২০০৯ এপ্রিলের কোনো-এক সন্ধ্যা। আমাদের এপ্রিল অত ক্রুয়েলেস্ট নয়, এলিয়টের যতটা। কালবৈশাখী হয়, কিন্তু তা তো ক্রুয়েল কিছু নয়, যেন লুই বুনুয়েলের সিনেমা। অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ মন্তাজদৃশ্য।
অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেদিন, টিভিসেটের সামনে বসে, অজিত পান্ডে তাঁর ঋজুসুন্দর সত্তরোর্ধ্ব গলায় বলছিলেন কথা এবং গাইছিলেন গান। পশ্চিমবঙ্গের গণসংগীতশিল্পী অজিত পান্ডে। এসেছিলেন বাংলাদেশে, সম্ভবত উদীচী কিংবা এ-রকম কোনো গ্রুপের জয়ন্তী উদযাপনের আমন্ত্রণে। সেবার বিটিভিতে তাঁর আলাপচারণ ও টুকটুক কিছু সুরের সমবায়ে একটা আলাদা মর্তবার আড্ডা হয়েছিল, সঞ্চালনা করেছিলেন হাসান ইমাম। অজিতবাবু বলে সেই অনুষ্ঠানটা আগপাশগোড়া দেখেছিলাম পুরো, এবং মনেও রয়েছে দেখছি যথেষ্ট স্পষ্ট।
অজিত পান্ডের গান আমরা শুনেছি মূলত ক্যাসেটে, ফিতেধৃত মুক্তির মর্সিয়া, অ্যাংরি উজ্জীবক কথা ও সুরের গান। সিডিযুগে এসে তাঁর গান শোনার মওকা পাই নাই আর।
সত্যি ছিল অসাধারণ সেদিনের শ্রবণাভিজ্ঞতা। আপ্লুত ও উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম বটের মতো বয়সী কিন্তু তারুণ্যমণ্ডিত গণশিল্পীর গান ও কথা শুনে। গেয়েছিলেন পাঁচখানা গান, সবিনয় দার্ঢ্য সহ। দুখু মিয়া শিরোনামে নজরুলকে নিয়ে একখানা, অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল শিরোনামে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই বিখ্যাত কবিতার স্ব-সুরারোপ গাইলেন খুব সুন্দর করে, শামসুর রাহমানের বর্ণমালার বন্দনা বিষয়ক একটা কবিতার গানরূপ—কবিতাটা খুব-সম্ভব বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা, বা বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে, ঠাকুর রবীন্দ্রনাথকে শিল্পীর জন্মগ্রাম লালগোলায় একবার বেড়িয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজের বাঁধা একখানা দারুণ গান—যেখানে কবিগুরুকে অনুনয়ভরা আমন্ত্রণে একবার লালগোলার কঠোর-কঠিন-রুখোশুখো বাস্তবতা দেখে যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে, এবং সবশেষে খোদ রবীন্দ্রনাথের একটা গান গাইলেন অনির্বচনীয় অনভিজাত, সহজ ও উদাত্ত স্বরে। এর পাশাপাশি স্মৃতিচারণ করে যাচ্ছিলেন, গুনগুনানির ফাঁকে ফাঁকে, তাঁর বেড়ে-ওঠা তাঁর গানযাপন তাঁর জনপদসংযোগ তাঁর তৎপরতা আর সর্বোপরি তাঁর সময়কার লড়াই-নীতি-অর্জন-বিসর্জন প্রভৃতি নিয়ে।
এরও বছর-বারো আগে একটি লিটলম্যাগাজিনে, এবং জলার্ক নামের সেই পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্বপন দাসাধিকারী নিয়মিত সম্পাদনা করতেন, একটি বিশদ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল অজিত পান্ডের। পত্রিকার বিশেষ সেই সংখ্যাটি ছিল যুদ্ধজয়ের গান শিরোনামে দেশ-বিদেশের গণসংগীত এবং সবিশেষ আমাদের জনপদে সেই ষাটের গরিমাময় সময়টি নিয়ে একটি বৃহৎ সংকলন। উত্তাল সেই ষাটের দশকে যারা বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে লিপ্ত-তৎপর লড়েছিলেন এবং একসময় নকশাল আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, গণসংগীত ব্যাপারটাকে তাঁরা নিছক গান হিসেবেই দেখেননি, ওটা ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে বড় কার্যকর ও আন্তরিক অস্ত্র। শুধু অজিত পান্ডে নন, সুরেশ বিশ্বাস, বিপুল চক্রবর্তী, পরেশ ধর, মেঘনাদ, গদর, শৈলেন বল, প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অসংখ্য শিল্পী নিয়ে বিশদে জানা যায় সেই সংকলন থেকে।
তিন দশকেরও বেশি সময় ব্যাপী গণসংগীত গেয়েছেন অজিত পান্ডে, পেশা করে নিয়েছিলেন গণসংগীতকেই, রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অজিত পান্ডের গণসংগীতকে একটা আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। নুরুল তরাইকে উপজীব্য করে বাঁধা তাঁর গান তাঁকে দ্রুত মানুষের ভেতরে নিয়ে যায়। এরপর বেশকিছু ফিতেবন্দী অ্যালবাম বেরিয়েছে তাঁর, কিন্তু প্রকৃত গণসংগীতশিল্পীর জীবনই তিনি যাপন করে গেছেন মাঠে-ময়দানে গেয়ে বেড়িয়ে আজীবন। যুক্ত ছিলেন আইপিটিএর সঙ্গে। দুটো অ্যালবামের নাম আজও মনে পড়ে—একটি ‘নুরুল তরাই, আল্লা ও রাম’ এবং আরেকটি নোপাসারন । আরও ছিল, উই শ্যাল ওভারকাম নামে একটা যেমন, মনে পড়ছে না এখন।
তাঁর বিখ্যাত গানগুলো সব কান্নার গান। ক্রন্দন থেকে লেলিহান উস্কে উঠেছে সক্রোধ প্রতিবাদ। নিজেও বলেছেন তিনি, সাক্ষাৎকারে, বিষণ্নতার গান করেন। হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করেন মানুষের অকৃত্রিম অকপট মৌলিক অভিব্যক্তি কান্না। ভাবালুতা ছাড়াও ক্রন্দন হয়, এবং আমাদের সত্যিকারের অন্তর্ক্রন্দনগুলো জন্ম দেয় একটা ভালো কিছুর, শুভ সমস্তকিছুর, বলা বাহুল্য।
চলে গেলেন দুইহাজারতেরোয়। পঁচাত্তর বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। বাংলাদেশের পত্রিকায় ছোট্ট খবর বেরিয়েছে তাঁর চলে যাওয়ার। প্রস্থানের দিনটি ছিল চে-র জন্মদিন।
ঘুরে আসুন, কমরেড!
জাহেদ আহমদ ১৫ জুন ২০১৩
- আত্মহন্তার অন্তরাত্মা - June 25, 2025
- আমার জয়দেব - June 19, 2025
- অজিত পান্ডে রেমিনিসেন্স - June 15, 2025
COMMENTS