গদ্যগহ্বর

গদ্যগহ্বর

কোয়েক্সিস্টেন্স
তুমি পৃথিবীচিন্তক,
বহু পণ্ডিতি দিগগজি হইসে তোমার, হোক
দশটা ব্যাকড্রপওয়ালা ভালো সভায় সেমিনারে চেয়ার
বিশেষত ফরেনার ফরেনার
মনে হয় নিজেরে যেই মিটিঙগুলায়
সেইগুলায় সেল্ফি নিবায় নিজের ক্যামেরায়
এইগুলা পার্ট অফ হিউম্যান ডিজায়ার
একটু উয়্যিয়ার্ড যদিও, মনে হয়, বিজ্যার
আমার কাছে
এর একটা ভ্যালু তো অবশ্যই আছে
সমাজের গাছে গাছে
রেস্পেক্ট না-করে উপায় নাই
তাই
রেস্পেক্ট করি
শিয়ালের শাখামৃগের জবানে লিখি স্টারি নাইটের স্টোরি
নিমগ্ন কন্সেন্ট্রেইট করতে চাই কিছু অপার্থিব অন্বয় এবং দুরান্বয়
পৃথিবীতে একতানে এনে অ্যালাইন করা যদি সম্ভব হয়
আমার বিচারে এরচেয়ে বেশি পৃথিবীচিন্তা আবশ্যক নয়।

.
.
আন্দাজি
পৃথিবী নিয়ে এত ভেবে
কী হবে

সে তো চলতেসে
নিজের নিয়মে
সূর্যের চাইরপাশ ঘিরে
উপবৃত্তাকার পথে—
কেউ তো জানে না তা, আমি নিশ্চয় জানি

কিন্তু তথ্যটা আমি কাউরে জানতে দিচ্ছি না সহসা
কারণ ইনফর্মেশন ইজ পাওয়ার, নট নোলেজ
নোলেজ হইল ভুয়া কিসু বইপত্রের কারবার
আর ইমাজিন্যাশন তো হইল গিয়া আপনার মরার কোকিল

সকলেই জানে না তা, কেউ কেউ এক্কেবারে ভুষিমাল, খালি আমি জানি
পৃথিবী সূর্যের চাইরদিকে অবিরাম ঘুরঘুর করে, উপবৃত্তাকারে

তবু এত লোক, উজবুক, এত প্রতিষ্ঠান
পৃথিবী নিয়া ভাবছে, ভেবে মরছে
আর দেদার মালকড়ি গুনছে
আর বাজাচ্ছে বারোটা তার

হায়, জীবনানন্দ দাশের মুখ মনে পড়ে যায়, পৃথিবী!

দি বিশ্বব্যাংক যদি এই পদ্যপ্রস্তাবনা পাঠ সত্ত্বেও
তহবিলপ্রবাহ ন-যোগায় আমারে
তাইলে-যে পৃথিবীর কী হবে—

এর বেশি কিসু বলতে গেলাম না আর।

.
.
স্বপ্ন
মাটি থেকে উঠে আসছে
ফুঁসে, ফুঁড়ে, রুদ্র রোষে
শত শত স্বপ্নের চারা

আগাছার মতো গজাতেসে
ফাঁকে ও ফোকরে, আশেপাশে
তরুবর ধামাচাপা দিবার পাঁয়তারা

.
.
উড়ি

কোথা যাও
পাখি!
যাচ্ছটা কোথায়!

আর যাবাই-বা কই!

জায়গার অভাব নাই বিধাতার দুনিয়ায়
কেবল যাওয়ার জায়গার অভাব

নাই যেহেতু, স্থলভূমি, অবতরণপোত
তো চলো, উড়ি আসো, যাই
উড়ে বেড়াই —

লেট্’স্ ফ্লাই!

.
.
স্বপ্নউড়ি
স্বপ্নে যেহেতু উড়ব অতএব স্বপ্নেই উড়ি
ঘুড়ি
ঠিক যেভাবে বেড়ায় উড়ে

একটা কাঁটালেম্বুগাছের লগে ধাক্কা লেগে
ধড়ফড় উঠি জেগে

ব্যাকপকেটে
ছেঁড়া ওয়ালেটে
একটা পাঁচটাকার নোট রাখসিলাম স্কচটেপে মুড়ে।

.
.
দুপুরবেলার কলার পাতার ভিতর দিয়া জানালামাঠের ব্যাপ্ত ক্ষেতে আলোর বাম্পার ফলন
কলাপাতা আদতে একটি ফিল্টারিং পেপার
রৌদ্রালোক যখন এর ভেতর দিয়া আসে
এসে যখন বসে আমার বিছানাচাদরের ব্লকপ্রিন্ট ঘাসে
কেমন মেথিশাকের ন্যায় মৃদু মখমল ও মায়াময় হয়ে ওঠে ভুবনচরাচর
ভুলিয়া যাওয়া যায় বেদনাবৃন্দের হুলুস্থুলু হননবিলাস
এর সনে ওর সনে ঠেলাধাক্কা-কনুইক্রিয়া খানিক ভুলিয়া যাওয়া যায়
এসব সম্ভব হয় কেবল কলাপাতা-ফিল্টার্ড আলোঝরনাধারার ধুম দুপুরবেলায়

পদ্মায় ইলিশের মতন রোদ্দুরে কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ—
সেই-যে এক গল্প করসিলেন হাসান আজিজুল হক
এরপর থেকে সেই দর্পিত রৌদ্রবাতাসের দুপুরটা আসনপিঁড়ি জানালায়
এই আমার একলা-একা ধান্যবরন শোলক-বলার দগ্ধ দুপুরবেলায়

এইসব দেখা যায়, গেল দেখা এইসমস্ত, চৈত্রসুবাদে এই মিহিসুর দুপুরের কলাপাতাবাতায়নে
বসিয়া বিজনে
ব্যথাহীন, কথাক্লান্ত, শক্তির কবিতার মতো পরাঙ্মুখ।

.
.
স্তন
পৃথিবীটা হতো যদি স্তনের মতন স্নিগ্ধা ছায়াময়!
বেঁচে-থাকাটা হতো যদি স্তনাশ্রয়ী, শীতের দুপুর যথা, যাতনাবিহীন!

খড়ের পালান দেখে, কুমড়ার জাংলা দেখে, থানকুনিবিথার দেখে
কেটে যেত কনকবর্ণিল ঘড়ি-ঘিরে-থাকা লাইফ ও লিভিং

হাঁসজিভে শামুকমাংশের স্বাদ
যেন সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন মুখস্থ সন্ধ্যা ও চাঁদ

স্তন, সমস্ত ডিস্কোর্স শেষে, শান্তিচিহ্ন বলে বিবেচিত হোক!

.
.
পাখিনিবন্ধ
পাখির উড়িবার আকাশ কই — এই দুনিয়ায় —
এইখানে সঙ্কুচিত ক্রমশ তাদের ডানা, তাদের বিস্তার, হিম তাদের পালকপরিধি

কিন্তু কথা ছিল পৃথিবীটা পাখিদের অভয়ারণ্য হবে —
কে দিয়েছিল কথা, কার কাছে, কোথায়

এই এক হ্যাপা আজকাল, কথায় কথায় এভিডেন্স তলব, প্রমাণ দাখিল, ডিফেন্ডেন্ট, প্লেইন্টিফ —
বিলিভারদের কব্জা থেকে ভুবন চলে গেল ননবিলিভারদের বগলতলে

তাতে করে পাখিদের তো পোয়া-ছটাক ফায়দা কিছু হইল না
আস্তিক-নাস্তিক, বেজায় যাদের বক্তৃতাবাতিক, স্তাবক ও তার্কিক —

গাবগাছের সঙ্গে আমড়াগাছের ঝগড়া, বাতাসের সনে বেলপাতার ফ্যাসাদ

অথচ হইলেও হইতে পারত পৃথিবীটা বার্ড-স্যাংচ্যুয়ারি
উড়লেও উড়তে পারত পাখিরা আকাশ উতল উজালা করে

লেকিন ব্রো, ঔর বেহনো, নো, ভুবন ভ্রমিয়া শেষে এই সিদ্ধান্ত বুনিয়াছি ইহা পাখিবিরুদ্ধ সভ্যতা
আর এমনকি মূক ও বধির সংঘের সভ্যরা জানে এইটা হয় দিন-বদলের কাল

পাখি কিংবা বিহঙ্গ তো মূকাভিনয়শিক্ষার্থীর কাছে একতুড়ি একটা মুদ্রা মাত্র

তো, দিন-বদলের কালে পাখিদের জন্য কারো কোনো মাথাব্যথা নাই
ব্যস্ত সবাই দারিদ্র্যবিমোচন নিয়া

আর শীতে এবার ভালোই শীত পড়েছিল
পরিযায়ীদের আনাগোনা মনে হয়েছে যেন গতবারের চেয়ে ঢের কম

মুসল্লিদের সমাগম, তুরাগতীরে, বেড়েছে দেড়গুণ
লোকজনের প্রস্রাবপ্রবণতা আর পায়খানাহার ব্যস্তানুপাতিক বেড়েছে — অ্যাকোর্ডিং টু দ্য ওয়ার্ল্ড ইজতেমা রিপোর্ট

আমাদের বসতসংলগ্ন ভিটাবাগানের রবিসব্জি হয়নি এবার
মাটি শুকাইবারও ফুরসত পায়নি, শিশিরের কুয়াশার রাহাজানিতে কেটেছে একটা আচ্ছন্ন ঋতু
ফলে টোম্যাটোতরু জন্মায় নাই সুপুষ্টু সুফল

সমাসন্ন বর্ষাকাল, লেট্’স্ সি, শীতের অচরিতার্থ গান বরিষায় যায় কি না গাওয়া
দেখে যাই যেন দেখে যাই ওগো জন্মতরণী বাওয়া।

.
.
ফ্রাইডে ফ্রিডম
হন্তদন্ত হুড়োহুড়ি আর
হাপিত্যেশের পর
হপ্তাশেষে একটি দিনের
একটুকু অবসর

ছয়দিন যায় ছয়শ প্রকার
শয়তানি করে সয়ে
একটিই দিন তোমার-আমার
থাকুক আপন লয়ে

আপনার করে লভিয়াছি এই
একটামাত্র দিন
বাকি দিনগুলো কোনোটারই নেই
এমনটা ভায়োলিন

সুরে বাজিবার জন্যে এসেছি
সুরের সমুদ্দুরে
এমন মানবজনম পেয়েছি
সুরে ভাসিবার তরে

পেয়েছি এমন পরাবাস্তব
প্রভাত ও অপরাহ্ন
জন্মে দেখেছি হেন তাজ্জব
ঘাসফুল-ধনধান্য

ফুটিয়া আছে দেখিয়াছি শীতে
শিমের গাত্রে শিশির
বসন্তে প্রেম ধরিয়েছে চিতে
বিরহের ঝিরিঝির

চলিছে জীবন জড়াজড়ি করে
ছয়টি ঋতুর সনে
ঝিলিকিয়া ওঠে প্রহরে প্রহরে
ছেলেবেলা তনুমনে

বহতা আমার সপ্তাহব্যাপী
সশব্দ সংসার
অ্যাট উইকেন্ড একটিই হ্যাপি
সুনীল শুক্রবার।

.
.
নচিকেতা
হারতে হারতে জিতে যাই আমি
জিততে জিততে হারি
দ্বিখণ্ড করে নেবে মোর দেহ
নাই হেন তরবারি

তিলে তিলে আমি পৃথিবী চিনেছি
তিফিল শিশুর মতো
কত অজানারে এনেছি ধরায়
ফুল ফুটিয়েছি শত

নহে মহীয়ান আমা’ হেন কোনো
মন্ত্রী-মোটরবণিক
আখেরে আমারই শির উন্নত
কোণঠাসা সাময়িক

কত-না কাতেল কত কৃপাময়
কত জিও-এনজিও
দেখিলুম কত কুসীদজীবীর
গলেতে উত্তরীয়

হেরিনু কত-না গরজিগুমরি
রাজা যায় রাজা আসে
কত-না ধর্মাবতারের মন
দাঙ্গা বাঁধায়া হাসে

এতকিছু রোজ ঘটে এ-জগতে
এত বক এত ব্যাং
বাছুর-ছাগির নৃত্যলহরী
বকনাভূতের ল্যাং

পড়ে যেতে যেতে পেয়ে যাই পাখা
পুনরায় পিছলাই
মুখ-থুবড়ানো ভূমিতে বেহাল
আবার উঠে দাঁড়াই

যদিবা গহন রাতের ভুবন
তারা নাই নিশাকাশে
বিপত্তারিণী তারা খুঁজে পাই
স্মৃতি আর ইতিহাসে

এইটুকু শুধু মনে রেখো মম
সংক্ষেপে সংহিতা
আমি নচিকেতা আমা’ তরে নহে
কবর কিংবা চিতা।


গদ্যগহ্বর  ।। জাহেদ আহমদ ।। রচনাকাল  ২০১৩ ।। গানপারপ্রকাশ ২০২৪


 

COMMENTS

error: