উনিশ-শ-সাতানব্বইয়ের অক্টোবরে বিমানপতনে ইন্তেকালের আগে-অব্দি তিনদশকের মিউজিক-ক্যারিয়ারে ডেনভারের গান সংখ্যায় এবং সম্পন্নতায় ব্যাপক উঁচু চূড়ায় যেয়ে ঠেকেছে। যে-কোনো সংগীতকারের জন্যে ডেনভারের (John Denver) গানসম্ভার অভিনিবেশ সহকারে শ্রাব্য। মঞ্চে এবং অ্যালবামে একজন শিল্পী কীভাবে এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও নিজের সিগ্নেচার বজায় রেখে একটা স্ট্যান্ডার্ড লেভেলের মিউজিক উপহার দিয়ে যেতে পারেন, এই শিক্ষা যাদের কাছ থেকে লভ্য তাদের মধ্যে ডেনভার একজন। তিরিশ বছরের গানপদচারণায় ডেনভারের সাফল্য ঈর্ষণীয়। শুধু জনপছন্দের নিরিখেই যদি বিবেচনা করা হয়, যাকে বলে হিট গান, তাহলেও জনির গান গুনে একহাতের পাঞ্জায় শেষ করা যাবে না। অ্যালবামসংখ্যাও অনেক, সম্ভবত ডজন-দেড়েক অ্যালবাম রয়েছে ডেনভারের ঝুলিতে। এবং তার জনজোয়ার-তোলা গানগুলোর সব-কয়টা একবৈঠকে ইয়াদ করে ওঠা আদৌ সোজা না। গানগুলোর মধ্যে ‘টেইক মি হোম, কান্ট্রিরোডস্’, ‘রকি মাউন্টেন হাই ইন দ্য কলোর্যাডো’, ‘সানশাইন অন মাই শোল্ডার্স’, ‘লিয়িভিং অন অ্যা জেট প্লেইন’, ‘ক্যালিপ্সো’ প্রভৃতি মনে পড়ছে এই মুহূর্তে।
ডেনভার তার সমকালীন সংগীতশিল্পীদের কাছে হেলাফেলা আর হাসিঠাট্টা পেয়ে গেছেন আগাগোড়া। কারা তার সমকালে টেলিভিশনে-মঞ্চে দাপায়ে বেড়াচ্ছিলেন, এইটা আজ বাইর করা সাধ্যাতীত তো নয়, একটি ক্লিকেই হদিস মিলবে সেই সময়ের। কিন্তু কেন অবজ্ঞা আর ঠাট্টাতামাশার শিকার হতে হয়েছিল জন ডেনভারকে? সেসবই বিচিত্র হিউমিলিয়েইটিং কারবার। এমনকি ডেনভারকে গেঁয়ো ভূতের মতো দেখায়, এইটা পাব্লিকলিই বলা হয়েছে। এত বোকাহাবাগোবা চেহারার লোক, বুড়া দাদিমার মতো চশমা লাগায়ে স্টেজে-টেলিভিশনে অ্যাপিয়ার করে, এইসব কথাবার্তা কাগজে কাগজে ছড়িয়েছে। এবং সর্বোপরি মিউজিকের জন্য সইতে হয়েছে সতীর্থদের সংখ্যাতীত রগড়। জনি কী-রকম যেন স্পঞ্জি আর অসহনীয় সফট মিউজিক করেন যা আদ্যিকালের রদ্দি জিনিশ, শুনতে হয়েছে এমন কথাবার্তা। আর লিরিকগুলা যা লেখে তা তো পাতেই তুলবার মতো নয়। একেবারে ল্যাবগ্যাবে লিরিক্স সমস্তই। ফ্যাশনের ফ জানে না, আসছে স্টেজে … এইসব অবমাননার শিকার হয়ে যেতে হয়েছে ডেনভার বেচারাকে আমৃত্যু। তবু তার গান দাঁড়িয়েছে। এখনও বহাল তবিয়তে আছে ডেনভারের গানগুলো। সমকালীন অনেক তালেবর-কুতুবের গানবাজনা আজ আর শুনি না আমরা, ডেনভারের এখনও শুনি। টিকে গেছে ডেনভারের সিগ্নেচার। তার গান প্রভাব রেখেছে মিউজিকে, ব্যাপক প্রভাব রেখেছে বিশেষভাবেই ইংরেজি কান্ট্রিমিউজিকে, এরই মধ্যে একাধিক প্রজন্ম এসে গেছে, এবং তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জন ডেনভারের গান শুনছে এখনও, রেখে চলেছে ডেনভারের প্রভাবের পরম্পরা তারা আজও।
সম্প্রতি ট্রিবিউট জানিয়ে একটা অ্যালবাম রিলিজ্ হয়েছে ডেনভারের ষোলোটা গান নিয়ে। অ্যালবামটা রিলিজ্ হয়েছে অবশ্য ২০১৩ সনে, বেশ বছর-চার গড়িয়েছে এরই মধ্যে, একদম সম্প্রতি নিশ্চয় ঠিক হবে না বলা। তারপরও জন ডেনভারের মিউজিক একবিংশ শতকের নতুন প্রজন্মের শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিতে অ্যালবামটা ভালো অবদান রাখতে পেরেছে। দেখা যাচ্ছে যে অ্যালবামরিলিজের বছরেই বিলবোর্ড ম্যাগাজিনের র্যাঙ্কিং অনুযায়ী তিন নাম্বার স্থান পেয়েছিল টপ ফোক অ্যালবামের ক্যাটিগ্যরিতে। একইসঙ্গে পেয়েছিল টপ রক্ অ্যালবামের দশম এবং টপ ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যালবামেও দশম স্থান। টপ কান্ট্রি অ্যালবাম হিশেবে এইটা দ্বাদশ হয়েছিল ওই সময়। এই হিসাব ইউএস বিলবোর্ড টপচার্টের ২০১৩ মোহাফেজখানায় প্রিজার্ভড।
অ্যালবামটার নাম ‘দি মিউজিক ইজ্ য়্যু : অ্যা ট্রিবিউট টু জন ডেনভার’ (The Music Is You : a tribute to John Denver)। ষোলোটা ট্র্যাক রয়েছে অ্যালবামে, সেগুলোর প্রতিটাই জন ডেনভারের গ্রেইট নাম্বার একেকটা। গানগুলো হচ্ছে : ‘লিয়িভিং অন অ্যা জেট প্লেইন’, ‘টেইক মি টু টুমরো’, ‘অল অফ মাই মেমোরিস্’, ‘প্রিজনার্স’, ‘সানশাইন অন মাই শোল্ডার্স’, ‘ব্যাক হোম অ্যাগেইন’, ‘দিস্ ওল্ড গিটার’, ‘সামডেইস্ আর ডায়মন্ডস্’, ‘রকি মাউন্টেন হাই’, ‘অ্যানি-স্ স্যং’, ‘ল্যুকিং ফর স্পেইস্’, ‘টেইক মি হোম, কান্ট্রিরোডস্’, ‘দি ইগল অ্যান্ড দি হ্যক্’, ‘আই গ্যেস্ হি উড র্যাদার বি ইন কলোর্যাডো’, ‘ড্যার্সি ফ্যারো’, এবং ‘উডেন ইন্ডিয়ান’। সব-কয়টা গান ডেনভারের হলেও সংকলনে শিল্পীরা কাভার করার সময় সেগুলোর ইম্প্রোভাইজড ভার্শনের দিকে যত্ন নিয়েছেন বোঝা যায়, ইম্প্রোভাইজেশনের সুন্দর নজির রেখেছেন কয়েকটা গানে, আদি ট্র্যাকের টেম্পো কমিয়ে-বাড়িয়ে গানগুলোকে ইন্টারপ্রেট করেছেন নিজেদের কায়দায়। ডেনভার তাতে ক্ষুণ্ণ হন নাই, খর্ব হয় নাই অরিজিন্যালের ডিগ্নিটি, ইয়াঙ্গার অডিয়েন্সের জন্যে ব্যাপারটা ভালো হয়েছে বলা বাঞ্ছনীয়। মূলের দিকে ধাবিত হবার তোরণ হয়েছে এফোর্টটা।
একদল অ্যামেরিক্যান মিউজিশিয়্যান অ্যালবামটাতে কন্ট্রিবিউট করেছেন, রেকর্ড প্রোডিউস করেছেন, কণ্ঠ দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটা ব্যান্ড এবং কয়েকজন ব্যক্তি অবদায়কের নাম আমরা লিখতে পারি এখানে। যেমন, গ্রুপগুলোর মধ্যে যেমন, ‘মাই মর্নিং জ্যাকেট’, ‘ট্রেইন’, ‘ওল্ড ক্রো মেডিসিন শো’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তি সিঙ্গার কয়েকজন যেমন ডেইভ ম্যাথ্যুস্, শ্যারন ফন ইটেন, ল্যুসিন্ডা উইলিয়াম্স, অ্যামোস্ লি, অ্যালেন স্টোন, ব্র্যান্ডি কার্লাইল প্রমুখের নাম বললে চেনা যায়।
একঘণ্টা ব্যাপ্তির অ্যালবামখানা খালি বিলবোর্ড টপচার্টে এসেছে একাধিক ক্যাটিগ্যরিতে, তা নয়; ক্রিটিকদের অ্যাক্লেইমও লভেছে বেশ উল্লেখ করার মতো। জন ডেনভারের গানে যে-প্রশান্তি, যে-মাধুর্য, যে-চিরনৈসর্গিকতা, অ্যান্থোলোজিটিতে সেসবের ছোঁয়া হারায় নাই বৈকি। বিশেষভাবে নয়া জামানার শিল্পীদের গলায় এবং সংগীতায়োজনে ডেনভার কেমন লাগে শুনতে, এক্সপেরিয়েন্সটার জন্যে অ্যালবামটা সাধারণ্যে গ্রাহ্য হতেই পারে। এমনিতে এই ইউটিউবযুগে যদিও জন ডেনভারের কাভার ভার্শনের অভাব নাই, সীমাশুমার নাই, কিন্তু সুপরিকল্পিত সংকলনের একটা আমেজে ডেনভার শোনার মওকাটা আলবৎ হাতছাড়া করতে রাজি হবেন না তার সমুজদার শ্রোতারা।
প্রতিবেদক : মিল্টন মৃধা
… …
Ξ গানপারে জন ডেনভার Ξ
————————————————————–
ক্রিসম্যাস ট্যুগেদার :: জন ডেনভার
জন ডেনভার : তবুও শুনাইয়া যাব ফিইরা আসার গান || হাসান শাহরিয়ার
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS