আকাশের রঙ বুঝি বারবার বদলায়। কখনো নীল। কখনো হলুদ। কখনো আবার টকটকে লাল। মাঝে মাঝে যখন সাদা কালো মেঘগুলো ইতিউতি ছড়িয়ে থাকে আর সোনালি সূর্যের আভা ঈষৎ বাঁকা হয়ে সহস্ৰ মেঘের গায়ে লুটিয়ে পড়ে তখন মনে হয়, এর রঙ একটি নয়, অনেক।এখন আকাশের কোন রঙ নেই।
শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০)
আজ ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ সিনেমার মুকুটবিহীন ঐশ্বর্য জহির রায়হানের ৮২তম জন্মবার্ষিকী।
তিনি বাংলাদেশের একজন সিনেমা-কারিগর যিনি কখনো রাষ্ট্রের চোখ রাঙানিকে তোয়াক্কা করেন নাই, আত্ম-সমালোচনায় কখনো নিজেকে/নিজেদের ছাড় দেবার মানসিকতার নজির রাখেন নাই। মনে রাখা যেতে পারে, স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১)-এর প্রসবকাহিনি। স্টপ জেনোসাইড নির্মাণে বাংলাদেশের জন্য সহানুভূতিশীল ভারতীয় বন্ধুরা টাকাকড়ি যোগাড় করে দিয়েছিলো। নির্বাসিত রাজনীতিবিদ এবং তাদের চলচ্চিত্র বিভাগ এই উদ্যোগে গরহাজির ছিলো। যাইহোক, ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ স্টপ জেনোসাইড-এর গুরুত্বটা দেখতে পেরেছিলেন; ইন্ডিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও দেখলেন স্টপ জেনোসাইড, তিনি রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছিলেন। এবং ইন্ডিয়ার ফিল্ম ডিপার্টমেন্টকে নগদ নগদ অর্ডার দিলেন সিনেমাটি ক্রয় করে, বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালানোর জন্য (লিহি, ২০০২)।
আজ তাঁর জন্মদিন।
তাঁর আধুনিক শহুরে বা চিরায়ত বাঙলার গল্পগাথা নিয়ে রচিত সিনেমায় কালচারের ধারক হয়ে থাকে পাড়াগাঁ আর শহর কালচারের দ্রষ্টা (আহমদ, ১৯৬৬)। ভুলে যাই কী করে মনসামঙ্গলকাব্যের বেহুলাকে নিয়ে তিনিই প্রথম সিনেমা করেছিলেন। বেহুলার কথা চিন্তা করেন…জহিরের অন স্ক্রিন অ্যাডাপটেশনে কিন্তু হিন্দুয়ানি ব্যাপারটা নেই। তিনি এই কাজটার মধ্যে দিয়ে একটা জিনিস ধরবার চেষ্টা করেছেন; সেটা হলো, মানুষ যদি মানুষকে ভালোবাসে তাহলে মৃত্যুর কাছ থেকেও তাকে ফিরিয়ে আনা যায়। বেহুলা-লখিন্দর সংক্রান্ত মাইথোলজির একটা অন্যতর ব্যাখ্যা সে হাজির করেছে। একটা সাদামাটা গল্পের মধ্যেও প্রাণের জোয়ার এনেছে। এইটা কিন্তু মূল বেহুলার মধ্যে নেই। কিংবা কাচের দেয়াল সেখানে কিন্তু একটা সাইকোলজিক্যাল মুভ বা মুক্তির কথা বলেছেন যা তখনকার সিনেমাচর্চায় ছিল অভিনব। এই জিনিসগুলো ভাববার বিষয় (ফিরদাউস, ২০১৫)।
পুংলিঙ্গের সামাজিক কালচার চর্চিত সমাজের উঠোনে দাঁড়িয়ে তাঁর সিনেমার নারীরা আওয়াজ তোলে যৌন-সমতার, চিহ্ন উৎপাদন করে প্রচলিত দাসী-বান্দী ধারণার বিরুদ্ধে।
তিনি দলগত অর্জনের চাইতে বিশ্বাস করতেন সামষ্টিক উপার্জনে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কালে ইন্ডিয়ার কলকাতায় শরণার্থী শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী পরিষদ। এই ব্যানারে শুধু নিজেই স্টপ জেনোসাইড নির্মাণ করেননি, প্রতক্ষ্য সহযোগিতায় আলমগীর কবির, বাবুল চৌধুরীকে সহায়হতা করেন লিবারেশন ফাইটার্স, ইনোসেন্ট মিলিয়নস সহ একগুচ্ছ প্রামাণ্য-সিনেমা নির্মাণে; এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববাসীর সামনে গণহত্যা,পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ড, শরণার্থী দশা তুলে ধরা — যা বলাই বাহুল্য। সমবায়, সহযোগিতার ভিত্তিতে সিনেমা নির্মাণের চর্চা পূর্ব-পাকিস্তান আমলেও জারি ছিল।
বিশ শতকের ষাট-সত্তরের দশকে আমরা দেখে থাকবো অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতাদের যারা সাংবাদিকতা পেশা (যেটাকে তারা অ্যাক্টিভিজমের অংশ বলে মনে করে থাকবেন) থেকে সিনেমাচর্চায় আসেন। যেমন, ক্ষুধার নন্দনতত্ত্বের উদ্গাতা ব্রাজিলের গ্লোবার রোচা, অস্বাচ্ছন্দ্যদায়ক বাস্তবতা উৎপাদক ইতালির পিয়েরে পাওলো পাসোলিনি, সাহসী, মৌলিক, এবং উপেক্ষিত আফ্রো-মার্কিন সিনেমা-করিয়েদের পথিকৃৎ উইলিয়াম গ্রিভেস প্রমুখ। হাজার বছর ধরে বাঙলাকে পর্যবেক্ষণকারী জহির রায়হানও এর ব্যতিক্রম নন। ফলত, সাংবাদিকতা চর্চাকারী জহির রায়হানের এই অঞ্চলের জল-হাওয়া, মানুষ, প্রকৃতির সাথে ছিল এক গভীর অভিনিবেশীয় বোঝাপড়া। যা তাঁর সিনেমার ইমেজেও প্রস্ফুটিত হয়েছে দ্ব্যর্থহীনভাবে।
আজ যখন বাংলাদেশের সিনেমাও মানুষবিরোধী উন্নয়নসংস্কৃতির ঝোলে, উন্নয়নসন্ত্রাসের অংশে পরিণত হচ্ছে, তখন আমাদের আরো বেশি করে জহির রায়হানকে স্মরণ করা জরুরি। যদিও, বাঙলাদেশে জহির রায়হান চর্চা চলচ্চিত্রকর্মী অনুপম হায়াত ভায়া উইকিপিডিয়ার বাঙলা বা ইংরেজি ভুক্তির পৌনঃপুনিক তর্জমার ভেতরে সীমাবদ্ধ। জহির রায়হানের জীবন ও কর্মের ফিরিস্তির দোহাই হয়ে থাকা এইসব তথ্যপঞ্জি একটি ধ্রুবকের ধারাপাতের মতোই স্থির, অবিচল।
জহিরকে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের বাস্তব-ঘন যাপন করা জরুরি, অন্য দেশের সিনেমার লড়াইকে সাফল্যের প্রেশক্রিপশন মনে না করে, বরং নিজেদের লড়াইয়ের পথটা, প্রায়শ্চিত্তটা করে উঠতে পারাটা এখন সময়ের প্রয়োজন।
তিনি চর্চা করতেন — ‘ফিল্মমেকিং’, নাম-কা-ওয়াস্তে একটি পেশা নয়, এটি একপ্রকার সৃজনশীল চর্চা, যার প্রমাণ অব্যশই কয়টা ফিল্মফেস্টিভাল কাভার করা গেল সেটি নয়। বরং, আপনি কতটা মানুষের জন্য, মানুষের পক্ষে, সময়ের সাথে, সততার সাথে, সর্বপ্রাণের মুক্তির পক্ষে সিনেমা করতে পারলেন — সেটিই মুখ্য।
ভালো থাকুন মায়েস্ত্রো। যেখানেই থাকুন, যেভাবেই থাকুন। আমরা চিঠি লিখে যাবো আপনাকে, আপনার বাংলা দেশ থেকে।
সেলাম।
কৈফিয়ত
১। আহমদ, আবুল মনসুর, ১৯৬৬, বাংলাদেশের কালচার, আহমদ পাবলিশার্স, ঢাকা
২। ফিরদাউস, ইমরান, ২০১৫, “আমি জহির রায়হানকে অপাঙক্তেয় মনে করি না”, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার, ঢাকা
৩। রায়হান, জহির, ১৯৬০, শেষ বিকেলের মেয়ে, সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা
৪। লিহি, জেমস, ২০০২, ফিল্মস দ্যাট মেক ডিফারেন্স…সান্তিয়াগো আল্ভারেজ অ্যান্ড দ্য পলিটিক্স অফ বেঙ্গল, (অনু. ইমরান ফিরদাউস)
ইমরান ফিরদাউস রচনারাশি
জুলাই জেনোসাইড, লাল জুলাই : গানপার সংকলন
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS