সেদিন রাতে, সারারাত প্রায়, একটা পাখি বাঁশঝাড়ের ওইদিকের লটকনফলের গাছে—যেটুকু ঠাহর হচ্ছিল দূরাগত শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি থেকে—চেঁচিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল বুঝিবা কাঁদছে পাখিটা। কানের ভুল হতে পারে, কিংবা ভাষিক সংযোগসেতুর অভাবহেতু ভুলবোঝা, আবেগের আতিশয্যও হতে পারে আমার। কিন্তু মনে হচ্ছিল ঠিক তা-ই, যা আমি বললাম, কিংবা বলিনি এখনো, বলতে চলেছি। হিচককম্যুভির বার্ড নয় এটি, কিংবা কোনো সাইকো-হরর স্কেয়ারি নাইটের গল্পও নয়, একদম পরিচিত পরিবেশের বাস্তুভিটা-লাগোয়া গাছে একলা জাগর নিশাচর পাখির পিকচার। অথবা মোশন ফোটোগ্রাফি অফ অ্যা বার্ড…
কাঁদছিল অথবা না, তা তো হলফ করে কয়ে দেবার কোনো উপায় নাই, আপাতত ধরে নিচ্ছি কাঁদছিল বলে। এবং ডিউরিং দ্যাট নাইট আমার যেহেতু ওই ইম্প্রেশন হয়েছিল। আর ফার্স্ট-ইম্প্রেশনের একটা দাম তো অদ্যাবধি পৃথিবীর নিকট রয়েছে। কেন কাঁদছিল, ওই অত রাতে, বেচারা পাখিটা! হায়, জগতের কতকিছুর অন্তরতালাশ না-করেই আমরা দিব্যি বেঁচে যাই বহু বছর, ধরাধামে, ধেই ধেই নাচি, নাচতে নাচতে বিদায় নিই এ-জীবন ও মরণমুখর এ-জগৎ থেকে! আহা, কতকিছুই থেকে যাবে অজানা আমাদের, রয়ে যাবে অদেখা কত জায়গা ও জলাশয়! কত পাহাড়ের চুড়ো পড়ে থাকবে একাকী নির্জন, ঋষির চুলের মতন মৌনী মিহি বাতাস বয়ে যাবে অতিলৌকিক শিস বাজিয়ে চূড়াদেশ ছুঁয়ে, আমরা কোনোদিন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় হব না অভিস্নাত! কতকিছুর সঙ্গেই যোগ হবে না আমাদের, এ-জীবনে, আর আমরা মরে যাব! যাওয়া হবে না জাহাজে চেপে দূর দরিয়ার দেশে, এ-জনমে, এবং সমুদ্র একদিন অপেক্ষায় ক্ষান্ত দিয়ে একঝটকায় উঠে আসবে সোজা আমাদের আঙিনায়! হে আমার দশদিগন্তের দেশ, পাইন ও বার্চের বন, মিসিসিপি আর দজলা-ফোরাত! হে প্রেইরিপৃথিবী! ফিলিস্তিনের হে আমার গাছে গাছে জলপাই ফসলোত্তোলন! হে আমার আর্শিশহরের বাড়িঘর! দার্জিলিং, আহা, দার্জিলিং!
এইমাত্র উপর্যুক্ত কথাগুলো কেউ বুঝতেই পারবে না একদিন, কেউ ওই পরম্পরাছাড়া বাক্যগুলোর মধ্যে খুঁজে পাবে না কোনো ধ্বনিমাধুর্য, ধরতে পারবে না একবিন্দু অর্থসাযুজ্য। এইটা যেমন সত্যি, আবার এইটাও সত্যি যে, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদন থেকে লিখিত হয়নি প্রোক্ত বাক্যনিচয়। একান্ত ব্যক্তিগত এক বিহ্বল সময় এবং সেই সময়ের বিমূর্ত বিষাদ ধরা রইল ওই আগের প্যারাগ্রাফে। বহুদিন বাদে, হয়তো-বা, কোনো গোধূলিবিকেলে যেয়ে হাতে নিয়ে দেখা যাবে, এর থেকে তৈরি হয় কি না কোনো অর্থের মর্মর। হয়তো তখন অদ্যকার অভিপ্রেত অর্থ খসে যাবে এর গা থেকে, এর কাণ্ডে হয়তো যুক্ত হবে সম্পূর্ণ নতুনতর অর্থের বাকল, হয়তো অনর্থ বাকলহীন ন্যাড়া হয়ে যাবে। যে-কোনোকিছুই সম্ভব, জীবনেরই মতো, বস্তুতপক্ষে লেখা বা লিখিত টেক্সট মাত্রই জীবনই তো, অযোধ্যার চেয়েও সত্য হয়তো নয় সেই রচিত অযোধ্যা, বলা যাক অতুলনীয় অথবা সত্য ভিন্নতর। আর জীবন তো অন্য কিছুই নয়, জেব্রাঘোড়াহাতিহিপোপোটেমাস নয়, কেবল একের-পর-এক পরিয়ে যাওয়া অর্থের অলঙ্কার।…
ফের যদি একবার পাই ফিরে জীবন, চাইব এই একই জল, একই হিজল, একই ফিউশন ও ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি, একই নৌকা ভাসমান ও ঘাটে-বাঁধা আধাজলডোবা, একই সেই রেস্তোরাঁ এবং আহার ও আমোদ, একই তৃষ্ণা একই পাত্রে নিবারণী প্রতিদিন পানি। কিন্তু, অয়ি প্রিয়ংবদা মুখরা, আরেকটি জীবন চাই, প্রিয়!
ইনসমনিয়া আছিল বুঝি পাখিটির! কে জানে, কী বিত্তান্ত প্রকৃত। পাখিদের দেশে বুঝি নিদ্রাবড়ি নাই!
—জাহেদ আহমদ ২১ অক্টোবর ২০১৩
- ইন্ডিয়ান বাংলায় মেইনস্ট্রিম ও অফস্ট্রিম প্রকাশনা - November 18, 2025
- নৃপতি নিরো ও নগরভস্ম - November 15, 2025
- ভারতীয়া শারদীয় সংখ্যায় একটা বাজারবান্ধব নভেলা পাঠের স্মৃতি - November 9, 2025

COMMENTS