তবুও থিয়েটার || তারিক আনাম খান

তবুও থিয়েটার || তারিক আনাম খান

কেউ কি দিব্যি দিয়েছে থিয়েটার করতে হবে? তবু কেন করা? কেন এত ভাবনা, কল্পনা, পরিশ্রম দিনের পর দিন? দিনের পর দিন রিহার্সাল, একই মানুষ একই সময়ে জড়ো হওয়া, কেটলিতে করে চা আনা, প্যাকেটের বিস্কুট ভাগ করে খাওয়া? কি হয় করলে? কি হয় না-করলে? অনেক কষ্ট, হতাশা, উত্তেজনা — আর সবশেষে অতৃপ্তির জ্বালা নিয়ে ঘরে ফেরা। আবার আগামী দিনের প্রতীক্ষা করা!

প্রত্যেকদিন নতুন করে বাঁচা — তারই নাম বোধহয় থিয়েটার। আমরা সবাই আসি বিভিন্ন জায়গা থেকে, পরিবার থেকে, পরিবেশ থেকে। কেউ গাড়িতে, কেউ রিকশায়, কেউ হেঁটে। আমাদের মধ্যেও বৈষম্য আছে — কিন্তু থিয়েটারের আমরা সবাই সবকিছু ভাগ করে নিতে শিখি। চা-বিস্কুট ভাগ থেকে দায়দায়িত্ব ভাগ। মঞ্চে অভিনেতাদের অংশ ভাগ করে নেয়া, যার যার অংশের প্রতি প্রবল মনোসংযোগ সহ নিবেদিত থাকা, মঞ্চের বাইরে কর্মীকুশলীদের টানটান দায়িত্বসচেতন উপস্থিতি; কেননা, ঐ তো দর্শক — থৈ থৈ করছে জীবন চারিদিকে; একটু পরেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ — যার জন্য এত পরিশ্রম।

থিয়েটারে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। অভিনেতার প্রস্তুতিতে, নির্দেশকের ভাবনায়, সংগঠনে, নেতৃত্বে — সব জায়গাতেই কায়িক-মানসিক পরিশ্রম দাবি করে থিয়েটার।

থিয়েটার কাজ করে মানুষ নিয়ে। থিয়েটারের যা-কিছু আয়োজন সব মানুষের জন্য। জীবন্ত মানুষের সঙ্গে জীবন্ত মানুষের বিনিময় — প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক। তাই থিয়েটারের শেকড় প্রোথিত ইতিহাসে — মানুষ যে-ইতিহাস নির্মাণ করেছে — নির্মাণ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। থিয়েটার তাই সরাসরি আক্রমণ করে চারিদিকের অব্যবস্থাকে, অন্যায়-অবিচারকে, রাজনীতির ভণ্ডামিকে — থিয়েটার মুখোশ খুলে দেয় নষ্ট সমাজের, ভণ্ড মানুষের আর মিথ্যা ইতিহাসের। শুদ্ধতা আর সততা নিয়েই থিয়েটার বাঁচে।

কিন্তু সেই মানুষ আজ আক্রান্ত। প্রতিনিয়ত বেনিয়া অর্থনীতির নির্মম শিকার — সমাজের ভণ্ডামির, নষ্টামির শিকার, শিকার দেশীয় সন্ত্রাস আর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের। যে-শিশুটি শিখছে বন্দুকের জোর থাকলে অতি সহজেই সব দখল করে নেয়া যায় — তার ভ্রান্তি ভাঙানোর দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে আজ না হোক কাল।

থিয়েটারকে ভয় পায় অপশক্তি। তাই তারা বাধা দেয় — ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে। কিন্তু মানুষের মনকে তো শিকলে বাঁধা যায় না। তাই থিয়েটার আছে, থাকবে। থিয়েটারের মানুষকে তাই হতে হয় শক্ত মানুষ। থিয়েটারের পথ বড় দীর্ঘ — কুসুমাস্তীর্ণ তো নয়ই। তাই যে-তরুণ আজ থিয়েটারে যোগ দেবেন তাকে ভাবতে হবে — এই পথ পাড়ি দিতে তার মনের জোর আছে কি নেই। একদিনে, একমাসে, একবছরে কিছুই হবে না। দিনের পর দিন পাড়ি দিয়ে মাস — বছরের পর বছর। আজকাল এটা কম দেখি। যারা নতুন আসছেন তাদের চাওয়া অনেক — পরিশ্রম কম — লেগে থাকার মানসিকতাও নেই। সহজ জনপ্রিয়তা লক্ষ্য হলে মিলবে হয়তো — কিন্তু তা আবার সহজে হারিয়েও যাবে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার কষ্ট আছে, হতাশা আছে, কিন্তু সূর্যের দেখা মিলবেই।

থিয়েটার করতে আমরা অনেকেই আসি ভিতরের তাগিদ থেকে। অন্যভাবে বাঁচার ইচ্ছায়। কিছু বলার আছে, কিছু করার আছে, নিজের জন্য যেমন তেমনি অন্য মানুষের জন্যও। চারপাশে যা ঘটে তার প্রতিক্রিয়া ঘটে প্রতিনিয়ত আমাদের ভিতর — প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি আমরা শিল্পের ভাষায়। আমাদের সৃষ্টিশীল মনগুলো জড়ো করি — আমরা কল্পনা করি সুন্দর আনন্দময় পৃথিবীর।

আজকের বিশ্বে অন্য অনেক মাধ্যমের ভূমিকা যেখানে সন্দেহাতীত নয়, — থিয়েটার সেখানে শুদ্ধতা, সততা, জীবনমুখিতা নিয়ে আজও উপস্থিত। তাই থিয়েটার। তবুও থিয়েটার।

 

থিয়েটারগানপারটীকা
বাংলাদেশের প্রথিতযশা নাট্যব্যক্তিত্বের মধ্যে একজন তারিক আনাম খান গত চার দশকেরও বেশি কাল মঞ্চে অভিনয়শিল্পী, নির্দেশক, অনুবাদক ও নাট্যকার হিশেবে ব্যাপৃত। ‘ক্রুসিবল’, ‘আরজ চরিতামৃত’, ‘তুঘলক’, ‘বিচ্ছু’ প্রভৃতি তার নির্দেশিত কয়েকটা কাজ যা ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে নাট্যসমুজদারদের কাছে। তারিক আনাম খান মঞ্চে নির্দেশনা ছাড়াও অনেক নাটক লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, রূপান্তর করেছেন বাংলায় এবং সেসব কাজ সম্প্রতি গ্রন্থাবদ্ধ হয়ে বেরিয়েছে ঢাকার একটা পাব্লিশিং হাউস্ থেকে। এইখানে যে-লেখাটা গানপার প্রকাশ করছে, সেটা তারিক আনাম খানের নাটকসমগ্র গ্রন্থভুক্ত হয় নাই। এই লেখাটা আমরা নিয়েছি ‘নাট্যকেন্দ্র’ অষ্টম প্রযোজনা ‘প্রতিসরণ’-এর প্রদর্শনীস্মারক পুস্তিকা থেকে। উল্লেখ্য, তারিক আনাম নাট্যকেন্দ্র গোষ্ঠীর পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত, এবং পরিচালনা পর্ষদের প্রধান সম্পাদকও বটে। যে-নাটকটার প্রদর্শনীস্মারক পুস্তিকা থেকে এই নিবন্ধ সংগৃহীত হয়েছে, সেইটা নাট্যকেন্দ্রের আরেক সদস্য তৌকীর আহমেদ রচনা করেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন। ও হ্যাঁ, জানায়া রাখি, গানপার থেকে এই কাজটা আমরা চালু রাখতে রাখতে চাই — বিভিন্ন মঞ্চপ্রযোজনার স্মারকপুস্তিকা থেকে একেবারে অকিঞ্চিৎকর লেখাটাও সংগ্রহ করে সেইটা আর্কাইভ করে রাখা, পারলে সেই টেক্সটের সাপোর্ট কিছু নোটস্ ড্রাফ্‌ট করা, সাংস্কৃতিক বিচরণের ধাড়িপথ-ফাঁড়িপথ নির্বিশেষে ডক্যুমেন্টেড রাখিয়া যাওয়া। — গানপার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you