[দুইটা কিস্তিতে এই আড্ডাটার পূর্ববর্তী অংশদ্বয় আপ্লোড করা আছে গানপারে, শেষাংশ প্রকাশ করা যাচ্ছে এখন, এই তিনকিস্তি কথাবস্তু গ্রথনের মধ্য দিয়া বাংলা গানের ব্যাপ্ত চৈতন্যভুবনের উজ্জ্বল একটা হাজিরানা গানপার করতে চেয়েছে এবং শেষমেশ কর্তব্যটুকু সম্পন্ন হতে চলেছে এই কিস্তি পাঠকসমক্ষে নিয়া আসার মাধ্যমে।
হ্যাঁ, এইটা ঠিকই যে এই আড্ডাটা গানপারের অরিজিন্যাল কন্টেন্ট নয়। এইটা ‘ধাবমান’ নামে একটা সাহিত্যপত্রিকার মৌলিক কন্টেন্ট, — যা ছাপা হয়েছিল আজ থেকে দেড়যুগ আগে, এবং আজকের জমানার লোকজন হুট করে সেইটা হাতের নাগালে পেয়ে যাবেন বলিয়া আদৌ মনে হয় না। তা, ধাবমানসংশ্লিষ্ট কারো সৌজন্যে পুরানা পত্রিকাটা বা তার আংশিক ফোটোকপি পেয়ে থাকলে আলাদা কথা।
কাজেই, নয়া প্রাযুক্তিক জমানার নয়া ছাপাব্যবস্থায় নয়া জেনারেশনের গ্রিপে এই কন্টেন্টটা রাখার নেক্ নিয়তেই দীর্ঘ কথোপকথাটা গানপারের উদ্যোগে মুদ্রণের এই ইনিশিয়েটিভ। যদিও অনুমতি গ্রহণ করার কাজটা গানপার সারতে পারে নাই, — উৎসপত্রিকার সঙ্গে কার্যকর কোনো যোগাযোগ না-থাকাটাকে এক্সকিউজ্ হিশেবে দেখতে পারেন, — তবে এই সপ্রেম শ্রমনিষ্ঠ কাজটায় যারা ধাবমানের পক্ষে সেইসময় জড়িত ছিলেন তাদের প্রত্যেকেই গানপারের অভিনন্দনার্হ।
মূল প্রকাশের বিস্তারিত তথ্য, প্রয়োজনীয় অ্যাক্নোলেজমেন্ট, অল্পকথায় রিমার্কস্ পূর্ববর্তী কিস্তিদ্বয়ের শুরুতে রয়েছে। এইখানে সেসব পুনরোত্তোলন না করি বরং। বলবার কথা হচ্ছে এ-ই যে, এই দীর্ঘ কথোপকথাকাজের সময়টায় এখানে যারা কথা বলেছেন, চিন্তাবিনিময় করেছেন নিজেদের মধ্যে এবং আখেরে আমাদের সঙ্গে, এরা প্রায় সকলেই গানসৃজন ও সংগীতসমুজদারিতায় নিষ্ঠাবান দুইয়ের অধিক দশক পার করে এসেছেন এরই মধ্যে। যে-সময়ে এই বিস্তারের আলাপকাজটুকু সংঘটিত হতেছিল সেই-সময়টায় আড্ডার মুখ্য ব্যক্তি কফিল আহমেদ বলি কিংবা পার্টিসিপেটরদের মধ্যে মিউজিশিয়্যান অমল আকাশ, প্রত্যেকেই ইভোল্ভিং ওভার টাইম বদলেছেন, যোজন-বিয়োজন ঘটেছে তাদের ভাবনাচিন্তায়, সৃজনের ঝুলিও কলেবরে বেড়েছে এদ্দিনে স্বাভাবিকভাবে। এখনও সংগীতপ্রশ্নে তারা একই অবস্থানে থেকেই চিন্তাভাবনাচালিত নাকি শিফট্ করেছেন কিছু কিছু পয়েন্টে, এইসব কৌতূহল জেগে উঠতে পারে পড়া শেষে। জ্যান্ত কথাবার্তার ক্ষেত্রে তা-ই তো হওয়া বাঞ্ছনীয়।
তবে পাঠকের পার্টিসিপেশন বোধহয় গানপারের নসিবে সেইভাবে জুটবে না; — গানপার অলমোস্ট পাঠকফোরাম ও লেখকসিন্ডিকেটের আনুকূল্য না-পাওয়া একটা খাটোমতো পত্রিকা; — না জুটুক, সংগীতের ভাবুক ও কর্মযোগী কারো যদি নিভৃত চৈতন্যের চুল্লিতে এই কথাবার্তা খানিকটা জ্বালানি যোগাতে পারে, গানপারের কিবোর্ডে ঘাড় ঝুঁকিয়ে এই টাইপিং তাতে অভিপ্রেত মোক্ষলাভ করবে। — গানপার]
__________
“বেদনা জেগেছে বলেই তো বিদ্র্রোহ জাগাতে হবে। সাথে স্বপ্নটাও থাকা চাই। বিদ্রোহের সামনে অবশ্যই স্বপ্ন থাকা চাই। নয়তো বিদ্রোহটা নৈরাজ্যিক হয়ে উঠতে পারে।”
সমগীতআড্ডায় কফিল আহমেদ
আড্ডায় অংশগ্রাহীবৃন্দ :: অমল আকাশ ।। কাজল কানন ।। আবীর পরশ
আড্ডাস্থান :: ধাবমান ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা
পাব্লিশড ইন ফেব্রুয়ারি ২০০১
__________
আবীর পরশ :: আচ্ছা, এই প্রেক্ষিতেই আমি বলছিলাম যে, ওই যে মিসিং-লিঙ্কটার কথা অমল বলল আর আমরা সবাই স্বীকার করলাম যে, হ্যাঁ, বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটায় আমরা এসেছি। তো উচ্চাঙ্গ সংগীত থেকে আমরা কতটুকু নেব সেখানে আপনাদের আলোচনায় দেখা গেল নিবেদনের ব্যাপারটা, কিন্তু আবার ঐ বিদ্রোহের শক্তি মেলানোর জায়গাটায় ঘাটতিও আছে আর-কি। তো একটু আগে অমল বলছিল যে, আমাদের চর্যাপদের গানের থেকে আমরা যেই গতিতে ফাস্ট হয়ে গেছি কিন্তু আসলে ঐ মেজাজটা সহকারে আসি নাই। আমাদের যে-ঐতিহ্যপরম্পরা সেখানে এখনো ঠিক এত দ্রুততায় পৌঁছার ব্যাপারটা আমাদের রক্তে সেইভাবে আসেনি। এই-যে হঠাৎ করে জাম্প করল, জাম্প করে-যে আবার আমরা সেই ইয়াং ক্রেজের বিটের জায়গাটায় দেখলাম যে এটাও সাময়িক, এটা চিরন্তন আমেজ আনে না; সেখান থেকে আমরা বলছিলাম সেই চর্যাপদ আরো আগের ঋগ্বেদের যে ‘ওম’, সে-জায়গাটায় পরিভ্রমণ করে আমরা ঐ মিসিং-লিঙ্কটা খুঁজে পাব কি-না বা সেখানে কোন্ আমেজটা টাচ করলে আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করব? গণসংগীতের ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার আছে যে সুরের চেয়েও বাণীপ্রধান এবং গণসংগীত পাশ্চাত্যের সেই লেননদের বিটলস্ গ্রুপের যে-বিটের গান — পপ্ গান — সেগুলির পশ্চিমা ইয়াং ক্রেজ দেখে আমাদের এইখানে গণসংগীত রচয়িতারাও সেই-সেই বিটটাকে নিয়ে ভাবছে যে, না রবীন্দ্রসংগীত বর্জন করছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। এটা এক ধরনের আত্মপ্রসাদ, তো তারাই উচ্চাঙ্গসংগীত প্রায় একেবারেই বর্জন করছে। এ ধরনের কোনো-একজন লোককে আমি দেখলাম না যে উচ্চাঙ্গসংগীত সে পছন্দ করে। এটাকে মনে করে যে কিছু না। তো আমাদের ভেতর যে প্রগতিশীল অংশটাকে নিয়ে আমরা ভাবনাচিন্তা করি, সেই অংশটাকে দেখি যে সংগীত সম্পর্কে প্রচণ্ড অজ্ঞতা এবং এক-ধরনের উন্নাসিক ভাব রয়ে গেছে তাদের, গণসংগীত বলতে তারা খুব ক্ষুদ্র অর্থের, ক্ষুদ্র মাপের গণসংগীত বোঝে এবং খালি কিছু দ্রুত বিট-টিট বোঝে, সেখানেও দেখি যে, গণসংগীত বলতে এক-ধরনের টাইপড ব্যাপার বোঝে এবং তাও অনেকে শোনে না আসলে। যে-শ্রমিকজমায়েতে বলা হয় বা পোস্টারে লেখা থাকে যে, শেষে গণসংগীত — দেখি যে, গণসংগীতের সময় একটা লোকও থাকে না, চলে যায়। তাহলে সেই যে গদ্দার-এর কথা বললাম, যে কি-না লোকসংগীতকে ভিত্তি করে হাজার হাজার লোককে আবার আন্দোলিত করতে পারছে বা এখনো প্রতিরাতে যে-মাহফিলে বয়াতিগান হওয়ার কথা থাকে, সেখানে হাজার হাজার লোক তা উপভোগ করছে, বয়াতিগান তাদের আকৃষ্ট করতে পারছে। তাহলে এই বয়াতিরা সংগীতের কোন্ জায়গাটা ধরতে পারছে? সেখানেও কিন্তু বিট্ আছে, সূক্ষ্ম অনুভূতির সুর আছে। কিন্তু আমাদের ব্যান্ডসংগীতঅলারা তো ফেল মাইরা এখন ফোকের কাছে গেছে। কোনো ব্যান্ড এখন ফোক ছাড়া চলতে পারছে না। উপায় নাই। তাহলে, লোকসংগীতকে আমাদের ভিত্তি ধরতে হবে এবং সেখানে ঐ রাগরাগিণীর মেজাজগুলি আছে এবং হাজার বছরের পথপরিক্রমায় যেটা জেনিটিক্যালি আমাদের খাপ খেয়ে গেছে, সেটাকে ধরে নতুন সুর যোজনা করলে সেখানে ঐ বিটও যেমন থাকবে এবং আমাদের বিভিন্ন সময়ের অনুভূতির মেজাজও মনে হয় ধরা থাকবে। আমাদের জনপদের মানুষের অনেক বছরের একটা সমৃদ্ধি অর্জনের ফল ছিল, সেই জায়গাটিকে ধরে হয়তো-বা সামনে এগোনো যেতে পারে।
কাজল কানন :: আমার কাছে মনে হয়, এটা একটা মহাপ্রাণের ঐক্য। সেই ঐক্য আমাদের আছেই। মহাপ্রাণের মানে মানুষ থেকে মানুষে, মানুষ থেকে সমস্ত প্রকৃতিতে একটা সুরের ঐক্য প্রবহমান। এমনকিছু গান কিংবা এমনকিছু সুর, এমনকিছু প্রবণতা আমাদের মানুষদের ভিতর আছে বা ছিল, আমরা হয়তো-বা আমাদের দর্শনের দারিদ্র্যের কারণে সেটাকে আবিষ্কার করতে পারছি না। সেটি পারলে, একটা কাছাকাছি অবস্থান নিশ্চয়ই পাবো। তার জন্য শিল্পীদের দর্শনের দরিদ্রতা আগে দূর করা দরকার। দরিদ্রতা, হীনতা, নীচতা নিয়ে একটা বড় জায়গায় যাওয়া যাবে না।
কফিল আহমেদ :: আর যারা গাইব, যারা শুনব সে-গানটাকে আমরা সকলেই সংগ্রামের করে নেব, চর্চায় ভালোবাসার করে নেব। তাতে গরু-মোষের খুরের ছন্দও থাকবে, পাখির ডানার ‘ওড়াওড়ির লয়টাও’ থাকবে। এ ওর দিকে তাকাবার মুহূর্তটি, এসবের নিঃশব্দ দশাটিও ভাষার সুরে গেয়ে উঠতে থাকব। গেয়ে উঠতে থাকব আমরা কেমন আছি! আমরা কি চাই! এই তো দেখুন, বোবা মেয়েটি হঠাৎ একটু নাচতে-নাচতে হরিণের মতো নয়, আসলে একটা হরিণই, এখন ‘ও’ একটা হরিণই, একটা বোবা হরিণই আমাদের মুখে ভাষা দিয়ে গেল, চোখে সুর দিয়ে গেল। সমগীতে আন্তঃসম্পর্কের ঐকতানটি এভাবেই এগোয়। আর চোখে সুর দেয়া বললে তো গানেরা দৃশ্য হয়ে যায়। তাই না! গান তো দেখাও যায়। সমগীতের সংগ্রামের জন্য গানটাকে দেখতেও হয়। প্রত্যক্ষ করতে হয় বাস্তবিকতায়, স্বপ্নে। সেজন্যই তো আমাদের সংগ্রামে সম্পর্কিত হওয়া। অতীতের থেকে যা জানতে পাই, তা শুধু সেই জানাটুকুই নয়, জানাটুকু কি করতে বলে আমাদের! সময়ে নির্দেশনাটা কি হওয়া উচিত তা ভাবতেই হয়। শুধু ভাবনাটাই নয়, ভাবনাটুকুকে সংগ্রামে প্রত্যক্ষ করতে হয়। সংগীতের মুক্তির জন্য হরিণ আসবেই, সমগীতের সামগ্রিক সত্যের প্রয়োজনে পাখি আসবেই। শ্রমিক আসবেই। কৃষক আসবেই। শ্রমিক, কৃষক, পাখি কিংবা হরিণেরা, সবাই পরস্পরের হবই। তা তো আমরা চাইতেই পারি। কিন্তু পাখির মরা মুখ দেখছি কেন? ওর ডানায় এত ক্লান্তি, দৃষ্টিতে এত এত ভয় কেন? শ্রমিকেরা কাজে আনন্দ পাচ্ছে না কেন? বেতন পাচ্ছে না কেন? সাপ্তাহিক ছুটি পাচ্ছে না কেন? ওরা রোজ রোজ ছাটাই হচ্ছে কেন? আরো বলি — একজন মানুষ কখন নিজেকে উইথড্র করে! একটা চাপের মুখেই কি সে অভিমান করে! কিন্তু অভিমানে তো লাভ নাই। এজন্য চিন্তার জায়গায় পরিষ্কার থাকা চাই। চিন্তার জায়গায় পরিষ্কার থাকাই তো মূল্যবোধ। মূল্যবোধের পরাজয় আমরা মেনে নিতে পারি না। নিজেকে উইথড্র করে করে পাখিরা হরিণেরা শ্রমিকেরা কৃষকেরা কিভাবে বাঁচে? সময়ের নির্দেশনাটা কি হওয়া উচিত? এদেশের নারীরা একটা ট্রাডিশনের চাপে অস্তিত্বকে উইথড্র করে। নিজেকে একে একে উইথড্র করেই তো সে শোষিত হয়! শোষণটা মেনে নেয়। আমাদের মায়েরা সন্তানের জন্য তো নিজেকে সম্পূর্ণ উইথড্র করেছে। নিজেকে এক-রকম বিলীন করবার বেদনাটা কতটা কঠিন! এই বেদনাটা তো একটা ট্রাডিশনের চাপ থেকেই। স্তরে স্তরে বৈষম্য। দফাফ দফায় বৈষম্য। প্রতিটা মুহূর্তই বৈষম্যের! বৈষম্য রাখলে তো বলতে হবে পৃথিবীর সংগীত ব্যর্থ। সংগীত ব্যর্থ হোক আমরা তো তা চাইতে পারি না। বেদনা জেগেছে বলেই তো বিদ্র্রোহ জাগাতে হবে। সাথে স্বপ্নটাও থাকা চাই। বিদ্রোহের সামনে অবশ্যই স্বপ্ন থাকা চাই। নয়তো বিদ্রোহটা নৈরাজ্যিক হয়ে উঠতে পারে। ট্রাডিশন বিষয়টা কি? আজকে রাষ্ট্রীয় ট্রাডিশনটা কি? কোনো কৃষকের হালের গরু-মোষের চামড়া দিয়েই তো পুলিশের পায়ের বুট বানানো হয়েছে। একটা ট্রাডিশনের পদ্ধতিতেই কিন্তু হালের গরুর চামড়া দিয়ে পুলিশের পায়ের জুতা বানানো হয়েছে। আবার একটা ট্রাডিশনের জন্যেই কিন্তু সেই জুতা পায়ে পুলিশ কৃষকের বাড়িতে যাচ্ছে জেলখানার ফরমান নিয়ে। গরু নিয়ে কৃষক নিয়ে গান গাইছি, তো ট্রাডিশনটা ভাঙার সংগ্রামটাও করব আমরা। আর ভবিষ্যৎকৃষকেরা যেন হালের গরুর চামড়াটাকে চিনতে পারে, ভাষাটাকে বুঝতে পারে তাও তো ভাবতে হবে। গরু ও কৃষকের মুক্তি একসাথে হবে, না-কি একে একে হবে, তাও আমাদের সমগীতে বেজে ওঠা চাই। মনে বেজে ওঠা চাই। ওসবেরও নমুনা সমগীতে ফুটবে। সুরের মাঝেই ফুটবে। ছন্দের টানেই গাঁথা হবে দৃশ্যগুলি। দৃশ্যের রিদমেই সঞ্চারিত হবে সুর। ছন্দের টান — একটা আন্তঃসম্পর্কের টান।
আবীর পরশ :: আমরা প্রায়ই দেখি, সাধারণ মানুষ মানে রিকশাচালক, শ্রমজীবী মানুষ বিনোদনের জন্য বিভিন্ন হ্যলটলগুলোতে যায় তার বিনোদনটা মেটাতে। সারারাত জেগে যে বয়াতীর গান শোনে, তার একটা মানসিক ক্লান্তি লাঘবের জন্যে — এই উপভোগের ব্যাপারটা, অনেকে যে এটাকে কিছুটা নেতিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে — এই যে কিছুটা, মেন্টাল রিলিফের এই ব্যাপারটা — এর প্রয়োজন আছে কি-না, এটা সংক্ষেপে অমল আকাশ বা আপনি কি মনে করেন?
অমল আকাশ :: এটা বলতে চাচ্ছিলাম যে, একজন মানুষ খুব ব্যস্ততা শেষে একটু বিশ্রাম চায়, একটু বিনোদন চায় এবং তার এই বিনোদনের জন্য সে গান শুনল — সেটার জন্য এক-রকমের গান, আর আন্দোলন-সংগ্রামে চাঙ্গা হওয়ার জন্য, লড়াই করার জন্য আরেক-রকমের গান, যে-গান আমরা মেন্টাল রিলিফ পাওয়ার জন্য শুনি না — এটা হতে পারে না। সত্যিকার গান হচ্ছে সেটাই, যে দুটা অবস্থাকেই ধারণ করতে পারে। হতে পারে একটি তার বিরহের, একটি তার আনন্দের আবার কোনোটি দ্রোহের। কিন্তু ভেতরের যে অন্তর্নিহিত সুরটি, সে-সুরটি তো বেজে উঠতে হবে তার জীবনকে সামগ্রিকভাবে ধারণ করার ক্ষমতা নিয়ে। সেটাই সংগীত। আমি যদি গণসংগীতকে — টোটাল গণসংগীতকে, মানে এ-যাবৎ যা গাওয়া হয়েছে সেটাকে একটা সেক্টরে ভাগ করে রেখে দিলাম যে এটা শুধু আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য, আর এটাই হচ্ছে গণসংগীত; — আবার বিরহ-রোমাঞ্চের জন্য নিলাম রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কিংবা মান্না দে। এ-রকমভাবে তো আর শ্রেণিবিভক্ত করা ঠিক হবে না সংগীতকে। আমার কাছে এটা মনে হয় না। আমার কাছে মনে হয় কখনো কোনো বিদ্রোহের সময়েও এমন কোনো ভালোবাসার গান আমাকে আরো বেশি বিদ্রোহী করে তুলতে পারে, যা হয়তো ঐ সময়ে অন্য কোনো গান দিতে পারবে না। সেই গানের সেই সুরের মধ্যকার এমন কোনো কোনো প্রাণের জায়গা থাকে যা আমাকে টানতে পারে। সুরের সেই ক্ষমতাটা আছে। সত্যিকার সংগীতের, চিরায়ত সংগীতের সেই ক্ষমতাটা আছে। সেটাই আসলে আমাদের ভাবনার বিষয় এবং সেটা আমরা মনেও করি। বিশেষ করে আমরা ‘ধাবমান’ থেকে তো এটা অবশ্যই মনে করি যে, গণসংগীত বলে একটা হেডলাইন দিয়ে এটাকে শেলফে তুলে রাখার বিষয় নয়। সেদিক থেকে মেন্টাল রিলিফের জায়গাটা আলাদা হতে পারে না। মেন্টাল রিলিফ বা সিরিয়াস সংগীত দুইটা বিভাজন করা আমার মনে হয় ঠিক নয়। বরং এমনটা মনে হয় যে, এই বিভাজনের মাঝে সত্যিকার সমগীতের মুক্তি নেই। তাকে সমস্ত ঘরানার দরজা-জানালা খুলে বাহিরানায় এসে দাঁড়াতে হবে।
আবীর পরশ :: ধন্যবাদ অমল আকাশ। আসলে আমরা সংগীতের সেই বিশাল এবং বড় জায়গাটিকে ধরতে চাচ্ছিলাম এবং গণসংগীতকেও আমরা ওই বড় জায়গারই একটি অংশ হিসাবে মনে করি এবং আমাদের এতক্ষণের আলোচনাটা যে-জায়গায় নিয়ে আসলাম, সেই বড় জায়গাগুলির ক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য কোন জায়গাগুলি কেমন, প্রকৃতির বিরাজিত সুর, বিভিন্ন মানুষের শ্রমের বা মানুষের চলার ছন্দের সুর — এই জিনিসগুলি যেন গণসংগীতে ধারণ হয়। কিভাবে হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা বিভিন্ন জিনিসকে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন? তিনি বলেছেন যে, মার্কসবাদের সরল হিসাবের মধ্যে পড়ুক বা না-পড়ুক, গণসংগীত মানুষের প্রাণের জায়গাটা স্পর্শ করার একটা ব্যাপার। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মধ্যে বড়মাপের গণসংগীতকারের প্রতিভা ছিল। আমরা সেই হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে ধরেই — যাকে নিয়ে আবার কিন্তু সেই বাম-রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যারা গণসংগীতকে ক্ষুদ্র অর্থে ধরে, সেই তাদেরও কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিয়ে কোনো কথা নেই। তারা আবার হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে এক-ধরনের শ্রদ্ধা দেখায়, কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে আবার ঠিক ততটা পরিমাণে ধারণ করতে পারে না। কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার সেই ‘সেলাম চাচা’ গান যেভাবে লিখেছেন, তারপরে ‘তোমার ব্যাটন’ তারপর ‘মশাল জ্বালো’ বা তার সেই অমর ‘শঙ্খচিল’ গান বা তিনি আরো যে গান যেভাবে ব্যাপকতা নিয়ে, যে-সময়ের, যে-আবেদনের গান গেয়েছেন, সেই লোকসংগীতের — যে-জায়গাটা আমরা আজকে আলোচনায় ধরলাম যে, এক-সময় মানুষ আপনাআপনি যে-গানগুলো গেয়ে উঠত, সেই আপনাআপনি সুরটাকে পরে শাস্ত্রীয় সংগীতে নেয়াতে সেটা যেমন এক-ধরনের বাঁধা পড়েছে, সেই বাঁধাটাকে আবার হেমাঙ্গ বিশ্বাস সরিয়ে সত্যিকার অর্থে গানটাকে মানুষের হৃদয়গ্রাহী করার চেষ্টা করেছেন। আমরা সেই জায়গাটাই আবার অধিকার করার চেষ্টা করছি এবং গণসংগীতকেও আমরা মনে করছি ওই বড় জায়গা ধারণ করার ক্ষমতা তার আছে। গণসংগীত শুধুমাত্র আন্দোলন-সংগ্রামের গান বা কোনো পোলিটিক্যাল পার্টি বা একটি বামপার্টির আলোচনার শেষে এক-ধরনের দ্রুত বিটের উচ্চকিত গানের কোনো বিষয় না। এই-তো কিছুদিন আগে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘গণসংস্কৃতি’ ও ‘লোকসংস্কৃতি’ এই দুটো বিষয় যে আলাদা, এটা ‘লালন আখড়া রক্ষা কমিটি’-র একটি মুখপত্রে তুলে ধরেছেন। গণসংস্কৃতি বলতে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, যে-সংস্কৃতির কারণে মানুষ কোনো রক্ষনশীলতা মানে না, যে-সংস্কৃতি মানুষ তার সবসময়ের জন্য নিয়ে নেয়, সবসময়ের কাজের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে, তার প্রাত্যহিক জীবনযাপনের অংশ হিসেবে নিয়ে নেয়, সেটা গণসংস্কৃতি। আর লোকসংস্কৃতি হলো, একটা পর্যায়ে বিভিন্ন জনপদের মানুষ একেক এলাকায় একেক ধরনের যে-সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল এবং তা সেইভাবেই আছে, তা বেশি ব্যাপক অর্থে যায়নি, একেবারে প্রায় অবিকৃত অবস্থা। এখন অনেকেই তার পৃষ্ঠপোষকতা করতে যেয়ে তাকে ড্রয়িংরুমের মধ্যেও নিয়ে আসার এক-ধরনের ফ্যাশন দেখাচ্ছেন। কিন্তু গণসংস্কৃতি বলতে যেটা একেবারে বিলীন হয়ে গেছে, বোঝা যাবে না আর মোটাদাগে যে এটা গণসংস্কৃতি, একেবারে প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ভেতরের হয়ে গেছে। এই যে বাঙালির স্বরগুলো এক-রকম, বাঙালির গান এক-রকম, পোশাক এক-রকম, এই যে ব্যাপারগুলো — এগুলো সবই গণসংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা যদি কৃষকের ঘরে একটি পাটের শিরা বা একটি লক্ষ্মীর সরা দেখি, তাহলে বুঝি যে এগুলো ফোক। মানে এই বিষয়গুলো কিন্তু সেই জায়গায়ই আছে। কিন্তু আমরা গণসংস্কৃতি বলতে আরো যেগুলি একেবারে এখন আর আলাদা করা যায় না সেভাবে বুঝি। গণসংগীতকেও আমরা — একটু আগে অমল আকাশ যে-কথাগুলো বলল, সেই প্রতিটি মুহূর্তের, প্রতিটি রাগ-অনুরাগের, প্রতিটি আনন্দ-বেদনার, বিরহের, বিদ্রোহের অনুভূতিগুলি আমার ঐ সংগীত দিয়ে এসে যাবে। এমন না যে, আমার বিদ্রোহের সময় আলাদা করে একটা গণসংগীত নিয়ে আসতে হবে। গণসংগীতগুলো এমনই হবে যে মানুষ সেই গানগুলো নিয়ে নিবে এবং তার বিভিন্ন সময়ে এই গানগুলি তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গাইবে। ঐটা ঐ আলাদাভাবে রবীন্দ্রসংগীত নয়, আলাদাভাবে এটা পল্লিগীতি নয় বা অতুল, রজনীকান্ত, ডিএল রায়-এর গান নয়। এখন আধুনিক বলতে যে একটি ধারা এসেছে সেই আধুনিক গানের এগুলো হবে আরেকটি ধারা, যা ব্যাপকভাবে মানুষ গ্রহণ করবে। ব্যাপক মানুষ এই গানের সাথে একাত্মতা অনুভব করবে। কিন্তু এখন আমরা দেখছি যে, পূঁজিবাদী সংস্কৃতি এসেছে আমাদের এখানে এবং এখানে তা আমাদের মানুষে-মানুষে বিভেদ তৈরি করে দিচ্ছে, মানুষে-মানুষের একতা নষ্ট করছে। মানুষ সেই হার্মোনিটা সেই ঐকতানটা অনুভব করছে না অনেক ক্ষেত্রেই। এখন আবার প্রয়োজন সেই ঐকতানটা ফিরিয়ে আনা, সেই হার্মোনিটা উপলব্ধি করা। আমার মনে হয়, গণসংগীতকে এখন যদি সেই বৃহত্তর জায়গা থেকে কিছুটা ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, গানটাকে সুরারোপিত করা যায়, তো বাণী এবং সুরের মিলনে সেই গান আবারো বৃহত্তর মানুষের মধ্যে ক্রিয়া করবে এবং মারাত্মকভাবে তা একটি ঐকতান সৃষ্টি করতে পারবে এবং মানুষ সমস্বরে গেয়ে ঠবে সেই গান, কোরাসকণ্ঠে গেয়ে উঠবে সেই গান, অতীতে বিভিন্ন সময়ে হাজার হাজার বছর মানুষ শিকারে যেয়ে সেই ধরনের ঐকতানের গান গেয়ে উদ্বেলিত হতো, উদ্বুদ্ধ হতো। মানুষ যখন এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর প্রতি আধিপত্য বিস্তারের জন্য যেত, তখনও মানুষ সেইভাবে সমবেতভাবে সেই গানগুলি গেয়ে উঠত। সেই সমবেত বা কোরাস থেকে আমরা গ্রিক সংস্কৃতিতে দেখি, তাদের বিভিন্ন নাটকে, বিভিন্ন জায়গায় কোরাসের ব্যবহার এবং এখানেও আমাদের যে যাত্রার ফর্ম ছিল সেখানেও কিন্তু বিভিন্নভাবে কোরাস গান ছিল, বিভিন্নভাবে আমাদের দলীয় একটি ব্যাপার ছিল, ছিল সমবেতভাবে গান গাওয়ার। আমাদের এখানে যে মধ্যযুগীয় কীর্তন গানগুলি এসেছে সেগুলিও সমবেতভাবে গাওয়ার জন্য। বৈষ্ণবগানেও সমবেতভাবে গাওয়ার চর্চার কথা জানি। কিন্তু তা আজ যেন একটু হারিয়ে গেছে। আজ যেন একক ব্যক্তির পরিশীলিত মাধ্যম হয়ে গেছে গান। এই গানগুলোকে আপাতত একটু সচেতনভাবেই মনে হয় সমস্ত মানুষের গান হওয়ার জন্য চেষ্টা করা উচিত, যেন মানুষ কোরাসকণ্ঠে আপনাআপনি গেয়ে ওঠে, সেই প্রচেষ্টা কিছুটা করা উচিত। তারপরে হয়তো আবার আমরা দেখব যে ঐ গানগুলি অটোমেটিকভাবে সাধারণ মানুষ নিচ্ছে এবং তখন যে বড় বড় সুরকাররা আসবেন, সংগীতব্যক্তিত্ব আসবেন, তারা যে-গানগুলি করবেন বা সেই জনপদের মানুষ আরেকটু যদি সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে, তারা যদি ঐ সমাজটা কিছুটা বদলায় বা যদি তার মৌলিক কিছু চাহিদা, যেমন — ভাত, কাপড়, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের কিছুটা গ্যারান্টি হয়, তাহলে কিন্তু মানুষ আবার আনন্দে হেসে উঠবে, আবার সমবেত কণ্ঠে গাইবে সেই গান। ঐ গানগুলি হবে তখন সত্যিকার গণসংগীত।
অমল আকাশ :: এখানে আমি একটা বিষয় যুক্ত করতে চাই। এখন আমাদের আলোচনায় তো গান নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমরাও কিন্তু বিশেষভাবে গণসংগীতকে চিহ্নিত করতে চাচ্ছি। আমরা বলছি যে, এটাকে আমরা সমগ্র সংগীতজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছি না। কিন্তু আবার অন্যদিকে এটাকে বিচ্ছিন্ন বা বিশেষভাবে চিহ্নিত করা দরকার, এ-রকম একটা বিষয় আমাদের আলোচনা থেকে বের হয়ে আসছে। আবীর পরশের কথা থেকে এটা মনে হলো যে, গণসংগীতের একটা বিশেষ রূপ আছে। অর্থাৎ গণসংগীত হচ্ছে সে-সংগীতগুলো যা কোরাস গাওয়া হচ্ছে — গাওয়া হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার কথা, সবার জন্যে বা সবার কথাকে একা কি গাওয়া যায় না? কোনো শিল্পী কি একা গণসংগীত বা গণমানুষের গান গেয়ে উঠতে পারে না? সেখানে তো তাহলে কোরাস ছাড়াও গাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেক সময় সমবেত কণ্ঠে গাওয়া গানেও গণমানুষের মূল সুরটা না-ই বাজতে পারে। সমবেত বা গোষ্ঠীবদ্ধতার বিকাশটা না-ও ঘটতে পারে। সুতরাং কোরাস গাইলেই সেটা গণসংগীত হবে, এ-ব্যাপারে আমার দ্বিমত আছে।
আবীর পরশ :: আচ্ছা, এ ব্যাপারে আমি একটু বলি। অমল আকাশ বেশ সূক্ষ্ম জিনিসটা ধরেছে, তাতে ভালো হয়েছে। আমি বলতে চাচ্ছি, তখন এমন একটা পরিবেশ হবে বা কফিল আহমেদের আলোচনা থেকেও আমরা যা বুঝলাম যে, ঐ জনপদ থেকে কেউ-একজন গেয়ে উঠবে, সেই গান আবার সমবেত গান হবে। তাহলে যে কেউ-একজন গায়, সে কিন্তু ঐ জনপদের নাড়ির স্পন্দনটা টের পায়। এটা আবার কোরাসের স্থান লাভ করে, রূপ লাভ করে। ঐ একজন আসলে সবসময় থাকবে কিন্তু সে আবার বেশিমাত্রায় বিকশিত হবে না সবসময়। এই যে বললাম, এখন আপাতত কিছুদিন ঐ বিষয়টা আরোপিতভাবেই করতে হবে; এখানে চাপানো ব্যাপার এসে যায়, তখন আবার বললাম, মৌলিক অধিকারের কথাগুলো। একটা অনুকূল পরিবেশ হয়ে গেলে ঐ গান আবার গণমানুষ বিভিন্ন সময়ে ব্যাপকভাবে গাইবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের নাড়ির স্পন্দনটাকে টের পায় সবসময় শিল্পীরা আগে, যে নাকি একটু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। একজন শিল্পী সেই নাড়ির স্পন্দনটা বুঝে গেলে তখন আবার সেটাকে সব মানুষ লুফে নেয়। যখন ঐ স্পন্দনটা কেউ না-বুঝে জোর করে করতে চায়, তখন সেখানে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, কেউ সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না। আবার সেখানে কিছু জোরের ব্যাপার এসে যায়, এটা তখন আর তত স্বতঃস্ফূর্ত হয় না, এই ব্যাপারটা বলছিলাম। এটা যুগে যুগে সবসময় হবে। ঐ নাড়ির স্পন্দনটা টের পাবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পীরা। তারা এটা গাইবে এবং সেটা আবার খুবই দ্রুত বিস্তার লাভ করবে, দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এটাই পরবর্তীকালে গণসংগীত হয়ে যাবে, গণমানুষের গান হয়ে যাবে।
কফিল আহমেদ :: উল্লেখ করার মতো আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আমরা এসেছি। গানে সমবেত হবার বিষয়টির সাথে একক পরিবেশনার কথাটিও গুরুত্বের সাথে আসা চাই। সমগীত আমাদের আকাঙ্ক্ষা। দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা। আমাদের শক্তি। ডাকটিকে অনেক গভীর থেকে তুলে আনবার জন্য সমগীতে একক কণ্ঠস্বরটিও জরুরি হয়ে আসা চাই মূল্যবোধের সামগ্রিকতার চর্চার প্রয়োজনেই। সমগীতে একক সত্তাটিকে অনুভব করা চাই। প্রকাশ করা চাই। ব্যক্তিসত্তা প্রকাশিত না হলে তো একে-একে মহাঐকতানের আন্তঃসম্পর্কটি গড়ে উঠতে পারে না। আর শ্রমের সাথে মানুষের অবসরের মাঝখানে একটা বড় দূরত্ব একটা বড় দেয়াল রাখা আছে। কারণ তো শ্রমের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত যে গণমানুষ, তার শ্রমের আনন্দটা তো এখনো পর্যন্ত শোষকের শোষণের শাসনের চাবুকের সামনে বন্দী। পরাধীন। শ্রম এখন ক্লান্তিকর। শ্রমকে শোষকের শোষণের কবল থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত, সাধারণের শ্রমের স্বাধীন বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত, সেই শ্রমের সাথে সাধারণের আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। শ্রম যখন অসহ্য অনিশ্চিত এবং ক্লান্তিকর, তখন সাধারণের অবসরটুকু তো আর জোরালো বা সুখের হবার কথা নয়। তার অবসর কই! শরীর জুড়াবার জন্য, মন মেশাবার জন্য তার অবসর কই? শ্রমে, শ্রমের উপাদানে, উৎপাদনপদ্ধতিতে জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত শ্রমের মুক্তি ঘটবে না। ঘটতে পারে না। শ্রমের উল্টোদিকে অবসর, আর অবসরে বিনোদন; আর বিনোদনটা গথিক বা ভৌতিক করবার বিষয়টা ব্যবস্থার স্তরে স্তরে ঘাপটি মেরে আছে। একটা চাপের মধ্যে, অবদমনের মধ্যে থেকেও সাধারণ তার শ্রমের সাথে আনন্দকে জাগাতে চেয়েছে। আমাদের ফসলের গানে বারোমাসি গানে শ্রমের আনন্দটুকু সামান্য হলেও প্রকাশিত হতে চেয়েছে। তাও আর কতদূর! প্রয়োজন তো শ্রমের ক্ষেত্রের পরতে পরতে সকল আনন্দগানের মিলন। প্রকৃতিতে একদল পাখির উড়বার সাথে, তার উড়বার বিষয়টি যেমন শ্রমের; তেমনি তার আনন্দের প্রকাশেরও। আবার একপাল হরিণ, সে দৌঁড়াবার সময় তার খুরের ছন্দ-ধ্বনি তাকে সুন্দরভাবে তার গতির সাথে দৌড়াতে প্রেরণা দেয়। পাখির উড়বার শ্রমের আনন্দের কথা বললাম, প্রশ্ন আসতে পারে — পাখি বিদ্যমান উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় যন্ত্রব্যবস্থার দাস কি না? আমরা তো চাইব — পাখির ওড়াওড়িটাও উৎপাদনে শ্রমিকের শ্রমের আনন্দের সাথে সম্পর্কিত হোক মহাসৃষ্টির প্রতিটা প্রাণের গতির স্পন্দনে, প্রাণের দ্যোতনার উচ্ছ্বসিত জাগরণে, ঐকতানের জাগরণে। এটাই শ্রমের আনন্দগান। শ্রম বিষয়টি সমগীতের আনন্দের সাথে সম্পর্কিত হয়ে তা আরো প্রাণবন্ত, আরো সহজতর হতে পারে। এটাই তো আজকের বিজ্ঞান। তা না হবার কারণ তো শ্রমের উপর শোষকের রক্তচক্ষুর বর্বর কর্তৃত্ব। নিয়ন্ত্রণ। এসবের বিপরীতেই তো আমাদের গানের প্রস্তুতি। অমল আকাশ বলল যে, বিদ্রোহের বেলায়, বিদ্রোহ প্রকাশের বেলায় আমাদের অন্তরের, আমাদের ভালোবাসার প্রেরণার জায়গাটি যতটা গভীর, যতটা আস্থার, বিদ্রোহের প্রকাশটাও ততটা প্রখর, ততটা শক্তির হবে। অপ্রতিরোধ্য হবে। ভালোবাসার প্রেরণার সাথে তো বিদ্রোহের প্রয়োজনের বিরোধ থাকতে পারে না। উপলব্ধি তো একটাই। লক্ষ্য তো একটাই — মুক্ত হওয়া, মিলিত হওয়া। আবীর পরশ বলছিলেন যে, প্রিমিটিভ মানুষেরা শিকারে বেরোবার সময় তাদের পায়ের গতিতে, চলবার ছন্দে এমনকি মুখের ভাষাতেও একটা কোরাস বা সমবেত প্রকাশ লক্ষ করা যেত। প্রিমিটিভ মানুষের বাঁচার সংগ্রামই তাদেরকে একই গতিতে, একই ছন্দে, একই ভাষায় একটা ঐক্যে এনেছিল। আমাদের আজকের ঐক্যটা তো আরো জরুরি, আরো স্বাচ্ছন্দের আরো গভীর হবার অপেক্ষায়। আমাদের গানের সংগ্রামে একজন আহত মানুষের উপমা হয়ে যদি একটি আহত পাখি আসে, তাহলে আহত পাখিটা যেন শুধুমাত্র উপমার স্তরে এসেই আটকে না যায়। মানুষ এবং পাখি — দুজনেই তো আহত এবং অনাহত। শুধুমাত্র মানুষ গাইবে মানুষের সাথে তা তো নয়। পাখিটাও যদি গাইতে পারে, একটা নদীর জলধারা যদি গেয়ে উঠতে পারে, তখনই আসলে মানুষ সমগীতের জায়গায় পৌঁছুবে। সমগীতের জায়গাটা কিন্তু ওখানেই। সে-প্রস্তুতি সমগীতের কথায়, সুরের মেজাজে বাদ্যে থাকা চাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তির সংগ্রামে, শ্রেণিবৈষম্য উচ্ছেদের সংগ্রামে গানে গানে আরো মুখোমুখি, আরো দুর্বার হওয়া চাই। কারণ এই কাজগুলি কে করবে! মানুষ করবে। আমরা করব। প্রথমে তো আমরা মুক্ত হব, মানুষেরাই মুক্ত হব। সাথে সাথে পাখিরাও — হরিণেরাও — মাছেরাও — গাছেরাও।
সম্পাদক : দেখা গেল যে, আমরা সকলেই সমগীতের ধারণা নিয়ে গণসংগীতকে বুঝছি। সাধারণত একটি আড্ডায় বিতর্কের বিষয়টি প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের এই আলোচনায় বিতর্কের বিষয়বস্তুর চেয়ে প্রায় অভিন্ন মতপ্রকাশের সুরটি ধ্বনিত হলো। আমরা আমাদের ধারণাগুলোকে আরেকটু ঝালাই করে নিলাম। এখন আলোচনার ইতি টানা দরকার। দেখা গেল, আমাদের চারজন মিলেই সমগীত গাইলাম। সমগীত বিষয়ক একটা আলোচনার সূত্রপাত করলাম আমরা। আসলে পৃথিবীতে কোনোকিছুরই শেষ বলে কিচ্ছু নেই। সুন্দরের তরে শুধুমাত্র অন্তরের দিকে বয়ে যাওয়া। সমমানসের ঐকতান নিয়ে গাওয়া হোক সমগীত। সকল মুক্ত প্রাণের গীত — সমগীত। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
সমগীতআড্ডায় কফিল আহমেদ :: পূর্ববর্তী কিস্তিদ্বয়
কিস্তি ২ ।। কিস্তি ১
- ফিউরিয়োসা - September 26, 2024
- অনবরত অনুসন্ধান || সজীব তানভীর - September 26, 2024
- অ্যাক্টর্স জার্নাল : শতেক পাতার লাইনটানা ব্ল্যাঙ্ক নোটবুক - September 26, 2024
COMMENTS