খুবই অস্থির সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা। চারদিক শুধু দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর প্রতিহিংসায় ঘেরা। চারদিকের চাঞ্চল্যকর যত অবনমন দেখে মাঝেমাঝে এত হতাশ লাগে যে মনে হয় একটুখানিও পরিবর্তন হয়নি আমাদের আদ্দিকালিক মানসিকতার। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেবল নিজেদের আখের গোছানোর ব্যস্ততা আর বেহদ্দ ক্ষমতার লড়াই। বিতিকিচ্ছিরি এই বর্তমানতায় জীবনাবসান হলো আমার আকৈশোর-আযৌবন গানশোনা মাতাল দিনের আরেক নায়কের। চলে গেলেন প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী বাংলা হার্ডরকের রাজা আইয়ুব বাচ্চু। চলে গেলেন এত অকস্মাৎ এবং এত অল্প বয়সে! মাত্র ছাপ্পান্ন হয়েছিল বছরের গণনায় তার বয়স, দেখলাম সংবাদতথ্যে। শরীরের বয়স কি অত হয়েছিল? মনের? মঞ্চে যখন গাইতেন, বা টিভিশোতে, মনে তো হতো না তারে জরা এসে পাকড়াও করছে। এত অকস্মাৎ তবু চলে যেতে হলো।
প্রবাসে থাকি। কিন্তু মন পড়ে রয় দেশের ভালোমন্দে। সেঁটে রাখি চোখ বাংলা চ্যানেলের খবরদৃশ্যে। এই কয়দিন ধরে কেবল দেখছি দেশের হোমরাচোমরা রাজনীতিবিদ-সংস্কৃতিবিদরা আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুখবরে ব্যাপকহারে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। অথচ জীবদ্দশায় এদের বেশিরভাগেরই মুখে এবি শিল্পী হিশেবে স্বীকৃতিটাও পান নাই। কী আশ্চর্য! রকার আইয়ুব বাচ্চু নিশ্চয় চিরনিদ্রায় শুয়ে থেকে এইসব তামাশা দেখছেন আর মুচকি হেসে সুখ গ্রহণ করছেন! হায়! কী স্যেল্যুকাস! এই ধরাধামে মৃত্যুই জীবনের অবধারিত অংশ, মৃত্যুটাকে সারাক্ষণ কাঁধে নিয়ে চলতে হয় আমাদের। আবার এই কাঁধে করে নিয়েই একদিন চিরনিদ্রায় শায়িত করতে হয় কবরে বা কাঠকুটো জড়ো করে পোড়াতে হয় শ্মশানে। কিন্তু অনেক মৃত্যুসংবাদ মন থেকে মেনে নেয়া যায় না, কিছুতেই কষ্ট দমন করা যায় না, মন শুধু ডুকরে কেঁদে ওঠে। এবির মৃত্যু তেমনই নিঃসঙ্গ ক্রন্দনের মৃত্যু।
সংগীতশিল্পীদের চলে-যাওয়া মানে আমাদের জীবনের একেকটা পার্ট চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। আজম খান চলে গেলেন, তারপরই লাকী আখান্দ। এইবারে গেলেন আইয়ুব বাচ্চু। ওরা আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে আমাদেরই লাভ হতো। আরো কিছু হৃদয়চেরা গান শুনে মনটারে অক্সিজেন জোগাতে পারতাম আমরা। তা হলো না আর, পোড়া কপাল আমাদের। “সেলাইছাড়া শাদা কাপড় / হবে সবার একই সাজ / থাকবে না রে রঙিন বোতাম / রঙিন সুতোর কারুকাজ” … “এই রূপালি গিটার ফেলে / একদিন চলে যাব দূরে” … “আরো বেশি কাঁদালে / উড়াল দেবো আকাশে” … এমন সমস্ত মনখারাপ-করা অভিমানী গান গেয়ে গেয়ে এই অসময়ে চলে গেলেন উপমহাদেশীয় রকগানের এই কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু।
যদিও রকগানে তিনি আমার প্রথম পছন্দের ছিলেন না, তবুও তার অনেক গান ও গিটারের সুরে মনটার ভিতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠত। মন দিয়ে শুনতাম। সেই ফিতার যুগে, যখন হাইস্কুলে পড়ি। ওই সময়টা ছিল উড়নচণ্ডি। তখন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব কিংবা মুঠোফোন কিছুই ছিল না। অবসর সময়ে প্রচুর গান শুনতাম। বাউল-রবীন্দ্র-লালন। রক বলতে কেবল জেমস্। সম্ভবত ২০০১ সালে আইয়ুব বাচ্চুর ‘কষ্ট’ ক্যাসেটটি প্রিয়মানুষটির কাছ থেকে গিফট পাই। খুলে মনখারাপ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। আরো কিছুক্ষণ পড়ে মনে-মনে ভাবলাম, আচ্ছা, একটু শুনে দেখি যেহেতু সে দিয়েছে। প্রথম গানটি “কোনো সুখের ছোঁয়া পেতে নয় / নয় কোনো নতুন জীবনের খোঁজে / তোমার চোখে তাকিয়ে-থাকা আলোকিত হাসি নয় / আশা নয় / না-বলা ভাষা নয় / আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি / তাই তোমার কাছে ছুটে আসি” — এই গান শুনে আমি অনেকটা সময় চুপচাপ ছিলাম। আর সেই থেকে রকগানে জেমসের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চুও প্রিয়দের মধ্যে হয়ে গেলেন।
এত দ্রুত কেন-যে প্রিয় মানুষজন চলে যায়! ভাবলে মনটা ভারী ও অবশ হয়ে যায়। সবকিছু যেন স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময়ে তার, আইয়ুব বাচ্চুর, আরো কিছুদিন মিউজিকে নিরীক্ষায় থাকা দরকারি ছিল। কিন্তু না-ফেরার দেশে চলে গেলেন নোটিসছাড়া। প্রায় চার দশকের মতো একটানা গান বেঁধে গান গেয়ে সারাদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে এবি বিদায় নিয়েছেন। আইয়ুব বাচ্চুর না-বলা কথাগুলো অন্যদের গানে কষ্টের ফুল হয়ে ফুটুক গিটারে। এবির সুর ও সংগীত আগামী দিনের নতুন নিরীক্ষার বাংলা গানে, রকগানে এবং অনামা আনকোরা ধাঁচের গানে, পুষ্টি জুগিয়ে যাবে।
এবি, প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু, আপনি ভালো থাকুন। সংগীতসিক্ত থাকুন। সমাগত-অনাগত গোটা বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে এতদিন দূর থেকে এতটা ভালোবেসেছে, আপনার চিরপ্রস্থানের যাত্রায় সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে মানুষ তাদের ভালোবাসা জানাচ্ছে নানান প্রকাশমাধ্যমে। এইখানেও আমিও জানালাম। আমার ও আমাদের ভালোবাসায় আপনি চিরশান্তিতে থাকুন। সালাম আপনাকে।
… …
- ভালোবাসাস্তোত্র || সৈয়দ আফসার - October 26, 2018
- বাউলের এই জীবনধর্ম || সৈয়দ আফসার - March 2, 2018
COMMENTS