খণ্ড খণ্ড রকচিত্র || অসীম দাস  

খণ্ড খণ্ড রকচিত্র || অসীম দাস  

ইন্সট্রুমেন্ট বাজাইবার শখটা আমাদের হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুকে দেখে। এই কথাটা আমাদের জেনারেশনের মেজরিটি ইয়াং মিউজিশিয়্যানের ক্ষেত্রে সত্য। ওভার-জেনারালাইজড হয়ে গেলেও কথাটায় মিথ্যা নাই বোধ হয়। এবির গিটার শুনতে শুনতেই নিজের ভিতরে একটা পাগলপারা গিটারবাদকের ছবি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ যদি না হতো, তবে কেমন হতো তা-ই ভাবি। তবলাটা বাজানো রপ্ত করেছি, হার্মোনিয়্যমটাও সামলাতে পারি, কিছু খোল-করতাল-মন্দিরা বাজাইতে পারা তো দোলনা হইতেই শিখনের অংশ হয়ে এসেছে এই কিছুকাল আগ পর্যন্ত আমাদের হাউজহোল্ডগুলোতে। এতকিছুর পরে গিটারটা আবার কেন! কোথাকার এক বিজাতি জিনিশ, নচ্ছার অপসংস্কৃতি, এই আওয়াজগুলা তো ছিলই সারাউন্ডিংস্ জুড়ে। কিন্তু উপায় ছিল না আমাদের পক্ষে গিটারের দিকে পতঙ্গের মতো ধাবিত না হয়ে। এবি আমাদেরে উন্মাদ করে তুলেছিলেন তার ক্যারিজম্যাটিক বাজনায়।

আইয়ুব বাচ্চু ‘সোলস’-ডিউরিং মিউজিক করেছেন এক-রকম, ‘এলআরবি’-ডিউরিং মিউজিক সম্পূর্ণ আলগ। সোলসের সঙ্গে এবির গাঁটছড়া আদৌ অল্পদিনের নয়, একটা টানা দশক সোলসের সঙ্গে মিউজিক করেছেন। সোলসে এবির মিউজিকে যে-ফ্লেভ্যরটা আমরা পাই তা অনেকটা নাইন্টিসের আধুনিক বাংলা গানের ফ্লেভ্যর। সোলস ব্যান্ডের প্রায়োরিটি অনুসারে এবিকে মিউজিক করতে হয়েছে। বেশ-একটু ব্লুজি, কিছুটা র‍্যেগেই মিউজিকের ব্লেন্ড। পরে ‘এলআরবি’ দিয়া আইয়ুব বাচ্চু নিজের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করা আওয়াজটা মিউজিকটা মাটিপৃথিবীর আলোয় নিয়া আসেন। আমরা বাংলায় হার্ডরকের সাউন্ড পয়লা আইয়ুব বাচ্চুর মাধ্যমে পেয়েছি।

কিন্তু শুরুতে যা ভেবেছিলাম, তা তো নয়। রাস্তায় নেমে দেখি যাত্রা ব্যাপক দুর্গম। ঘটনা হচ্ছে, একজনকে ধরে আঙুল ফাটিয়ে একটুখানি গিটার তো বাজাইতে শিখলাম, এবির গানগুলোতে যে-সাউন্ড সেইটা আমার গিটারের গলা দিয়া বাইরায় না কোনো কসরতেই। তখনই জানলাম যে এবি বলতেই গিটারদক্ষ একটা লোক মনে হলেও এবি আসলে একজন কমপ্লিট মিউজিশিয়্যান। তিনি নিজের মিউজিকটা নিজেই কম্পোজ করেন, ইন্সট্রুমেন্ট অ্যারেইঞ্জিং প্ল্যান করেন, স্যংরাইটার এবং সিঙ্গার তো বটেই। গিটারে নয়, এবির ম্যাজিক তার প্রসেসরগুলা। অ্যাম্পগুলা। মার্শাল অ্যাম্প। মফস্বলে বসে এইগুলার নাগাল পাওয়া সাধ্যাতীত। বাচ্চুর গিটারে যে-সোলোগুলা আমরা শুনতে পাই, সোলোগুলার যে-টোন, এইগুলা সবই ইউনিক। এইগুলা বাচ্চুর নিজের কম্পোজ করা, বাচ্চুর বানানো। মফস্বলে এই টোন কপি করে দেবার কেউ ছিল না, ঢাকায় ছিল। ঢাকায় ‘এলআরবি’-র টোন প্রসেসরে পুরে দেবার বিনিময়ে দেদার ব্যবসা করেছে সেইসময়কার লোকজন। প্রসেসরে টোন ক্রিয়েট করে দেবার বিনিময়ে বেশ ভালো অঙ্কের পয়সা আর্ন করত তারা।

আইয়ুব বাচ্চুর গান ততটা না, তার মিউজিক আমি পছন্দ করে এসেছি সবসময়। মিউজিক কম্পোজার আইয়ুব বাচ্চুর শক্তিমত্তা আমায় বিস্মিত করেছে বেশকিছু কম্পোজিশনে। এবং লিডগিটারে এবির দক্ষতা আমি সমীহ করেছি চিরদিন। যদিও নিজে যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি আমার ভিতরেও সুরের পোকা ঘ্যানঘ্যান করে বেড়ায় সারাক্ষণ না-হলেও যখন-তখন, বাইরে বেরোবার পথ খোঁজে, তখন টিউন করতে গিয়ে দেখি যে আমার লিরিকগুলা হার্ডরকের জঁরায় যাইতে চায় না। আমার কম্পোজিশনগুলার জঁরা আমি নিজে ভেবে দেখি নাই কি হবে। ম্যে বি সাইক্যাডেলিক বলা যেতে পারে, হ্যাঁ, অ্যান এক্সটেন্ট অফ ব্লুজ, অথবা জানি না আদৌ কম্পোজিশনগুলা ছাই হচ্ছে না কুলা। অ্যানিওয়ে। এবির হার্ডরক কম্পোজিশন আর তার গিটার আমায় ইন্সপায়ার করেছে নিজের ভিতরের গুঞ্জরনগুলার সুর ও সংগীত যোজনায়। অ্যাক্যুয়িস্টিক গিটারেই মূলত।

প্রথম যে-গানটা আমি গিটারে তোলার চেষ্টা করেছি, তুলেছি এবং গেয়েছিও অনেকদিন বন্ধুবৃত্তে, সেইটা আইয়ুব বাচ্চুরই গান। ‘সেই তুমি’ বা ‘চলো বদলে যাই’, ওইটা। গানটা গিটারওয়ার্কের দিক থেকে খুবই ইন্ট্রেস্টিং। সি-মেজর স্কেলের কর্ড প্রোগ্রেশনে করা। ব্যান্ডমিউজিকের দীর্ঘ যে-ক্যারাভ্যান আমাদের, সেইখানে এমন সিম্পল অথচ স্যুপার্ব কম্পোজিশন খুঁজে পাওয়া ভার। গ্রেইটদের মধ্যে জেমস্ বলি বা আরও যারা তাদের ভাণ্ডারে এমন সিমপ্লিসিটি-ঠিকরানো সংগীত নাই বলতে গেলে। এতই মিনিম্যাল অ্যাপ্রোচে এর কাঠামোটা গড়া। আর বিগিনারদের কাছে এইটা মাস্ট-লিসেনিং একটা নাম্বার হয়েই থেকে যাবে আরও বহুদিন। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, ‘সেই তুমি’ ইলেক্ট্রিক গিটার দিয়া অ্যাক্যুয়িস্টিক সাউন্ডইফেক্ট দেয়া কম্পোজিশন। আমি অ্যাক্যুয়িস্টিকেই শিখেছি। সিম্পল কর্ড প্রোগ্রেশনে গ্রেইট গান এইটা। বাচ্চুর একটা ইন্টার্ভিয়্যু পড়েছিলাম অনেকদিন আগে, সেইখানে তিনি জানিয়েছিলেন যে এই গানটা খুবই চিপ একটা মাইক্রোফোনে রেকর্ড করা হয়েছিল। স্টুডিয়োরেকর্ডের সময় কেউ কল্পনাতেও ভাবেন নাই যে অ্যালবামের অন্যান্য দুর্ধর্ষ কম্পোজিশনগুলা বাদ দিয়া এই শিশুতোষ কম্পোজিশনটা গ্রাহ্য হবে শ্রোতাদের কাছে। এইখানে আরেকবার ওই পুরানা প্রবাদটাই জিতে যায় যে একটা আর্টপিসের বিউটি চিরদিনই সিমপ্লিসিটিতে। এবং লোকে স্বচ্ছতা আর সারল্যের কদর করতে জানে।

এবির কম্পোজিশনগুলার মধ্যে ব্যক্তিগত পছন্দের শীর্ষগানটার উল্লেখ যদি করতে হয় তাহলে আমি বলব ‘রাজকুমারী’ গানটার কথা। এইটা বোধহয় বিগিনিঙে লিরিসিস্ট লতিফুল ইসলাম শিবলী গেয়েছিলেন, একটা অ্যালবামই রিলিজ হয়েছিল এই নামে। এবি গেয়েছেন পরে। এইটা আমার মধ্যে একটা মেস্মেরাইজিং স্পেলবাউন্ড পরিস্থিতি ক্রিয়েট করেছিল মনে পড়ে এবং বজায় ছিল তা আরও অনেক অনেকদিন পর্যন্ত। খুবই পার্সোন্যাল অ্যাটাচমেন্টের কারণে এমন হতে পারে মানছি, কিন্তু কম্পোজিশন হিশেবে এইটা আদতেই অতুলনীয়। সুনীল দাসের বেহালা অ্যাড করা হয়েছিল সঙ্গে, এবির রক-ব্লুজ ভোয়েস, বেহাগ রাগে বেহালার ছড়ে যে-ব্যঞ্জনা তা আমি ইহজন্মে ভুলছি না। বাচ্চু ওইসময় ‘ফেরারী মন’ নামে একটা আনপ্লাগড অ্যালবাম করেছিলেন সুনীল দাসের বেহালা বেইস্ করে। এই অ্যালবামটা বাংলা ব্যান্ডমিউজিকের ইতিহাসে একটা সাক্সেসফ্যুল ইস্ট-ওয়েস্ট ব্লেন্ডেড অ্যালবাম বলেই মনে রাখব আমি।

ঠিক কবে থেকে এবি/এলআরবি শোনার শুরু এক্স্যাক্ট বলতে পারব না। থাকতাম পাড়াগাঁয়ে। বাজারে ছিল ছোটকাকুর অডিও-ভিডিও লাইব্রেরি। বিক্রি হতো ক্যাসেট দেদারসে। ডেমো শোনানো হতো বাজারের পথচারীদেরে। খদ্দের আকৃষ্ট করতে একটা বিরাট ডেকসেটে অ্যামপ্লিফায়ার অ্যাড করে ক্যাসেট বাজত। স্কুলফের্তা আমরা দোকানে গিয়া বসতাম, ছোটকাকু বেরোতেন দরকারি ঘোরাঘুরিতে। ব্যান্ডের গানই বাজাইতাম মোস্টলি বিশ্ববিদীর্ণ আওয়াজে। বাড়িতে ক্যাসেটপ্লেয়ার থাকলেও জোরে বাজাইবার উপায় ছিল না। বাবা বাড়িতেই থাকতেন, আর মায়েরও কানে-মগজে ব্যান্ডের গান সইত না। আর এলআরবি তো হার্ডকোর ব্যান্ডখোর ছাড়া বাকিদের কাছে স্রেফ শব্দদূষণই মনে হতো শুরুর দিকে। কাজেই দোকানে গিয়া ব্যান্ডের গান শুনতাম আশ মিটাইয়া। আর গাইবার দরকারে যেতাম নদীতীরে। একলব্যের মতো জনশূন্য নদীর তল্লাট জানে এই আমার গলার রগ ফুলাইয়া গানশেখার শুরুর দিনগুলো কেমন ছিল।

সম্ভবত ২০০৮/’০৯ দিকটায় এবি মৌলভীবাজারে এসেছিলেন শো করতে। জেমস্ ছিলেন সেই যাত্রায় বাচ্চুর সঙ্গে স্টেজ শেয়ার করতে। সেই প্রথম কন্সার্ট দেখা আমার জীবনে। মৌলভীবাজার শহিদ মিনার মাঠে ছিল কন্সার্ট। তখন জেমস্ আগে স্টেজে উঠতেন, শো-স্টপার শিল্পী হিশেবে এবি স্টেজে উঠতেন সবার শেষে। এই কন্সার্টেও হয়েছিল তা-ই। কিন্তু বছর দুইয়ের মধ্যে জেমস্ হয়ে ওঠেন শো-স্টপার আর্টিস্ট। এবি ক্রমশ তার আদি ফ্যানবেইস্ হারাইতে থাকেন। নানান কিসিমের গান গাইতে যেয়ে এবি ডিসলোকেইটেড হয়ে যেতে থাকেন।

ফ্যানবেইস্ চেইঞ্জ হওয়ার শুরু অবশ্য আরও আগে থেকে। এবি বিচিত্র সব মিক্সড প্রোজেক্টে, ঢাকাই ফিল্মি মিউজিকে, টেলিভিশন মিউজিক্যালে একটা আলাদা ফ্যানবেইস্ ড্র করতে থাকেন। অনেক বড় পরিসরে এবি নিজের পরিচয় পাকাপোক্ত করতে থাকেন ট্র্যাডিশন্যাল ধারায় বিস্তর কম্পোজিশনের মধ্য দিয়ে। অ্যানশিয়েন্ট হার্ডরকার আইয়ুব বাচ্চুর আইডি শেষের দিকে একদমই নিভুনিভু হয়ে গেছিল। কবে বেরিয়েছিল বলতে পারব না, তবে মনে আছে যে ‘কাফেলা’ নামে একটা অ্যালবাম রিলিজের পর থেকেই আমি ডিমোটিভেইটেড হতে থাকি আইয়ুব বাচ্চুর ব্যাপারে।

চ্যাপ্টারটা যেহেতু ক্লোজ হয়ে গেল এবির প্রস্থানের মধ্য দিয়ে, যে-কথাটা কাজেই দ্বিধা করব না বলতে যে আমরা আইয়ুব বাচ্চুর সময়ের মানুষ। যদিও বাচ্চুর প্রাইম টাইমে আমি ছিলাম স্কুলশিক্ষার্থী, কিন্তু আইয়ুব বাচ্চুর সময়ই আমার সময়। কেননা আর-কোনো সনাক্তিযোগ্য সময় এর মাঝখানে আসে নাই যেইটা আমার সময় হিশেবে দাগিয়ে দেখাতে পারব। আরও যাদের গানের সঙ্গে অ্যাক্যুয়েইন্টেড হয়েছি সেইসময়, রবীন্দ্রনাথ বলেন বা কাজী কি ডিএল রায় বা রজনীকান্ত এবং হেমন্ত-মান্না-কিশোরকুমার বা আব্দুল হাদী কি সুবীর নন্দী, এদের কেউই ঠিক আমার বলে মনে হতো না। ঠাকুর-কাজী শুনতাম তখন বারোয়ারি হিশেবেই। নিজের এক্সক্লুসিভ গানটা ব্যান্ডের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমার গান বলতে যা বোঝায়, যে-গানগুলা আমি ঔন্ করেছি, তা প্রথম পেয়েছি বাংলাদেশের ব্যান্ডগুলার মাধ্যমে। ম্যাকের গান, এবির গান, শুরুর দিকে; এরপরে জেমস্ এসে যুক্ত হন এই তালিকায়। বাচ্চু সক্রিয় থাকলেও পরের দিকে ডিগ্রেইডেড হতে থাকেন আমার কাছে। এভারগ্রিন এবিনাম্বারগুলা ছাড়া আইয়ুব বাচ্চুর শেষ একদশকের নয়া গানগুলা কান পেতে শোনা হয় নাই। কিন্তু কানে এসেছে ঠিকই। বিশাল বাংলার ফ্যানবেইসের কারণে এবির শেষদশকের গানবাদ্য প্রত্যেকটা পাড়ার পানতামুকের ঠেকগুলাতে বেজেছে অবিরাম। শুনতে হয়েছে ঘুম থেকে উঠে এবং ঘুমাইতে যেতে যেতে।

এবির কোনো নয়া গান আর শুনতে পাবো না। আগের গানগুলাই ফিরে পাবো নতুন করে জীবনের মোড়ে মোড়ে।

… …

অসীম দাস

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you