেই নাই হয়ে যায়। সতর্ক থাকলে এ-রকম আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ। আসল বেদ্না উঠলে শুধু পোয়াতি নয় আশপড়শিরাও টের পায়। লেখার বেলাতেও এমনটা হামেশাই ঘটে। দড়কচা জীবনে ছুটাছুটির কোনো অন্ত নাই। এর মাঝে আবার লেখার পিছনে ছোটা! যদ্দুর আন্দাজ করা যায়, সোহাগকাড়া মেয়ের মতো খাঁটি লেখা নিজেই এসে পেছনে ঘুরঘুর করে। বারবার মনে টোকা দেয়। একবার তার সুন্দর মুখ দেখায় তো আরেকবার খাউদা-খাউদা পিঠ দেখায়। মগজে ভুড়ভুড়ি তোলে। সরতে চায় না। একটু নিফুডি পেলে তার সুখ-দুঃখভরা চিটচিটা ঝোলাটা বুকে চেপে শিথানে এসে বেজার মনে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘুমটা জমতে দেয় না। কোনো কোনো তর্ফে দিন-মাস পেরিয়ে বছর তক লেখাটা পিছে লেগেই থাকে। এই হলো খাঁটি জিনিস। এটাতে হাত দিলেই সোনা ফলবে।

৩. সহ্যক্ষমতা
মা প্রায়ই বলত, ‘যে সয়, সে রয়।’ বিষয় কিংবা আচান্নক একটা চরিত্রের দুই-একটা বাও পেয়েই টেবিলে খাপ পেতে বসে থাকলে আখেরে ঠেকতে হবে। তাই সহ্যগুণ বাড়াতে হয়। বুঝমতো একটু ধীরিকও ধরতে হয়। বুড়ো ঠাকুর কয়ে গেছেন, ‘যেমন একটা সুতাকে মাঝখানে লইয়া মিছরির কণাগুলো দানা বাঁধিয়া ওঠে তেমনি আমাদের মনের মধ্যেও কোনো-একটা সূত্র অবলম্বন করিতে পারিলেই অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ভাব তাহার চারিদিকে দানা বাঁধিয়া একটা আকৃতি লাভ করিতে চেষ্টা করে।’ তাহলে বলা যায়, সন্দেহটা অমূলক নয়। রদ্দি মাল কয়েক বাও দিয়ে দানা বাঁধার আগেই ঝরে পড়ে। তার নাক-মুখ-চোখ-গতরের বর্ণ কিছুই গড়ন নেয় না। তাই লেখার বিষয় ও চরিত্র বাছাইয়ের আগে পোড়খাওয়া চাষার মতো আমের বোলের সুবাস, রোদ-গরমের কামুড় সহ্য করতে হবেই।

৪. কাকে নিয়ে লিখব
একদম হাতের কাছ থেকে চেনা-জানা মানুষটাকে নিতে হবে। শত ভিড়ের মাঝেও যেন তার গলার আওয়াজ কিংবা মাথার চুল দেখলেই চিনে ফেলা যায়। লোকটা যেভাবে বাঁচে, হাসে, ক্ষেপে গেলে গালি দেয় অবিকল তার সবটা চাই। কথাসাহিত্যের আসল মাজেজা এখানেই। সে সাধারণকে অসাধারণ করে তোলে; এই মনস্কামে কড়িবর্গা আটকাতে হয় নিজের চিন্তার শক্ত শক্ত পেরেক দিয়ে। তার আগে পত্তনের জন্য বাস্তবের ভিটা নিতেই হবে। ওটা না হলে বোশেখ তো দূরে থাক, ফাল্গুনের পয়লা বাওয়ারেই ধপ্পাস করে লুটিয়ে পড়বে।

৫. কতটা লিখব
কার্তিক-অঘ্রান মাস এলে পুবদিক থেকে একজন থুত্থুরা বুড়ামানুষ লাঠি ঠুকে ঠুকে আমাদের বাড়িতে এসে উঠত। আমাদের কারোর নাম সে ঠিকমতো বলতে পারত না। আমাকে ডাকত উৎফর। বড়ভাইকে ডাকত অজিবর। বড় মায়া ছিল তার অন্তরে। আমার বড় ভাইবোনেরা তার পিঠে-কাঁখে বড় হয়েছে। আমরা তাকে ‘কটাদাদা’ বলে ডাকতাম। শুকনার দুই-তিন মাস সে আমাদের পেঁয়াজ-রসুন-তামাক-মরিচ ক্ষেতের যত্ন-তালাফি করত। লোকটা ছেনি দিয়ে ক্ষেতের মাটি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সামনে এগোত আর পেছন পেছন মরিচ-রসুনের চারা ঘষটে ঘষটে, মাটি হিঁচড়ে যেত তার বিরাট দুটো অণ্ডকোশ। আমরা ফাঁক পেলেই পিছন থেকে তা মুঠি দিয়ে ধরতাম। বুড়ো বলত, ‘ছাইড়া দ্যা, এইডার ঘষা না খাইলে মরিচগাছ বড় অইব না, ফুল ধরব না।’ সেই দাদা মাঝে মাঝে বড় কামলাদের সাথে তর্ক করার সময় বলত, ‘কথা কওয়ার দাম যুদিন একট্যাহা অয়, তে কথা না-কওয়ার দাম দুইট্যাহা।’ কথাসাহিত্যের আরেকটা মাজেজা এর মাঝেই গুপ্ত আছে। শব্দের মোহ, চরিত্রের প্রতি পক্ষপাত, পাঠকের মন মজানোর লোভ সব কাটিয়ে শিবের মতো নির্মোহ না হতে পারলে তামাম আয়োজন মাটি হয়ে যাবে। কথাসাহিত্যে ভাব, বাক্য ও ভাষাকে লক্ষ্যভেদী করে তোলা চাই। সেজন্য একতারার তারের মতো টানটান করে বাক্য বাঁধতে হয়। শব্দ বাছাই ও উপমার গালা লাগাতে মাটির পাতিল বাজিয়ে খরিদ করার মতো অভ্যাস করতে হয়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কথাসাহিত্যের গতর-গড়ন-অন্তঃকরণ অনেকটা কবিতার মহত্ত্বের মতো। সেজন্য কথাসাহিত্যের গিন্নীপনায় কবিতার চেষ্টাচরিত্র থাকলে আরও ভালো হয়। তাই আরেকবার মনে করা যাক, ‘কথা বলার দাম একটাকা হলে জাগামতো কথা না বলার দাম দুইটাকা।’

৬. লেখার কৌশল
দর্জি যেমন সুতার মাথাটা জাগামতো টেনে ধরে, তেমনি মনমতো বিষয় ও চরিত্র ধরতে পারলে সে-ই ভাব, ভাষা ও আঙ্গিক জোগাবে, শালিকের মতো খুঁটে খুঁটে ওজনমাফিক শব্দ বেছে দেবে। তখন চরিত্র নিজেই বাঁকে বাঁকে শক্তিমান মরদের মতো একলাই ডাকাডাকি করে দশজন জড়ো করবে, পথঘাটের দিশা দিবে, নিজেই টেনে টেনে সময়মতো বন্দরে পৌঁছে দেবে। লেখার কৌশল বা ক্রাফট, এইসব আলাপ একিনে ঠাঁই না দিলেও হাল ও দাঁড়ের মাঝিরা বেসাতে ঘাটতি খাওয়াবে না।

৭. সময়ের এজমালি বৈঠকখানা
একখানা নজির দিয়ে শুরু করা যাক :

‘ভালো ওয়ার্ডার, সদাশয় ওয়ার্ডার,’ আমি বললুম। ‘আজ সকালে দারোগাসাহেব বলছিলেন গান্ধিজি নাকি মৃত্যুশয্যায়। তুমি এ-সম্বন্ধেকিছু শুনেছ, ওয়ার্ডার সাহেব?’
‘উনি অনশন ভঙ্গ করে লেবুর রস খেয়েছেন।’
অতি উত্তম। মোহনদাস গান্ধি দীর্ঘজীবী হোন।
একের পর এক লোহার দরজা পেরিয়ে আমরা হেঁটে চললুম।
আমি জিজ্ঞেস করলুম : ‘এখন এখানে কতজন রাজনৈতিক বন্দী আছে?’
‘তুমি যেখানে যাচ্ছো, সেখানে সবসুদ্ধু সতেরোজন আছে।’
(‘দেয়াল’ — ভৈকম মুহম্মদ বশীর)

একেবারে চোখ বন্ধ করে বলা যায়, ভৈকমসাহেব কলমের কয়েকটা খোঁচায় সময়, প্রতিবেশ আর চরিত্রের রসায়নে কী অসাধারণ সমন্বয় ঘটিয়েছেন!

এবার দেখা যাক কথাসাহিত্যে সময় ও চরিত্রের চারপাশ বিষয়ে বুড়ো ঠাকুরের মতামত কী :

‘বস্তুজগতেও ঠিক জিনিসটি ঠিক জায়গায় যখন আসর জমাইয়া বসে তখন চারিদিকের আনুকূল্য পাইয়া টিকিয়া যায় — এও ঠিক তেমনি। অতএব যে বস্তুটা টিকিয়া আছে সে যে কেবল নিজের পরিচয় দেয় তাহা নয়, সে তার চারিদিকের পরিচয় দেয়; কারণ সে কেবল নিজের গুণে নহে, চারিদিকের গুণে টিকিয়া থাকে।’
(সাহিত্যসৃষ্টি— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

নিশ্চয়ই এবার পরিষ্কার হয়ে গেল,  ‘যে বেটি রাঁধে, সেই বেটি চুলও বাঁধে।’ তাই শুধু চরিত্রকে ভাব-ভাষা-আঙ্গিক ও বাস্তবতার মোড়কে কষে বাঁধলে চলবে না। ফাঁকমতো দুই-একটানে সময় ও চারপাশের খুঁটিনাটি দিয়ে ঝানু কামারের মতো পান দিতে হবে।

৮. খাঁটি ওস্তাদ আগে ভূত সামলায়
বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। কথাসাহিত্যে পাঠক এক আজব জিনিস। এই জিনিসের রসনার কূলকিনারা নাই, সুরাহা নাই। কারণ পাঠক যখন ঠকতে শুরু করে তখন সে আর পাঠক থাকে না। ভূতের মতো আপদ হয়ে দাঁড়ায়। তাই পয়লা সবকেই ঠকাঠকির হিসাবটা শক্ত হাতে মিটিয়ে ফেলতে হবে। প্রথম বাক্যেই ভরে দিতে হবে আদত জিনিসের একটা চিক্কন ইশারা। এখানে ওজনে বাটপারি করলে আর-কিছুতেই ভাঙন রোধ করা যাবে না। না-চাইলেও শুরু হবে ঘ্যানর ঘ্যানর। গেরামে ভূতে-আছর-করা মানুষ প্রায়ই দেখা যায়। দিনমান বিড়বিড় করে আর হাঁটে। এই ধরনের কথাবলাকে মানুষ ‘বগর বগর’ বলে। কেউ কেউ বলে ‘জ্বরের প্যাচাল।’ জ্বরের প্যাচাল মনে রাখা তো দূরে থাক কেউ শুনেও না।

৯. যে পড়ে সে-ই লেখে
এখন যে লিখতে বসেছে, সে এর আগে হাজারবার বসেছে পড়তে। তাই সে নিজেও একজন ভালো পাঠক। অন্যের লেখা পড়ে যদি মন মজে, তবে সেটার কি কি ধনদৌলত আছে তা অবশ্যই চোখে পড়বে। তাই নিজের লেখার গুণের চে’ দোষগুলি বেশি বেশি চোখে পড়ার কথা। যদি না পড়ে, তবে নিশ্চয়ই ভেজাল আছে। সেটা হয় পাঠকের মগজে, নয়তো লেখার পরতে পরতে। তাই নিজের লেখার দরদস্তুর সবার আগে নিজেকেই বাজিয়ে নিতে হবে। তা না হলে নিজের অজান্তে বেপারির চতুর পোলার মতো খরিদ্দারকে সবসময় ওজনে কম দেওয়ার অভ্যাস রপ্ত হয়ে যাবে।

১০. লেখালেখিতে শিষ্য আছে, গুরু নেই
লেখতে বসেলে নিজেকেই গুরু মানতে হবে। তখন মনে আসতেই পারে, ‘এই মুহূর্তে লিখিত হচ্ছে বিশ্বসাহিত্যের সেরা ক্লাসিক।’ তরুণের এই অহংবোধ ও বিশ্বাস যদি না থাকে তবে সজিনা ডালের মতো মাঝপথেই কড়াৎ করে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দশ মিনিট আগে টেবিলে যে কালোত্তীর্ণ বইখানা ছিল, মগ্ন পাঠকের হৃদয় জুড়ে যে লেখক জেঁকে বসেছিলেন, লিখতে শুরু করার পর নিজের ছায়াতে তার কায়া চাপা দেওয়াই সবচে’ নিরাপদ। গুরু পাঠকের থাকতে পারে কিন্তু লেখকের না-থাকাই স্বাস্থ্যকর। কারণ কে না জানে, লেখালেখিতে গুরুর জন্য নখ পরিমাণ জমিন বরাদ্দ নাই। ওটা বিশ্বাস করলে জ্যান্ত ডুবতে হবে। আর পাঠকের কাছে যারা গুরু বনে গেছেন তারা এইজন্য গুরু যে, তাদের চিন্তা জীবনজগতের প্রায় চিরন্তনের কাছাকাছি। এবার তাহলে অবশ্যই নিজের লেখাটাতে চোখ ফেরাতে হয়। যে যে কারণে তাঁরা চিরন্তনের কাচাকাছি তার দুই-এক ছিঁটা নিজের লেখাটাতে আছে কী?

ইসহাকপুর, জগন্নাথপুর, সিলেট। ডিসেম্বার ২০১৬

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you