আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী : জীবন, সংগীত ও কবিতা || সুমন বনিক

আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী : জীবন, সংগীত ও কবিতা || সুমন বনিক

শেয়ার করুন:

 

বাংলা সাহিত্যের প্রতিভাবান কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর ১১৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হলো ৩১ মে ২০২৫ — সারদা হল, সিলেটে। আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিকে স্মরণ করা হলো। কবির রচিত গানের প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন বয়সের শিশুকিশোর অংশগ্রহণ করে এবং প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কার ও সনদ বিতরণ করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী রচিত গান পরিবেশিত হয়। আলোচনা সভা পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি, গবেষক ও শিক্ষাবিদ ডক্টর আবুল ফতেহ ফাত্তাহ। ‘কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার’ প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন তিনি।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন লেখক ও অনুবাদক মিহিরকান্তি চৌধুরী, কবি ও গবেষক ডক্টর মোস্তাক আহমাদ দীন, কবি ও সম্পাদক পুলিন রায় এবং বক্তব্য রাখি আমি। আলোচনাপর্বটিতে সভাপতিত্ব করেন কবি ও গবেষক এ. কে. শেরাম। অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্যে কবিপুত্র আলী মোস্তাফা চৌধুরী উপস্থিত সুধীজনদের ধন্যবাদ জানান এবং কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর রচিত সৃষ্টিসমগ্র পঠনপাঠনের আহ্বান জানান।

সবশেষ আয়োজনে ছিল মনকাড়া সংগীত পরিবেশনা। আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী স্মৃতি পর্ষদ কর্তৃক আয়োজিত পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল মনোমুগ্ধকর। পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক কবি ও সংগীতশিল্পী বিমান তালুকদারের নিষ্ঠা ও শ্রমে অনুষ্ঠানটি ছিল রুচিশীল ও মননশীল। অনুষ্ঠানের নেপথ্যে-থাকা কবির সুযোগ্য পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী মোস্তাফা চৌধুরীর নামোল্লেখ না করলেই নয়!

আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী : জীবনসংক্ষেপ
কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী, জন্ম ১৯১২ ও জীবনাবসান ১৯৬৬, সিলেট।

ওগো সজনী গোয়াগাছো ট্যাক্সো লাগিলোনি
বাটার উফর ফইলো ঠাটা গাল ভরি ফান খায়তায়নি।

বহুল জনপ্রিয় ও কালোত্তীর্ণ ওই দুই চরণওয়ালা গানটির রচয়িতা আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী।

কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী কবিতা ও সনেট লিখেছেন, লিখেছেন গান। তিনি ছয়শতাধিক গান, প্রায় এক হাজারের বেশি সনেট রচনা করেছেন। মর্মত, কবিতাই ছিল তাঁর মূল চারণভূমি । কবিতার সৃজন-আনন্দই আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীকে সংগীতের জগতে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর রচনার বিশেষ দিক হলো, তিনি কবিতা-সনেট লিখেছেন প্রমিত বাংলায়, আবার অনেক গান লিখেছেন আঞ্চলিক ভাষায়। তিনি বিশ্বমানব ও লোকমানব দুই সত্তাকেই অন্তরে ধারণ করেছেন পরম মমতায় এবং অত্যন্ত সচেতনভাবে। কবিকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি।

আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী মূলত কবি। গীতিকারও, সমানভাবেই, তিনি প্রায় ছয়শতাধিক গান লিখেছেন।

গুরুসদয় দত্ত ও আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী ছিলেন অভিন্ন বংশধারার উত্তর পুরুষ। কবিতার সৃজন-আনন্দই আবদুল গফফার দত্ত চৌধুরীকে সংগীতজগতে আকৃষ্ট করেছিল। তবে এক্ষেত্রে সহায়ক ছিল গুরুসদয় দত্তের নির্দেশনা ও প্রেরণা। গুরুসদয় দত্ত তাঁকে যুক্ত করেছিলেন ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে এবং পরে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সিলেট অঞ্চলের সমৃদ্ধ লোকসংগীত সংগ্রহের। অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে-ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন লোকগানের বিপুল সম্ভার। সংগৃহীত গানের ওই সংকলন গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমাও দিয়েছিলেন গুরুসদয় দত্ত। ১৯৪১ সালে গুরুসদয় দত্ত মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘকাল পর ১৯৬৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গ্রন্থটি প্রকাশিত হলেও, সম্পাদক-সংকলক-সংগ্রাহকের নামপত্রে আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর নামোল্লেখ ছিল না। এমনকি গ্রন্থের ভূমিকাপৃষ্ঠায় লোকগানের সাংগ্রাহক হিশেবে আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর নামোল্লেখিত হয়নি। অথচ, আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর সশ্রম প্রয়াসে সিলেটের লোকগান লুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা সেদিন দূরীভূত হয়েছিল। দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, ১৯২৮ সালে নজরুল যখন দ্বিতীয় দফায় সিলেটে এসেছিলেন তখন আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর পাণ্ডুলিপি পড়ে দু-জনের কাঁধে হাত রেখে তিনি বলেছিলেন, “গফ্ফার ও রাজ্জাক তোমাদের উভয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। চালাও কলম, তোমাদের সফলতার নিশ্চয়তার জন্য আমি দায়ী রইলাম।”

আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী : সৃজন অধ্যয়ন ও অন্বয় সাধন
যাদের অনুরাগ, অনুসন্ধানে ও ভালোবাসায় কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর সৃষ্টিসম্ভার বিকশিত হয়েছে তাদের নামোল্লেখ করা উচিত বলে মনে করি।

০১. ‘আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী : শতবার্ষিক স্মরণ’ গ্রন্থটি সংকলন ও সম্পদনা করেন শুভেন্দু ইমাম। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ৩১ ডিসেম্বর ২০১২।

০২. তাঁর ১১০টি গান সন্নিবেশিত ‘নির্বাচিত গান : আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী’ শীর্ষক গ্রন্থটির সম্পাদক ছিলেন — ভীষ্মদেব চৌধুরী, লীনা তাপসী খান, আলী মোস্তাফা চৌধুরী। প্রকাশকাল ০১ জুন, ২০১৮।

০৩. ‘আবদুল গফ‌ফার দত্তচৌধুরী : নির্বাচিত কবিতা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় মে ২০২৪, গ্রন্থটি সংকলন ও সম্পাদনা করেন — ভীষ্মদেব চৌধুরী ও মোস্তাক আহমাদ দীন।

০৪. আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর ৯৭০টি সনেট সন্নিবেশিত ‘সনেট সমগ্র’ সম্পাদনা করেন আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, গ্রন্থটি ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়।

বাংলা ভাষার একজন প্রতিভাবান কবির স্বরূপ উন্মোচনে যার অবদান অনবদ্য তিনি হচ্ছেন কবি আবদুল গফফার দত্তচৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী মোস্তাফা চৌধুরী।

আর, আমি, বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই কবি বিমান তালুকদারকে, যিনি দীর্ঘদিন যাবত ‘আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী স্মৃতি পর্ষদ’ নিয়ে কাজ করছেন।

মনস্বী অনুধ্যান ও কতিপয় প্রস্তাবনা
০১. বিশ্বসাহিত্যজগতে কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর সৃষ্টিসম্ভার পৌঁছানো জরুরি। এক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টি ও নির্মাণ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা প্রয়োজন। এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ রাখছি।

০২. কবি আবদুল গ‌ফ্ফার দত্তচৌধুরী প্রণীত রচনাবলি মনিপুরী ভাষায় রূপান্তর/অনুবাদ করা যেতে পারে। যেহেতু মনিপুরী জতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের একটা নিবিড় ও আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে।

০৩. আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী একজন লোকগানসংগ্রহক ছিলেন। সেই হিশেবে তাঁর সংগৃহীত লোকগান বাংলাভাষার দুর্লভ সম্পদ। এই সম্পদকে সংগ্রহ/সংরক্ষণ করার জন্য তাঁর লোকগানের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা দরকার বলে মনে করি। বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।

০৪. আমরা জানি, ছোটকাগজের মূল কাজটিই হচ্ছে শেকড় সন্ধান করা। সিলেটের মৃত্তিকাসংলগ্ন কবি আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরীর সৃষ্টিনির্মাণ ভিত্তি করে এক বা একাধিক ছোটকাগজ-সংখ্যা প্রকাশ করা যেতে পারে। ছোটকাগজের সম্পাদক হিশেবে এই দায়িত্ব গ্রহণে আমি সানন্দে প্রস্তুত।


সুমন বনিক রচনারাশি
গানপারে আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you