দ্য ওয়ান, দ্য ওনলি || শর্মি হোসেন

দ্য ওয়ান, দ্য ওনলি || শর্মি হোসেন

ঢাকা শহরে ‘ফোক’ ব্যাপারটা ইন-ভোগ হবার ১০ বছর আগে জেমস্ জানত সে নগরের বাউল। একেবারে অর্গ্যানিক। হোমগ্রোন। খাঁটি জিনিশ।

সময়টা আশির শেষ বা নব্বইয়ের শুরু। ঢাকা এবং অন্যান্য শহরের প্রত্যেক পাড়ায় কিছু পোলাপাইন এসিডিসি লেখা গেঞ্জি উইথ কালো সানগ্লাস পরে গিটার হাতে ঘোরাঘুরি করত। তারা ব্যান্ড করে। আমরা তখন ছোট। আমাদের মনে হইত ব্যান্ড মানেই বিদেশি ধরনের একটা ব্যাপার। কাজেকর্মে না-হলেও মিনিমাম ভাবেসাবে বিদেশি না হলে ব্যান্ড করা যায় না।

আমরা তখন টিভিতে ব্যান্ডশো দেখি। রীতিমতন অখাদ্য সব গান। এই নিয়ে বাসার বড়রা হাসাহাসি করে। মাঝেমাঝে পাশের বাড়ির জানলা থেকে আমার বড়বোনের উদ্দেশে গান চালানো হয় — “মৌসুমী কারে ভালোবাসো তুমি / মৌসুমী বলো কারে খোঁজো তুমি / মৌসুমী আছি একা এই আমি /  ভুলে অভিমান হও সঙ্গিনী” … গান চালালেই দড়াম করে জানলা বন্ধ করে দেয় বোন। দেয়াই উচিত। এইরম পুতুপুতু লিরিকের গান চালাইলে আমি হরলাল রায়ের বাংলা ব্যাকরণ বইটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে মারতাম। যাক, সেটা অন্য কথা।

তবে তদ্দিনে বাংলা গানের রয়াল বেঙ্গল টাইগার চুপিচুপি নখে শান দিচ্ছিলেন। আমরা এক-জেনারেশনের তাবৎ নিরীহ পোলাপান তার শিকার হবার অপেক্ষায় তখন সোলস শুনে নাক কুঁচকাই, অরবিট শুনে মুখ ভ্যাটকাই, ডিফারেন্ট টাচ শুনে ঘুমায়া যাই। আমরা কি আর জানি যে এগুলো আসল ঘটনার ওয়ার্ম-আপ? আমরা কি আর জানি কী ক্যাটাস্ট্রফিক মিউজিক্যাল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য?

উপরোল্লিখিত রয়াল বেঙ্গল টাইগার তখন দুনিয়ার হাবিজাবি কপিয়ার-মপিয়ার করতেসেন সবাইকে দেখাইতে, কিন্তু আসলে তলে তলে আমাদের মন-জান-প্রাণ প্রভৃতি ধ্বংসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাঘ যখন ধীরপায়ে শিকারের দিকে আগায়, টের পাওয়া যায় না, — তবে কোনো কোনো পশু তার গন্ধ পায়। ‘জেল থেকে বলছি’ শুনে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই গন্ধ পেয়েছিল। আমি তখনও বেমালুম তৃণভোজী হরিণশাবক।

জেমস্

আমাকে বাঘে খেল ‘প্রিয় আকাশী’ দিয়ে। এ কেমন ড্রামস! এ কেমন লিরিক! একই সুরে স্ট্যাঞ্জার পর স্ট্যাঞ্জা দিয়ে পুরা একটা গান গেয়ে ফেলল? এইটা কি? এরপরে শুনলাম ‘নগর বাউল’। সিরকা ১৯৯৬। এরপর থেকে জীবন চেঞ্জ। আমরা ঘোরগ্রস্থ। রকওয়ালাদের আর কাউকে দুই-পয়সার দাম দেই না। বহুদিন দেই নাই। ইন-ফ্যাক্ট এখনো দেই না। অনেক শিশুবাচ্চারা এসে বলে — কিন্তু ম্যাম, হাউ অ্যাবাউট ওয়ারফেইজ, নেমেসিস, অমুক-তমুক? আমি হেসে বলি, না না এরা ভালো তো। ভালো ভালো। মনে মনে ভাবি, কৃষ্ণপ্রেমে পোড়া দেহ, কি দিয়া জুড়াই বলো সখি?

তো যেটা বলছিলাম। কালো শার্ট আর সানগ্লাসের যুগে পাঞ্জাবি পরে গিটার হাতে রীতিমতন আগুন লাগায় দিলো লোকটা বাংলা মিউজিকসিনে। আমাদের গানটাকেও জাস্ট বোমবার্ড করে পরের ধাপে উঠায়ে দিলো একের পর এক কামাকাজি বোমারু বিমানের মতন অ্যালবাম : নগরবাউল, দুঃখিনী দুঃখ করো না, ঠিক আছে বন্ধু,  অথবা লেইস ফিতা লেইস। ততদিনে তার গলায় ও গায়কীতে এসে গেছে বাউলসুলভ এক প্যাশনেট নির্লিপ্ততা। নগরের বাউলের আপনরূপে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, আমাদের চলছে বিশ্বরূপ দর্শনপর্ব।

মনে আছে, ঐসময় আমার মাথায় ক্যারাব্যারা লাগায়ে দিয়েছিল ‘লুটপাট’ গানটা। বলে রাখা ভালো ‘তোমাকে চাই’ তদ্দিনে প্রেমের অ্যান্থেম। চৌরাস্তার মোড়ে, পার্কে, দোকানে, শহরে, গঞ্জে, গ্রামে, এখানে, ওখানে … সবখানেই তখন তোমাকে চাই আর তোমাকে চাই। অসাধারণ গান। কী চিরন্তন কথা! কিন্তু লুটপাটের প্রেমিকটি একদম আলাদা। ‘তোমাকে চাই’-এর প্রেমিকটি যদি সকালবেলার রোদ্দুর হয়, লুটপাটের প্রেমিকটি তবে চৈত্রের কালবৈশাখী ঝড়। সেই ঝড়ের জন্য সদাই আমার প্রাণ আকুলিবিকুলি রাধারানী। কেমন করে যে সেই নির্বিকার, সাহসী, ধ্বংসকামী এক ভালোবাসায় মজে গেলাম সে-আর কীভাবে বোঝাই? গায়ে কাঁটা দেয় এখনো গানটা শুনলে, — “চোখের ইশারায় ছুঁড়ে দেবো সূতীক্ষ্ণ চুম্বন / তুমি দিশেহারা হয়ে যাবে তুমি পথভোলা হয়ে যাবে / অনন্ত আকাশে উড়ে যাবে ভালোবাসা / অন্তরে মাঠেঘাটে তুমি সব বিকিয়ে দেবে / ও তুমি লুটপাট হয়ে যাবে / তুমি চৌচির হয়ে যাবে” …  আসলেই তাই। এ-রকম প্রেমও হয়।এ-রকমও হয়!

তার কন্সার্টের কথা আর কি বলব। ইউ হ্যাভ টু সি ইট টু বিলিভ ইট। স্টেজের সে একচ্ছত্র সম্রাট। দেবতার মতন নিষ্ঠুর, প্রেমিকের মতন স্বেচ্ছাচারী। ইচ্ছা হলে গাইবে, না-ইচ্ছা হলে গাইবে না। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। স্টেডিয়ামভর্তি কাতারে-কাতার ১৫ থেকে ৩০-এর হাজারো বান্দা তার যাদুকরী সম্মোহনে হ্যামিলনের শিশুদের মতনই মোহগ্রস্থ — “ইয়ারব, ইয়ারব বলে, ইয়ারব, ইয়ারব”। একটা সময় ছিল যখন ঢাকার কন্সার্টগুলোতে লাস্ট অ্যাক্ট হিসাবে আসত এলআরবি। নগরবাউল অ্যালবামের পর থেকেই সেটা বদলে যায়। জেমসের পরে আর কিছু চলে না। উঁহু, একদম না।

জেমস্জেমসের মহাকাব্যিক এই উত্থানের পর থেকে “তুমি কেন এলে না, আমি কেন গেলাম না” টাইপের প্যানরপ্যানর ভ্যানরভ্যানর বাংলাদেশ আর খায় নাই। জেমস্ রয়ে গেছেন বাংলাভাষার তাবৎ রকমিউজিশিয়্যানদের আব্বা হয়ে। স্যামুয়েল জনসন হোমারের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, সমগ্র ইউরোপীয় সাহিত্য আসলে হোমারের সাহিত্যের প্রতি ধারাবাহিক পাদটিকা মাত্র। বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের গল্পটাও ও-রকম, শুধু নামগুলো এদিক-ওদিক। গত সপ্তাহে জেমসের একটা কন্সার্ট দেখার সৌভাগ্য হলো। সে-নিয়ে পরে আলাপ পাড়ব। শুধু বলে রাখি যে সে স্বরূপেই বিরাজমান।

এ-রকম রকস্টার সারাদুনিয়ায় আর কয়টা আছে সন্দেহ। মনে মনে জানি এখন আর এ-রকম আর্টিস্ট হয় না। অবশ্য আগেও হইত না। হঠাৎ হঠাৎ ধূমকেতুর মতন কোইত্থেকে জানি এরা আসে। এ-রকম আর্টিস্টরাই আদতে নিজের ভাষাকে নিয়ে, নিজের সময়কে নিয়ে সিনা টানটান করে দাঁড়াতে শিখায়ে দেয়। আমাদের জীবনটা লণ্ডভণ্ড করে দেয়। বেঁচে থাকা দায় করে দেয়। তর্জনী উঁচিয়ে জ্বেলে দেয় সবুজ আগুন। অন্যসব প্যানরপ্যানর-ভ্যানরভ্যানরকে লাথি মেরে দুদ্দাড় মুচড়ে দেয়। এই ছন্নছাড়া মনস্টার আততায়ীর পর অন্য কোনোকিছুকেই আর ভাল্লাগে না। পানসে লাগে। সারাদিন। বহুদিন।

এই লোকটার মিউজিক্যাল মনস্ট্রসিটি আমাদের জন্য একটা গিফট। দ্য ওয়ান, দ্য ওনলি …

… …

শর্মি হোসেন
Latest posts by শর্মি হোসেন (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you