হলদে ডানায় স্মৃতিভ্রমণ || নিবেদিতা আইচ

হলদে ডানায় স্মৃতিভ্রমণ || নিবেদিতা আইচ

কথাসাহিত্যিক সাগুফতা শারমীন তানিয়ার ‘কনফেশন বক্সের ভিতর। অটাম-দিনের গান’ পড়ে ভেসে বেড়ালাম স্মৃতির পালক গায়ে জড়িয়ে, ম্লান হলদে ডানার পাখির মতন।

“প্রায় অন্ধের মতো আমরা জীবন হাতড়াই — বুঝতেই পারি না জীবন হাতির শুঁড়ের মতো — না দাঁতের মতো — না লেজের মতো।’ পড়তে পড়তে মনে হলো সত্যিই কী অদ্ভুত অস্পষ্টতা নিয়ে জীবন ফুরিয়ে যায় চোখের নিমিষে!”

“আমার অত ভালো লাগছিল কেন? তুম পুকার লো। কে আমাকে ডেকে নেবে? (ঠিক তার কদিন আগে পল নিউম্যান আমাকে নারীতে পরিণত করেছে অযথাই।) এইবার অযথা ভালো লাগার শুরু, অযথা কুলকুল করে শরীর ভরে ওঠবার শুরু।”

তখনো ঝুমুর মেয়েবেলা শুরু হয়নি। মুভি অফ দ্য উইকে ছবি দেখে বুঝবার মতন পরিপক্বতা আসেনি। তবু পুরুষের হাসির জলে ধুয়ে ওঠা ভ্রুকুটি আর হাস্যরেখা তাকে সেদিন অধীর কোনো অপেক্ষায় ডুবে যেতে দিলো। কী অদ্ভুত সরল এক স্বীকারোক্তি যা খুব অপরিচিত কিছু নয়। পড়তে পড়তে ভেবেছি এমন কোনো-এক ফিরোজারঙের বিকেলে আমিও শুনেছি — ‘তুম পুকার লো’ আর অপেক্ষা করেছি কেউ হয়তো আমাকে ডেকে নেবে!

আমার ভালো লেগেছে ক্রতুকে। সত্যি বলতে ক্রতুকে আবিষ্কার করার পর বেশ রোমাঞ্চ বোধ করেছি। কারণ ঝুমু কিংবা ক্রতু কে তা বুঝে উঠতে কিছুটা অপেক্ষা করতে হয়।

ক্রতুর প্রতি রঞ্জুর অনুভূতিটা যাতনাময় অথচ কী তীব্র আবেগের।

“ক্রতু একটা মোরগজবা ফুল খুঁটতে লাগল, পোস্তাবাঁধানো দেয়ালে হেলান দিয়ে। শেষ বিকেলের আকাশে একপোঁচ মেঘ ছিল, মেঘের রঙ ঝিনুকে।”

খামখেয়াল আর ‘প্রভিনশিয়াল সারল্য’-র সাথে ক্রতুর চরিত্রে যে অন্যমনস্কতা, ক্রতুর অপমান গিলে নিয়েও রঞ্জুর মাথার ভেতর কৃষ্ণচূড়ার আলো জ্বলে ওঠা অন্যরকম সুন্দর।

“আমি যাকে খুঁজছিলাম তুমি সে ছিলে না রঞ্জু, দুঃখজনক কিন্তু এটুকুই শুধু — তুমি সে ছিলে না। আমি তো খেলতে চাইনি, পরিত্যাগ করেছি কেবল।”

তারপর একদিন ঝুমু কিংবা ক্রতুও ব্রিফ মাইন্ডফুলনেস রিল্যাক্সেশন প্র‍্যাকটিস করতে করতে এভাবে রঞ্জুকে ভাবে৷

রঞ্জুর হৃদয়টা সদা ক্ষুণ্ণ আর একরোখা ঘোড়ার হ্রেষার মতন তার ভেতরটা ফুঁসিয়েছে অনবরত। ফাদার জো.-এর প্রতি তার মায়ের যে আবেগ তা নিয়ে রঞ্জু ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু সে কাব্যিক, প্রতিভাবান আর বেমালুম উদাসীন। হয়তো এ কারণেই যে রঞ্জু জানত না প্রেম এক ‘অনচ্ছ মন্ডলী’, মায়ের চরিত্র নিয়ে যার ক্ষোভ ছিল আশৈশব সেই রঞ্জুই পরবর্তীতে প্রেমকে সংজ্ঞায়িত করেছে ‘হঠাৎ আবিষ্কার করা ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত’-এর মতন।

রঞ্জুর মা ফরহাত বানুর চরিত্রটি আমার চোখে নিঃসঙ্গ সম্রাজ্ঞীর মতন। আটপৌরে সংসারে তিনি ভেসে থাকতেন অনাগ্রহে অথচ তিনি অনাদর করেননি কাউকেই৷ সবার মাঝে থেকেও একাকী ছিলেন! এই মাষডালের বড়ি ছাদের রোদে দিচ্ছেন, তেওহারের দিন জর্দা বানাচ্ছেন। তারপর একসময় লিখতে বসেছেন বেগম  পত্রিকায়। জরিপাড় কাতান গায়ে জড়িয়ে তিনি অর্গান বাজাচ্ছেন আর গাইছেন অনুচ্চ স্বরে। কখনো আবার সব ফেলে রেখে ঘোরতর সংসারী হয়ে উঠলেন। আমি তাকে দেখতে পেয়েছি প্রতিবারই। “সামাজিক মন এত বকিতেছে, চরিত্রহীনার মানবিক মন — প্রাণীজ মন একেবারে কলাপ মেলিয়া দিয়াছে। মেঘ ঘনাইছে পাহাড়ে পাহাড়ে।” শেষদিকে ‘কর্তব্যপরায়ণা’ ফরহাত বানুর এই কনফেশন পড়ে বিষাদগ্রস্ত হয়েছি।

এমন কিছু স্বীকারোক্তি নিয়ে ‘কনফেশন বক্সের ভেতর। অটাম-দিনের গান’ বইটি পাঠ শেষে ঝরাপাতার দীর্ঘশ্বাসের অনুভূতি রেখে গেছে। সাগুফতা শারমীন তানিয়ার গদ্যভঙ্গি আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছে। তার অন্যান্য বইগুলোও নিবিড়ভাবে পাঠ করব বলে অপেক্ষায় আছি।


উপন্যাস  : কনফেশন বক্সের ভিতর । অটাম-দিনের গান
লেখক  : সাগুফতা শারমীন তানিয়া
প্রকাশক  : ভাষাচিত্র
প্রকাশকাল  : ফেব্রুয়ারি ২০১০


… …

নিবেদিতা আইচ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you