বেগানা সমাচার ও নারীর বেটাগিরি || আহমদ মিনহাজ

বেগানা সমাচার ও নারীর বেটাগিরি || আহমদ মিনহাজ

নাফিস সবুর বিরচিত বেগানা সমাচার  পাঠের ক্ষণে মনে আফসোস জাগে ভেবে বাংলা গানাবাজনার জগতে নারীকুলের দেহমন তালাশের বাক্যবুনোটের জন্য আজো পুরুষ রচয়িতার মুখপানে জাতিকে তাকিয়ে থাকতে হয়! এই গদ্যভাষ পুরুষ লেখকের পরিবর্তে নারীহস্তে রচিত হইতে পারত। একজন নারীর নিউরনকোষ থেকে বাক্যগুলা বাহির হলে ঘটনা সেখানে কেমন দাঁড়াইত সে-কথা মনে-মনে ভাবি। গানপার-এর লেখকতালিকায় নারীলেখকের অংশগ্রহণ বিশেষ চোখে পড়ে না। তাদের জগৎ ও কাজকারবার নিয়ে বিচিত্র ভাবনায় সবাক লেখাপত্তর সরবরাহের দায় এখনো মোটা দাগে পুরুষকে মিটাইতে দেখি। নারীলেখকে বঙ্গভূমি গিজগিজ করে জানি, তথাপি পুরুষভাবিক দুনিয়ায় নারীর স্বকীয়তা তালাশের বয়ান বিরচনে পুরুষ রচয়িতারাই ভরসা হয়ে ওঠেন। এমনকি পুরুষ বিরচিত এইসব বয়ানের সঙ্গে সহমত, দ্বিমত বা পৃথক ভাবনায় রচিত বয়ান নিয়ে হাজির নারীলেখকের নাম ইয়াদ করতে বসলে গাড্ডায় পড়তে হয়। নারীর ব্যক্তিক ও সামাজিক জগৎকে বুঝে ওঠার তাগিদে এঁড়ে হইতে বকনা বাছুর অবধি বিস্তৃত পুঙ্গব প্রণীত ভাষা ও বাক্যজালের বিপরীতে স্বয়ং নারীজবানে রচিত ভাষ্যের আকালটা এখানে বেশ চোখে লাগে। একুশ শতকের যুগবিশ্বে ঘটনা ভিন্ন হওয়ার কথা থাকলেও দুর্ঘটবশে সেটা আজো ঘটতে দেখি নাই।

বেগানা সমাচার  শিরোনামের এই বয়ান নারী-রচয়িতার হাত দিয়ে বের হওয়া জরুরি ছিল। বেগানা  শব্দবন্ধের সোজাসরল অর্থ অজ্ঞাতকুলশীল  হয় বলেই জানি। কারুবাসনার জগতে নারীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ফাঁদতে বসে বক্ষ্যমাণ গদ্যের রচয়িতা তাকে অচিহ্নিত ও অজ্ঞাত ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। ভাবার কারণ রচনায় তিনি লুকাছাপা করেন নাই। গানাবাজনা থেকে শুরু করে কারুবাসনার বহুবর্ণিল শাখা-প্রশাখায় নারীর স্বকীয় কণ্ঠস্বরের বিস্ফার টের পাইতে যেসব সমস্যা সকলের আগে চোখে ভাসে তার সবগুলা মোটামুটি কাভার করায় বক্তব্যকে সুগঠিত মনে হয়েছে। অধম পাঠক স্বয়ং পুঙ্গবকুলের কাতারভুক্ত এঁড়ে/বকনা বাছুরের দলে বিচরণ করেন। লেখকের বক্তব্যে নিজ মনোভাবের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাইতে তার তাই অসুবিধা হয় নাই। পুরুষের চোখ দিয়ে বিচরাইলে যেমনটি মনে আসার কথা সেই সুরছন্দে বাক্যজাল বোনার কারণে লেখকের বক্তব্যে দ্বিমত পোষণের চেয়ে সহমতে গমনের ভাবনা আপনা হইতে মনে ভর করে। নারীকুলের কারুবাসনাচর্চায় নিজের মনের কথা  কইতে না দেওয়ার অন্তরালে পুংসমাজের লাঠিয়ালদের যুগান্তকারী সব ভূমিকা ও অবদানকে রচয়িতা আলোচনায় আরাধ্য করেছেন। তার কৌশলকে নজর করলে এই গদ্যভাষ্যে নারীসংবেদী গুণের বাহার চোখে পড়ে। জীবনের প্রতি স্তরে নারীর স্বকীয়যাত্রা কামনা করেন এ-রকম পুরুষপাঠক যে-কারণে অনায়াসে রচনার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম ভাবতে ইতস্তত করবেন বলে মনে হয় না। প্রশ্ন হলো নারীও কি তাই? — এই জিজ্ঞাসার সূত্র ধরে নারীসংহতির মনোরম প্রতীক দুর্গতিনাশিনী দুর্গা আর অবিরাম সৃষ্টি ও বিনাশের খেলায় শিবত্বের আদ্যপ্রতিমায় অভিন্ন মা কালীর নামস্মরণে বেগানার পাঠবিশ্লেষণে অগ্রসর হইতে চাই।

বেগানা সমাচার  যে-আঙ্গিক ধরে আগায় সেখানে নারীপাঠকের অবস্থান হইতে প্রশ্নটি উঠানো যাইতে পারে, — সবই ভালো, কিন্তুক মা দুর্গা ও কালীর গুণধারী নারী স্বয়ং কি এই অঙ্গে চিন্তাভাবনা করেন? তার কি মনে হয়, পুরুষের সঙ্গে তাল দিয়ে যেসব অনুভবকে সে ভাষা দিতে চায় অথচ পারে না তার পেছনে পুরুষভাবিক দাপট হইতে সৃষ্ট অন্তরায় একমাত্র গণ্য কারণ? রচয়িতার ব্যাখ্যার সঙ্গে তার কি সহমত পোষণের ইচ্ছা হয়? অথবা সেইসব বিন্দুতে নিজের দ্বিমত সে জানাইতে চায় যেখানে রচয়িতা পুরুষভাবিক নারীসংবেদ  বহনের কারণে প্রেমিকা-ভার্যা-জননী থেকে গণিকা অবধি বিস্তীর্ণ মানচিত্রে অবরুদ্ধ নারীকে যৎকিঞ্চিৎ সহানুভূতির চক্ষে দেখতে বাধ্য থাকেন, যেখানে নারীর স্ব-রূপে  প্রস্ফুটিত হইতে না পারার জন্য পুংপুচ্ছধারী সমাজ ও শ্রেণিকে চপেটাঘাত করা ছাড়া তার উপায় থাকে না? নারীপাঠক কি মনে করে রচয়িতার এই সদয় সহানুভূতি তার জন্য ব্যারামবিনাশী? অথবা সে এভাবে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, — পুরুষভাবিক সমাজে নিজের মনের কথা অকপটে বলতে না পারলেও নারীসংবেদী পুরুষ যবে তার হয়ে প্রক্সি দিতে যায় সেটা উল্টা বিড়ম্বনার কারণ হয়ে তাকে দংশায়? নারীসংবেদী পুরুষের বয়ান এক্ষেত্রে পুঙ্গবকুলের ওপর প্রতিশোধকামী এক চরিত্র রূপে সেই নারীকে হয়ত হাজির করে। এমনধারা বয়ানে নারী তার নিজেকে উপস্থাপনের কথা আদৌ ভেবেছিল কি না সে-জিজ্ঞাসা নারী-স্বকীয়তার অগ্রযাত্রা দেখতে ব্যাকুল পুরুষ হয়ত গভীরে গিয়ে তলিয়ে দেখে নাই! বেগানা সমাচার-এর পাঠপ্রতিক্রিয়া যে-কারণে নারীপাঠকের অংশগ্রহণ ও আওয়াজ ছাড়া পূর্ণতা পাইতে পারে বলে একিন হয় না। রচনালেখ্যের বহুমাত্রিক যাত্রায় পাঠকের নিজস্ব ভাবনা ও মতামতের প্রশ্নে পুরুষের চেয়ে নারীপাঠকের অংশগ্রহণ এখানে অধিক কাম্য বলেই মানি।

মনের কথা কওয়ার বাসনা পূরণে প্রতিশোধকামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার চাইতে ন্যায্য হিস্যা বা বণ্টনের ভাবনা মনে হয় জগতের নারীকুলকে অধিক প্রভাবিত করে যায়। পুরুষসঙ্গীর মতো মন খুলে নিজের ও সঙ্গী পুরুষের জগৎকে ভাষা দিতে তারো ইচ্ছা করে এবং সমাজে সেই ব্যবস্থাটা থাকা প্রয়োজন। প্রেমিকা-ভার্যা-জননী-গণিকা ইত্যাদি রূপে নারীর সমাজসৃষ্ট ইমেজগুলা কালের আবর্তে জটিল ও নেতিবাচক সুরত ধারণ করলেও নারী এগুলাকে ডিজওন  করার কথা ভাবে বলে বিশ্বাস যাইতে এখন আর মন ওঠে না। দুনিয়া জুড়ে ছড়ানো উগ্র নারীবাদী বয়ান তাকে এই কাজটা করতে অবিরত প্ররোচনা দিলেও নারীকুলের বৃহৎ অংশ নীরবে সেটা উপেক্ষা ও প্রত্যাখ্যান যায়। পুং-প্রজাতির সৃষ্ট নারীর ইমেজেগুলায় বিস্তর কালি পড়েছে তাতে সন্দেহ নাই; সেইসঙ্গে মিথ্যে নয় এই নিরিখন, — তার দেহমনের কোষে ইমেজগুলার প্রতি মায়া, রাগ-অনুরাগ আর জৈব তাগিদকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। সমানাধিকার নাকি ন্যায্যতা? — নারী আসলে কোনটা চায় তার উত্তর জটিল হলেও বেগানা সমাচার-এর পাঠভাষ্যে এই প্রশ্নের কাটাছেঁড়া হয়ত করা যায়। সেক্ষেত্রে উভয় লিঙ্গের পাঠকের এই রচনার প্রতি পরতে প্রবেশ জরুরি।

সমানাধিকারের দাবি নারীবাদী ভাষ্যে বিমোহিত নারীগণকে একুশ শতকের যুগবিশ্বে সম্ভবত বহুরূপী অঙ্গে প্রভাবিত করে থাকে।দাবিটিকে তাই নতুন করে আলোচনায় ফেরত আনা প্রয়োজন। কারুবাসনার জগতে নারীর স্বকীয়যাত্রা ও অন্তরায়ের মনোবিশ্লেষণে বেগানা সমাচার-এর রচয়িতা যেসব প্রসঙ্গ টেনেছেন সেগুলার প্রতি এছাড়া সুবিচার হয় না। মানুষকে যদি প্রাণিজগতের অংশ বলে ভাবি সেখানে সমানাধিকার নামক বস্তুর খবর মিলে না। প্রাণিকুলে সাম্য বা সমতার কারবার নেই; তবে হ্যাঁ, ন্যায্যতার রাজত্ব সেখানে বেশক চলে। সরীসৃপ প্রজাতির তুখোড় শিকারি পুরুষ কুমির, জান্তব হিংস্রতায় অতুল বাঘ মামা কিংবা মানুষের সংসারে করেটরে খেতে ওস্তাদ হুলো বিড়ালের ছোঁকছোঁক পেটুক স্বভাবের কথা জানে বলে মা কুমির, বাঘিনী বা মার্জারনী নিজের ছানাপোনাকে বুক দিয়ে আগলে রাখে। ছানাপোনারা গায়েগতরে জোয়ান হওয়ার পর মা কিন্তু তাদেরকে লাত্থি দিয়ে বনে বা সংসারে পাঠায়। যেহেতু সে জানে, এই জোয়ানের স্বভাবে নিজের জোরে করে খাওয়ার তাকত জন্ম নিয়েছে, কাজেই তাকে এখন তার মতো করে গোল্লায় যাইতে দেওয়া সমীচীন। প্রকৃতির ক্রোড়ে লালিত প্রাণিকুলের জীবনধারায় এই যে প্রচণ্ডতা, খেয়াল করলে দেখবেন মনুষ্যসমাজ প্রণীত কামাচারের বয়ান তাকে ঢেকে রাখতে চায়। এখন সেই বয়ান যদি আজিকার নারীবাদী ভাষায় বোনা হয় তো সেখানে নারী ও পুরুষের দেহকোষে প্রকৃতিসূত্রে সক্রিয় নানা ঘনঘটার মনোবিশ্লেষণ সেভাবে কদর পায় না। কারুবাসনা থেকে সমুদয় বাসনা পূরণে নারীর স্বকীয় উদযাপন  কেমন হইতে পারে তার ফয়সালা অবধারিত নিয়মে পুরুষকে প্রতিপক্ষ বানানোর মধ্য দিয়ে উপসংহার টানে।

জনৈক মার্কিন অভিনয়শিল্পীর প্রতি সিমন দ্য বোভোয়ারের উন্মাদতুল্য প্রেমাবেশের ঘটনা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যাইতে পারে। সার্ত্র ও বোভোয়ার পুঙ্গবসৃষ্ট বিবাহ প্রথাকে সেই সময় ডিনাই  করেছিলেন। অস্তিত্বিক স্বাধীনতা উদযাপনে মরিয়া হওয়ার কারণে প্রত্যাখ্যানটা তাঁদের জীবনে জরুরি ছিল। দুজনে মর্জি ও প্রয়োজন বুঝে একত্রে বা আলাদা থাকতেন। ভাবুকতায় মোড়ানো সার্ত্র যতদূর শুনতে পাই কামশীতল টাইপের লোক ছিলেন। অস্তিত্বিক যাপনের অর্থ বা অনর্থের তালাশে মগজের নিউরনকোষ এতটাই ধ্বংস করেছিলেন যে বোভোয়ারের সঙ্গে দৈহিক মিলনের চেয়ে আত্মসঙ্গ যাপন তাঁর কাছে বেশি প্রীতিকর ছিল। বোভোয়ারও এই ঘটনায় অভ্যস্ত বা স্বচ্ছন্দ ছিলেন। যদিও তাঁর যৌনচাহিদা সার্ত্রর তুলনায় খানিক উগ্র ছিল মনে হয়। যারপরনাই মার্কিন অভিনেতার পক্ষে এই বিদূষীর মন হরণ করা সহজ হয়েছিল। ঘটনা বেশ গুরুতর মোড় নিয়াছিল তখন। পুঙ্গবাকীর্ণ সমাজে নারীকে পুতুল করে তোলার যেসব খেলাকে নিজের পুস্তিকায় যৌক্তিক কারণে তিনি সমালোচনার তূণে বিদ্ধ করেছিলেন, মার্কিন অভিনেতার রূপ ও পৌরুষের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার ক্ষণে স্বয়ং তার পুতুল হইতে চাওয়ার ব্যাকুল বাসনা একই বোভোয়ারকে পেয়ে বসেছিল!

অভিনেতার প্রতি তাঁর এই প্রেমাবেশমোহকে আজব মানতে হয়। শয্যায় তার দ্বারা নিষ্পেষিত হওয়ার বাসনা তো ছিলই, উপরন্তু অভিনেতার আন্ডার গার্মেন্টস নিজের হাতে কেঁচে দেওয়ারে উদগ্র ইচ্ছে তাঁকে উতলা করে তুলেছিল। কাহিনির সত্যমিথ্যা সঠিক জানা নেই, তবে বোভোয়ারের চিঠিপত্র ও তাঁকে যারা ঘনিষ্টভাবে জানেন তাদের বক্তব্যে অস্তিত্বিক মুক্তির জন্য উতলা রমণীর রূপবুভুক্ষু আবেগের খবর মিলে বটে! সত্যমিথ্যা বা অতিরঞ্জন যা-ই থাকুক, কাহিনির মোর‌্যালটা এখানে ভাবনার বিষয়। মস্তিষ্কের ক্ষুধা নিবারণে বোভোয়ারের কাছে সার্ত্র অবিকল্প ছিলেন। এক্ষণে এই ক্ষুধাকে যদি যৌনতার স্মারক ভাবি সেক্ষেত্রে সার্ত্রকে বোভোয়ারের Cerebral Sexmate বলা যাইতেও পারে। তাঁরা পরস্পরকে যতটা-না দেহ দিয়া রমণ করতেন, তারচেয়ে একে অন্যর মস্তিষ্কে প্রবেশ ও তাকে রমণে ব্যাকুল ছিলেন।

সে-নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু তাতে কি জীবনের সকল রহস্যের ইতি ঘটে? পাশব পৌরুষে জাগ্রত শক্তি নিজ দেহে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা নারীকে পৃথক স্বকীয়তা দান করে বলে অনেকে মানেন। বুনো উগ্ররসে দেহকে ভরভরন্ত ভাবার তৃপ্তি বোধহয় বোভোয়ারকে সেই সময় খ্যাপাটে করে তুলেছিল। ক্ষুরধার মস্তিষ্ককে স্থগিত হতে দিয়ে অভিনেতার চিয়ার লিডার  বা প্রমোদ-সহচরী হইতে তাঁর আর আপত্তি ছিল না। পুরুষের পাশব কামাচারে বিদ্ধ হওয়ার ক্ষণে অস্তিত্বের বুনো মুক্তির উল্লাস নারীর দেহকে প্রকৃতির ন্যায় সরস করে তোলে। বোভোয়ার সম্ভবত সরস হইতে ব্যাকুল ছিলেন। অভিনেতাটি সার্ত্রর তুলনায় আকাট মূর্খ জেনেও তার জুতো পালিশ করে দেওয়ার আবেশ তাঁকে পেয়ে বসে। শেষ রক্ষা এ-ই যে আবেশটা বেশি দিন স্থায়ী হইতে পারে নাই। বিদূষী বোভোয়ার নিজের পরিচিত স্বভাবে অচিরে ফেরত গিয়েছিলেন।

মার্কিন দেশে উড়াল দেওয়ার ক্ষণে তাঁর মনে সার্ত্রকে ছেড়ে যাওয়ার তিক্ত বেদনা জেগে ওঠে। মনে হইতে থাকে, — দেহের বুনো উল্লাস অভিনেতাকে দিয়ে মিটানো যায়, চপল প্রেমের খেলায় মেয়েরা কেন বোকার মতো ঝাঁপ দেয় সে-অভিজ্ঞতাও তার উসিলায় পাওয়া সম্ভব, কিন্তু এইসব চপলতা শেষ হওয়ার পর মস্তিষ্ককে রমণের উপায় তো এই লোক জানে না! ওটা কেবল সার্ত্রর পক্ষে যোগান দেওয়া সম্ভব। অগত্যা বোভোয়ার নিজের Cerebral Sexmate-এর কাছে ফেরত গিয়েছিলেন। জীবনের অন্তে ক্ষীণদৃষ্টি সার্ত্রকে খবরের কাগজ পড়ে শোনানোর কাজটা তাঁর কাছে প্রীতিকর হয়ে উঠেছিল। সেইসঙ্গে পুরুষ সার্ত্রকে বাচ্চার মতো আগলে রাখার ব্যারাম মনে তীব্র হয়। এডওয়ার্ড সাঈদ তখন সদ্য যুবা। প্রবল কৌতূহল নিয়ে সার্ত্রর সঙ্গে দেখা করতে প্যারিসে পা রেখেছিলেন। বোভোয়ারের হাবভাব তাঁর তখন একদম পছন্দ হয় নাই। সাঈদের মনে হয়েছিল সুন্দরী এই মহিলা ভীষণ জাদরেল ও কর্তাসুলভ! সার্ত্রর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ কাউকে সে দিতে রাজি নয়। ভাবখানা এমন, সে ছাড়া অন্য কেউ এই লোকের সঙ্গে বাতচিতের হক  রাখে না!

নারীবাদী বয়ানের জায়গা হইতে বোভোয়ারকাণ্ডকে উদ্ভট মনে হইতে পারে। তাঁর অমর কীর্তি দ্বিতীয় লিঙ্গ-র নারী-স্বকীয়তা বিষয়ক আলাপের ধারা বিচারে এমনধারা আচরণকে স্ববিরোধী আখ্যা দেওয়াকে অনেকে হয়ত সংগত ভাববেন। অন্যদিকে মানুষের দেহে প্রাণিজগৎ হইতে সঞ্চারিত বিধান বিবেচনায় নিলে বোভোয়ারকাণ্ড অন্যায্য নয়, একে বরং ন্যায্য বলে স্বীকার যাওয়া উচিত। মা মার্জারনী নিজের ছানাপোনা বালেগ হওয়া মাত্র তার সঙ্গে সকল সম্পর্কের পাট চুকায়। সে জানে সম্পর্কটাকে এখন টেনে লম্বা করতে গেলে হিতেবিপরীত ঘটার সম্ভাবনা বাড়ে। প্রাণিকুলে যে-কারণে পুরুষভাব বলে কিছুর অস্তিত্ব টের পাইতে ফাঁপরে পড়তে হয়। পুংলিঙ্গধারী প্রাণী সেখানে পাশবতার নজির রূপে নিজের দাপট দেখানোয় নিবেদিত থাকে। পাশবতাটা তার বেলায় ন্যায্য বৈকি। ওটা ছাড়া স্ত্রী প্রাণীকে পটানো বা তাকে রমণ ও গর্ভদান সম্ভবে না। পুরুষ প্রাণী অগত্যা সেখানে নারীভাবে সংস্থিত জীবনচক্রের ধারা বজায় রাখার কামলা খাটে। মানুষের জগৎ ব্যতিক্রম নয়। পুরুষ-পাশবতার অনেকখানি (*সেরিব্রাল কর্টেক্সের অমিত স্ফিতি ও সেখানে বিচিত্র মোর‌্যাল প্রহিবিশন-এর জাল রচনা করে নিজের পশুভাবকে দমনের চেষ্টা সত্ত্বেও…) প্রকৃতিসূত্রে পাওয়া। এই জৈবতাকে নারী যে সবসময় অপছন্দ করে এমন নয়। বোভোয়ারের ঘটনাই তার প্রমাণ দিয়া যায়।

পুরুষ তাকে জয় ও বিদ্ধ করুক; — এ-মতো মনোবাসনা যেমন সিংহীর থাকে, তদ্রূপ নারীর দেহের গোপন তারেও সে নীরবে রাজত্ব করে। নিজ দেহে পুরুষের পরাক্রমকে অবলীলায় সামাল দিয়ে একাদিক্রমে শিবভার্যা পার্বতী ও দুর্গা হয়ে ওঠার মাঝে যে-শক্তি ও স্বকীয়তা বিচ্ছুরিত হয় তাকে প্রকাশ্যে আনার ভাবনা নারী বিরচিত কলাচর্চার জগতে ভাষা পাইতে দেখি না। কীভাবে বললে পরে তার অনুভবকে ভাষা দিতে পারবে সে-নিয়ে নারী নিজে দ্বিধাদ্বন্দ্বে বেলা পার করে। ওদিকে সদাসঙ্গী পুরুষের দেহমনের খবর নেওয়া বা তাকে ভাষা দানের প্রশ্নেও তাকে বিব্রত ও দিশেহারা দেখায়। সংগীতের ভুবনে নারীর নিজ মনের কথা প্রকাশের অন্তরায় অন্বেষণের ক্ষণে বেগানা সমাচার-এর বয়ান এই জায়গাটা ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, যদিও আরো গভীরতলে যাওয়া বোধহয় প্রয়োজনীয় ছিল।

মানুষের জগতে পুরুষের দায়িত্ব কামলার অধিক হওয়ার কথা ছিল না। পিঁপড়ে বা মৌমাছির দুনিয়ায় পুরুষ পিঁপড়ে বা মৌমাছি উদয়াস্ত বেগার খাটে রানী পিঁপড়ে বা মৌমাছিকে সুরক্ষিত রাখার তাগিদে, কারণ রানী সেই অমূল্য গুণ ধরে যাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির পক্ষে সংস্থিত ও বহমান থাকা কঠিন। মানুষের জগতে পুরুষও একদিন সে-রকম ছিল। কালক্রমে সেখানে সভ্যতা ও শতেক হিজিবিজি ঢুকে পড়ায় নারীভাবিক সমাজ থেকে পুরুষভাবিক সমাজে মানবজাতির উত্তরণ বাকি সবকিছুকে কুটিল ও বিষাক্ত করে দিয়েছে। নারীদেহে যেসব গুণ একদা অনায়াস মনে হইত সেগুলাকে এখন দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। নিজের বেটাগিরি কায়েম করতে গিয়ে পুরুষরা একে-একে তার সবটা নিকাশ করেছে। ওদিকে পুরুষের দেহে সক্রিয় সহজাত গুণগুলাও আর বেঁচে নেই অথবা সময়ের ফেরে বদখত সুরত ধরেছে। একে অন্যকে শোষণ ও ব্যবহারের মওকাজালে বাঁধা পড়ায় দুজনের কেউ এখন আর কাউকে একরত্তি বোঝে না। বিষয়টি বোধহয় নারীর স্বকীয়তা সন্ধানের জায়গা হইতে গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

প্রকৃতিসূত্রে পাওয়া গুণ-বিনাশী আসর  নারীর ওপর অধিক ভর করায় তাকে এখন বেশি যুঝতে হয়। একালের নারীবাদী ভাবনার বিবিধ দৈন্যদোষের কারণে পুরুষের সমকক্ষতা আদায়ের লড়াইয়ে নারীর ভূমিকা মূলত পুরুষসদৃশ আয়তনে নিজেকে তৈরি করা ও তাকে প্রতিপক্ষ বানানোর খেলার দিকে মোড় নিয়েছে। যেমন ধরা যাক সমাজ-সংসারে কর্তা রূপে পুরুষের যে-ইমেজ পুরুষতন্ত্র সরবরাহ করে ও সেটা দিয়ে নারীকে দাবায়া রাখে, এইবেলা তাকে ধ্বংস করতে হলে নারীর কর্ত্রী ইমেজে নতুন রূপান্তর আবশ্যক হয়, যার প্রভাবে পুরুষকর্তার জোশে ভাটা নামবে এবং তারা একে অন্যকে সহ্য করতে ও ছাড় দিতে শিখবে। কর্তা ও কর্ত্রীগিরির জগতে বাস্তবে এরকম ঘটনা কদাচ দৃষ্টে। পুরুষকর্তার ইমেজে ধস নামানোর বিপ্লব প্রায়শ বিষ দিয়ে বিষ মোক্ষণের নিয়ম অনুসারে ঘটে থাকে, অর্থাৎ পুরুষকর্তার ইমেজে বিদ্যমান সব গুণ নকলের কামে নারী তার সকল শক্তি ব্যয় করে এবং নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে পুরুষে পরিণত হওয়ার পাট চুকায়। ঘটনাটি প্রকৃতিসূত্রে পাওয়া গুণের বিরোধী এবং নারীর স্বকীয়তা অনুভবের পরিপন্থী বটে। নারী ও পুরুষে বিরাজিত বৈষম্যের পেছনে জৈবপ্রকৃতি থেকে পাওয়া গুণ অথবা বডি বায়োলজির হাত নেই, বৈষম্যটা এখানে সাংস্কৃতিক দুর্ঘটনার ফসল; — নারীবাদী ভাবনাছকে অহরহ উচ্চারিত এই আলাপের প্রধান সমস্যা হলো প্রকৃতিসূত্রে বিভাজিত গুণপনার নিরিখে নারী ও পুরুষের দেহমনের স্বকীয়তা বা সেই অনুসারে তাদের মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ভাবনা করার পথে সে বাধার প্রাচীর তুলে দেয়। যে-কারণে প্রচলিত নারীবাদী ভাবনাছকে দাঁড়িয়ে নারীর পক্ষে পুরুষভাবিক সমাজের বানানো প্রতিমার জগতে নিজের স্বকীয়তাকে ভাষা প্রদান কাভি মুমকিন নেহির মতো ঘটনায় মোড় নিয়াছে।

বোভোয়ারের মার্কিন অভিনেতার সেবাদাসী হওয়ার মোহাবেশের পেছনে Cultural Mindset-এর চেয়ে সার্ত্রর জৈবযৌন সক্ষমতায় ঘাটতির দোষ আগে চোখে লাগে। বুদ্ধিজীবিতায় নিজেকে খর্চা করতে গিয়ে তিনি প্রাকৃতিক সুবাদে পাওয়া অস্তিত্বিক উদযাপনের সকল সুখ হারায়ে ফেলেছিলেন। নোসিয়া  বা বিবমিষার বেগ এড়াতে সার্ত্র নিরন্তর কাজের মধ্যে ডুবে থাকার কথা ভেবেছেন। যদিও কর্মের ভিতর দিয়ে মানুষকে তার অস্তিত্ব উদযাপনের সুখ দিতে পারে সে-রকম দেহমনের নিবিড় সংগত ও প্রাকৃতিকতার ভাবনায় তাঁকে গমন করতে দেখা যায় না। কেন জন্মিলাম? — এই প্রশ্নের উত্তর রকমারি হইতে পারে এবং সকল উত্তর সেখানে সমান বৈধ ও যৌক্তিক। সার্ত্র এই জিনিসটা মানতে পারেন নাই। জন্মগ্রহণকে তিনি দুর্ঘটনা আর অস্তিত্ব যাপনকে বমনেচ্ছার আধার ভাবতেই সুখ বোধ করেছেন। নিজের বমন তীব্র হয় দেখে অগত্যা বিস্তর বইপত্তর আর বিশ্বজুড়ে বহমান রাজনৈতিক সহিংসতায় একজন অ্যাক্টিভিস্ট রূপে হাজির থেকে বমনের মারণ এড়াতে চেয়েছেন। এখন অস্বিত্বের অপার অর্থহীনতা মোকাবিলায় তাঁর পদ্ধতিকে যদি একমাত্র ভাবি তাইলে সর্বনাশ। এই জীবন লইয়া কী করিব? — বঙ্কিম চাটুজ্যের বিখ্যাত প্রশ্নের জবাব বহুরূপী চরিত্র যবে ধারণ করে তখন তাকে সুন্দর দেখায়। নারীবাদী ভাববলয় এখানে পুঙ্গব বিরচিত সভ্যতায় নারীর হেনস্থা হওয়াকে প্রতিরোধ করার নামে যেসব সূত্র হাজির করে সেটা কতক ক্ষেত্রে যৌক্তিক হলেও এর ওপর ভর করে নারীর পক্ষে নিজের প্রাকৃতিক গুণে সংস্থিত হওয়া ও তার সাহায্যে পুরুষের বদখত অভ্যাসের সংশোধন সম্ভব নয়।

সভ্যতা নারী বা পুরুষের কাউকে প্রাকৃতিক নিয়মে নিরাময়ের ক্ষমতা রাখে না, কেননা প্রকৃতি সূত্রে পাওয়া মৌল গুণের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ছাড়া সভ্যতা দাঁড়ায় না। প্রকৃতিকে সে তাই উপলব্ধি করার পরিবর্তে সবসময় ম্যানিপুলেট  করতে চেয়েছে। যে-কারণে হয়ত অধুনা বিজ্ঞানে বায়োমিমিক্রির উদয় ঘটেছে। তাত্ত্বিক এই প্রস্তাবনার মূল কথাটি সরল। নিজের ফায়দা হাসিলে প্রকৃতিদেহে শল্যচিকিৎসা কী করে ঘটানো যায় এইসব ভাবনাচিন্তায় মানুষ এতদিন নিজেকে ধ্বংস করেছে। ফলাফল সকলের জানা। বায়োমিমিক্রি  উল্টাপথে হাঁটার পক্ষে মত রাখে। শত-হাজার কুটিল পন্থায় প্রকৃতির বারোটা বাজানোর ভাবনা বাদ দিয়ে কী উপায়ে সে নিজের বিকাশ ও সংস্থিতি ধারণ করে তার অধ্যয়নে বিজ্ঞানীরা এখন মন দিতে আগ্রহী। প্রাকৃতিক নিয়মে সৃষ্ট বনভূমি কীভাবে নিজেকে সংরক্ষণ করে ও বিনিময়ী হয়, তার সামাজিক সংস্থিতি সেখানে কেমন করে ঘটে, নিজেকে পূর্ণ ও নিঃস্ব করার ক্ষেত্রে তার নিয়ম কীভাবে কাজ করে … এইসব প্রকৌশল যদি হুবহু অনুকরণ করা যায় তাহলে হয়ত ক্রমশ বনশূন্য ধরিত্রীতে নতুন প্রাকৃতিক বন সৃষ্টি করা সম্ভব। সভ্যতায় সৃষ্ট বনায়নের রীতিনিয়মের বিপরীতে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট বনায়নে ফেরত যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যদি কোনোদিন সত্য হয় সেক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের পক্ষে নিজের মৌলগুণে ফেরত যাওয়া সম্ভব হইতেও পারে। পরিতাপের বিষয় হলো বুদ্ধিদীপ্ত নারীকেও আজকাল নিজের প্রাকৃতিক অরণ্যসদৃশ স্বকীয়তা অন্বেষণের প্রশ্নে পৃথক ভাবনায় গমন করতে কদাচিৎ দেখা যায়।

জটিল দ্বন্দ্বের জগতে নারী এখন খালি ঘুরেফিরে। একদিকে পুরুষসৃষ্ট ইমেজ তাকে সমাজে অবিরত নির্দিষ্ট হইতে বলে। রক্তে মিশে যাওয়া এইসব ইমেজে নির্দিষ্ট হওয়ার কারণে এগুলার প্রতি নিজের মায়া ও পিছুটান সে ছাড়তে পারে না। এগুলাকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে বুকে লাগে। অন্যদিকে স্বকীয়তাকে জানান দেওয়ার বাসনায় সে যবে মরিয়া হয় তখন এই ইমেজগুলা প্রতিপক্ষ হয়ে তাকে জ্বালা দেয়। নারীমনের জটিল এইসব চোরাটান কি বঙ্গ বা জগতের নানা প্রান্তে মুখরিত গানাবাজনা ও কলাচর্চায় সুলভে মিলে? মনে তো হয় না। নারীসংবেদি পুরুষকুল হয়ত-বা এ-নিয়ে দুছত্র বাক্য আওরান, যেখানে স্বয়ং নারীকে তার এই দ্বান্দ্বিক অনুভব নিয়ে কদাচিৎ কথা বলতে শুনি। নারী যে গানের জগতে নিজের কথা অবিরত বলতে পারে না তার পেছনে পুরুষতন্ত্রের শঠতা নিশ্চয় ভূমিকা রাখে, তবে সেটা একমাত্র নয়, নারীর হয়ত নিজেকেই জিগানো প্রয়োজন, — তার স্বকীয়তাকে সে নিজে সম্যক বুঝে তো? নাকি সেখানেও পুরুষ তাকে স্বকীয়তা নামের ঘটনাকে যেভাবে তালাশ করতে বলে সে ওই ছকে তাকে খুঁজে মরে? নারী নিজে কোনটা চায়? ন্যায্যতা? নাকি সমতা? এই প্রশ্নের মীমাংসা ছাড়া তার পক্ষে নিজের জন্য গান গাওয়া বা দেহমনকে বিচিত্র আঙ্গিকে জগতের কাছে নতুন ভাষায় হাজির করা পাহাড় ঠেলার শামিল মনে হয়।

বেগানা সমাচার-এর অধম পাঠক যেহেতু নারী নয় তার পক্ষে নারী রূপে যাপনের অনুভব বা সেখানে বিদ্যমান চোরাটানের হদিশ পাওয়া কঠিন। যে-নারী গর্ভধারণ করে একমাত্র সে বুঝে নিজের দেহ চুষে জীবিত ভ্রূণের বড় হওয়ার অভিজ্ঞতা আসলে কেমন হয়। বলিসেলেব কারিনা কাপুর যেমন করণ জোহরের সঙ্গে সাম্প্রতিক আলাপে জানান গর্ভবতী হওয়ার দিনকালে বিচিত্র অনুভবের মধ্যে তাঁকে যাপন করতে হয়েছে। তার মনে হয়েছে ঢোলা পেট নিয়ে তাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। নিজের শরীরে যৌনতার অনুভূতি সেই সময় তিনি হারায়া ফেলেছিলেন সেই কথা করণকে অকপটেই বলেছেন। এমন দিন গিয়েছে, নিজের ভিতরে বাড়তে-থাকা শরীর ও সেইসঙ্গে নিজের শরীরকে তিনি স্পষ্ট বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। তবে হ্যাঁ, এই সময়ে স্বামীকে আশপাশে দেখার বাসনা মনে তীব্র ছিল, যেমনটি জগতের সকল বিবাহিত রমণীর থাকে আর-কি। মজাটা এখানে যে, এন্তার সিনেমা বা গানে অভিনয় করলে কী হবে, গর্ভধারণ করতে গিয়ে নিজের দেহে আরেকটি সত্তার বেড়ে ওঠার কাহানি ও তাকে ঘিরে সৃষ্ট অনুভবের লহরি জগতের সমুখে তুলে ধরার সুযোগ তাঁর কপালে আজো অধরাই থেকে গিয়াছে।

গর্ভধারিণী এখনো গানের সুরে নিজের অনুভবকে মোক্ষম উপায়ে জানান দিতে পারে না। সিনেমায় সে ফোলা পেট নিয়ে নড়েচড়ে ও বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর পরিবার সেটা নিয়ে উল্লাস করে। বেচারি তখন ভার্জিনিয়া উলফের রমণ-পরবর্তী নারীর ন্যায় আস্ত একখান প্রাণ প্রসবের বিহ্বলতায় খানিক নিষ্ক্রিয়  তার মধ্যে নিঃস্ব ও পরিতৃপ্ত হইতে থাকে। তার এই নিঃস্ব ও পরিতৃপ্তি যাপনের অনুভবকে আজো কেউ তুলে ধরতে আগ্রহ বোধ করে নাই। সেই ভাষার জন্মই হয় নাই যেটা গর্ভধারণের অভিজ্ঞতা যাপনের দিনগুলায় নারীর জীবনে সংঘটিত সূক্ষ্ম সব অনুভবের রসায়নকে সিনেভাষায় বা সংগীতে সবাক করতে পারে। অগত্যা সাহিত্যের আশ্রয় নেওয়া কারিনার কাছে সার মনে হয়েছে। করিনা কাপুর’স প্রেগন্যান্সি বাইবেল  কিতাবে নিজের অনুভবকে তিনি ভাষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। না, তিনি সেখানে পুরুষভাবকে দায়ী করে কটুবাক্যের ফোয়ারা ছোটাননি, তবে ছোট্ট করে কথাটি বলে দিয়েছেন, — পিতা হইতে গেলে গর্ভধারিণীর আশেপাশে তার ঘুরঘুর করা ফরজ। এ না হলে তিনি কী করে বুঝবেন তার সঙ্গিনীর দেহ খেয়ে যে-প্রাণ কদিন বাদে জরায়ুমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে তাকে বহনের অনুভূতি রমণীর কেমন ছিল!

পশুর জগৎ হইতে মানুষের এই ভিন্নতা সভ্যতার সুবাদে পাওয়া হলেও কারিনার জেন্ডার নিউট্রাল  কথাখান এখানে মূল্য ধরে। বীজ ডোনেট করলেই পিতা হওয়া যায় না। নিজের সন্তানকে সে যেহেতু ভক্ষণের বাসনা করে না এবং এদিক থেকে নিজেকে কুমির-বাঘ-হুলো বিড়াল ভাবতে ঘোরতোর আপত্তি ঠুকে বসে এবং জনক হওয়ার গর্বে ফুলতে চায়, সেক্ষেত্রে রমণীর প্রযত্ন করা ও মনের ভাও বুঝে তার কামলা খাটা বাপের জন্য ফরজ। এছাড়া অদ্বৈতভাবটা আসে না যার জোরে নারী ও পুরুষ পরস্পরের সুরক্ষার কথা ভাবে। সুরক্ষা প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের মৌল মন্ত্র। নারীর গানের ভাষায় এই বার্তাটা (বেগানায় উদ্ধৃত আবিদা সুলতানার প্রজাপতিটা যখন তখন উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে  গানটা সে-রকম বটে। আমার নবজাতক শিশু সন্তান এই গান শুনে কান্না থামিয়ে শান্ত হয়ে যেত মনে পড়ে।) যেদিন জেন্ডার নিউট্রাল  হয়ে আসবে সেদিন সেই গান জন্ম নিবে যেটা খালি নারীর নয়, সর্বজনীন মানবসমাজের হবে।

তো এই জায়গা থেকে মনে হয় পুঙ্গব সমাজের লাঠিয়ালদের কাছে নারী অধিক কিছু আসলে চায় না। সে চায় প্রেমিক-স্বামী-পিতা অথবা পুরুষবেশ্যাকে সমাজ যখন স্পেস ও ছাড় দেওয়ার কথা ভাবে তখন যেন তার ইমেজগুলাও অনুরূপ ন্যায্যতা লাভ করে। এইসব ইমেজ তো প্রকারান্তরে মনুষ্য সমাজের বিচিত্র দ্বান্দ্বিক গতি ও সংঘাতের ফসল বৈ কিছু নয়। পুরুষের জন্য বরাদ্দ ইমেজ যদি নিজের কথা কইতে পারে তাহলে তারো সেই সুযোগ থাকা উচিত। প্রেমিকা-ভার্যা-জননী বা বেশ্যার চরিত্রে বহমান ইমেজ নিয়ে ভালোমন্দ কথা বলার হকখানা  সে শুধু চায়, যেখানে এগুলাকে ছেড়েছুড়ে অজ্ঞাতকুলশীল হওয়ার ইচ্ছা তাকে আর বিশেষ তাড়িত করে বলে মনে হয় না। এইসব ভূমিকা থেকে বাহির হওয়ার চেষ্টায় যেসব গীত ও সিনেভাষা জন্ম নেয় তারা উল্টা সমাজ থেকে নারীকে বিচ্যুত ও এ্যালিয়েন করে তোলে। এতদিন নির্দিষ্ট কিছু ইমেজে সে হয়ত বন্দি ছিল। এখন তার কোনো ইমেজ নাই। অগত্যা নিজেকে বেগানা ঘোষণা দেওয়া ছাড়া তার পক্ষে নিজের গান গাওয়াটা সম্ভব না! রক মিউজিকে নারীদের সমস্যা একারণে ঘটে। তারা এই চিৎকৃত সংগীতপ্রণালীর সঙ্গে সাবলীল হইতে পারে না, কারণ ওটা ইমেজকে ধ্বংস করে নৈরাশ্য ও মাদকে তাকে নিঃস্ব হইতে বলে। আকাট এক নিহিলিজমে ডুব দিয়ে চিৎকার ছুঁড়তে তাকে বাধ্য করায়। নারীকে প্রকৃতি যে-অঙ্গে বয়ন করেছে সেখানে বিচিত্র ক্লেদ জমা হইলেও তার দেহ ও মনের সবটাই নিহিলিজমের ঘোর বিরোধী। যে-কারণে হয়ত তাকে রক-এর চেয়ে পপ বা হিপহপ-এ অধিক মনোরম দেখায়। বক্ষ্যমাণ রচনায় নারীর স্বকীয়তা প্রকাশের অন্তরায় তালাশের ক্ষণে এই দিকটা নিয়ে বিস্তারে যাওয়ার আরো সুযোগ বোধহয় ছিল। পরবর্তী কোনো স্টলমেন্টে এই প্রসঙ্গটা ব্যাপক আকারে সংযোজিত হলে পাঠভাবনায় নতুন রসদ যোগ হইতে পারে।

জগৎসংসারের যজ্ঞে নারীর অংশগ্রহণকে তিনি স্বয়ং কীভাবে বিচরান ও সেটা নিয়ে ভাবেন ইত্যাদি নিয়ে হাজারেবিজারে লেখাপত্তর অবশ্য মিলে। বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয়, এইসব রচনার চৌদ্দআনা নারীবাদ ইত্যাদি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া জাজমেন্টের ব্যবহারে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। পুংকুল বিরচিত নারীসংবেদি বয়ানের ছাপ সেখানে ভালোই টের পাওয়া যায়। সুলভ এই প্রবণতার কারণে নারীর বাচনিক বিভূতিকে তার নিজের পরিবর্তে অন্যের প্রতিধ্বনি বলে ভ্রম হয়। যারপরনাই নারীকে নিয়ে নারীর স্ব-বিচার  বা সেল্ফ জাজমেন্ট শোনা ও সেই নিক্তি দিয়ে তার বয়ানের ওজন মাপার মওকা পুরুষের ভাগ্যে জোটে না। বেগানা সমাচার-এর গদ্যভাষ্য নারীর স্ব-বিচারিক  শক্তি ব্যবহার করে রচিত হলে তার ধাঁচ বোধহয় অন্যরকম হইতেও পারত। যে-কারণে ভাবি, — পুরুষ বিরচিত এই বয়ানে নারীপাঠকরা যতক্ষণ-না আওয়াজ দিচ্ছেন ততক্ষণ অবধি রচনায় গাঁথা ইশারার শক্তি ও নতুন ভাবনা সংযোজন মনে হয় না সম্ভব।


শুরুয়াতের প্রশ্নগুলা গানের প্রসঙ্গ ধরে আবার ফিরায়া আনা যাক। পুরুষের নিউরনকোষ এই লেখার বাক্যজাল তৈরিতে যেসব প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছে নারী কি সেগুলা এস্তেমাল করতেন? টানা গদ্যের ফাঁকফোকরে যত ভাবনা বীজাকারে রচনার প্রতি পরতে ছলকায়, রচয়িতা নারী হইলে ভাববীজগুলা কি সেখানে ব্যবহৃত হইত, নাকি অন্যদিকে মোড় নিত? উত্তর অধমের জানা নেই। তবে প্রসঙ্গসূত্রে বিনয়ের সঙ্গে জানায়া রাখি, — অধমের অভিজ্ঞতায় বাংলা গানের জগতে মৌসুমী ভৌমিক বাদে দ্বিতীয় কারো নাম এই মুহূর্তে স্মরণ হয় না যিনি গানের জনরায় নারীর দেহমনের স্বকীয়তাকে স্বয়ং নারী কি চোখে দেখে সে-নিয়ে দুচার ছত্র ভাবনা জাতিকে উপহার দিতে পারেন। একথা ঠিক, বঙ্গে ফিমেল ভয়েস  অতীত দিনের ন্যায় খালি একধাঁচের গান এখন আর গায় না। মেল ভয়েসের  সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিচিত্র ভাবের গান সে গায়। চমৎকার ভাব ও সুর সেখানে ঠিকরায় বটে! এতকিছু সত্ত্বেও গানের কথা হইতে কম্পোজিশনের বনেদে পুরুষের নিউরনকোষ হইতে সৃষ্ট নারীপ্রতিমাকে অবিরত ইকো  করে যায়! বেগানা সমাচার  এই বিষয়ে বিস্তর আলোকপাত করার পাশাপাশি যর্থাথ বাক্যবুনোটে ইকোর কার্যকারণ তালাশ করেছেন; তবু কেন জানি মনে হইল কোথাও বুঝি ফাঁকি রহিয়া গেল। ইকোর পেছনে পুরুষভাবের আধিক্য দায়ী হইলেও নারী স্বয়ং নারীভাবে নিজেকে তালাশ করে কি না এমন একখান জিজ্ঞাসা সেখানে অমলিন থেকেই যায়!

আগেই বলেছি, নারী অদ্য নিজের সাকিন তালাশে নেমে পুরুষভাবকে বৃহদাংশে প্রতিপক্ষ ঠাওরায়, যেহেতু তার মনে হইতে থাকে ব্যক্তি ও মানব রূপে তার জৈবঅস্তিত্বকে ভাষা দিতে গেলে পুরুষভাবের দুনিয়ায় সৃষ্ট প্রতিমাকে প্রত্যাখ্যান ও বিরোধিতা ছাড়া উপায় নাই। যারপরনাই সে যবে ‘নিজের একটি ঘর’ সন্ধান করে সেখানে দেবী, জননী, প্রেমিকা, ভার্যা, গৃহিণী, গণিকা ইত্যাদি শত রূপে তার যে-সর্বংসহা শক্তি, সেটাকে মহিমান্বিত করতে বিমুখ থাকে। তার কাছে এইগুলা পুরুষসৃষ্ট ফাঁদ হিসেবে ধরা দেয়। বুদ্ধিমতি সচেতন নারী ইমেজগুলাকে ইগনোর করতে মরিয়া হয় ও বেটাছেলে হইতে চায়; আর ওদিকে অসেচতন নারী হইলে এগুলার মধ্যেই নিজের নারীত্বের উদয় ও অস্ত মাপে। যারপরনাই নারী যখন সচেতনভাবে তার নিজেকে গানের কথা, ভাব ও সুরে খুঁজে ফিরে সেখানে হয় সমর্পণ নয় প্রত্যাখ্যানের বেটাগিরি অগ্রে ফোটে। সোজা কথায় বাংলা বা আবিশ্ব সংগীতে নারী এখনাবধি (*ব্যতিক্রম থাকতে পারে এবং সেটা সামগ্রিক বিচারে এখানে গৌণ) নিজের সহজাত প্রাকৃতিকতাকে দার্ঢ্য সহকারে তুলে ধরতে সফল নয়। বেগানা সমাচার-এ এই দিকটায় বিস্তারিত আলোকসম্পাত ঘটিলে ভালো লাগত।

ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর বহিতে পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন শেষের মুহূর্তিক অনুভবকে তুলে ধরেছিলেন। মিলন শেষে এটা ঘটে, পুরুষ স্খলিত হয় ও শয্যা ছেড়ে দ্রুত উঠে পড়ে। সে হয়ত জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তামাক সেবনের বাসনায় সিগ্রেটে অগ্নিসংযোগ করে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘরে পাক খায়। পুরুষ সেই মুহূর্তে হয়ত খানিক উদাস হয়। অতঃপর সে নিজেকে পরবর্তী কোনো কাজের জন্য প্রস্তুত করে। জামাকাপড় গায়ে চড়ায় আর রমণীকে বিদায়চুম্বন উপহার দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ধান্দা করে। ওদিকে রমণী শয্যায় আরো কিছুখন শায়িতই থাকে। রমণের পুলক ও ধকল সামলেসুমলে তৎপর হইতে তার খানিক বিলম্ব হয়।জগৎসংসারের দিকে উভয়ের তৎপর হওয়ার মধ্যবর্তী এই ব্যবধানকে উলফ নারীর নিষ্ক্রিয়তা   বলে পুকার গিয়াছিলেন। এই নিষ্ক্রিয়তার প্রতি পুরুষের উদাসীন মনোভাবে তিনি দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার বীজ দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল বেটাছেলে কাম খালাস করে ভাগা দিতে চায়। তার সংবেদনে রমণ-পরবর্তী রমণীর পুনরায় জগতের দিকে সংযুক্ত হওয়ার শ্লথ প্রক্রিয়া কোনো গুরুত্ব বয়ে আনে না। এই সংবেদনহীনতাকে উলফ পুরুষভাবের সেই লক্ষণ বলে বুঝে নিয়েছিলেন যে কেবল স্বার্থপরের মতো দেহকে ব্যবহারের পর টিস্যু দিয়ে হাত মোছার মতো নারীকে শয্যাশায়ী রেখে পালায়।

পুরুষ চিরকাল পালায় আর নারী সেই পলয়ানপর পুরুষকে ধরবে বলে নিজের দেহকে অবিরত উত্তাল এক কামযন্ত্র রূপে নানা উপাচারে সুসজ্জিত করতে থাকে। উলফের ব্যাখ্যাকে এখানে অবশ্য অন্যভাবেও ভাবা যায়। রমণসুখের প্রক্রিয়াকে নিজ দেহে শোষণের এই যে প্রকৃতিগত বিলম্ব সেখানেই নারী ও পুরুষে জন্মের ফারাক ঘটে যায়। কথা সত্য, পুরুষ দিয়ে খালাস। নারী ওদিকে কেবল নিঃসরণে খালাস হইতে পারে না। তাকে নিঃসরণের সঙ্গে গ্রহণের কামটাও সারতে হয়। একটা রোমন্থন ভারাতুর ঘোরের মধ্যে সে তখন ধরিত্রীর সঙ্গে নিজেকে অবিচ্ছেদ্য করে। পুরুষের কাছে রমণ মানে হচ্ছে জৈবসুখ। খালাস করার ব্যাপার মাত্র। নারীর কাছে সেটা জৈবসুখের অধিক। তার দেহ এই জৈবতার ভিতর দিয়ে একইসঙ্গে পূর্ণ ও নিঃস্ব হয়। পুরুষের বীর্যে সে এখন পূর্ণ। নিজের রাগমোচনের কারণে কার্যত নিঃস্ব। এই দ্বৈততার মাঝে সে ক্রমাগতভাবে প্রেয়সী, জননী হইতে গণিকা অবধি বিচিত্র সজ্জায় সমাজের দায় মেটায়। পুরুষের পক্ষে তার এই আপাত নিষ্ক্রিয়তার মাঝে সচল সক্রিয়তাকে অনুভব করা সহজ ব্যাপার নয়। উলফ এদিক থেকেও ভাবতে পারতেন। সেদিকে না যাওয়ার কারণে তাঁর পুরুষ কর্তৃক ব্যবহৃত নারী অবধারিত নিয়মে নিজের দেহকে বিপজ্জনক কামযন্ত্রের অধিক কিছু ভাবতে পারে না। দেহখানাকে অস্ত্র করে সে পুরুষের ওপর নিজের বেটিগিরি ফলাতে উন্মুখ হয় ও আরো বেশি পুং-প্রজাতির শিকারে পরিণত হয়। বাংলাদেশে অদ্য যে-ঘটনা নিয়ে জাতির বিবেকগণ ভীষণ সোচ্চার সেই পরীমণির ঘটনা এমনধারা বেটিগিরির পরিণাম বটে!

বেটিগিরির এই কামটা কেটি পেরি তার Bon Appétit  গানের কথা ও দৃশ্যায়নে দারুণভাবে ঘটায়েছেন। গায়িকা তার দেহকে মার্কিন দেশের জনপ্রিয় ও সুস্বাদু খাদ্য রূপে হাজির করে। রান্নাঘরে পাচকরা মিলে তার অপূর্ব দেহখানাকে ময়দার খামি রূপে ব্যবহার করে এবং সুস্বাদু ডিশ হিসেবে গায়িকা গ্রাহকের টেবিলে সার্ভ হইতে থাকেন। নিজেকে Bon Appétit  রূপে হাজির করার মাধ্যমে কেটি পেরি যেন পুরুষকে বার্তাটা জানাইয়া দেয়, — দেহটারে খাবিই যখন তো মজা করে খা। একটা প্রতিশোধস্পৃহা সেখানে নীরবে বহে। স্পৃহাটা অন্যভাবে ক্যালিবানিজমের স্মারক। এই সমাজে পুরুষ খাদক এবং নারী খাদ্য। প্রেমিকা হইতে জননী হইতে গণিকা সকল সজ্জায় তার অঙ্গভক্ষণে সমাজের তিয়াস মিটে। বেগানা সমাচার  যেমন ‘বস্তির রানী সুরাইয়া’-র উদাহরণ পেশপূর্বক পুরুষভাবে বিদ্যমান নারীমাংসভূক বাসনা তথা ক্যানিবাল খিদেটার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।  সমস্যা হলো এই স্পৃহায় পুরুষকারের আঁতে ঘা লাগে না। ঘটনাখান তার কাছে আমোদ ও যৌনসুড়সুড়ির মজা নিয়ে আসে। এখান হইতে সে মার্কিন ললনা কেটি ও বঙ্গের সুরাইয়া বা পরীমণিকে ক্যালিবান উপাচার সরবরাহের জন্য তাতিয়ে তোলে। বাংলা গানে শুধু নয়, পশ্চিমা মুল্লুকে ম্যাডোনা থেকে কেটি পেরি সকলেই নিজের দেহকে আজো চিনতে শিখেন নাই। এভাবেও বলা যায়, প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ স্মারক রমণীদেহকে প্রতিশোধস্পৃহা হইতে সৃষ্ট আঙ্গিকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে চতুর পুরুষের সমীহ ও ভালোবাসা আদায়ের এহেন পন্থা প্রকারান্তরে নারীবাদী চেতনার বিকারকেই অবমুক্ত করে যায়।

যেসব দেশে নারীর নিজত্ব (*আত্মকাহনও বলা যাইতে পারে) তালাশের স্পেস আগে থেকে তৈরি সেখানেও পুঙ্গবসৃষ্ট প্রতিমার প্রতিধ্বনি  ব্যাপক। প্রকৃতির অনুপম জৈবতায় সৃষ্ট দেহকে নারী প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত করে কেন জানি ভাবতে পারে না! সর্বংসহা ধরিত্রীর সঙ্গে তার জন্মের মিত্রতা। ধরিত্রীর মতোই বেটাছেলেদের শতেক পীড়ন সে মুখ বুজে সহ্য করে। বেটাছেলেরা তাকে যেমন ইচ্ছা রগড়ায়। এই দেবী তো পরক্ষণে সেবাদাসী রূপে তাকে হাজির করে। প্রেমিকা থেকে নিমিষে গৃহিণী ও ভার্যায় তার সাকিন ঠিক করে দেয়। ক্ষণপরে গণিকা রূপেও সম্ভাষে। প্রকৃতি কামাচারী, এছাড়া তার পক্ষে সৃজন ও লালন সম্ভব নয়। নারী স্বয়ং প্রকৃতি হওয়ার কারণে কামাচারের সামগ্রী হইতে সে বাধ্য থাকে। অবিরত ব্যবহারযোগ্যতা তার নিয়তি। এত কিছু সয়েও তার একখণ্ড ত্রিভূজ হইতে যে-জগৎ অবিরাম চমকায়…! — নারীত্বের এই প্রচণ্ড সহনক্ষমতা এবং সকল আকারে উপযোগ মেটানোর শক্তিকে তুলে ধরার পরিবর্তে নারী স্বয়ং বোধশক্তিহীন পুতুলের ন্যায় সমাজে ঘুরেফিরে। বেগানা সমাচার-এ নারীর আত্মচেতনায় সবাক হওয়ার এই ঘাটতিটা খানিক উপেক্ষিত মনে হয়েছে।

বাউল ও লোকগানের জগতে নারীভাবিক ভাষার উপস্থাপন বিষয়ে রচয়িতার ইশারামাখা আলাপ এই রচনার শ্রেষ্ঠাংশ বটে। তবে রামপ্রসাদী সেখানে সংযুক্ত হইতে পারত। নারীভাবিক আবেশে ঈশ্বর ও প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগ তালাশের অনন্য ঘটনা উপমহাদেশ ছাড়া অন্যত্র বিশেষ চোখে পড়ে না। বাউলের ঈশ্বর চেতনায় সমর্পিত হওয়াটা এক্ষেত্রে নারীর প্রকৃতি সূত্রে প্রাপ্ত মৌল গুণাবলীর অবধানে বড়ো কোনো বাধা নয়। অবাঙমানসগোচর ঈশ্বরকে বাংলার বাউল সাধক মহাবৈশ্বিক ঘটনা রূপে মানবদেহে লীলা করতে দেখে। দেহটা এখানে মহাবৈশ্বিক ঈশ্বরের আণুবীক্ষণিক স্বরূপ বৈ অন্য কিছু নয়। নারী বা পুরুষ পরিচয় ছাপিয়ে সৃষ্টিজগৎ আর মানুষের জয়গান সেখানে বড়ো হয়ে ওঠে। যারপরনাই বাংলার বাউল ও লোকগানের জগতে সেই নারীকে পাই যে একাদিক্রমে সৃষ্টির সারবস্তু থেকে শুরু করে তার পালন, সংস্থিতি ও বিনাশের আকর। নারীর ধরিত্রীরূপী ইমেজকে পুঙ্গবসৃষ্ট ইমেজের ঘষামাজার কামে ব্যবহার যাওয়ার কথা বঙ্গের সচেতন নারীকুল ভাবতে পারলে কারুবাসনার অনেক কিছু পাল্টানো সম্ভব হইত। বাউল করিম জন্ম সূত্রে পুরুষ হয়েও নিজেকে কুলহারা কলঙ্কিনী  ভাবতে পেরেছেন এ-কারণেই।

লোকগানের রানী মমতাজ আর ওদিকে নিজের নারীসত্তার খবর নেওয়ার তাগিদে আনু শেহ আনাদিলরা বাউলের নারীভাবিক সংযোগপদ্ধতিতে গমনের চেষ্টা করেছেন বৈকি। যদিও তাঁদের এই ডুবুরি হওয়ার ঘটনা বড়ো কোনো মাত্রাগত ব্যবধান বা প্রতি-অভিসন্দর্ভ তৈয়ারে সহায় হইতে পারে নাই। আবদুল গফুর হালীর রসিক দিলকা জ্বালা / ও লাল কুর্তাওয়ালা / দিলি বড় জ্বালা রে পাঞ্জাবিওয়ালা  গানের কলির মধ্যে Spiritual Sexism-এর যে-উচ্ছ্বলতা ফেটে বের হয় তার তুলনায় মমতাজের বুকটা ফাইট্টা যায়  বা বন্ধু তুই লোকাল বাস  ইত্যাদি পুরুষের বিকৃত কামবাসনা নারীর ঘাড়ে চালান করার নামান্তর মনে হইতে থাকে। হালীর গীতকলি নারীভাবিক অঙ্গে পুরুষকে এ্যাপ্রোচ করে এবং তাকে নিজেদেহে টেনে নিয়ে অদ্বৈত হইতে চায়, শিব ও পার্বতী যেমন রমণক্ষণে অর্ধনারীশ্বরে রূপ নিতেন। এই Spiritual Sexism  হালীর পরিবর্তে একজন নারীর হস্তে রচিত হইতে পারত। আফসোস, আজো সেটা ঘটে নাই!

বাংলার লোক ও বাউল অঙ্গের গানে নারীর মেটাফোর তো খালি আধ্যাত্মিকতায় নিজেকে নিঃস্ব করে না। তার মধ্যে নারীর সর্বপ্রাকৃতিক রূপের অঢেল বিবরণ আশ্চর্যজনকভাবে পুরুষরা যুগে-যুগে সৃজন করেছেন। পুরুষভাবিক সমাজে বিদ্যমান ইমেজফাঁদে বন্দি নারীর বেদনাকেও বহুমাত্রিক মেটাফোরের ভিতর দিয়ে নতুন অর্থে মহিমান্বিত করার চেষ্টা সেখানে আকছার মিলে। প্রশ্ন এখানেও ওঠে, — লোকগানের বহুমাত্রিকতায় নিজস্ব ঢংয়ে নতুনত্বের স্বাদ আনয়নে নারী সংগীতকার সফলকাম হইতে পেরেছেন কি? নাকি এখানেও পুরুষ-প্রণীত পদ্ধতির জালে তারা আটকে আছেন? এ-বিষয়ে বিস্তারিত লেখার দম এই মুহূর্তে নাই। তবে লোকাচারে নিহিত নারীর সুখদুঃখমাখা অনুভবের জগৎকে তালাশ ও সেই সূত্রে তার নারীকৃত নবায়নের জরুরতকে বেগানা সমাচার  যথার্থই চিহ্নিত করেছে। যে-কারণে এই রচনার পাঠান্তর-পরবর্তী ভাবনায় (*আবারো বলি) নারীপাঠকের সক্রিয়তা বড় বেশি কাম্য।

তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you