জফির সেতুর লেখা নিয়ে পরিচয়মূলক গদ্য/ভূমিকা লেখা বাহুল্য। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও সম্পাদক। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই হচ্ছে সতেরোটি; দুটি উপন্যাস লিখেছেন, একটি গল্পগ্রন্থ; লিখেছেন ভ্রমণ-আখ্যান ও প্রবন্ধগ্রন্থ; সম্পাদনা করেছেন মূল্যবান কিছু গ্রন্থ। কবিতার কথা যদি বলি, তাঁর প্রথম কাব্য বহুবর্ণ রক্তবীজ — প্রকাশকাল ছিল ২০০৪। তারপর সহস্র ভোল্টের বাঘ (২০০৬), স্যানাটোরিয়াম (২০০৮), তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১), সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২), জাতক ও দণ্ডকারণ্য (২০১৩) কিংবা ইয়েস, ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস (২০১৫), কিংবা তিন ভাগ রক্ত (২০১৯) প্রভৃতি, অতি সম্প্রতি বের হলো আমি করচ গাছ। কবিতার সঙ্গে এই যে লং-জার্নি — এখানে দেখতে পাই তিনি বারবার বাঁক পরিবর্তন করেছেন, বিষয় ও আঙ্গিক উভয় ক্ষেত্রেই। বিশেষত বিষয়ের ক্ষেত্রে মানুষ-প্রকৃতি-মিথ থেকে শুরু করে মরমি চিন্তা বা ভাববিশ্বে চলে এলেন। তাঁর কবিতা নিয়ে যারাই আলোচনা করেছেন তারা মনে করেন নিয়ত নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কবিতাকে উপস্থাপন করেন তিনি।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস অকালবোধন। একনিশ্বাসে অনেকে পড়েছেন বলে জানি। গ্রন্থাকারে বের হয়নি বলে পড়ার সুযোগ হয়নি আমার। কিন্তু গ্রন্থিত প্রথম উপন্যাস হিজলের রং লাল (২০১৬) পড়েছি। একটি নিরীক্ষামূলক উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও দেশভাগ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণজাগরণমঞ্চ ইত্যাদি বিষয়াদি উঠে এসেছে। আবার প্রেম এবং দার্শনিক প্রতিপাদ্যের আখ্যান একটা জাদুর হাড়। এই উপন্যাসে তাঁকে যেন নতুনভাবে দেখি । না চেরি না চন্দ্রমল্লিকা এই ভ্রমণ-আখ্যানে তাঁকে একজন পর্যটনপ্রিয় কবি হিসেবে আবিষ্কার করি। আবার তাঁর সম্পাদিত সিলেটি বিয়ের গীত, শ্রীভূমির রবীন্দ্রনাথ, তাম্রশাসনে শ্রীহট্ট ইত্যাদি গ্রন্থ কিংবা গবেষণাগ্রন্থ বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের ইতিহাস, স্ত্রীশিক্ষার উন্মেষপর্ব, ঘাটুগান ঘাটুসংস্কৃতি ইত্যাদি সাহিত্য এবং ইতিহাসের মূল্যবান সংযোজন। কিন্তু আমি কবিতাকে প্রাধান্য দিয়েই বলতে চাইছি, সাহিত্যে এই-যে বহুচারী গমন অর্থাৎ সাহিত্যের বিভিন্ন উঠোনে তিনি রোদ ছড়াতে চান, এই সৃষ্টিমুখরতা আমাদের বিস্ময়ে আবিষ্ট করে রাখে।
কবির জন্মদিন ২১ ডিসেম্বর। স্বদেশের সমবয়সী কবি জফির সেতুর সঙ্গে এই কথোপকথনে কবিতাপাঠক ও কবির অনুরক্ত শুভানুধ্যায়ীরা আনন্দ পাবেন আশা করি। আসুন, কবির আলাপ পড়া যাক। — সুমন বনিক
কবিতার কুশলমঙ্গল ও অন্যান্য কোলাহল
জফির সেতুর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপ
সুমন বনিক : কেমন আছেন কবি?
জফির সেতু : এটা একটি সরল প্রশ্ন, আবার জটিলও। শুভেচ্ছা বিনিময়ের একটা পদ্ধতি হিসেবে বলতে হয় ভালো আছি। নিতান্ত খারাপ যে সেও বলে ভালো আছি। কোনো রোগীকে হাসপাতালে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন ওই একই কথা বলবে। ভালো আছি। সুতরাং ভালো আছি। আর জটিল বললাম, এই কারণে যে একজন সংবেদনশীল মানুষের ভালো থাকার ক্ষমতা নেই বলে আমি মনে করি। কারণ চারদিকে এত অসাম্য, এত অনিয়ম, এত সংহার, এত শঠতা-আপনি কীভাবে বলবেন ভালো আছেন? একমাত্র মানুষের সঙ্গে সংযোগহীন মানুষই বলতে পারে ভালো আছি।
সুমন বনিক : একটি সরল প্রশ্ন করি, কেন কবিতা লিখেন?
জফির সেতু : তাহলে সরল জবাব, না লিখে পারি না বলে। সবসময়ই যে লিখি তা নয়। এমনও হয় ছয় মাসেও একটি কবিতা লেখা হলো না। তখন সময়টা থাকে কষ্টের, বেদনার। না লিখতে পারার মতো দুঃখ পৃথিবীতে আর নেই।
সুমন বনিক : একজন কবির কাছে বোদ্ধা-পাঠক কতটুকু সৌভাগ্যের?
জফির সেতু : কবিরা প্রথমত লিখেন নিজের ভিতরের তাগিদে। এটাই থাকে প্রথম চাওয়া। কবিতাটা লেখা হয়ে গেলে যে সুখ কবি পান, যে রিলিফ পান সেটাই কবির জন্য আসল। আমার মনে হয় সকল শিল্পীর জন্য এ-কথাটা খাটে। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাঠক বা বোদ্ধার প্রশ্ন আসে। কবি কবিতা লেখার পর আর কবি থাকেন না। নিজেই হন কবিতার প্রথম পাঠক। কবিতা পাঠ করে তিনি খুব আনন্দ পান। তার পর কবি চান তার কবিতা আর কেউ পড়ুক। যিনি পড়বেন তিনিই তো পাঠক। পাঠ করার সময় পাঠক, আর কবিতার ভিতরের কবি এক হয়ে যান। আসলে দুজনের মধ্যে তফাৎ থাকে না তেমন। যদি তিনি তেমন পাঠক হন। আপনি মনে হয় বোদ্ধা অর্থে সেই পাঠককে বুঝিয়েছেন।
সুমন বনিক : আসলে ঠিক তা-ই!
জফির সেতু : শার্ল বোদলেয়ার এই পাঠককে বলেছে ‘যমজ ভাই আমার!’ অনেক সময় কবিতার ভুল ইন্টারপ্রিটেশন হয়। কবি এটা চান না। সারা পৃথিবীতে সকল কালেই কবিদের ভাগ্যে তেমন কিছু ঘটেছে। কবিরা তিরস্কৃত হয়েছেন, দেশান্তরী হয়েছেন। সমকালেই এমনটা হয়। কবির শক্তি সমকাল অনেক সময় ধরতে পারে না। সত্যিকার কবি যে বাহবা পাওয়ার জন্য লিখেন তাও কিন্তু নয়।
সুমন বনিক : কবিতায় দুর্বোধ্যতা এবং আভিধানিক অপ্রচলিত শব্দ প্রয়োগের কারণে কখনো কখনো কবিতা সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছুতে পারছে না বলে অনেকেই মনে করেন। এই বিষয়টির ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
জফির সেতু : কবিতায় দুর্বোধ্যতা বলতে আদপে কিছু আছে কি? দুর্বোধ্য মানে সহজে বোধগম্য নয় এমন কিছু। কবিতা তো একটা শিল্প, শিল্পে সহজ রাস্তা বলে কিছু নেই। না সৃষ্টিতে, না শিল্পরস আস্বাদনে। জীবনের সঙ্গে সংযোগ বড়ো একটা বিষয়। বেঁচে থাকা মানেই যে জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা তাও কিন্তু নয়। জীবনের সঙ্গে সংযোগ মানে মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকা, সমকালের সঙ্গে থাকা, অতীতের সঙ্গে থাকা। সকলের ক্ষেত্রে কি তা সম্ভব হয়? হয় না। ফলে সে-ব্যক্তির পক্ষে তো অনেক কিছুই দুর্বোধ্য থাকবে। এখন, কবিতার মাধ্যম হচ্ছে ভাষা; ভাষা আবার সহজ জিনিস না। যা-কিছু মানুষ, তা হচ্ছে তার ভাষা। ভাষা মানেই অর্থমাত্র নয়, তার দার্শনিক দিকও আছে। কবিরা ভাষাকে গতি দেন, সুন্দরও করেন। মৃত শব্দকে পুনরুজ্জীবিত করেন। শব্দের প্রচলিত অর্থকে বদলেও দেন। সুতরাং ভালো কবিতা পাঠের জন্য পাঠকের প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। আবার আভধানিক অপ্রচলিত শব্দের জন্যই কবিতা দুরূহ হয় এমনটা নাও হতে পারে। খুব প্রচলিত এবং সহজ শব্দ দিয়ে লিখিত কবিতাও অনেকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকতে পরে। রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতার কথাই ধরুন না কেন? ওখানে একটি শব্দও তো আভিধানিক নয়। তা হলেও একে অনেকে দুর্বোধ্য বলেছেন। বনলতা সেনের কথা আপনি জানেন, এত ভুল বোঝাবুঝি ছিল কবিতাটি নিয়ে। কিন্তু তখনও সমঝদারেরা এর স্বাদ আস্বাদন করেছেন, বহু লোক একে অনর্থ বা দুরূহ কবিতা বলেছেন। আজ তো এই কবিতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাহলে যারা অভিযোগ করেছেন সমস্যাটা তাদের ছিল, কবিতা বা কবির নয়। আসলে কবিরা সময়ের চেয়ে অগ্রসর থাকেন বলেই পিছিয়ে-থাকা পাঠকের পক্ষে কবিতার মর্মোদ্ধার সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর পাঠকের মন জুগিয়ে লেখার দায়িত্ব কবির নয়, অকবির। ওই যে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বৈশ্য লেখকের পক্ষে শূদ্র পাঠকের মনোরঞ্জন স্বাভাবিক।’
সুমন বনিক : অর্থাৎ, আপনি বলতে চান যে, কবিতার পাঠক হতে হলে তাঁদের প্রস্তুতির দরকার আছে? কিংবা যদি বলি কবিতা সবধরনের পাঠকের জন্য নয়। আপনি এই ব্যাপারটি কীভাবে দেখছেন?
জফির সেতু : অবশ্যই একজন কবিতাপাঠকের প্রস্তুতির দরকার আছে। আমার মনে হয় আপনার প্রশ্নের উত্তর আগের কথাগুলোতেই আছে। ধরুন এই পঙক্তিটি : ‘তার পরে এল রণমন্থনে দূর বিদেশের নারী’— সাধারণ পাঠক এর ধ্বনিগুণ, অর্থ, ছন্দ, চিত্রকল্প প্রভৃতি মিলিয়ে প্রেমের কবিতার একটা স্বাদ পেতে পারেন। কিন্তু পাঠক যদি হন অগ্রসর, তিনি যদি গ্রিক মিথলজি সম্পর্কে জানেন, ট্রয়যুদ্ধ সম্পর্কে জানেন, আর জানেন সেই অনিন্দ্যসুন্দরী হেলেন নাম্নী নারীটিকে জানেন; এমনকি তাকে নিয়ে ঘটে-যাওয়া সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা জানেন তাহলে এই একটি পঙক্তি পাঠেই তিনি অপূর্ব কিছু পেতে পারেন যা সাধারণ পাঠকের পক্ষে অসম্ভব। আরেকটা কথা, জীবনানন্দ দাশ, হ্যাঁ, জীবনানন্দ দাশই তো বলেছেন, ‘কবিতা অনেক রকম’। অর্থাৎ হরেক রকম পাঠকের জন্য হরেকরকম কবিতা।
সুমন বনিক : একজন কবির আবির্ভাবকাল খুঁজতে আমরা অনেক সময় কবিকে দশকের ফ্রেমে বাঁধি। আবার অনেকের কাছে কবিকে দশক বিবেচনায় মূল্যায়ন করা অবান্তর, অমূলক। যেমন ষাটের দশকের কবি হিসেবে পরিচিত অনেক কবির প্রথম কাব্য প্রকাশিত হয়েছে সত্তর কিংবা আশি দশকে। উদাহরণ হিসেবে অরুণাভ সরকার, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, হেলাল হাফিজ প্রমুখের কথা বলা যায়। তাঁদের সবাই সমান সক্রিয় ছিলেন না ষাটের দশকে। আবার ষাটের দশকে আধিপত্য ছিল পঞ্চাশ দশকের কবিদের। কবিদের নিয়ে সময়পর্ব ভাগ করে নেওয়ার বিষয়টি কীভাবে দেখবেন?
জফির সেতু : দশক নিয়ে অনেকে নানান কথা বলেন। কিন্তু একে এত সিরিয়িাসলি নেওয়ার তো কিছু নেই। শতকের ঠাঁই পাবেন না বলে দশকের হিসাব, এই তো কথা তাই না? দেখুন দশকের হিসাবটা শুরু হয়ে পশ্চিমে, এবং আমাদের এখানে তা পশ্চিমাগত। ওরা এই হিসাব চালু করেছে কবিদের আবির্ভাবকাল খুঁজতে গিয়ে। অন্য ক্ষেত্রেও। এটা একটা সংখ্যাতত্ত্বই। এখন কেউ যদি বলেন ১০ বছর নেহাতই সামান্য, আমার কথা মহাকালের তুলনায় শতকও তো তুচ্ছ। আমাকে তো একটা সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে। সেই সূচনাবিন্দু দশক হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না বলে আমার ধারণা। শামসুর রাহমান কোন সময়ের কবি? এর উত্তরে যদি বলি বিশশতকের পঞ্চাশের দশকের, তাতে কীই-বা দোষ হয়? শুধু বিশশতকের বললে তো তার সত্যিকার কালটা বলা হলো না। কারণ বিশশতকের প্রথম ও শেষের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। নাকি?
সুমন বনিক : কবিতার ক্ষেত্রে কাল বা সময়কে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? তিরিশের কবিতা থেকে শূন্য দশকের কবিতার মৌলিক কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন কি? কিংবা কবিতার এই কাল পরিভ্রমণ কীভাবে দেখছেন?
জফির সেতু : সময় তো সবকিছুরই নিয়ামক। কারণ সময় ধারণ করে সবকিছু। ব্যক্তির অভীপ্সা থেকে রাষ্ট্রনীতি পর্যন্ত। সময় ব্যক্তিকে নির্মাণ করে; ব্যক্তি সৃজন করে শিল্প। হোমারের কথা ভাবুন? কিংবা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের কথা। তাঁরা যদি সেসব যুগে জন্ম না-নিয়ে এ যুগে জন্ম নিতেন তাহলে লিখতেন ইলিয়াড বা মহাভারত? মোটেও না। কারণ ওই কালটাই ছিল মহাকাব্য লেখার উপযোগী। দেখুন সফোক্লিস কিংবা এস্কাইলিসের জন্ম হয়েছে কখন? যখন গ্রিস সভ্যতা-সংস্কৃতিতে চূড়ায় অবস্থান করছিল। দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, শেক্সপিয়র — এঁরা ইটালীয় বা ইউরোপীয় রেনেসাঁ থেকে বের হয়ে আসা একেক প্রতিভা। রাশিয়া বা ইউরোপীয় যুদ্ধবিগ্রহের উত্তরপ্রজন্ম না হলে টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস কিংবা শলোকভের কোয়াইট ফ্লস দ্য ডন লেখা সম্ভব হতো? একইভাবে সাঁ জন পের্স কিংবা টি এস এলিয়টের কথাও বলা যায়। সুতরাং কালের ধর্ম কবিতার ধরন, ভাব বা ভঙ্গিকে পালটাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি চাইলেও মধুসূদনের মতো কবিতা লিখতে পারব না। এমনকি শামসুর রাহমানের মতো কবিতা লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। এটা ওই কালধর্মের জন্য।
বাংলা কবিতার জার্নিটাও বিশ্বকবিতার মতো। কাল-কালান্তরে বাংলা কবিতার রূপ-রূপান্তর হয়েছে নানাভাবে, নানা বিচিত্র পথ ধরে। বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে বাংলা কবিতার উদ্ভব; মূলত সেসব কবিতা ছিল পদ, গীত বা গীতি। গাওয়া, এমনকি নাচের উদ্দেশ্যেও সেসব রচনা। তাই দেখা যাবে সেই সপ্তম শতক থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলা কবিতা পাঠের চেয়ে গাওয়ার উদ্দেশ্যে রচিত। সেই প্রভাব বাংলা কবিতায় এখনো বর্তমান। এখানকার অনেক বড়ো কবির কবিতাও একধরনের গীতি। এই সেদিন পর্যন্ত কবিতার সঙ্গে পদ বা গীতের পার্থক্য ছিল না। আমি বলছি না পদ বা গীতি কাব্য নয়। আমি বলতে চাচ্ছি আধুনিক কালে ‘কবিতা’ বলতে যে শিল্পাঙ্গিককে বোঝানো হয়।
তিরিশের কবিরা তাই কবিতার ইশতেহার ঘোষণা করে বললেন, যা-কিছু কবিতা নয় তা থেকে মুক্তি দিতে হবে কবিতাকে! তাহলে, রবীন্দ্রনাথকে মনে রেখেও এই ঘোষণায়, কবিতায় কবিতাবাচ্য ছিল না সেসব তাহলে কী? আধুনিক বাংলা কবিতায় তিরিশের সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা আছে, তা আমরা সকলেই মানি। কিন্তু যে-জিনিসটা প্রকাশ্যে আনা দরকার তা হচ্ছে বাংলা কবিতাকে শেকড়চ্যুত করেছিল সে তিরিশই। তিরিশের কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ ছিল আধুনিকতাবাদ, সেটা আবার ওই অর্থে ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদ নয়। ইউরোপের বিশেষ দু-একটি দেশের অর্থাৎ ঔপনিবেশিক আধুনিকতাবাদ। সুতরাং উপনিবেশিত বাংলায় এমন আধুনিকতাবাদ সোনারপাথরবাটি, সেটাই স্বাভাবিক। বাংলার কবিরা বাংলা ভাষায় ইউরোপীয় মননের কবিতা লিখলেন। কিন্তু তার পরে উপনিবেশের অবলোপ, দেশভাগ, ভারত-স্বাধীনতা, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, জেলহত্যা, সামরিক শাসন প্রবর্তন, আশির দশকের শেষের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ইত্যাদি; আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা, স্নায়ুযুদ্ধ, সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাঙন, বিশ্বায়ন, মুক্তরাজার অর্থনীতি, তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি, আকাশসংস্কৃতি, মোবাইলসংস্কৃতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রভৃতি কারণে তিরিশ হতে শূন্যেও ফারাক। মানবজাতি বিগত যুগে যতটা উন্নতি করেছিল এই প্রায় একশত বছরে অগ্রসর হয়েছে অনেক বেশি। সবচেয়ে বড়ো অগ্রগতি হয়েছে জনচিত্তের। সুতরাং তিরিশের কবিতার সঙ্গে শূন্যের দশক বলতে যে-কালপর্বকে আপনি বুঝাতে চেয়েছেন এ-সময়ের কবিতার ফারাক তো থাকবেই। হয়েছেও। এককথায় যেটুকু বলার তা হলো, এই সময়ের কবিতা তিরিশের অনুগামী নয়। অবশ্য এটুকু বলা আবশ্যক যে শূন্যের একটা পাটাতন প্রয়োজন ছিল তা হচ্ছে নব্বইয়ের দশক বা নব্বইয়ের দশকের কবিতা।
সুমন বনিক : সমকালীন কবিতা বা কবিতাচর্চা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কেমন হতে পারে?
জফির সেতু : সমকাল নিয়ে সকল যুগেই নাক সিঁটকানোর একটা বিষয় থাকে। গেল গেল সব রসাতলে গেল। এমন জিগির সকল কালেই থাকে। এটা মূল্যাবোধ, রুচি ও সংস্কৃতিগত। কারণ সমকালের সৃষ্টিকে ওই অর্থে মূল্যায়ন করা যায় না। হয়তো এজন্যেই। কিন্তু সময় তো শিল্পের নিয়ামক। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে শিল্পনির্মাণে পরিবর্তন আসবে। নতুন রুচির সঙ্গে পুরাতন রুচি মিলবে কেন? আবার শিল্প যেমন সমকালীন, আবার তা সর্বজনীন ও সর্বকালীনও। তাই যে নতুন ধরনের কবিতাকে আজ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন, সেটাই ভাবিকালে নতুন কবিতার মডেল হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় জীবননানন্দ দাশ আমাদের দেশে সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ।
সুমন বনিক : কবিতাকে ব্যাকরণের ফ্রেমে বেঁধে কবিতাচর্চার আবশ্যকতা কতটুকু — আপনার ব্যাখ্যাটি বলবেন?
জফির সেতু : ব্যাকরণ মানে তো কিছু নিয়ম। আর নিয়ম তো সবখানেই আছে, না থাকলে নৈরাজ্য। নিয়ম পরস্পরের জন্য, মিলনের জন্য। শিল্পেও ধরাবাঁধা নিয়ম কিছু আছে, সে-নিয়ম এসেছে জীবনচর্যা থেকে, মানুষের অস্তিত্ব থেকে। ধরুন, মানুষ বলতে যা বোঝায়, তার শারীরিক ও মানসিক কিছু গুণ/বৈশিষ্ট্য থাকতেই হবে । না-হলে আপনাকে কেউ মানুষ বলবে না। যেমন বাঁশকে কেউ মানুষ বলে না। কিংবা বককে বলে না হাতি। কবিতার নিয়ম হচ্ছে কবিতার গুণ, এই গুণ বা গুণাবলিই কবিতাকে অন্য শিল্প থেকে আলাদা করেছে। তাই কবিতা লিখতে গেলে ওই গুণগুলো সম্পর্কে যেমন ধারণা থাকতে হবে, তেমনি রচনায় তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
সুমন বনিক : শব্দ/শব্দবিন্যাস, ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প ইত্যাদি কবিতা বিনির্মাণে কতটুকু আবশ্যক বলে মনে করেন?
জফির সেতু : দেখুন, কবিতা একটি শিল্পমাধ্যম। এই শিল্পাঙ্গিকের কিছু অপরিহার্য উপাদান আছে। কবিতার মূল উপাদান শব্দ। এই শব্দ দিয়েই কবি অলংকার সৃষ্টি করেন। সেটা হতে পারে শব্দালঙ্কার, হতে পারে অর্থালঙ্কার। সংস্কৃত অলংকারবিদরা বলেছেন, ‘রসাত্মকং বাক্য কাব্যং’ — অর্থাৎ রসযুক্ত বাক্যই কাব্য। তাঁরা এও বলেছেন, এই রস সৃষ্টির মূলে রয়েছে অলংকার। অলংকার প্রয়োগে কবিকে তাই কুশলী হতে হয়। ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’ — এই বাক্যে কবির শব্দপ্রয়োগ খেয়াল করুন। যদি এমন লিখতেন কবি, ‘গগনে গর্জে মেঘ ঘন বর্ষা’ তাহলে ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’-র ধ্বনিসুষমা বা তান বা মাধুর্য আমরা পেতাম? আমাদের মনে ভেতরে বর্ষার মেঘমেদুর সেই ছবি ফুটে উঠত এমন জীবন্তভাবে? উঠত না। চিত্রকল্প তৈরির জন্য যথার্থ শব্দ প্রয়োগ করতে হয়। তাই কবিতা নির্মাণে এসবের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
সুমন বনিক : কবি এবং কবিতা-এই দুই সত্তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
জফির সেতু : আমার মনে হয় ব্যক্তিকবি ও কবিতার মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে আপনি কিছু জানতে চেয়েছেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে বলতে হবে বিষয়টা জটিল, তবে বিশ্লেষণযোগ্য। কবিতার জন্ম হয় ব্যক্তিকবির বোধের জগৎ থেকে। কিন্তু কবিতা মানে ব্যক্তিকবি নয়। বিশেষ একটা মুহূর্তে কবিতাটি লিখিত হয়, যতক্ষণ ধরে কেউ এটা লিখে ততক্ষণ তিনি কবি। লেখা শেষ হয়ে গেলে অন্য যে-কারও মতো পাঠক হয়ে যান। তবে তিনিই হন কবিতার প্রথম পাঠক। এই পাঠক কখনোই ওই কবির স্থানে পৌঁছাতে পারেন না। সেটা সম্ভবও নয়। কেননা সময় ও সত্তার দিক থেকে দুজনেই আলাদা। রবীন্দ্রনাথ হয়তো এ-কারণেই বলে থাকবেন, ‘কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে’। আমারও তো তা-ই মনে হয়। তবে এটাও ঠিক যে, ব্যক্তিকবির অভিজ্ঞতাই কবিতার প্রত্নউপাদান।
সুমন বনিক : এখন আপনার লেখা নিয়ে কথা বলি। আপনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও সম্পাদক। আপনার প্রকাশিত কবিতার বই হচ্ছে সতেরোটি; দুটি উপন্যাস লিখেছেন, একটি গল্পগ্রন্থ; লিখেছেন ভ্রমণ-আখ্যান ও প্রবন্ধগ্রন্থ; সম্পাদনা করেছেন মূল্যবান কিছু গ্রন্থ। কবিতার কথা যদি বলি, আপনার প্রথম কাব্য বহুবর্ণ রক্তবীজ — প্রকাশকাল ছিল ২০০৪। তারপর সহস্র ভোল্টের বাঘ (২০০৬), স্যানাটোরিয়াম (২০০৮), তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১), সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২), জাতক ও দণ্ডকারণ্য (২০১৩) কিংবা ইয়েস, ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস (২০১৫), কিংবা তিন ভাগ রক্ত (২০১৯) প্রভৃতি, অতি সম্প্রতি বের হলো আমি করচ গাছ। কবিতার সঙ্গে এই যে লং-জার্নি — এখানে দেখি আপনি বারবার বাঁক পরিবর্তন করেছেন, বিষয় ও আঙ্গিক উভয়ক্ষেত্রেই। বিশেষত বিষয়ের ক্ষেত্রে মানুষ-প্রকৃতি-মিথ থেকে শুরু করে মরমি চিন্তা বা ভাববিশ্বে চলে এলেন। আপনার কবিতা নিয়ে যারাই আলোচনা করেছেন তারা মনে করেন নিয়ত নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কবিতাকে উপস্থাপন করেন আপনি। এই বিচিত্র যাত্রাপথকে কীভাবে ব্যখ্যা করবেন?
জফির সেতু : কবিতার জগতে আমার আগমন আকস্মিক কিছু নয়। আমার ভাবনা, কল্পনা ও চিন্তায় কবিতার বড়ো ধরনের প্রভাব ছিল ছোটোবেলা থেকে। কৃষিভিত্তিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে আমার পিতৃ ও মাতৃকূলের একটা সম্পর্ক ছিল। এমনিতেই সিলেটের হাওর-অঞ্চলে লোকগীতি, বেহুলার ভাসান, পুথি-পাঁচালির সঙ্গে লোকজীবনের সম্পৃক্ততার কথা আপনি জানেন। আমরা ঘুমাতাম গানের সুর কানে নিয়ে, জেগে উঠতাম কোরানের সুর শুনে শুনে। আমাদের বাড়িতে শীত ও বর্ষায় পুথিপাঠ হতো। রূপকথার গল্প হতো আয়োজন করে। বড়ো চাচা মনসামঙ্গলের পালা গাইতেন প্রায় রাতেই। আমার নানা বহু ভাষা জানতেন, বাংলা ছাড়াও ফারসি, উর্দু, হিন্দি, আরবি তিনি লিখতে পড়তে পারতেন। তখন বুঝতাম না, এখন মনে করতে পারি তিনি আসলে মাথা নিচু করে ফারসি সাহিত্যই পড়তেন। ছিলেন বনেদি, পরে গরিব হয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতায় তাঁর যাতায়াত ছিল। এসব বলার কারণ হচ্ছে এইসব আবহ আমাকে কাব্যের দিকেই নিয়ে যায়। কিন্তু কবিতা লিখতে যখন আসি, তখন মনে হলো একটু ভাবনাচিন্তা করে লেখা দরকার। তখন নব্বইয়ের দশক শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে আমার বয়েসি কবিরা নতুন ধরনের কবিতা লিখতে মশগুল হচ্ছেন। লিটলম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে, পত্রযোগাযোগ হচ্ছে। এখানে যেসব বন্ধুরা সাহিত্য নিয়ে পড়ালেখা শুরু করি সকলেই সিরিয়াস ধরনের লেখার দিকে ঝুঁকছিলেন। আসলে নব্বইয়ের দশকটাই নানা দিক থেকে পরীক্ষানিরীক্ষার। সুতরাং দায়সারা কবিতা লেখার সুযোগ ছিল না আমাদের। কবিতা পদবাচ্য হোক না হোক আমাদের ভিন্ন পথে হাঁটতে হয়।
আপনি লক্ষ করবেন আমার প্রত্যেকটি কবিতার বই আলাদা মেজাজের। বিষয় ও নির্মাণ উভয় দিক থেকে। একটু আলাদা না হলে বই করার কথা কখনোই ভাবিনি। বিষয়ের কথা যদি বলেন, একটা পাঠের জগৎ আমার ছিল। সে-জগতে দানিকেন থেকে হকিং, হোমার থেকে মধুসূদন, ডারউইন থেকে ভবানীপ্রসাদ, গ্রিক মিথ থেকে সুনামগঞ্জের বৃক্ষকথা। মানুষের ইতিহাস পড়তে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন কবি দিলওয়ার এবং তাঁর কবিপুত্র কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। মানুষের ইতিহাস আজও আমার প্রিয়। মানুষের ইতিহাস যত পড়ি ততই বিস্মিত হই। প্রকৃতি জগতের বিবর্তন আমাকে বিস্মিত করে। মানুষের ধর্মের ইতিহাস আমাকে অবাক করে দেয়। হ্যাঁ, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস আমাকে বরাবর টানে। আমার মনে হয় এই সবকিছুর একটা প্রতিফলন আমার কবিতায় আছে। যৌনতা আমাকে তরুণ বয়েসে খুবই টানত। যৌনতা নিয়ে পড়তাম, ভাবতাম; তার প্রতিফলন কবিতায় আপনি দেখতে পাবেন। যৌন-অভিজ্ঞতা ছাড়াই যৌনতার কবিতা ও গল্প লিখেছিলাম, অনেকে বিস্মিতও হয়েছিলেন। ফলে মিথ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, নারী, যৌনতা ইত্যাদি দেখবেন আমার কবিতায় কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। আরেকটা কথা, দেখবেন আমার কবিতায় অন্য প্রাণীদের বেশ উপস্থিতি, পশুর একটা জগৎ। মানুষ কিন্তু পশু থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, পশুকে নিয়েই মানুষ সামনের দিকে এগিয়েছে। হয়তো তার অনেকটাই রূপক হিসেবে এসেছে। আসলে মানুষের জার্নিটাই আমার কবিতায় আছে, আপনি যদি খেয়াল করেন দেখে থাকবেন। এই জার্নি বায়োলজিক্যাল যেমন, চেতনারও তেমন। আর আপনি যেটা বললেন, মরমি ভাব — ঠিকই বলেছেন। এই অঞ্চলে বিশেষত যে সাংস্কৃতিক আবহে আমরা বেঁচে আছি, এই প্রাচ্যে, আমাদের মরমি করাতে ফালা ফালা না হওয়ার সুযোগ কম। একটা সময় আমি যৌনতার মধ্যেও মিস্টিকতা সন্ধান করেছি। কবিতায় আপনি পাবেন। প্রথম কবিতার বইয়ের একটি লাইন মনে পড়ছে, ‘কারেন্টের খুঁটিতে বসা ওই যে চিল, সে আমার মালিক।’ মরমি হওয়া ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই।
সুমন বনিক : আপনার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস অকালবোধন। একনিশ্বাসে অনেকে পড়েছেন বলে জানি। গ্রন্থাকারে বের হয়নি বলে পড়ার সুযোগ হয়নি আমার। কিন্তু গ্রন্থিত প্রথম উপন্যাস হিজলের রং লাল (২০১৬) পড়েছি। একটি নিরীক্ষামূলক উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও দেশভাগ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণজাগরণমঞ্চ ইত্যাদি বিষয়াদি উঠে এসেছে। আবার প্রেম এবং দার্শনিক প্রতিপাদ্যের আখ্যান একটা জাদুর হাড়। এই উপন্যাসে আপনাকে নতুনভাবে দেখি । না চেরি না চন্দ্রমল্লিকা এই ভ্রমণ-আখ্যানে আপনাকে একজন পর্যটনপ্রিয় কবি হিসেবে আবিষ্কার করি। আবার আপনার সম্পাদিত সিলেটি বিয়ের গীত, শ্রীভূমির রবীন্দ্রনাথ, তাম্রশাসনে শ্রীহট্ট ইত্যাদি গ্রন্থ কিংবা গবেষণাগ্রন্থ বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের ইতিহাস, স্ত্রীশিক্ষার উন্মেষপর্ব, ঘাটুগান ঘাটুসংস্কৃতি ইত্যাদি সাহিত্য এবং ইতিহাসের মূল্যবান সংযোজন। কিন্তু আমি কবিতাকে প্রাধান্য দিয়েই বলতে চাইছি, সাহিত্যে এই-যে বহুচারী গমন অর্থাৎ সাহিত্যের বিভিন্ন উঠোনে আপনি রোদ ছড়াতে চান, এতে করে আপনার কবিতা সৃষ্টিতে কোনো ছেদ পড়বে কি? যদি না-পড়ে তাহলে আপনি কী লিখতে বেশি সুখ অনুভব করেন এবং কেন? ব্যাখ্যা করবেন কি?
জফির সেতু : অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন। আমি যখন যা লিখি আনন্দের সঙ্গে লিখি। আপনি নিজেও একজন কবি। এটা তো জানেন লেখার মতো কষ্টকর কাজ দ্বিতীয়টি নেই। উপন্যাসের জগৎ কবিতার জগতের চেয়ে ভিন্ন। প্রবন্ধের জগত আলাদা। গবেষণা তো গরু খুঁজে বেড়ানো! তবে সব ধরনের লেখায়ই সুখ আছে। এই সুখের সন্ধানেই আমি লিখি। এটা ঠিক বলেছেন, কবির প্রতি আলাদা পক্ষপাত তো আছে। কারণ জীবনে তো কবিই হতে চেয়েছি। এখন মনে হয়, কবি হওয়া সহজ কাজ না। কারণ কবিরা চিরকালের, তাদের মৃত্যু হয় না। এজন্য দরকার বড়ো প্রতিভার, বড়ো পরিশ্রমের। কবিতা সোজা জিনিসও না। কবিতা সবসময়ই আমার কাছে চিরআরাধ্য।
সুমন বনিক : আপনার ডক্টরাল গবেষণা ছিল সমাজভাষাতত্ত্বের ওপর। আপনি এই বিষয় কেন আগ্রহী হলেন, এর পেছনের গল্পটা বলবেন?
জফির সেতু : ভাষা হচ্ছে একটা প্রপঞ্চ। ভাষা আমাকে টানে বেশি। আসলে ভাষা ধারণ করে সবকিছু। ভাষার সঙ্গে নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্পকলা সবকিছুর নিকটসম্পর্ক বিদ্যমান বলেই হয়তো এতে আমার বেশ আগ্রহ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে আমি সর্বোচ্চ নম্বর পাই। বিশেষ করে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ধ্বনিতত্ত্ব ও শব্দতত্ত্ব আমাকে বুঁদ করে রাখত। স্নাতক পর্যায়ে সমাজতত্ত্ব আমার সাবসিডিয়ারি ছিল। পরে নিজের অজান্তেই ভাষার সমাজতাত্ত্বিক বিষয়গুলো আমাকে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। গবেষণার জন্য যখন পড়তে শুরু করি তখন ভাষার সঙ্গে নৃগোষ্ঠী, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ, বয়স, শিক্ষা, অঞ্চল, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামাজিক স্তর, মনস্তত্ত্ব, বায়োলজি, অবদমন, যৌনতা, অপরাধ, নৈতিকতা ইদ্যাদির পারস্পরিক সম্পর্ক দেখে খুব উৎসাহ বোধ করি। এটা ঠিক এই বিষয় নিয়ে কাজ না করলে জগতের অনেককিছু অনুদ্ঘাটিতই থেকে যেত আমার কাছে। বলতে হয় যে এ বিষয়ে কাজ করে আমি সুখী।
সুমন বনিক : এখন আসি অন্য প্রশ্নে। লিটলম্যাগ প্রথাবিরোধী লেখার কাগজ। অনেকে বলেন, ‘লিটলম্যাগ বামুন হয়ে আকাশ ছুঁতে চায়’। একটা সময় ছিল লিটলম্যাগ প্রথাবিরোধী আন্দোলনের মুখপত্র ছিল। লিটলম্যাগ আজো কতটুকু প্রাসঙ্গিক কিংবা লিটলম্যাগ চর্চার আবশ্যকতা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
জফির সেতু : হ্যাঁ, লিটলম্যাগ প্রথাবিরোধী পাটাতন বটে। নামের মধ্যেই এর শক্তি নিহিত। অনেকটা গেরিলাযোদ্ধার মতো। আপনি গণ্য করছেন না, তবে নিমিষেই কুপোকাত করে ফেলবে আপনাকে। কিন্তু এই প্রবচনটি সঠিক নয়। লিটলম্যাগ বামুন হতে যাবে কেন? তবে চাঁদ স্পর্শ করে সে। আদপে প্ল্যাটফর্মটি প্রতিষ্ঠানবিরোধী। প্রতিষ্ঠান একসময় সবকিছু পচিয়ে ফেলে, সকল দেশে। বিশেষত শিল্পসাহিত্যে। লিটলম্যাগ হচ্ছে বিকল্প ধারা। নতুন ভাবনা, নতুন শিল্পপদ্ধতি চর্চার নিরুদ্বেগ জায়গা এটি। অবশ্যই লিটলম্যাগ প্রথাবিরোধী আন্দোলনের মুখপত্র ছিল, এখনো যে নেই তা নয়। এর প্রাসঙ্গিকতাও ফুরিয়ে যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প নন্দনতত্ত্ব, বিকল্প নির্মাণরীতি প্রতিষ্ঠান মেনে নিতে নারাজ থাকে, শিল্পসাহিত্যের মোড়লেরা গ্রাহ্য করে না। এমন অবস্থায় নিজেদের প্ল্যাটফর্মের দরকার হয়ে পড়ে। কেউ গ্রাহ্য করুক না-করুক, আমরা যেটা মনে করি তা-ই করব। এটা তো চিরকালীন একটা বিষয়। সনাতনপন্থীরা সকল সময়ে মনে করে নতুনরা সব রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে, শিল্পসাহিত্য রুচি-অরুচি বলে আর কিছু থাকছে না। সুতরাং তাদের চপেটাঘাত করতে, নিজেদের প্রকাশ করতে তো লিটলম্যাগ দরকারই। অনেকে ব্লগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি ইন্টারনেটভিত্তিক ওয়েবম্যাগের কথা টেনে বলছেন লিটলম্যাগের দিন ফুরালো। বইয়ের দিন যদি থাকে তাহলে লিটলম্যাগেরও থাকবে। এটা আমার মত।
সুমন বনিক : ইদানীং দেখছি অনেকেই সাহিত্যসংকলন অথবা সাহিত্যসাময়িকীকে লিটলম্যাগ হিসেবে চালিয়ে যান। এমনটিও দেখি লিটলম্যাগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করা হয়, প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু লিটলম্যাগের ধর্মই তো নীরবে-নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করা। লিটলম্যাগের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে। সমকালীন ভাবনা থেকে লিটল ম্যাগাজিন চর্চার চরিত্র-চিত্রণ কীভাবে করবেন, বিষয়টি কি বুঝিয়ে বলবেন?
জফির সেতু : মুক্তবাজার অর্থনীতি বা বিশ্বায়নের একটা বড়ো প্রভাব আছে আমাদের চিন্তার জগতেও। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধারণারও পরিবর্তন হয়। কোনো ধারণাই স্থির বা অকাট্য নয়। সেই হিসেবে হয়তো লিটলম্যাগকর্মীদের কর্মকাণ্ডে রূপ-রূপান্তর ঘটছে। অর্থব্যবস্থা আমাদের কপট করে তুলেছে। সেজন্যই হয়তো লিটলম্যাগের পরিসর যতটাই বেড়েছে, লেখার কমিটমেন্ট ততটাই কমেছে বলেই মনে হয়। জানেন তো একটা কমিটমেন্ট নিয়েই লিটলম্যাগের যাত্রা হয়, সেটা যদি না-থাকে তাহলে তাকে লিটলম্যাগ বলব কেন? আর বর্তমান যুগ নীরব-নিভৃতের যুগ নয়, এখন প্রকাশ্যে আসার যুগ। এখন সত্য নির্মাণের যুগ। সুতরাং জনতার কাতারে এসেই ম্যাগাজিন হাতে দাঁড়াতে হবে।
সুমন বনিক : আপনার লিটল ম্যাগ সুরমস সম্পর্কে কিছু বলুন ।
জফির সেতু : এটি একটি কবিতাবিষয়ক ছোটোকাগজ। ঢাউস-ঢাউস কাগজ বের হয়, পড়ার মতো লেখা থাকে না তেমন। সারাজীবন লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিকই ছিলাম। কিন্তু নিজে কখনো সম্পাদনা করব ভাবিনি। কিন্তু ওই-যে একটা অভাববোধ, একটা দায় থেকেই পত্রিকাটি প্রকাশের উদ্যোগ নিই। কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশও হয়। এখানে-ওখানে অনেকে পছন্দও করেন। কিন্তু ভালো লেখার এত অভাব যে পত্রিকার প্রকাশই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার উপর কোভিড-১৯। ছয় বছর ধরে প্রকাশ হচ্ছে না। এখন একটা সংখ্যার পরিকল্পনা করছি। দেখি কী হয়।
সুমন বনিক : নতুন প্রজন্মের যারা কবিতা লিখেছেন তাদের জন্য কোনো পরামর্শ আছে কি?
জফির সেতু : না, কোনো পরামর্শ নেই। কবিরা তো পরামর্শ শোনে না, শুনে কাজই-বা কী। তবে একটা কথা, এত তাড়াহুড়া কেন ভাই?
সুমন বনিক : আপনি অধ্যাপক হিসেবে আমর্ম ছাত্র-অন্তঃপ্রাণ, পাশাপাশি আপনাকে বিবেকী চিন্তক হিসেবেও আমরা দেখি। আপনি আপনার জন্মভিটায় শিক্ষার আলো ছড়ানোর ব্রত গ্রহণ করেছেন। সেখানে স্কুল-স্থাপনের তাগিদের মর্মমূল গল্পটি বলবেন?
জফির সেতু : আমি এসেছি জলাজংলার দেশ থেকে। ভাই, আমি প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ। ওখানে কোনো মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ও নেই। সুতরাং দু-চারটা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে যেসব ছেলেমেয়েরা বের হয় সুযোগের অভাবে আর পড়তে পারে না। সকলের পক্ষে থানাসদরে বা সিলেট শহরে আসা কখনোই সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ বিষয়টি আমাকে সবসময় ভাবাত। একদিন দেখলাম একটি মেয়ে হাওরের আলপথ দিয়ে বইখাতা বুকে চেপে হাঁটছে, অনেক পিছনে তার বয়োবৃদ্ধ দাদা। এই বৃদ্ধলোক তাঁর নাতনিকে নিয়ে রোজ থানাসদরে যান। মেয়েটির পড়ার আগ্রহ এবং বৃদ্ধলোকটির স্বপ্ন আমাকে খুব নাড়া দিলো। তারপর আমি গ্রামে যাই, এবং দু-গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলি, তাঁদের স্বপ্ন দেখাই। চাইলেই আমরা একটি স্কুল করতে পারি। কিন্তু টাকা পাবো কোথায়? আমি বলালাম, স্কুল করতে টাকা লাগে না, মন লাগে। তাঁরা সকলে অবাক। টাকা লাগে না? আমি বললাম, আপনাদের কিছু বিক্রি করতে হবে না, শুধু মানসিক ত্যাগ সহ্য করতে হবে। তাঁরা বললেন, আমরা রাজি। এই তো স্কুলের গল্প। এখন ২৮০ জন শিক্ষার্থী পড়ছে, এদের অধিকাংশই মেয়ে, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ে ওরা।
সুমন বনিক : আপনার এতসব সৃষ্টি ও নির্মাণের পেছনে প্রেরণার উৎসে কেউ আছেন কি? এই বিষয়টি খুলে বলবেন?
জফির সেতু : অনেকেই আছেন। তবে নিজের ভিতরে কেউ একজন সর্বদা তাগিদ দিয়ে বেড়ান। এটা করো, এটা করো। তাকে তো চিনি না!
সুমন বনিক : বাংলাদেশের সমান বয়স আপনার, এখানে দাঁড়িয়ে কেমন বাংলাদেশ আপনি দেখতে চান?
জফির সেতু : দেখুন, এই দেশটার একটা ইতিহাস আছে। হাজার বছরের ইতিহাস। এছাড়া যুদ্ধ করে রক্তের বিনিময়ে দেশটা আমরা পেয়েছি। যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নটা হতে হবে আমাদের সকলের একমাত্র কমিটমেন্ট। কী ছিল তাঁদের স্বপ্ন? তাঁরা চেয়েছিলেন একটি দারিদ্র্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে ধর্মনিরপেক্ষতা, আইনের শাসন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য, ন্যায়বিচার ইত্যাদি। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমরা কি তা অর্জন করতে পেরেছি? এই প্রশ্ন নিজেদের প্রত্যেকেই করা উচিত। দিন যত যাচ্ছে মানুষে মানুষে অসাম্য বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৌলবাদ; বুদ্ধির মুক্তি মুখ থুবড়ে পড়ছে সমাজের সর্বত্র। আমি এর বিপরীতে হিমালয়ের সমুন্নত এক বাংলাদেশ দেখতে চাই। শোষণহীন, দারিদ্র্যমুক্ত, বিজ্ঞাননিষ্ঠ, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। কিন্তু সামনে আমাদের কঠিন পথ। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও কূটজাল সর্বত্র। যেন অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে এক লড়াই। এই লড়াই সবচেয়ে বড়ো বলে মনে হয়।
সুমন বনিক : ধন্যবাদ, কবি। আপনার সান্নিধ্য পেয়ে ঋদ্ধ হলাম। ভালো থাকুন। আপনার সর্ববিধ কল্যাণ কামনা করি।
জফির সেতু : আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনিও ভালো থাকুন। আপনার জন্য এবং সকলের জন্য শুভকামনা।
গানপারে জফির সেতু
সুমন বনিক রচনারাশি
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
- অন লেখালেখি, ইনফর্ম্যাল (তিস্রা দাগ) - October 11, 2024
COMMENTS