‘আইটেম স্যং’-এ এত মধু! || শিবু কুমার শীল

‘আইটেম স্যং’-এ এত মধু! || শিবু কুমার শীল

[ঘটনাটা ছিল এমন যে, ২০১১ সনের উপান্তে একটা আওয়াজ উঠেছিল জোরেশোরে বলিউডি হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশে আমদানি করার এবং দেশের মূলধারা প্রেক্ষাগৃহগুলোতে সরাসরি হিন্দি সিনেমা প্রদর্শনের। প্যশ স্যুপারম্যলের সিনেপ্লেক্স ছাড়াও কয়েকটা টেলিচ্যানেলে হিন্দি ম্যুভি প্রোজেকশনের জন্য স্লট বরাদ্দও হয়ে গিয়েছিল বলিয়া আখবারে জানা যায়। এমতাবস্থায় বাংলাদেশী ইন্টেলিজেনশিয়্যায় বেশ-একটা ঝাঁকানি দৃষ্ট হয়েছিল, জনপরিমণ্ডলে একটা চাপান-উতর চলেছিল অনেকদিন, জনবিরোধিতার তোপে বলিউডের নিরঙ্কুশ-নির্বাধা বাংলাদেশজয় ব্যাহত হয় এবং আমদানির আলাপটা তামাদি হয় এক-সময়। তার আগে অবশ্য জরুরি অনেক আলাপ উত্থাপিত হয়, আলোচনা সাধিত হয় ইতিউতি বিক্ষিপ্ত অনেক, এইটুকু নগদে ফায়দা।

আইটেমগানা নিয়া আনুপূর্বিক বিশ্লেষণী নিবন্ধ নয় এই লেখা; এইটা মূলত বাংলাদেশের অল্পব্যাপ্তির চলচ্চিত্র নির্মাণ, বিপণন, প্রদর্শন ও বিকাশের বেদনাজাত। রচয়িতা নিজে একজন ভিশ্যুয়্যাল আর্টিস্ট ও মিউজিশিয়্যান হবার কারণে লেখার ভিতরে সেই প্রতিরোধ ও স্বগৃহ গোছানোর ঘনসংবদ্ধ সঙ্কল্প প্রকাশিত লক্ষ করা যাবে। এই সঙ্কল্প অকৃত্রিম বলিয়াই মনে হয়। লেখক ভনিতা ছাড়াই নিজের পোজিশনমার্ক ক্লিয়ার করেন ‘আমদানির প্রশ্নই আসে না’ বাক্যোচ্চারে লেখার একদম অন্তিমে।

এই নিবন্ধটা আমরা নিচ্ছি রচয়িতার ফেবুনোটসম্ভার থেকে। এথা গানপারে প্রকাশের জন্য সম্মতি চেয়ে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও অনাপত্তিপত্র আদায় করা সম্ভব হয় নাই। ঠিক আপত্তিও ওঠে নাই বটে লেখকের তরফ থেকে। সেহেতু আশ্বস্ত হতে পারা যায় নীরব অনুমোদনের ব্যাপারে। কার্যত রচয়িতার অনুমোদন-ঝুলন্ত রচনাটা আমরা ছাপছি বেশ-একটু ঝুঁকি নিয়ে। এমনিতে এই লেখায় তাৎক্ষণিকতা, তৎকালিকতা আর তাড়াহুড়ার দাগগুলো অগোচর নয়। তা সত্ত্বেও রচনাটা আমরা পাঠ-আকর্ষক এবং দরকারি বিবেচনা করছি। নিশ্চয় ইন-ফিউচার সিনেমা, আইটেমগানাবাজানা, নাট্য ও নৃত্যের কলা-কলকব্জা নিয়া গানপারে বিচিত্র রচনাদি প্রকাশে সফলকাম হব আমরা। – গানপার।।

বি.দ্র. রচনার সঙ্গে একটি দৈনিকীর প্রতিবেদনসূত্র সংযুক্ত হলেও লক্ষ করা যাবে যে সেই লিঙ্কটা কাজ করছে না। সম্ভবত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটা পত্রিকাপক্ষ থেকে পরবর্তীকালে প্রত্যাহৃত হয়েছে। তবু অকেজো লিঙ্কটাই আমরা রাখছি এভিডেন্স হিশেবে। – গানপার]

19021510_10210785452204978_31170710_n

‘আইটেম স্যং’ কি বস্তু? এই হেন প্রশ্ন নেহায়েৎ বেকুবের। কারণ চতুর ব্যক্তি মাত্রই জানেন এর মর্ম। এটি মূলত খায়। মাথায় দেয় না। কে খায়? লোকে। কোন লোক? আম, অর্ডিনারি পিপল। তাইলে মধ্যবিত্ত কি খায়? ঘাস খায় না নিশ্চয়ই।

তারাও খায়। তবে তলে তলে। যেমন ‘লিন্ডসে লোহান’। এখন এই যে ‘আইটেম স্যং’ যা কি-না বোকাচোদা পাব্লিকরে মত্ত করার জন্য মহাঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়। এই ভাবনা আইলো কোত্থেকে? এই মাল অনুমান করি বুর্জোয়া সিনেমার জন্মলগ্ন থেকেই সিনেমার হিস্ট্রিতে আছে। এই যেমন কয়দিন আগেও আমাদের সিনেমানির্মাতারা বলত যে হিন্দি সিনেমায় গানের ব্যবহার নাকি এর মৌলিকত্ব। ফলে সিনেমায় গান থাকাটা একটা কালচারের পার্ট। এটাকে ত্যাগ করা যাবে না। এর সঙ্গেই আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। বেশ। তবে গানই হোক। গান এখনও হচ্ছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখি সিনেমায় গানের ব্যবহার হলিউড থেকেই আমদানিকৃত। এটা ইন্ডিয়ান ফিল্মের ধার-করা বৈশিষ্ট্য। খাইছে ধরা।

যখন ভিএইচএস-এর যুগ আছিল তখন আমাগো ফিল্মইন্ডাট্রি কিন্তু যেমনে পারসে হিন্দি সিনেমার গান-গল্প নকল কইরা এইখানে একটা আসর জমাইসিল। সেইকথা এখনও শুনি। ‘আগে মধ্যবিত্ত সিনেমাহলে গিয়া সিনেমা দেখসে।’ মধ্যবিত্তের তো তখন কোনো উপায় নাই। অপশন নাই। দেশে স্যাটেলাইট টিভি নাই, ইন্টার্নেট নাই, পর্নসাইটও নাই। হুদাই ‘অবুঝ মন’ দেইখা মনরে বুঝ দিত। দিন বদল হইসে।

19074026_10210785449724916_2117193733_nআমি যে-কথাটা পাড়তে চাই সেইটা হইল আদতে আমাগো বঙ্গদেশের চলচ্চিত্রের কোনো ইতিহাস বা পাতিহাস নাই। পুরাটাই বুর্জোয়া ফিল্মের আলাপ। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভালো সিনেমা বা নির্মাতার নাম নেয়া যায়, কিন্তু তাতে কইরা সিনটা পুরা দেখা যায় না। পুরা সিন হইল ভারতের চলচ্চিত্রের ওগড়ানো আইডিয়া তারা আমাদের খাওয়াইসে। এখনও খাওয়াইতে চাইতেসে। এখন বিচি ফাটা-বাঁশে আটকাইসে। কারণ আমাগো নির্মাতারা ভাবসিল তারা খাল কাইটা কুমির আনতেসে কিন্তু এখন দেখে ওইটা আসলে কুমির ছিল না, ছিল ডায়নোসর। ঠ্যালা সামলাও!

হিন্দি ছবি এসে গেছে। আগে যা ছিল কেবল আকাঙ্ক্ষার দুয়ারে এখন সে আমাদের গিলবে। আমার সিনেমা গিলবে। আমাদের নিঃস্ব প্রমাণ করবে। এটা একটা মারাত্মক পরিণতি বটে। হায়! ইস্কান্দর যে কইসিলো, ‘সেলুকাস কী বিচিত্র এ দেশ!’ – আমাগো নির্মাতাদের তখন ইস্কান্দরের দশা হবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এখন দেশে যে হাইপ উঠসে এটার মর্মে কিন্তু অন্য জিনিশ লুকায়িত। সেটা হলো, ‘ভারতবিরোধিতা’ এখন প্রগতিশীলতার রাম-লক্ষণ। এখন এই হাইপ জরুরিও বটে। যে-অস্তিত্বের দোহাই বা স্বাধিকারের দোহাই নির্মাতারা দিচ্ছে সেগুলো আবার চরম আয়রোনিতে ভরপুর।

19021355_10210785452164977_1160350820_nকথা হইল, এই দেশে তো সিনেমার হিস্ট্রিই নাই। সব প্রি-হিস্ট্রি। সব ভারতীয় ছবির টুক্লিফাই। আমি একটা ফ্যাসিস্ট আইডিয়া দিতে পারি, সেটা হলো – যেই নির্মাতারা হিন্দি সিনেমার আদলে সিনেমা বানায় বা বানানোর স্বপ্নদোষে আক্রান্ত তাদের বর্জন করা যেতে পারে। ধরা যাক যারা মনে করতেসে ভারতীয় গরুর মতো ভারতীয় অ্যাক্টর-অ্যাক্ট্রেস আমদানি কইরা ফিল্ম বানাবে তাদের উপর বিধিনিষেধ জারি করা হবে। ইন্ডিয়ান পিঁয়াজ আর খাইয়েন না ইত্যাদি ইত্যাদি। এইটা কিন্তু বলা যাবে না। কারণ এর বেনিফিশিয়ারি স্বয়ং মিডলক্লাস, – যে তার ঘরের দরজা লাগাইয়া গার্লফ্রেন্ড লইয়া পর্ন দেখে, কিন্তু বাংলা ফিল্মের কাটপিস নিয়া নাক সিঁটকায়। তারা মনে করে আমজনতার সেক্স নাই, খিদা নাই, অধিকার তো দূরের কথা।

কথা শুরু করসিলাম আইটেম স্যং দিয়া। মানে আইটেম স্যং টার্মটাই কিন্তু ইন্ডিয়ান ফিল্ম থেকে আমাদের নির্মাতারা শিখসে। এবং এর সুফল ভোগ করতেসে। গতকালের [২২ ডিসেম্বর ২০১১] প্রথম আলোর ‘আনন্দ’ পাতায় দেখলাম সিমলা নামে একটা নায়িকা ‘না মানুষ’ সিনেমায় আইটেমগানে অংশ নিসে। তার বুকচিতানো ছবিও ছাপা হইসে। এবং যিনি আর্টিকেল লিখসেন তার জবাব নেই। মনে হচ্ছে পতিতাপল্লির বর্ণনা দিচ্ছেন। মারহাবা! বহুত খুব!

(http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-12-22/news/210463)

ভারতীয় চলচ্চিত্র বন্ধের আন্দোলনের পাশাপাশি এমন ‘আইটেম স্যং’-এর মতো থিকথিকে ভেজা-ভেজা সেক্সজেল যদি আমাদের সিনেমায় আমরা প্রলেপ করতে থাকি তা আমাদের প্রকৃত সেক্স হারানোর সম্ভাবনা তৈরি করে। আরেক আয়রোনির জন্ম দেয় মাত্র।

19021891_10210785450644939_30087608_nমিডিয়া কিন্তু এটাকে উৎসাহিত করে, এর মধ্যে তারা ভারতীয় গন্ধ খুঁজে পায় না। ওই যে আমপাব্লিক – যে কি-না হিন্দি বা হলিউড বোঝে না, তারে যা খাওয়ানো হয় তা-ই খায়। তারাই রাক্ষুসে আকার ধারণ করবে এখন। এদের থামানো যাবে না। আমার রাষ্ট্রে হিন্দি ফিল্মের নায়কেরাই নায়ক। সেখানকার নায়িকারাই আসল সেক্সি। সারা বছর ইডিওলজিক্যালি হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকাদেরই আইডল করে আমাদের সামনে হাজির করা হচ্ছে। মিডিয়া এটা সফলভাবেই করছে। এখন যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকসে, অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে শুরু করসে, তখন আন্দোলনের ডাক দিসে। যদিও এই ডাক মিডিয়ার নয়। এই ডাক বিচ্ছিন্ন ডাক, এতে চেতনার চাইতে অসহায়ত্বই বেশি ধরা পড়ে। চলচ্চিত্রে অশ্লীলতাবিরোধী ডাকের মতোই। ফাঁকা, চেতনাহীন।

আলমগীর কবীর বা জহির রায়হান বা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন যে চেতনা ক্যারি করত সেটাকে আমরা সো-কল্ড আর্টফিল্ম বইলা ত্যাগ করেছি সেই কবেই। এখন আমরা চেতনাহীন এবং দিকভ্রান্ত। কে হবে কান্ডারি? কে ধুয়ার বদলে আলো দিবে? এই আলো এনলাইটেনমেন্ট-এর চেরাগ নয়। এটি আমাদের অর্ন্তগত আলো। আমদানির প্রশ্নই আসে না।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you