বাংলায় গানগুচ্ছ :: জন লেনন

বাংলায় গানগুচ্ছ :: জন লেনন

জন লেননের ছয়টা গানের একটা গুচ্ছ এইখানে গুঁজিয়া রাখা হলো। জনপ্রিয় গানগুলোর একটিও নয় এখানকার এই ছয়টা। যাকে বলে টপ টেন বা টপ টোয়েন্টি কিসিমের কোনো তালিকাতেই গানগুলো কস্মিনকালেও পড়বে না। তারপরও জন লেননের অন্তরঙ্গ মুখাবয়ব এই-সমস্ত অত-পরিচিত-নয় লিরিকগুলোতেই মিলবে। লেনন নয় শুধু, ববি ডি কিংবা বায়েজ অথবা মার্লি কিংবা কোহেন সহ দুনিয়ার সমস্ত কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকের অন্তরঙ্গ অস্তিত্ব ধরা পড়ে তাদের অত-জনপ্রিয়-না-হওয়া বা প্রায়-অপরিচিত রচনারাজিতেই — ঠিক এহেন প্রত্যয়ে আস্থা রাখেন এমন মানুষের সংখ্যা নগণ্য নয়। এবং, বলতে হয়, বহুজনপ্রিয় রচনাকাজে শ্রোতা/পাঠক/দর্শক ভোক্তারা প্রায় সক্কলেই নিজেদের মুখ দেখতে পায় বিধায় হয়তো রচয়িতার মুখ তথায় ঝাপসা হয়ে যায়। কাজেই, রবিপঙক্তির আদলে বলতে হয়, মিউজিশিয়্যানেরে পাবে না তুমি বিলবোর্ড টপচার্টে … যেমন কবিরে পাবা না তার জীবনচরিতে। অ্যানিওয়ে।

এইখানে লেননের বিটলস্-পর্যায়ের নয়, বিটলসোত্তর কয়েকটা গানের দ্রুতলেখ বঙ্গানুবাদ রাখা হলো। মূল গান খুঁজে পেতে সুবিধে হবে এমনটা আশায় গানগুলোর শিরোনাম বাংলা না-করে রেখে দেয়া আছে ইংরেজিতেই। ইউটিউবে এদের অরিজিন্যাল এবং নানাবিধ ভার্শন যেমন শোনার দুয়ার অবারিত, তদ্রুপ এগুলোর লিখিত রূপের সঙ্গেও শ্রোতাপাঠক চাহিবামাত্র করমর্দন করে নিতে পারেন গ্যুগল্-পরিসরে। এই সিরিজের বঙ্গানুবাদপ্রবাহে লেননের অন্তরালস্থ মুখচ্ছবির হদিস পেতে ভবিষ্যতে আমরা আরও কয়েকটা হাল্কাপাৎলা চেষ্টা চালাব মূলানুগত্য যথাসাধ্য ওভার্ল্যুক করেই। ঠিক অন্য বৈঠকে এর আগে যেমন দুইডজন লেননগান বঙ্গানুবাদিত হয়েছিল অন্যত্র অভিন্ন অনুবাদকের কিবোর্ডে।

লেননের এই ছয়টা গানের মধ্যে প্রেজেন্টেড প্রথম তিনটেয় দেখা যাবে একেবারে ব্যক্তিক রেফ্রেন্সেস্। জন লেননের আত্মজৈবনিকী লিরিকেই লিপিবদ্ধ রয়েছে এর আগুপিছু অনেক গানেই আরও। অত্র উপস্থাপিত পয়লা গানে মায়ের মৃত্যুসংবাদে লেননের শোকস্পৃষ্টতা আমরা হাজির পাই। দ্বিতীয়টায় প্যারেন্টস্ দুইজনের প্রতিই শিল্পীর আবাল্য অভিমানের প্রকাশভঙ্গিটির দেখা পাওয়া যায়। তৃতীয়ক্রমিক গানে জীবনসঙ্গিনী য়োকো ওনো সম্পর্কে লেননের বহুল চর্চিত তথা মিডিয়ালাঞ্ছিত প্রণয়চিত্রের বিপরীতে একটি দৃঢ়সঙ্কল্প পরস্পরানুগত প্রণয়ের সাক্ষাৎ পাই, যে-প্রণয়রেখা জন লেননের জীবন বদলে দিয়েছিল গোটা শেষের দশকটায়। শেষোক্ত প্রণয়সংবাদ তথা য়োকোলয়্যাল্টি লিরিকের পর লিরিকে এসেছে ফিরে ফিরে লেননের ‘জন লেনন প্ল্যাস্টিক ওনো ব্যান্ড’ পর্যায়ের কাজগুলোতে। অ্যানিওয়ে। এর পরে এইখানে হাজির দুইটা গান মুখ্যত প্রেমেরই গান। বলা যায় সাধারণ প্রেমেরই। এই গুচ্ছের লাস্ট গানটায় লেননের আত্মসন্ধিৎসু অবয়ব উপস্থিত দেখতে পাবো। অনাত্ম অনুসন্ধানের পাশে লেননের আত্ম অনুসন্ধানের প্রয়াস আরও অন্যান্য গানেও রয়েছে নানাভাবে, রয়েছে বিস্তর পঙক্তিতে, এবং ‘বিটলস্’ ও সোলো উভয় পর্যায়েই।

দ্বিতীয় দুনিয়াযুদ্ধের হানাহানিকালে লেননের জন্ম, ১৯৪০ সনে, লিভার্প্যুলে। ছেলেবেলাতেই বাবা-মা আলাদা হয়ে গেলে লেনন তার মায়ের বোনের জিম্মায় বেড়ে উঠতে থাকেন। ফলে ক্ষ্যাপা পাগলাটে লেনন তীব্র বিরাগ পোষণ করে ছেলেবেলা পার করেন, গনগনে আঁচের একপ্রকার ক্রোধ, বাপ-মায়ের প্রতি। কিন্তু মায়ের প্রতি মিশ্র উন্মাদ বোবা হাহাকারের এক টান ছিল জন উইন্সটন লেননের। যদিও বাপের কোনো ভূমিকাই তিনি স্বীকার করেননি নিজের বড়বেলায়। মায়ের পুনর্বিবাহের কারণে সেই-যে লেনন বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন মাতৃছায়া থেকে, এরপরে সেই ছিন্ন সুতা আর জোড়া লাগে নাই। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে লেনন মাকে নিয়ে এই বিপন্ন মর্মদ্রাবী লিরিকটি লিখে ওঠেন — এই তীব্র হাহাকারের কথামালা — মাই মামি ইজ্ ডেড! বাপ-মা দুইজনের প্রতিই লেননের অভিমান প্রকাশ্যে টের পাওয়া যায় ‘মাদার’ গানটায়। এক্কেবারেই পার্সোন্যাল রেফ্রেন্সেস্ এগুলো। উল্টা কায়দায় এগুলো অনুরাগই তো! বঞ্চিত প্রণয়ার্তের আজন্মা কাঙালপনা।

ব্যক্তিজীবনে লেননের ঝড়ো উদ্দামতা আর টগবগানো সৃজনোল্লাস নিয়ে বেশিকিছু বলার দরকার এইখানে নেই বিবেচনা করি। বিচিত্র তথ্যসম্ভাবের এই উইকিখিড়কি সকলের জন্য উন্মুক্ত। সংক্ষেপে কেবল এইটুকু উল্লেখ্য যে লেননজননী জুলিয়া স্ট্যানলি ইন্তেকাল করেন ১৯৫৮ সনে এক দুর্ঘটনায়। এর আগের বছর লেনন অ্যাডমিশন নিয়েছেন ‘লিভার্প্যুল কলেজ অফ আর্ট’-এ। এমনিতেই বিদঘুটে ক্ষ্যাপা, মায়ের মৃত্যুর পরে ক্ষ্যাপামো বল্গা ছাড়ায়ে টাট্টুঘোড়ার তীব্রতা পায়। সেইসঙ্গে নেশাভাঙের নিরীক্ষা, আর গানের পর গান। অচিরে এই পিতৃমাতৃস্নেহহারা ক্ষ্যাপা গায়েনের হাতে একাধিক ব্যান্ড গড়া আর ভাঙার পরে সেই ‘বিটলস্’ গড়ে ওঠে এবং জয় করে নেয় আশ্চর্য সুর-সংগীতের এই বিষণ্ণ অগ্নিবিকিরিত দুনিয়া। তারপরের ইতিহাস অর্বাচীন ও অধ্যাপক সক্কলেরই জানা।

পয়লা শাদি সিন্থিয়ার সঙ্গে একদম কচমা বয়সে। এই ঘরে এক পুত্রসন্তান আছে লেননের। দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করেন তিনবছর টানা আত্মিক-আধ্যাত্মিক রহস্যাঢ্য প্রণয়কীর্তির পরে প্রাচ্যদেশীয় য়োকো ওনোকে। এই প্রণয়কাণ্ডে লেনন-য়োকো গঞ্জনা সয়েছেন দুনিয়ার, ব্যান্ড ভেঙেছে, সম্ভবত জনৈক ভক্তের হাতে অ্যাপার্টমেন্ট-বেইসমেন্টে লেননের খুন হবার পেছনেও জন-ওনো প্রণয়ে ক্ষুব্ধ জাত্যাভিমান কাজ করেছে। লেনন তার মাত্র-চল্লিশবর্ষ-হ্রস্ব জীবনের শেষ দশকে দু-দণ্ড শান্তি পেয়েছিলেন বনলতা ওনোরই নিকটে — এই কথাটা সাক্ষাৎকারে এবং গানে বহুবার বহু প্রকাশাভিব্যক্তি দিয়ে বলে গেছেন লেনন। আমৃত্যু পরস্পরনির্ভর ছিলেন দোঁহে। এই দ্বিতীয় মঞ্জিলেও জনির রয়েছে একটি পুত্রসন্তান। ওনো বেঁচে আছেন এখনও, স্যংরাইটার-সিঙ্গার ছাড়াও ওনোর ম্যুভিনির্মাতা হিশেবে বেশ উল্লেখযোগ্য একটা ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছে লেননজীবনাবসানের পরে। লেননের গানের ব্যবসা আগাগোড়া ওনোই সামলে এসেছেন, আজও রয়্যাল্টি ইত্যাদি লেননসংগীতগৃহের কর্ণধার ওনোই আদায়-উসুল করিয়া থাকেন।

সোচ্চার ভালোবাসার শিল্পী জন লেননের গোটা-ছয় গানের বাংলায়নের দিকেই দৃকপাত করব আমরা এই নিবন্ধের নিচের অংশে। প্রেমহীন পর্যুদস্ত প্রতাপগর্জানো দুনিয়ায় আরেকটাবার আসুন সবাই প্রেমের গানটা গাই।

বাংলায় গানগুচ্ছ :: জন লেনন || ভূমিকাভাষ্য ও তর্জমা :: জাহেদ আহমদ   

Jhon Lalin

মাই মামি ইজ ডেড

আমার আম্মা বাঁচিয়া নাই —
কী-প্রকারে এবে ক্যামনে আমি মনেরে বোঝাই!
দিন যদিও চলিছে যেমন যায়
ছেলে চিরকাল মাতৃমূর্তি ফিরিয়া ফিরিয়া চায়
এই বাসনাভাষ্য বোঝানো দুষ্কর
ব্যাখ্যার অতীত বিদীর্ণ অন্তর
মাতৃবিয়োগে বেবাক ভাষা তুচ্ছ ও অসহায়
আমার আম্মা আজ আর নাই রে বাঁচিয়া ধুলারও ধরায়

মাদার

তুমি আমারে পেয়েছিলে মা আমি তো তোমায় পাইনি
তোমারে আমি বেদম চেয়েছি আমারে তো তুমি চাওনি
সুতরাং আজ আলাদা প্রকারে এমন কী-আর আসে যায়
বলতে যেহেতু হবেই, তো বলি : বিদায়, চিরবিদায়

আমারে ত্যাজ্য করেছিলে বাবা আমি তো তোমায় করিনি
গিয়েছ দ্রুতই দূরে ঠেলে দিয়ে আমি তোমারে তো ঠেলিনি
সুতরাং আজ আলাদা প্রকারে এমন কী-আর আসে যায়
বলতে যেহেতু হবেই, তো বলি : বিদায়, চিরবিদায়

বাচ্চারা শোনো তোমরা কখনো কোরো না আমি যা করেছি
হাঁটতে শেখার আগেই বিষম দৌড়াতে শিখে গেছি
পালাতে পালাতে এসেছি এতটা দাঁড়াতে তো শিখি নাই
ছেড়ে যেতে হলে এখনই সময় : ছেড়ে যাই, ছেড়ে যাই

মা, যেও না আমারে ছেড়ে
বাবা, এসো ফিরে বাড়িতে

হোল্ড অন

ধরে থাকো, জন, যত পারো ধরে থাকো
মুঠো খুলে যেন ফসকে যেও না আর
ধরে রাখো দম তোমার লড়াইটার

ধরে থাকো, য়োকো, যত পারো ধরে থাকো
মুঠো খুলে যেন ফসকে যেও না আর
ধরে রাখো দম তোমার লড়াইটার

তুমিই যখন কেবলমাত্র তোমার জিম্মাদার
একজনও নাই দোসর যখন দুঃখটা জানাবার
দাঁড়াও সটান নিজেই নিজের সর্বেসর্বা হয়ে
ছেড়োনাকো হাল, তুলে দাও পাল, বেরোও দিগ্বিজয়ে

ধরে থাকো গোটা বসুন্ধরাটা গাঢ় করে ধরে রাখো
সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে দ্যাখো সমুদ্রসৈকতে
দেখতেই পাবে আলো অচিরাৎ কোমলে ও ধৈবতে

যেইক্ষণে তুমি নিজের পাশেই দাঁড়াইবে নিজে একা
জয়ের চিহ্ন তোমার মুকুটে শোভমান যাবে দেখা
হাল ছেড়ো না, জায়া ও পতি, না-মেনো ললাটলেখা

ধরে থাকো জন, ধরে থাকো য়োকো
মুঠো খুলে যেন ফসকে যেওনাকো

ল্যভ

প্রেমই শীর্ষ সত্য ধূলির ধরায়
দ্বিতীয়রহিত সত্যের নাম প্রেম
অতল বোধিতে প্রেম হলো অনুভব
অনুভূতিদেশ থেকে আসা আলো প্রেম
প্রেম মুখ্যত অবধিবিহীন নিকষিত এক হেম

ধরাধামে প্রেম একটা আলতো স্পর্শ
রঞ্জিত হয় হৃদয় প্রেমেরই পরশে
প্রেম হলো শত উদ্বেগ শেষে উপশম
প্রেমেই লভ্য মুশকিল-আসান উদ্ধার
খুলে দেয় প্রেম গুমট ঘরের দুয়ার

তুমিই তো সেই প্রেমের অপর নাম
তুমি আর আমি এখানে প্রেমার্পিত
প্রণয়ের মানে এইটুকু অবগতি
মিলনে-বিরহে দুইজনা প্রার্থিত

প্রেম হয় সেই চিরটাকালের মুক্তি
বিহঙ্গ যথা স্বাধীন প্রেমেই সম্ভব
প্রেমই জীবনবাসনা আদ্য কথায়
জীবনে-যাপনে প্রেমেরই নিত্য স্তব
সত্যি বলতে প্রেম ছাড়া মিছা বাকিসব

ও মাই ল্যভ

জীবনে এই তো পয়লাবারের মতো
নয়ন মেলিয়া দেখছি দুনিয়াদারি
জীবনে এই তো পয়লাবারের মতো
দু-নয়নে দেখি জীবনের ঝকমারি

দেখছি বাতাস দেখছি ঝাকড়া গাছ
যাবতীয় দেখি হৃদয়নয়নে স্বচ্ছ
দেখছি মেঘলা আকাশে মায়ার আঁচ
দারুণ দরদে দেখছি যা-কিছু তুচ্ছ

জীবনে এই তো পয়লাবারের মতো
মনটা আমার মুক্তপুচ্ছ ময়ূর
জীবনে এই তো পয়লাবারের মতো
মন যেন শত অনুভবে ভরপুর

রয়েছে বেদনা রয়েছে স্বপ্ন শত
হৃদয় আমার অনুভবে অধিগত
রয়েছে ব্যাপক জীবনের গাঢ় বোধ
সমুখের সবকিছুই ভীষণ অগাধ ও অদ্ভুত

ল্যুক অ্যাট মি

আঁখির সামনে দাঁড়াও আসিয়া, তাকাও আমার দিকে
বলো তো দেখি, চিনতে পারো কি, কী আমি? আমি কে?
চেয়ে দ্যাখো, যদি চিনতেই পারো, বলো দেখি আমি কার?
নিঃশর্তে প্রেমিক আমি আমার প্রিয়তমার

অবশেষে এসে দাঁড়ায়েছি দ্যাখো এই আমি এইখানে
ভেবে জেরবার কোথা যাব আর করব কি কে-জানে!
অবশেষে এসে হেথা দাঁড়ায়েছি নির্ভরযোগ্যতায়
কী করব বলো তোমার জন্য, কখন এবং কোথায়?
অবশেষে দ্যাখো দাঁড়ায়েছি এসে এই-তো সমুখে তোমার
নিঃশর্তে এক প্রেমিক আমি চিরদিনই প্রিয়তমার
চোখে চোখ রেখে চেয়ে দ্যাখো অয়ি প্রিয়তমা আমি এই-তো
তোমার সামনে নতজানু আমি দুইহাত প্রসারিত

বলতে কি পারো অন্তরতমা আসলে এ-আমি কে?
এ-জগতে হায় আমি ছাড়া আর চিনেছে কে আমারে?
বলতে কি পারো অন্তরতমা আসলে এ-আমি কে?
কেউ কারো পানে ফিরিয়া না-চায় এই পৃথিবীর পারে
তুমি আর আমি দুইজনে যবে একদেহে হই লীন
তখনই তো পরিচয়ের পাখায় দোঁহে হই উড্ডীন
নিঃশর্তে এক প্রেমিক আমি প্রিয়তমা চিরদিনই
নিশ্চয় আমি তোমার নিকটে বেশুমারভাবে ঋণী

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you