সুরমা থেকে গঙ্গা জয় করে নেওয়া এক নিভৃতচারী সংগীতসংগ্রামী || অসীম চক্রবর্তী

সুরমা থেকে গঙ্গা জয় করে নেওয়া এক নিভৃতচারী সংগীতসংগ্রামী || অসীম চক্রবর্তী

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় একটা সময়ে অনেকগুলো ভাটিয়ালি গান গেয়েছিলেন; সেগুলো খুব জনপ্রিয়ও হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল বিখ্যাত সুরকার নচিকেতা ঘোষের “মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে / আমি আর বাইতে পারলাম না।” কলকাতায় ভাটিয়ালি গানের শিল্পী হিসাবে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের খুব নামডাক হয়েছিল। মানবেন্দ্র বলছেন, “ওই সময়ে অনেকগুলো ছবিতে এই ধরনের গানের জন্য ডাক আসছিল। তাই আমার মনের মধ্যে একটি গদ্দি হয়েছিল এই ভেবে যে মনে-হয় এই ধরনের গানের ধারাও দখলে নিয়ে আসলাম।”

তো একবার কোলকাতার বেলেঘাটাতে এক ফাংশন। প্রায় পাঁচ হাজার লোকের সমাগম। কিন্তু বাধ সাধল মাইকবিভ্রাট। অগত্যা কোনো উপায় না পেয়ে সব শিল্পী বসে রইলেন। এর মধ্যে উস্কোখুস্কো একটা লোক গলায় দোতারা ঝুলিয়ে বাঙ্গাল ভাষায় বলল, “ভাই, কেউ গান গাইছেন না, আমাকে একটা গান গাওয়ার সুযোগ দেন।” আয়োজক বললেন, “তুমি মাইক ছাড়া এত মানুষকে গান শুনাতে পারবে?”

তারপরেই রচিত হলো ইতিহাস। সেই বয়াতি স্টেজে উঠে নিজের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ না করে ‘মাঝি রে’ বলে একটা টান দিলেন। মানবেন্দ্র বললেন, “সেই টান এতই দরাজ আর উত্তাল ছিল যে, মনে হচ্ছিল সুর থেকে যেন লক্ষ লক্ষ তিরের ফলা ছুটে গিয়ে বিঁধল উপস্থিত সকলের বুকে।”

গভীর প্রত্যয়ে সেই শিল্পী পরপর শোনালেন ‘নাইয়া রে, সুজন নাইয়া’, ‘ললিতে কার লাগি আসিয়াছি কুঞ্জবনেতে’, ‘ভাল কইর‍্যা বাজান গো দোতারা’ …। ভাটিয়ালি থেকে ধামাইল, ধামাইল থেকে সারি গান, ভাওয়াইয়া।

গান শেষ হলে মানবেন্দ্র গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন সেই অখ্যাত বাউলকে। এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে জীবনেও আর ভাটিয়ালি গান গাওয়ার ধৃষ্টতা দেখাবেন না। কারণ জীবনের অভিজ্ঞতা আর অন্তরের টান ছাড়া কাদামাটিমাখা পল্লিগীতি গাওয়া অসম্ভব।

সেই অখ্যাত বাউল আর কেউ নন, তিনি আমাদের বাংলাদেশ তথা সিলেটের সুনামগঞ্জের বেহেলি গ্রামের বিবাগী বাউল নির্মলেন্দু চৌধুরী।

ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া আর সিলেটের ধামাইল গান পুঁজি করে অখণ্ড ভারতের লোকসংগীতকে দিয়েছিলেন তিনি ভিন্ন মাত্রা। কাজ করেছেন ঋত্বিক ঘটক, হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং গণনাট্য সংঘে। জয় করেন পদ্মভূষণ পুরস্কার।

… …

অসীম চক্রবর্তী

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you