বছর কয়েক আগে একবার আমার শখ হয়েছিল গ্রামের পুজো কেমন হয় দেখতে যাব। অনেক কথা শুনেছিলাম। পুজো হয় সনাতনী পদ্ধতিতে। মূর্তি গড়া হয় গ্রামবাংলার চিরায়ত ঢঙে। দুর্গার মুখ দুর্গার মতোই দেখতে হয়। চিত্রতারকা সুচিত্রা সেন বা রেখার মুখের ছাঁদে গড়া হয় না। ঢাকঢোল বাজে, মাইক বাজে না। রাত কাবার করে যাত্রার অনুষ্ঠান হয়, কবির লড়াই হয় ইত্যাদি। এইসব দেখবার উদ্দেশ্য নিয়ে এক অষ্টমীর দিন আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম। ইলামবাজারের কাছে পায়ে হেঁটে কম করে দশ-বারোটি গ্রামে ঢুকলাম এবং বেরোলাম। চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না — কোথাও উৎসবের চিহ্নমাত্রও নেই। কোথাও কোনও পুজোমণ্ডপ নেই, কোথাও নেই সাজপোশাক করা নরনারী-শিশুর ভিড়। সাধারণ অবস্থায় নিজের গবেষণার কাজে ওইসব গ্রামে আগে অনেক ঘুরেছি। সেই অবস্থায় পথেঘাটে মানুষজন যেরকম দেখেছি অষ্টমীর দিন তার তুলনায় মরুভূমির মতো খাঁ-খাঁ করছে সব। খোঁজ নিয়ে জানলাম, গ্রামের লোক সব বোলপুরে গিয়েছে পুজো দেখতে। প্রায় একই অভিজ্ঞতা হলো পরদিন আরেকটি অঞ্চলে। সিয়ান গ্রামের লাগোয়া পাঁচ-পাঁচটি গ্রামে ঘুরে একই চিত্র দেখলাম। নবমীর দিন — কিন্তু উৎসবের আনন্দ দূরের কথা, সাধারণ যে-কোনও দিনের চেয়েও অনেক বেশি যেন নিরানন্দ চতুর্দিকের আবহাওয়া। এক-আধজন লোক মলিন বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তফাতের মধ্যে হঠাৎ এক জায়গায় একটা ছোটখাটো জনসমাবেশ পাওয়া গেল। একটার পর একটা পাঁঠাবলি হচ্ছে। ভিড় করে সকলে তাকিয়ে তাকিয়ে সেই বীভৎস দৃশ্য দেখছে। কিন্তু তাদেরও চোখে-মুখে পোশাকে-আশাকে আর যা-ই থাক উৎসবের আনন্দের কোনও ছিঁটেফোঁটা ছাপও নেই। অনাহারক্লিষ্ট মলিন-বেশ দুঃস্থ কিছু ব্যক্তি অসুস্থ কৌতূহল চরিতার্থ করছে। এরপর আমি অন্যান্য জেলাতেও পুজোর সময় গ্রামে ঘুরে দেখেছি। সর্বত্রই একই নিরানন্দ চিত্র। খোঁজখবর করে কোনও কোনও বড় গ্রামে পুজোর সন্ধান পেয়েছিলাম। তাদের অধিকাংশ সার্বজনীন নয়, পারিবারিক। কোনও বড়লোকের বাড়িতে বড় প্রতিমা। কোনও অসচ্ছ্বল পরিবারের আঙিনায় শুধু ছবি দিয়ে কাজ সারা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিমা একেবারেই একা পড়ে রয়েছে। হয়তো-বা এক-আধজন পুরুত আছেন। কিন্তু ভিড় করে উৎসবের সাজে সজ্জিত নারী-পুরুষ-শিশুর ভিড় কোথাও নেই। গ্রাম ছেড়ে যখন আঞ্চলিক শহরে প্রবেশ করেছি তখন অবশ্যই অন্য চিত্র। চোখ-ধাঁধানো নিয়নবাতি, কান-ফাটানো হিন্দি গান, রাস্তায় সুসজ্জিত নরনারীর ভিড়ে পথ চলা দায়। অলিতে গলিতে আনাচে কানাচে এক বর্গমাইলে চার-পাঁচ-ছটা করে পুজোর মণ্ডপ। কলকাতার সঙ্গে এই ব্যাপারে তাল রেখে চলেছে মফস্বলের শহরগুলি।
আমরা বাস করি শহরে, গ্রাম নিয়ে কথা বলি। কিন্তু গ্রামের খবর কতটুকুই-বা রাখি? গ্রামবাংলা থেকে পুজো জিনিসটা উঠেই গিয়েছে, এতবড় একটা খবর আমার সম্পূর্ণ অজানা ছিল। অনেককাল পূর্বে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, সমস্ত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে সব রক্ত এসে যদি মুখে জমা হয় তো তাকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলা যায় না। তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সবকিছুর কলকাতায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা বলছিলেন। কিন্তু তখনও বোধহয় দুর্গাপুজোর মতো একটা লোকউৎসব গ্রামজীবন থেকে তিরোহিত হয়নি। তখনও লেখা হয়েছিল, “আনন্দময়ীর আগমনে, আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে।”
শরীরের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমা হলে তাতে যেমন মুখের সৌন্দর্য অবশ্যই বৃদ্ধি পায় না, তেমনই গ্রাম ছেড়ে দুর্গাপুজো জিনিসটা কলকাতায় ও অন্যান্য শহরে জড়ো হয়ে যে ফলপ্রদান করছে তা নিতান্তই অশুভ ও অসুন্দর। সত্যি কথা বলতে, পূজা বলতে এখন যা হয় তাকে কোনও মতেই লোকউৎসব বলা যায় না, বলতে হয় গণব্যভিচার। দোলও তো একসময় একটি সুন্দর উৎসবই ছিল। এখন হোলিতে পর্যবসিত হয়ে তা এমনই বিকট বিশ্রী আকার ধারণ করেছে যে সেদিন কোনও সভ্য ভদ্র মানুষ পথে বের হতে সাহসই পায় না। কোনও মহিলার তো বের হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, ভুলক্রমে কেউ বের হলে তাকে যে অশ্লীল দৈহিক অত্যাচার সহ্য করতে হয় তা ভয়াবহ।
দুর্গাপূজা এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। কিন্তু সেই পথেই চলেছে। পাড়ায় পাড়ায় পূজার আয়োজন করার ভার গ্রহণ করে যে তরুণেরা, শিক্ষাদীক্ষা-ধর্মবোধ এইসব কিছুই তাদের প্রেরণা নয়। যে-কোনও পাড়ার লোককেই সন্ত্রস্ত করে রাখে যে-সম্প্রদায়, তারাই নেয় এই ব্যাপারেও অগ্রণী ভূমিকা। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন যারা তারা প্রায়ই হয়ে থাকেন স্থানীয় রাজনৈতিক কেষ্টবিষ্টু, যাদের চরিত্র সম্বন্ধেও যত কম বলা যায় ততই ভালো। পুজোর চাঁদা তোলার নামে পীড়ন এমনই আকার গ্রহণ করেছিল যে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। এই হস্তক্ষেপের ফলে পীড়ন হয়তো আরও বেড়ে যেতে পারছে না। কিন্তু যে-টাকা তোলা হয় তার যে কত প্রকার অসদ্ব্যবহারই হয় তা কারও অজানা নয়। প্রতিমা, প্যান্ডেল, পুরুত প্রভৃতির উপর যে খরচ হওয়ার কথা তা হওয়ার পর অজ্ঞাত পরিমাণ অর্থ আয়োজনকারীদের কারও কারও মধ্যে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে তার হিসেব জানা না-থাকলেও ঘটনাটি যে ঘটে তা অনস্বীকার্য। এই অসদ্ব্যবহার বাদ দিলেও প্রতিমা, প্যান্ডেল প্রভৃতির উপর যে-খরচটা প্রতিবছর করা হয় তা সমাজের সম্পদের এক বিপুল অপচয় সূচনা করে। এখন যত শত শত পুজোর প্যান্ডেল খাটানো হয় উৎসবের জন্য তার যে কোনও প্রয়োজনই থাকতে পারে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বিপুল অর্থের এই প্রকার অপব্যবহার না করে তা যদি জনহিতকর কাজে ব্যয়িত হতো তো তা সমাজের সুস্থতার সূচনা করত। দেশে কত পার্টি, কত গণসংগঠন, যারা কত তুচ্ছ বিষয়কে উপলক্ষ করে কথায় কথায় রাজ্যময় ‘বনধ্’ ডেকে নাগরিক জীবনকে অচল করে দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই অপচয় বন্ধ করার জন্য কোনও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টাই করা হলো না। পুজোর উপলক্ষে অপচয় বন্ধ করার যে কোনও প্রচেষ্টাই করা হয় না, তার অন্যতম কারণ এ-ই যে, বাঙালি মধ্যবিত্তের মনে পুজোর সময়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে অপচয়ের ঋতু। প্রতি পরিবারে এইসময় পড়ে যায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করার ধুম। ধার করে, কর্জ করে রাশ রাশ শাড়ি কিনতেই হবে, বিতরণ করতেই হবে, এই হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ। আবার ওই একই মধ্যবিত্ত নাকে কান্না কেঁদেই চলবে, তাদের নাকি আর্থিক অবস্থা সঙ্কটের চূড়ান্তে উঠেছে।
সত্যের খাতিরে বলতে হচ্ছে, বাঙালি সমাজজীবনের যত কালিমা আছে তাদের যেমন একত্র সমাবেশ মহালয়া থেকে শুরু করে ভাইফোঁটার দিন পর্যন্ত দেখা যায়, ঠিক তেমনটি বছরের অন্য কোনও সময় দেখা যায় না।
গানপারটীকা : গ্রাম আর শহরের দুর্গাপূজা আয়োজনের মোচ্ছব নিয়া তুলনামূলক অবলোকনের এই গদ্য অশোক রুদ্র লিখেছিলেন নব্বইয়ের গোড়ায়। এইটা বাংলাদেশের গ্রাম বা বাংলাদেশের শহর নয় অবশ্য, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় বাঙালির পূজাকালিক চিত্র এইটা। তাহলে এই গদ্য গানপারে ছাপা হচ্ছে কেন? অত পুরানা স্টাডি, ভিনদেশের তদুপরি, রিপ্রিন্ট করা হচ্ছে একটাই হিডেন মতলব থেকে; — সেইটা আর কিছুই না, বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের পূজাপার্বণ-ঈদ-পূর্ণিমা-রাস-ঝুলন-বড়দিন প্রভৃতি রিলিজিয়াস ফেস্টগুলা আয়োজনের সেকাল-একাল ও কালনিরপেক্ষ অন্যান্য কমন ফেনোমেনা নিয়া গানপারে লেখা ছাপতে চাই। নিজেদের অবদায়ক যারা আছেন তারা খানিকটা ট্রাই নিশ্চয় করবেন, আমরা চাই বিভিন্ন কোণের দেখনদারি-বিবেচনা আসতে থাকবে এবং সব মিলিয়ে একটা আকৃতিক চেহারা দাঁড়াবে দেশের ডিপরুটেড সংস্কৃতির পরিবেশ-পরিবেশনা হালহকিকতের এবং সে-থেকে পাওয়া যাবে একটা সামনাদিনের ছবি। ঠিক কেমন হতে পারে গানপারপ্রার্থিত সেই নিবন্ধ-প্রবন্ধ-রচনা? হাতড়াতে যেয়ে হাতের কাছে ইন্সট্যান্টলি মিলে গেল ‘সমাজে নারীপুরুষ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ শিরোনামীয় অশোক রুদ্রের বই। সেই বই থেকেই রিপ্রিন্টেড এই রচনা। আইডিয়াল কিছু নয়, স্রেফ নমুনা হিশেবে এই নিবন্ধ হাজির হয়েছে গানপারে। এই বইটা পাক্কা দুই দশক আগেকার ছাপা। পাব্লিকেশনতথ্য : সমাজে নারীপুরুষ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, অশোক রুদ্র, পিপলস্ বুক সোসাইটি, কলকাতা, ১৯৯০। — গানপার
… …
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
- সপ্তপদীর দুপুরবেলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় || ইলিয়াস কমল - January 27, 2025
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
COMMENTS