‘ক্যারমের ঘুঁটি আঘাত খেতে-খেতে পকেটে ঢুকে যতক্ষণ না নেটে লেগেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কোনো নিস্তার নেই’ — আলাপ করতে-করতে কথাটি যখন বলেন মকদ্দস তখন তার রূপকায়ত বাক্যটি যেমন বুঝি তেমনি বোঝা যায় তার অন্তরালের অর্থটিও।অন্তরাল মানে দুঃসহ বাস্তব — গানগুলো পড়তে-পড়তে তাঁর কথার বিশেষ ধরনটির কথা যেমন মনে পড়বে, তেমনই মনে পড়বে সংসারের অতিশয় টানাপোড়েনের কথাও।
আমরা পড়ব তাঁর আঞ্চলিক গান। এমনিতে তাঁর অন্য গানগুলো স্বভাবত তত্ত্বমুখী; কিন্তু তাঁর আঞ্চলিক গানগুলো ব্যতিক্রম — যেখানে আমরা সহজেই বুঝতে পারব স্ট্রাইকার বা শোষক/নিয়তি-পীড়িত ঘুঁটির অবস্থা, এবং স্ট্রাইকারেরও আড়ালের অন্য-কারও উপস্থিতি। সেখানে উদাসী হয়ত তাঁর গানটিকে দেহতত্ত্বের ফ্রেমেই বেঁধেছেন, কিন্তু সাধারণত তাতে ব্যর্থতার আত্ম/দেহগত যে হা-হুতাশ থাকবার কথা, এখানে তা দেখা যাবে না। যেমন :
আমার ঘরর মাঝে থাইক্যা আমার ঘরর বান কাটে
গাইলে ছিয়ায় ফালাইয়া রাইতে দিনে বারা কুটে॥
বান(বন্ধন)-কেটে-দেওয়া বা, বারা-কুটে-যাওয়া সত্তার প্রতি যেন আক্রোশই প্রকাশ করা হল, আর ‘আমার ঘরর মাঝে থাইক্যা’ কথাটির মাধ্যমে যে নিজেকে অহংকারের পাত্র করে-ফেলা হয় তাতে প্রচলিত দেহতত্ত্বের গানগুলি থেকে এই গানটি আলাদা মাত্রা পেয়ে যায়।
গানগুলি পড়তে-পড়তে (শুনতে-শুনতে) এমন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, এমন স্বাতন্ত্র্য কীভাবে যুক্ত হতে পারল তাঁর গানে? তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের আলাপের সূত্রে অন্তত এটুকু বুঝতে পারি যে, নানাবিধ অপ্রাপ্তি আর অভাব বোধই এর প্রকৃত কারণ — কখনো তা ক্ষোভের আকার নেয়, যে-ক্ষোভ একার ক্ষোভের হয়েও নিপীড়িত সমাজের/যৌথ ক্ষোভেরই প্রতিনিধিত্ব করে, এবং তা-ই স্বাভাবিক। কারণ তা সামাজিক শোষণেরই নজির, ফলে, তাঁর আঞ্চলিক গানগুলোতে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় যেটা তা হলো তাঁর ইহজাগতিকতা। কখনো তা অভ্যেসবশত তত্ত্বশৃঙ্খলিত হয়ে গেলে অনুষঙ্গের চাপে রূপকটাই হয়ে ওঠে বাস্তব। আমরা তাঁর গানের মধ্যেই দেখি :
আতালিত হামাইছে গাই না ছেনাইয়া নিস্তার নাই রে
দাফনায় উলুন ছইয়া খাইল নাগপেছ লাগাইয়া রে॥
বাছুর বান্ধিয়া থইছে পড়দড়ির মাঝে
হাম্বা হাম্বা কইয়া কান্দে গাই পাইল না খুঁজে রে॥
গানের পরবর্তী দুটি অন্তরায় দেখা যায় আরও ঘনীভূত হয়েছে সংকট, এও হয়ত সেই তত্ত্বেরই ব্যঞ্জনা দেবে, কিন্তু শেষ অন্তরা ও ভণিতা-অংশে যখন দেখব :
লাঙল ভাঙে জোয়াল ভাঙে আর ভাঙে মই
জমিন আমার পতিত রইল কার কাছে কই রে॥
পরার বাড়িত থাকি করি মানুষে কইন দোষী
ধান্ধাবাজি খেইড় খেলাইল মকদ্দস উদাসী॥
পতিত জমিন আর পরার বাড়ি — এমন অনুষঙ্গ অন্য/অধ্যাত্ম ধারণার ইশারা দিলেও আমরা যারা তাঁর দারিদ্র্যতাড়িত উদ্বাস্তু জীবনের কথা জানি, এ-রকম চিহ্নায়নে কি নিঃসন্দেহ হতে পারব?
নিঃসন্দেহ না-হতে পারার পেছনে আরও কিছু কারণও রয়েছে। একদিন চা-খানায় চা খেতে-খেতে, বিষয়সম্পত্তির ক্ষেত্রে ভাইদের কাছে প্রতাড়িত হওয়ার কথা বলতে-বলতে, আমাদের বিস্মিত করে দিয়ে বলে ফেললেন মকদ্দস : ‘পরকাল বলতে সত্যি কিছু নাকি, এসব আগে বিশ্বাস করত মানুষ, এখন এত কিছুর পরও কেউ…’ — এ-কথায় বিস্ময়ের কারণ হলো তাঁর স্বরের দার্ঢ্য, আর বিভিন্ন সময়ে তাঁর অনেক তত্ত্বসংগীত পড়া/শোনা-র অভিজ্ঞতা। তারপরও এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি, তবে তাঁর সাম্প্রতিক গানে যে-প্রবণতাটি প্রধান হয়ে ওঠে সে-সম্পর্কে একটি ধারণা আমরা পেয়ে যাই :
গরিব অইলে মানইজ্জত তার কমি যায়
করজ আইন্যা তাউল্লা আতায়
বেইজ্জত অনল হায় রে হায়॥
অন্যত্র :
খাল কাইট্টা কুম্ভুর হামাইছে
আডুবা পুস্করিনীর মাছ খাইয়া পেট ফুলাইলিছে॥
এই গানের শেষ অন্তরা :
যতসব কুম্ভীরের চেলা আর যত আলাপালা
চিল্লাইয়া ভাঙইন গলা আসলে গিলিলিছে॥
কার লগে কিতা কইতা এখান হক্কলর মাথা
ছাল্লা করইন পলো বাইতা কয় উদাস মকদ্দসে॥
এখানে যে পলো বাইতে চায়, তার/তাদের সঙ্গে শুরুতে-উল্লিখিত স্ট্রাইকারের বা অন্তরালের কারও সাদৃশ্য কি পাওয়া যায়? সে সামাজিক কেউ, না কি অন্য কোনো সত্তা — এ-রকম দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর আঞ্চলিক গানগুলোতে।
মকদ্দস আলম উদাসীর আঞ্চলিক গানগুলো পড়বার আগে উল্লেখ করা জরুরি যে, সুনামগঞ্জ জেলার চরবাড়া গ্রামে, ১৩৫৪ বাংলায় জন্মগ্রহণকারী মকদ্দস আলম উদাসী এ-ধরনের আঞ্চলিক গান লিখেছেন প্রচুর। তাঁর আঞ্চলিক গানের সংকলন প্রকাশিত হলে নানা কারণে সেটি এ-অঞ্চলের একটি মূল্যবান দলিল হয়ে থাকবে বলে আমরা মনে করি।
১
আমার ঘরর মাঝে থাইক্যা আমার ঘরর বান কাটে।
গাইলে ছিয়ায় ফালাইয়া রাইতে দিনে বারা কুটে॥
কই যদি বুঝর কথা, গরম করিলায় মাথা,
দূরে গেলে লাগে ব্যথা, যথা যে ভাবে কুটে॥
দীলে থাকলে কুটিনাটি, মনে রয় কুমতির ঘাটি
মনটারে করিলে খাটি, আন্ধাইর ঘরও চান উঠে॥
মকদ্দস উদাসী হইল, নিজর থইয়া পর ভাবিল
কানে কানে কথা কইল, সব গেল হরির লুটে॥
২
আতালিত হামাইছে গাই, না ছেনাইয়া নিস্তার নাই রে।
দাফনায় উলুন ছইয়া খাইয়া নাগপেছ লাগাইয়া॥
বাছুর বান্ধিয়া থইছে পড়দড়ির মাঝে।
হাম্বা হাম্বা কইয়া কান্দে গাই পাইল না খোঁজে রে॥
দুধ না পাইয়া কাচি বাছুরর হুকাইল গলা।
গৃহস্থে খবর লয় না উদয় হইল বেলা রে॥
কাইত খরি ছয় বলদে ভাঙে খেড়র ভুলা।
হাল জুড়িলে জোয়াল ভাঙে মাথা দিয়া তোলা রে॥
লাঙল ভাঙে জোয়াল ভাঙে আর ভাঙে মই।
জমিন আমার পতিত রইল কার কাছে কই রে॥
পরার বাড়িত থাকি করি মানুষে কইন দোষী।
ধান্ধাবাজি খেইড় খেলাইল মকদ্দস উদাসী॥
৩
খাল কাইট্টা কুম্ভুর হামাইছে।
আডুবা পুষ্কুনির মাছ খাইয়া পেট ফুলাইলিছে॥
মাটির তলে থাকে বাইম, ডরাইয়া ফালায় না আইম।
গাত খুদিয়া রইত চায় কাইম, কৌশলে ধরিলিছে॥
যত সব কুম্ভীরের ছেলা, আর যত আলাপালা।
চিল্লাইয়া ভাঙইন গলা, আসলে গিলিলিছে॥
কার লগে কিতা কইতা, এখানো হক্কলর মাথা।
ছাল্লা করইন পলো বাইতা, কয় উদাস মকদ্দসে॥
৪
বুইঝ্যা হুইন্যা কথা মাতিছ নিজর লেমটি সাবুদ রাইখ্যা।
বেহুদা মাতিছ না তুই আরক বেটির ইতা দেইখ্যা॥
যার তলেদি বাঁশ হামাইব হে তার নিজর খবর পাইব।
মাতলে কার কিতা অনব ইজ্জত রয় না গাইল্যা বইক্যা॥
মামলতর মা সপরি গাছে উন্দুরে বাসা বান্ধিয়াছে।
পরার বুইদ্ধে খালি নাচে কান্ধর মাঝে সোয়ার থাইক্যা॥
মাতলে অউ কয় হারাইদিমু ইকথা কারে বা কনমু
ভাগনা থাকলে আছে মামু পেটর ভেতর আছে পাইক্যা॥
কয় উদাসী মকদ্দসে, ফাল দেখিয়া মুচকি হাসে।
দাফনায় গাইর উলুন চোষে, সুযোগ খুঁজে ঘরও থাইক্যা॥
৫
এ ভবের তুক্কুত খেলায় হইলাম আমি পরাজয়।
কোনখানে লুকাইছে সাথী, খুঁজতে খুঁজতে আয়ুক্ষয়॥
একসাথে ছল করিয়া লুকাইল আমারে থইয়া।
কোন নিগুঢ়ে রয় বসিয়া ভাবতে গেলে ভুতু কয়॥
গুট্টা লাগল নিজর ঘাড়ে কোনোমতে নাহি ছাড়ে।
খবর জানি হাড়ে হাড়ে কেমন করে নিরুদয়॥
গুরুর সকাল চলে গেছে শুভসন্ধ্যা এসেছে।
কয় উদাসী মকদ্দসে বৃন্দাবনে হবে প্রলয়॥
৬
চাচাজি রে কিতা খইতাম মামা ভাগনা ধান্ধাখোর,
ঘরর মাঝে জাগা দিল বিদেশী ছুছরা উন্দুর॥
ওগুদি হগুরে লাগায়, রাইতে দিনে বান কাটায়,
পালার জরও খুইদ্যা ফালায়, বিলাইয়ে মানে ঠাকুর॥
রাইতে দিনে বিষ টানা, কেউ মানে কেউ মানে না,
জানে ইতা আর কুলায় না, ওনে হইলাম নিশাখোর॥
বুঝিতে পারে না লোকে, কাটি কুত্তায় বাড়িত লুকায়,
রুটি যখন পাইলায় মুখে, লেংগুর নাচায় কয় হুজুর॥
মকদ্দস উদাসী হইল, নিজর কথা নিজে কইল,
গাইর বান্ধ দাফনায় খাইল উপাস রয় কাচি বাছুর॥
ক্লিক করুন : মকদ্দস আলম উদাসী নিয়া গানপারে অন্যান্য রচনা
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS