যেতে যেতে গেল না সে, ছেলেবেলার মেমোরির ন্যায়, এল ফিরে ফের। তার লাগি কৃতজ্ঞতার শেষ নাই, সীমা নাই আনন্দের, নৃত্যের মতো লহরে লহরে হাওয়ায় তাহার চকিত চপল ঘাই। ফিরিয়া আসা, তা যে-কোনো ফর্মে, যেইটাকে বলে প্রত্যাবর্তন, সর্বদা আনন্দেরই। বিসর্জনের বাজনা তার বাজিয়া উঠিছে দিকে দিকে যদিও, তবু তার যাওয়ার ইচ্ছা নাই বলেই মনে হয়। বিশেষত সন্ধে অবতরণের মুখে মনে হয় সে এই শ্রীহাট ছাড়িয়া যাইতে নেহায়েত বাধ্য না-হলে চাইছে না। আবার ভোরের পরে থেকে বেলা বারো অব্দি বিভ্রম হয় সে তার রাজপাট মেলিয়া বসতে চাইছে না তো!
ওদিকে দ্যাখো, স্যুয়েটার-প্যুলোভার বা জ্যাকেট-আলোয়ান প্রভৃতি শীতবস্ত্র তোরঙ্গে তুলিয়া রাখা সারা। ভাগ্যিস, পালঙ্কে পায়ের দিকটায় লেপ-কম্বল ফোল্ড করিয়া রাখা আছে এখনও। গোটা জানুয়ারি ঈষদুষ্ণ মধ্যদিন, ফেব্রুয়ারিশুরুটা খানিক কুসুমকুঁড়ি শীত অনুভূত হলেও অচিরে একটা বাদলা হাওয়ায় সেটুকুও উবিয়া যায়, মাঝফেব্রুয়ারি থেকে তো গুনগুনা ফাল্গুন শুরু হয়ে গেল। ঘোষিত বসন্ত বলতে এইটুকু গড়-উচ্চতা সাড়েপাঁচফুটিয়া বাঙালির। উরাধুরা আদেখলামো। ফলে, এইবার শীতদর্শন হলো বলা বাড়িয়েই হয়ে যাবে। এমনকি মাঘমাসেও লোকে সেইভাবে শীত সমীহ করেছে দেখা যায় নাই। স্ট্রিটসাইড টিস্টলগুলো ঘিরিয়া চায়ের ধোঁয়ায় কুণ্ডুলিপাকানো জটলা দৃষ্ট হয়েছে অল্পই। কিন্তু অল্প হোক বিস্তর হোক, শীতই ছিল তো! ফুটুক না ফুটুক ফুল, সুভাষবাক্যে যেমন সেইটা রাজবসন্ত; তদ্রুপ, গায়ে কাঁটা না-দিক, দাঁতে আর হাড়েহাড্ডিতে ঠকঠকানি না-লাগুক, হাওয়াটুকু শীতেরই ছিল তো!
অবশ্য এইবার তার নাইওরি ঠিকমতো হয়ই নাই বলতে গেলে। একেবারেই ক্ষীণ কণ্ঠে সে তার গানটা স্টার্ট করেছে কি করে নাই, ফুরিয়ে এসেছে তার চাঙ্ক। ধ্রুপদ সংগীতের মতো। স্টুডিয়ো জুড়ে চ্যানেলে চ্যানেলে রাতভর মিউজিক্যাল শো চলে, এফেম রেডিয়োতেও, সেইসব লাইভ শোগুলোতে এন্তার গানাবাজানা হয়। বিচিত্র ফর্মের গানাবাজানা। শাস্ত্রীয় সংগীতের কোনো সরাসরি প্রোগ্রাম নাই কোথাও। স্পন্সর জোটানো সম্ভব হয় না নিশ্চয়। বেচারা প্রোগ্রামপ্রোডিউস্যর তো স্পন্সর ছাড়া পঙ্গু।
কথা হচ্ছিল সেতারিয়া আবুল কাশেম সাহেবের সঙ্গে। এতদঞ্চলের সংগীতঋদ্ধ এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার লোক। বাজনার হাতেখড়ি পিতৃদেবেরই কাছে। এরপর নিজের ইচ্ছাজোরে লেখাপড়ার পাশাপাশি রিওয়াজ করা জারি রেখেছেন সেতারে। একটা সময়ে এসে স্বাভাবিক তাগিদে তালিম নিতে হয়েছে উস্তাদজির কাছে নাড়াগান্ডা বেঁধে। এরপর সেতারেরই কল্যাণে একটা গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা জুটেছে বেতারে। এ-ও যোগ করতে ভুললেন না যে শেখাশেখির মূল অংশটা আদতে হয়েছে পণ্ডিতজির বাজনা শুনে। কোন পণ্ডিতজি? জিজ্ঞাসার জবাবে সেতারমায়েস্ত্রো রবিশঙ্করজির নাম নিলেন কানের লতি চিমটি কেটে।
বেতার বাংলাদেশের স্টাফ-আর্টিস্ট তিনি। দেখতে দেখতে দেড়-দশকেরও অধিক পারায়ে গেছে সেতারবাদক হিশেবে চাকরি করছেন। বর্তমানে বেতার সিলেট কেন্দ্রে পোস্টিং। গত জানুয়ারি থেকে এসেছেন সিলেটে। এর আগে বেতার সিলেটে সেতারবাজিয়ে হিশেবে দীর্ঘদিন বহাল ছিলেন মধু খান সাহেব, সম্প্রতি তিনি ঢাকায় বদলি হয়েছেন, মধু খান সাহেবের স্থলাভিষিক্ত উস্তাদ আবুল কাশেম সাহেব বর্তমানে। এখনও পুরাপুরি থিতু হন নাই। ঢাকা-সিলেট-রাজশাহী করতে হচ্ছে হপ্তার এ-মাথা ও-মাথা। রাজশাহী কেন? সবচেয়ে বেশি সময় সেখানেই চাকরি করেছেন। গোটা নয়টা বছর, কম নয় কিন্তু! জমি কিনেছেন একটুকরো, বসতি গেঁড়েছেন বউবাচ্চা নিয়া সেখানেই। সিলেটে এসেছেন সবে। এর মধ্যে আরও দুইটা জায়গায় বদলিসুবাদে যেতে হয়েছে। একটা আপিশের ঘরোয়া মাইফেলে দেখা হলো, অনুষ্ঠানশুরুর আগে সাউন্ডচেক সেরে কেদারায় আড়াআড়ি বসে আইসব্রেইকিং হলো, টুকটুক কিছু কথাবার্তাও।
বলছিলেন তিনি, টিভিতে স্রেফ পনেরো মিনিটের চাঙ্ক বরাদ্দ ধ্রুপদ সংগীতের জন্য। কুল্লে এই ফিফটিন মিনিটের মধ্যে রাগের মুখটুকু ধরাই তো মুশকিল, রাগবিস্তার তো বহুদ্দুর। আর রেডিয়োয়? বিরস করুণ গলায় রিপ্লাই দিলেন, সে-তো আরও কম, মাত্র দশমিনিট! রোজ, না সাপ্তাহিক? রোজ কী বলছেন মশাই! লোকে এখন রসগোল্লাই খাইতে চায় না রোজ, হটডগ-বার্গার ছাড়া কিন্তু চলে না আধাঘণ্টাও, হপ্তায় একবার টিভিতে-রেডিয়োয় একটুকু বাজনা বাজিয়ে বাজনদারদেরও কোনো ফ্লাইট দেখানোর নসিব হয় না, আর শোননেওয়ালাদের ইম্প্রেস্ করার তো মওকাই পাওয়া যায় না। তা, চ্যানেল তো গুচ্ছের বেড়েছে। হ্যাঁ, তা যা বলেছেন; বিরস করুণ বদনে ফের আরেকবার ক্লিষ্ট চোখে এড়াতে চাইলেন প্রসঙ্গ। তবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের দিকে তাকিয়ে আছেন তাঁর মতো চৌষট্টি জেলার অ্যাট-লিস্ট চৌষট্টিজন স্টাফ-আর্টিস্ট। যদি কিছু সুযোগ পাওয়া যায়, ইন ফিউচার, স্থানীয়দের বাজাইবার মওকাটা হাত-হিয়া খুলে! রে অফ হোপ দেখতে পাচ্ছেন অবশ্য, আবুল কাশেম সাহেব, কথাচক্রে জানালেন।
জিগাইলাম, তবে বেতারে আপনার নিত্যিদিনের কাজটা কি ক্ল্যারিক্যাল? সেতার বাজাবার মওকা পান না তাহলে? না, সেতারই বাজাই, কিন্তু ওই আধুনিকের সঙ্গে, রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে, এবং নজরুলগীতির সঙ্গে। এই তিনটা ক্যাটাগোরিই রেডিয়োয় সেতার বাজাবার রোজকার ফিল্ড। ওইখানে ফিলার হিশেবে কট্টুক-আর, বলেন? গুটিকয় ছাত্তর পাওয়া যায় হঠাৎসঠাৎ, কন্টিনিউ করে এরচেয়েও গুটিকয়, ফলে শেখায়েও মজা প্রায় নাই বললেও হয়। কিন্তু লোকে সেতারযন্ত্রখানা দেখামাত্রই বলে যে, একবাক্যে একটাই কথা কয় সকলেই, শেখার বড্ড সাধ ছিল উস্তাদজি, কিন্তু যন্ত্রটা আজোব্দি শিখতে পারলাম না। রাগ হয়। আরে বাপ, দুনিয়ার সমস্তই শিখতে পারছ, সুযোগ-সময়-সাধ্য সবই করে নিচ্ছ শত ব্যস্ত সত্ত্বেও; শুধু সেতার-সরোদের বেলায় খামাখা আদবের শখপ্রকাশ কথাবার্তায়। এরচেয়ে ব্যেটার বলো যে শেখার ইচ্ছা নাই, ইচ্ছা হয় নাই কোনোদিনও, শিখতে চেয়েছ বোলো না খামাখা।
বায়না পান না আসরে যেয়ে বাজাবার? জবাবে উস্তাদজি উবাচ : কালেভদ্রে, একেবারেই ঘরোয়া আয়োজনে, সেই-রকম ব্যক্তি পৃষ্ঠপোষক নাই এখন আর। সবকিছুই ইদানীং অর্গানাইজ করে থাকে প্রতিষ্ঠান। ওইসবের ব্যাপারস্যাপার অনেক জটিল। বড়সড় আয়োজন হচ্ছে এখন, বাংলাদেশে, অন্তত দুইটা আসর তো উল্লেখযোগ্য নিয়মিত, লক্ষ্যাপারের আসর আর ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামের বেঙ্গল শো। ওইসব বড় আসরে কয়জনা চান্স পায় আর! নারায়ণগঞ্জেরটায় তা-ও দুইয়েকজন দেশজ উস্তাদজি মঞ্চের মাদুর পান, বেঙ্গলেরটা তো নক্ষত্রসমাবেশ শুধু। অবশ্য, যোগ করা কর্তব্য, বড় ও গুণী শিল্পীদেরে সামনাসামনি শোনাটাও মস্ত বড় ভাগ্য। ফলে এই শুধু চাকরিটাই করছি, কিন্তু বাজাবার তৃষ্ণা আদৌ মেটাতে পারছি না।
অ্যানিওয়ে। এইসব কথাবার্তার ফোকর দিয়া কাশেমজি নিজের দোসর সঙ্গী সিতারযন্ত্রে টিউনিং মিলিয়ে নিচ্ছিলেন প্রেক্ষাকামরার অনতিউঁচু মঞ্চে যেয়ে। বেশ কয়েকবার উনার তবলানেওয়াজকে একটা-কিছু বললেন নিচু গলায়, আঞ্জুমান জালালাবাদী শিল্পীর নাম, যিনি নিজে বেতারেরই স্টাফ-আর্টিস্ট, নবাগত উস্তাদজির সঙ্গে এই পয়লাবার আউটডোরে এসেছেন বলে একটু সময় নিয়ে মেলাতে হচ্ছিল সবকিছু, সঙ্গত্ করার কাজটা জালালাবাদী দীর্ঘদিন ধরেই করে যাচ্ছেন বারোয়ারি স্টেজে, সেতার-সরোদের সঙ্গে থাকাটাকে তিনি বুলন্দ নজরে দেখেন বলেই জানালেন। শুধু তবলায় একক বাদন পেশ করার সুযোগ পান নাই? তিনি তো আর আল্লারাখাতনয় জাকির হুসেনের নসিব নিয়া আসেন নাই ধরায়, কাজেই সেই সুযোগ একদিন হবে মর্মে কেবল খোয়াবটাই দেখতে পারেন বলে জানালেন।
অনুষ্ঠানের মূল অংশে সেতারবাদনের চাঙ্ক ছিল ওই ঘড়ি ধরে আধাঘণ্টাই। মিনিট বিশেক রাগ পুরিয়া ধানেশ্রী বাজালেন, শেষের দশমিনিট ভৈরবীর গৎ বাজিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ হলো। উপবিষ্ট অডিয়েন্সের বেশিরভাগই ছিলেন শীতবস্ত্রাচ্ছাদিত। পুরিয়া বাজানোর মধ্যিপথে একেবারেই বিনা নোটিসে বৃষ্টি এল ঝমঝমিয়ে। সেতারির কেরামতি, নাকি ঋতুবদলের বীণা, তা অবশ্য বলা যাচ্ছে না। যা-হোক, অল্প আঁচের এবারকার শীত যেন বসতেও চাইছে না আবার যেতেও চাইছে না। ফলে এই খুশখুশা কাশি, নিউমোনিয়াপ্রায়, শীতের সেতার আর বোল তবলার। মন্দ হয় নাই সিটার উইন্টার রিসাইটাল।
স্থিরচিত্রশিল্পী : ফারহান মালিক ।। প্রতিবেদনপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ
… …
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
COMMENTS