এক ঠিকানায় দুই চিঠি || ইমরান ফিরদাউস

এক ঠিকানায় দুই চিঠি || ইমরান ফিরদাউস

ভূমিকা
ক্রিস কর্নেল আর চেস্টার বেনিংটন। দুই জানি দোস্ত। দুই বিদেহী আত্মা। দুই মাসের দূরত্বে। বিনা নোটিশে। কারণ দর্শানো ছাড়াই, ছাটাই করে দিলেন পৃথিবীকে। বয়সে ছোট-বড় এই মানুষ দুইজন অদ্ভুত গভীর সম্পর্ক লালন করে গেছেন জীবনের আখেরি দিন পর্যন্ত। ক্রিস বা চেস্টার দুইজনই দুই সময়ে মাতোয়াল করেছেন দুই প্রজন্মকে। ক্রিসের মতন চেস্টারও গানে গানে বলতেন নিরাভরণ জীবন আর সহজ যাপনের স্বাধীনতার কথা। উদারনৈতিক দুনিয়াবির আলখাল্লার নিচে চাপা পড়ে যাওয়া প্রতিরোধ, প্রতিবাদ তাদের বিবাগী সুরের ঝঙ্কারে দর্শক-শ্রোতাকে করেছে একনিষ্ঠ হেডব্যাংগার। জীবনের সুরতহালে ব্যস্ত থাকা দুই আদমি কখন যে মর্গের ময়নাতদন্তের আইটেম হয়ে গেলেন নিজে নিজে, তা এক রহস্যপত্রিকার কাভারস্টোরি হয়ে ছাপা হয়ে রইলো মস্তিষ্কের পেপারস্ট্যান্ডে।

ক্রিসের মৃত্যু চেস্টারের কাছে এক সহোদর হারানোর বেদনার সমান অভিঘাত বয়ে আনে। এই হারানোর বেদনা চেস্টারের কষ্টের প্রান্ত ছুঁয়ে স্মৃতিমেদুর করে তোলে; যার সাক্ষাৎ নমুনা একটি চিঠি। বা একটি হাহাকার। যা চেস্টার লিখেছিলো গায়েবি ক্রিসকে। কিন্তু, বিধি ছাড়া আর কেইবা জানতো চেস্টারবিহীন দল লিংকিন পার্ককে ঠিক একই রকমের একটি পত্র রচনা করতে হবে বুকের উনুনে সেঁকা কথামালা দিয়ে। দু-চোখে হারানোর বেদনা নিয়ে।

ক্রিস বা চেস্টার পিয়াসিদের পুরনো হৃদয়ে এই পত্রমালা হয়তোবা নতুন করে খুঁজে নেবার সুযোগ করে দেবে জীবনের অথৈ নদী পাড়ি দেওয়া দুই রকস্টারকে। বুঝে উঠতে সহায়তা করবে হাত বাড়ালেই বন্ধু পাওয়া যায় না, বাড়ালেই হাত বন্ধু সবাই হয় না।

জিয়োহ!
ইফি

প্রিয় ক্রিস,
গত রাতে স্বপ্নে বিটলস্‌রা এসে দেখা দিয়া গেল। যখন স্বপ্নের ঘোরে মগজের থিয়েটারে চলছিল দ্য বিটলসে্‌র রকি র‍্যাকুন  গীতটা, ঘুমটা তখনো চোখ থেকে কপালে উঠে নাই। কিন্তু, চোখ খুলেই দেখি আমার বউয়ের শঙ্কাবিহ্বল থমথমে চেহারা। ও বললো, আমার জানিদোস্ত আর নেই।

তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো হুড়মুড় করে এসে জড়ো হলো মনের খেলাঘরে, মনের মধ্যে একটা স্মৃতিপ্লাজার ধ্স ঘটে গেল যেন খবরটা হজম করতে গিয়ে। সকাল থেকে আমি তোমার নাম ধইরা কানতেছি দুঃখে, সকাতরে অগাধ কৃতজ্ঞতাবোধে।

আমি ক্যামনে ভুলবো কী সুন্দর সময় কাটাইছি তোমার, তোমার পরিবারে লগে — তোমার স্নেহজড়ানো উষ্ণ অভ্যর্থনায়। তুমি যে আমাকে কতভাবে অনুপ্রাণিত করছো তার ফিরিস্তি তোমারে কোনোদিন দেওয়া হবে না আর।

তোমার মেধা বিশুদ্ধ এবং অতুলনীয়। তোমার কণ্ঠ যেন আনন্দ ও বেদনা, ক্রোধ ও ক্ষমা, প্রেম ও মর্মবেদনায় মোড়া এক বৈচিত্র্যের কাফন। মনে পড়ে, তুমিই কোনো-এক আড্ডায় বলছিলে…আমরা সকলেই যে তাই মানে এইসব গুণের মিশেলে গড়া মাটিকাদার মানুষ — তা তোমার কাছ থেকেই জেনেছিলাম। আমি মাত্রই একটা ভিডিও দেখলাম যেখানে তুমি দ্য বিটলসের অ্যা ডে ইন দ্য লাইফ  গাইছো আর আমি ভাবছি কিছুক্ষণ আগে দেখা স্বপ্নের কথা।

পথ ছেড়ে এই যে দূরে চলে গেলে…এইভাবেই মনে হয় তুমি বিদায় নিতে চেয়েছিলে — এমনটা ভাবতে পারলে সুখী হতাম। তোমাকে ছাড়া এই গ্রহ আমি কল্পনায় আঁকতে পারছি না। পরবর্তী জীবনে তুমি যেন খুঁজে পাও তোমার কাঙ্ক্ষিত শান্তি — এই প্রার্থনাই করি।

তোমার সহধর্মিনী, সন্তানসন্ততি, পরিবার আর বন্ধুদের জন্য আমার অবিরল ভালোবাসা রইলো।

অশেষ ধন্যবাদ, তোমার স্মৃতিমেদুর জীবনের অংশ হয়ে উঠার সুযোগ করে দেবার জন্য।

আমার সকল ভালোবাসা নিও।

ইতি
তোমার সখা
চেস্টার বেনিংটন
১৯ মে ২০১৭

প্রিয় চেস্টার,
আমাদের মন ভালো নেই। আমাদের পরিবারের সাথে যা ঘটে গেল, এ অবধি সেই শোক এবং অপলাপের গভীর অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমরা।

কত মনের মুকুরে যে তোমার ঠাঁই ছিল, তা বোধহয় তোমার নিজেরও জানা ছিল না। বিগত কয়দিনে আমরা দেখেছি, সিক্ত হয়েছি পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক মানুষের ভালোবাসা ও মমতায়। তালিন্ডা এবং তোমার পরিবার এই অনুভূতিকে সেলাম জানিয়ে সারা বিশ্ববাসীকে বলতে চায় — একজন অর্ধাঙ্গ, একজন পুত্র, একজন বাবা হিসেবে তুমি অদ্বিতীয়; তুমি ছাড়া এই সংসার অপূর্ণ। সামনের বছরগুলোতে কি করা যাবে বা যায়, তা নিয়ে আমাদের তুমুল আলাপের সময়গুলোতে তোমার অধীরতা আমাদেরও সংক্রমিত করে যেত এক লহমায়।

তোমার অনুপস্থিতি এমন এক শূন্যতার চাদরে জড়িয়ে দিল, যা ত্বকের মতন লেপ্টে থাকবে স্মরণ-বিস্মরণে গড়া ভাবনার দেহজুড়ে। প্রবল ফুর্তিবাজ, মজাদার, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সৃজনশীল, দয়াময়, উদার এক কণ্ঠস্বরের না-থাকার নীরব রোদন ডুকরে উঠছে ঘরের চারপাশ জুড়ে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি নিজেদের প্রবোধ দিতে এই বলে — যে-পিশাচ তোমারে আমাদের জীবন থেকে ছিনায় নিয়ে গেল সে এই খেলার সাইডলাইনের দর্শক ছিলো না মোটেও। সর্বোপরি, তোমার গানেই ছিলো ঐ পিশাচগুলোরে একহাত দেখে নেওয়ার ঈমানি জযবা; আর এ কারণেই সকলেই তোমাকে মনের গহীন ভিতর থেকে বেসেছে ভালো সবসময়। অকুতোভয় তুমি পেরেছিলে যাপনের (অ)যাচিত জঞ্জালগুলো হিপোক্রিসির ঝালর দিয়ে আড়াল না করে, বরং সেগুলো মেলে ধরতে। আর এইটা করে ফেলার ভেতর দিয়ে তুমি আমাদের এনেছো আরো ঘন নৈকট্যে, শিখিয়েছো আরো মানুষ হয়ে উঠতে।

গীত করা এবং পারফর্ম করার প্রশ্নে আমাদের ভালোবাসার শিখা জ্বলে, জ্বলছে, জ্বলবে অনির্বাণ। যখন আমরা জানি না ভবিষ্যৎ আমাদের কোন পথে নিয়ে পৌঁছুবে, তখনও আমরা মনেপ্রাণে জানি তোমার সাহচর্যই আমাদের জীবনকে করেছে শুভ্র-রঙিন। ধন্যবাদ এই সওগাতের জন্য। আমরা তোমাকে ভালোবাসি এবং অসম্ভবভাবে তোমারে হারায়ে খুঁজি…

যতক্ষণ না আবার দেখা হচ্ছে আমাদের।
ইতি
এলপি (লিংকিন পার্ক)
২৪ জুলাই ২০১৭

দোহাই
১।  Read Chester Bennington’s Heartbreaking Letter to Chris Cornell
২।  DEAR CHESTER


ইমরান ফিরদাউস রচনারাশি
গানপারে ক্রিস কর্নেল
গানপারে চেস্টার বেনিংটন ও লিঙ্কিন পার্ক

COMMENTS

error: