গদ্যগহ্বর ২

গদ্যগহ্বর ২

আসিতেছে অতিকায় ভীতিকর বর্ষার স্বৈরশাসনদিন
আসিতেছে, প্রিয়, অত্যাশ্চর্য বর্ষাকাল আবার
জাগিতেছে, অয়ি, শ্রেয় শত্রু পরাঙ্মুখের প্রেতায়িতা হাসি

এ-জীবনে বর্ষা আমি মর্মমূলে ভুলে যেতে চাই
হৃদয়ে রাখিতে নারি বিতিকিচ্ছা বারিষার দেহবল্লরী
ঘৃণা করে যেতে চাই ঘিনঘিনে রেইনি ন্যাকামি

হিজলের গাছগুলো কোমর-ডোবানো জলে কেলি করে যাক
নৌকা বাঁধা থাক তার নর্তকী নিতম্ব ছুঁয়ে একান্তর কোণে
দেখা দিয়া আবার হারাক দুইগোছা আলোকসজ্জার ন্যায় হিজলের ফুল
ছৈয়ের নিচে মেঘের মতন মখমল বাতাস এসে ভেজাক শরীর
তুলতুলা বাক্যালাপে ভেসে যাক দূরদেশে একাকিনী বিপুলা নারীটি

কিচ্ছুটি যায়-আসে না আমার তাতে, হে বর্ষার দেবতা, আমি নির্বৃষ্টি দিব্যশীতে বাঁচি

কিন্তু আমি, ডিয়ার উইন্টার, বিদর্ভ বর্ষার বদমতলবগুলো বলে যেতে চাই
দিয়া যাই ফাঁস করে তার কূটিল কদম, কুহকিনী বিভ্রম ও বনাচ্ছন্ন ঘনবর্ণা বারিধারাপাত
বিতদ্রু নদীর তীর থেকে বকের পাখনাপালকগুলো টুকিয়ে এনে রেখে দেই নিশাচর তক্ষকের চুলে
এবং অবলীলা খাতার পাতায় তুলি জলস্ফুলিঙ্গগুলো, স্পর্শপ্রবাহের আঁচে ফোটাই বৃষ্টিবিদ্যুৎ
বুড়ো রবীন্দ্রনাথ আর তার বিতানভরতি গীতের কলিগুলো নস্যাৎ করি শীতাভ অক্ষরে

এবং, বর্ষাজাদা বাদশা নামদার, তোমারে দেখাই এবে শেহজাদি শীতের কিছু সুদৃশ্যা হাইলাইট …

.
.
দ্বিধাবাদ্য

দুইটি দ্বিধার স্বর দ্বিধা-থরোথর
দ্বিধায় দ্বিধায় দীর্ণ দ্বিধার প্রহর

দ্বিধার শিখর ভেদি দ্বিধার পাতাল
ক্রমহ্রাসমান এই ধৃতি দ্বিধাকাল

দ্বৈধচূড়া পাহাড়ের দ্বৈধশীর্ষদেশে
দ্বিধাগাড়ি গাড়লের কাশি যায় কেশে

দ্বিধাদোল দোলায়িত দ্বিধাপ্রাজ্ঞগণ
ভানপটু বুকটান দ্বিধাঢ্য স্বজন।

.
.
মাতাল
মাতালের স্খলিত গলার প্লুতস্বর
ফিরিয়ে এনেছে এত ভয়াবহভাবে
আমাকে আমার কাছে এমন নিষ্ঠুর
ভদ্রলোকেদের মতো বমনে-প্রস্রাবে

হেন মধ্য ও মধুযামিনীর কাননে
কুসুমকলিটি হয়ে জেগে-থাকা হাল
আমিটি আমার মধ্যে হেন দোনামনে
ফেটে যেয়ে রাত্রিশীর্ষ সহসা সকাল

অথবা রাত্রিই বুঝি নিমপাখি স্থির
দোরকড়া নাড়ে ভোর ধ্বনিত চৌচির।

.
.
মার্চ মাসে একটা বাজপড়া বার্চগাছ টিভিতে দেখিয়া
আগুন তো দিলায়, হে, জতুগৃহে
এরপর কাঁটাতারে ঘের দিয়া রাখিলায় নিবারিত ফোরাতের কূল

তোমার পালা সাঙ্গ হইল বুঝি, এতক্ষণে, এবে?
(দ্যাখো তো, মরার মামদো ভূতের ছাও, হালায় রাও করে না ক্যা রে!
ব্যাটা আইসা কাকুতিমিনতি কিছু করবি তো যদি বাঁচপার চাস —
তবেই-না পাঠামু অগ্নিনির্বাপক, অবরোধ নিমু তুলি নীল যমুনা-কি-তীর থেকে
যথেষ্ট মর্সিয়ামাতম ধ্বনিত না-হইলে কী আর দাতাহাতিম বিধাতার বধির অঙ্গে বেদন কভু পশে?
ফালা শালারে আগুনকুণ্ডে, নিরম্বু করিয়া রাখ, বানা জিন্দা লাশ
মরুক গে ব্যাটারা, শালি ইসের বিটিরা, থার্ড-ওয়ার্ল্ডের তস্য দাসানুদাস…)

অতএব অধীনের দুর্বিনীত দুরভিসন্ধি ঠিক এইখানে করি বর্ণন :
আওয়াজ না-পায়া ব্যবসা চাঙ্গাতে নিজেগোরই গরজে আসিবেন দাতাগণ
তক্ষুণি, দিকে দিকে, নিকষ অন্ধকার ভেদি নির্গলিব অগ্নিবীভৎস সুন্দর
আমরা, যারা নিরম্বু, অগ্নিবিশুদ্ধ, যথা বাজ-পড়া বার্চগাছ বিদেশভূখণ্ডে —
এবং জড়াইয়া ধরিব যায়া বার্চগাছদিগেরে সম্ভ্রম সহকারে : হে হাতিম, মুঝে বাঁচাও, মুঝে বাঁ…
আর আমাদের শিশু ও প্রসূতি নারীদেরে এ-আহূতির বাইরে রেখে দেবো কড়াকড়িভাবে

টু এনশিউর সাস্টেইন্যাবিলিটি অফ দ্য রেইস …

.
.
কাল্পনিক ঝড়পূর্ব বাস্তবিক অনুবিবরণ
জোর বাতাসে গেল উড়ে ঝমঝম বৃষ্টির সম্ভাবনা। হাল্কা ঘুমের আরামে, অথবা তন্দ্রায়, ছিলাম তলিয়ে, বাতায়নপাশে বিছানায়, বেগবান বাতাসের শব্দে জেগে উঠি হুড়মুড়িয়ে। ত্রস্ত হস্তে জানালাপাল্লা বন্ধ করতে তৎপর হই। বারান্দায় বেরোই। দেখি নারকেলগাছের মাথা মাটিপৃষ্ঠ প্রণমিতে চাইছে প্রাণপণ। অথবা গাছ চাইছে আকাশমুখো দণ্ডায়মান রইতে, পেরে উঠছে না, ডাকু রুস্তমের ন্যায় ভীষণ বাতাস চাইছে চিরউন্নত নারকেলশির নুইয়ে দিতে মাটিতে। আশপাশের ঝুপ্সি গুল্মলতাগুলো, অনতিদীর্ঘ যৈতুনগাছগুলো, আমগাছ-জবাগাছগুলো আছাড়িপিছাড়ি আর্তচিৎকার করে চলেছে। বারান্দা থেকে ফেরার কালে দেখি, সামনের নির্মাণাধীন দালানের  মিস্ত্রীদল হন্তদন্ত গুছিয়ে তুলছেন তাদের দুপুর-অব্দি কৃতকর্মরাজি। কাছে-দূরে একসঙ্গে নানান বরন নতুন-পুরনো মানুষ — চেনা-অচেনার রহস্যালোকিতা মানুষ — রোদে-মেলে-দেয়া কাপড়চোপড় উঠিয়ে নিয়ে চলেছেন সম্ভাব্য বৃষ্টিস্পর্শ হইতে বাঁচাইবার আশে। এক নয় দুই নয়, একসঙ্গে অনেক হাত, ফর্শা হাত শ্যামলা হাত, রৌদ্রবর্ণা মেঘবর্ণা নানান বাহার হাতের ত্রস্ত-ব্যস্ত তৎপরতা, জামা তুলছে হাতগুলো সবাই মিলে বিচ্ছিন্নভাবে ও একলগে। কেউ সম্পূর্ণা গিন্নী, কেউ সদ্য গিন্নী, কেউ আসন্ন গিন্নী, কেউ-বা কিশোরী — ছাদে, ব্যাল্কোনিতে, একতলা বাড়িবারান্দায়, নিচের একতিল উঠোনে, হাওয়ায় হাওয়ায় হাতগুলো উঠছে-নামছে, মৃদু মোমের মতন আলো উড়ছে যেন জোনাকসদৃশ। এইসব দেখতে দেখতে একসময় ফের তলায়ে গেলাম তন্দ্রায়। এই বিবরণ তন্দ্রাজাত। ঝড়পূর্ব কল্পনার বাস্তবিক অনুবিবরণ।

.
.
এমনও দিনে তারে বলা যায়
সমুদ্রসৈকতের রোদ উঠেছে আমার জানালায়। দেখে এসেছি গৃহবাতায়নে, এখানে আপিশের উইন্ডো জুড়ে একই সেই সমুদ্র সুবিস্তীর্ণা। ভাসন্ত, স্বচ্ছ, সুদূরায়ত রোদ। এমন রোদ সবদিন ও সর্বত্র সুলভ নয়। জল আর বালির ওপর রোদ পড়ে যেমন ঝিকিয়ে ওঠে, যেমন অভ্রচকমকি দৃশ্য তৈরি হয়, তেমনি ঝিকানো রোদ উঠেছে আজ। সমুদ্রসৈকতের রোদ, সেইজন্যেই বলছিলাম। আজ গাছে গাছে গানের মতো রোদ ফলিয়াছে। আজি জানালার পর্দা ভরে বেশুমার রোদ গুঞ্জরিত। অল্প ছায়া, কিছু পাখি, কিচিমিচি শব্দ। বর্ণনা শুনে মনে হতে পারে বানোয়াট, মনে হতে পারে বানিয়ে বলা হচ্ছে, লেখার জন্যই লেখা মনে হতে পারে। তা নয়। সত্যি। সত্যি আজ ও-রকম সকাল ছিল। সুরেলা-সুস্নিগ্ধ সকাল। ও-রকমই দুপুর, অল্প গুমট যুক্ত হয়েছে কেবল।

এমনও দিনে তারে বলা যায়? এমনও আমকাঁঠাল-পাকানো জৈষ্ঠ্যগম্ভীর আবহাওয়ায়? না, এমনও দিনে তার সনে ঝগড়াঝাটি ভালো লাগিবে না। তারে বলতে যাওয়া মানেই তো অহেতু ফ্যাসাদ, অহেতু উৎপাত, অহেতুর হেতু উৎপত্তি একের-পর-এক। বয়স হলো আমার, বুড়ো হয়ে গেলেন প্রিয় সুমন ও ডিলান, ভালো লাগে না আর। বরং কাউকে কিছু না-বলে অচেনার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লে হতো। খুব ভালো হতো। এমন দিন এলে এলোমেলো সমস্ত ফেলে নির্জন কোনো উপকূলে যেতে ইচ্ছে করে। অত্যন্ত পরিপাটি ভ্রমণের সাধ জাগে। এমন দিনে সমুদ্রসৈকতে গিয়ে ঢেউয়ের প্রান্ত ছুঁয়ে হেঁটে যেতে মন চায় দূর দূর দেশে।

এমন দিনে আপিশকাচারি ইচ্ছে করে না মোটে। তবু এমন দিনে আপিশেই জবরদস্তিপূর্বক টেনে আনতে হয় শরীর, এনে ঘাড় গুঁজাতে হয় জোর করে টেবিলে, আর কোথাও নয়। এমন দিনে আশমান থেকে তালের রস ঝরতে পারত না? আমরা সবাই রোজগারের এক আজব কলে পড়ে আছি বাঁধা, জন্তুর মতন, হাঁসফাঁস করছি কিন্তু তালরস কোথাও পাচ্ছি না।

ধারা-ঝরঝর বহিবে না আর তারা, আমাদের মনজুড়ানো মুখর চপল বৃষ্টিকিশোরীরা!…

গদ্যগহ্বর ২ ।। জাহেদ আহমদ ।। রচনাকাল ২০১৩ ।। গানপারপ্রকাশ ২০২৪


জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you