আবহমান গৃহস্থের অঘ্রানলিপি || অসীম চক্রবর্তী

আবহমান গৃহস্থের অঘ্রানলিপি || অসীম চক্রবর্তী

কিছু কিছু বিষয় আছে যা অল্পবিস্তর কোনো বিশেষ ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও তা হয়ে ওঠে সার্বজনীন। লক্ষ্মী এবং অলক্ষ্মী এমনই একটি মিথ অথবা শব্দজোড় যা জড়িয়ে আছে আবহমান বাংলার প্রতিটি মানুষের শুভযোগের সাথে। কারো অর্থনৈতিক শুভযোগ হলেই মানুষ বলে একাদশে বৃহস্পতি অথবা লক্ষ্মী ধরা দিয়েছেন। সংগত কারণে লক্ষ্মী হয়ে ওঠেন সার্বজনীন। প্রাচীন পুরাণে বর্ণিত লক্ষ্মী হলেন ধনের দেবী, ফসলের দেবী, শুভযোগের দেবী। কৃষকের গোলার সাথে অথবা মাঠের সোনালি ফসলের সাথে লক্ষ্মীর সংযোগ অবিচ্ছেদ্য। ফলে অদ্যাবধি বাংলার সনাতন গৃহস্থের বাড়িতে লক্ষ্মী পূজিত হন সর্বাগ্রে। আজকের এই লেখায় বরাক উপত্যকার সনাতন ধর্মাবলম্বী গৃহস্থের অগ্রহায়ণলিপির (কার্তিক থেকে মাঘ মাস) আদ্যোপান্ত বর্ণনার বাঞ্ছা করেছি।

আমাদের ছোটবেলায় ভাদ্র মাসে আমন ধানের বপনউৎসব চলত মাঠে মাঠে। বীজতলা থেকে ছাড়া গাছ উৎপাটন করে মাঠে চারাগাছ বপনের আগে সদ্যগত বানের জল থেকে ভেসে-ওঠা জমিকে তৈরি করা হতো মুহুর্মুহু লাঙলের ফলায়। কলের যন্ত্রের দাপটে লাঙলের ব্যবহার এখন হয়তো চোখেই পড়ে না। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি আগে-থেকে-ঠিক-করে-রাখা লাঙলশ্রমিকরা ভোরে আমাদের গোয়াল থেকে গরু মাঠে নিয়ে যেতেন, সাথে অন্য অনুষঙ্গ হিশেবে থাকত জোয়াল (দুই গরুকে একত্রে শৃঙ্খলে রাখার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি একধরনের যন্ত্র), থাকত মই, যার বর্ণনা অনধিকার চর্চার মধ্যেই পড়ে। ধারণা করি আমাদের বঙ্গসমাজে এমন বাঙালি বিরল যে তাঁর জীবদ্দশায় কাউকে না কাউকে গাছে চড়িয়ে মই সরায়নি। সর্বশেষ থাকত লাঙলের সাথে মই সংযোগ করার জন্য হুকওয়ালা বাঁশের শক্ত কাঠি। লাঙলের ফলায় মাটি কর্ষণের পরে অসমান মাটি মই দিয়ে সমান করে দেওয়া হতো। ছোটবেলায় মইয়ে চড়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে বাড়ি ফিরে কতবার যে মায়ের হাতে ছাতিপেটা খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।

অবশেষে ভাদ্রমাসের প্রথমদিকে অথবা শ্রাবণের শেষে বীজতলা থেকে সদ্য-উত্তোলিত ধানের চারা লাগানো হতো পেঁজা তুলোর মতো নরম মাঠে। মাসখানেকের মধ্যেই দিগন্তজোড়া মাঠ ভরে উঠত সবুজ ধানে। ইত্যবসরে আশ্বিনের দুর্গাপূজা শেষে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো শেষেই অশ্বিন মাসের শেষদিনে আসত “অশ্বিন যাইতে কার্তিক আইতে” লক্ষ্মীপুজো। লক্ষ্মীপুজোর এমন নামকরণের সার্থকতা ক্রমশ প্রকাশ্য। আশ্বিনের শেষদিনে বাঙালি সনাতন গৃহস্থবাড়িতে পূজিত হন দেবী লক্ষ্মী। এই পুজোর একমাত্র কারণ হলো মা লক্ষ্মী যেন সন্তুষ্ট হয়ে নির্বিঘ্নে গৃহস্তের অনাগত ফসল ঘরে তুলতে সাহায্য করেন।

আশ্বিন যাইতে কার্তিক আইতে লক্ষ্মীপুজোয় যেসব উপকরণ লাগে তা হলো অবশ্যই আট ধরনের সব্জি দিয়ে পুজোর ভোগসামগ্রী, তবে এসবের সাথে প্রয়োজন হয় চালতা পাতা, সুন্দা (এক ধরনের জলজ অথবা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় জন্ম-নেয়া উদ্ভিদের কন্দ), মেথি, সরিষার তেল, কাঁচাহলুদ, নলখাগড়ার ডাঁটা ইত্যাদি। আমরা গ্রামের শেষমাথায় দেওরভাগা নদীর পাড় ঘেঁষে করচবনের ঠিক অন্যপাশে গোরস্থানের কাছে চালতা গাছ থেকে ভয়ে ভয়ে পাতা সংগ্রহ করতাম পাছে চালতাগাছের পেত্নী সিন্দাবাদের ভূতের মতো আমাদের ঘাড়ে ভর করে। পুজোর দিনে রান্না হতো আট ধরনের সব্জি দিয়ে উপাদেয় খিচুড়িভোগ, যা খাওয়া হতো পুজোর দিনে এবং অল্প রেখে দেওয়া হতো যা কার্তিকের প্রথম দিনে অর্থাৎ পুজোর পরের দিন সকালে খাওয়ার বিধান ছিল। পুজোর সময়ে চালতা পাতা ভাঁজ করে নলখাগড়ার ডাঁটা সেই পাতার মধ্যে সুঁইয়ের মতো গেঁথে রাখা হতো। অন্যদিকে সুন্দা পুড়িয়ে তাতে মেথি, কাঁচাহলুদ এবং সরিষার তেল মিশিয়ে হামানদিস্তায় পিষে এক ধরনের অরগ্যানিক মিশ্রণ তৈরি করে তা দিয়ে চালতা পাতার উপরে পাঁচটি করে ফোঁটা দেওয়া হয়, দেওয়া হয় সিঁদুরের ফোঁটাও।

পুজোর ভুরিভোজ শেষে আশ্বিনের শেষবিকেলে আমরা নলখাগড়া এবং চালতা পাতার তৈরি তিরের ফলার সদৃশ জিনিশগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম বাড়ির কাছের সদ্য-সবুজ-হওয়া নিজেদের আমন ক্ষেতে।

অশ্বিন যাইতে, কার্তিক আইতে
মা লক্ষ্মীয়ে পাঠাইছইন মোরে,
সুন্দা-মেথি দিতাম তোরে।

সুন্দা মেথি চৈলতার পাত
হিজা ধরিছ আড়াই হাত।

চৈলতা পাতায় ধরল কাঁড়াল
এক কিয়ারে নয় ভাড়াল।

এই ছড়া বলে একেকটি নলখাগড়া আর চালতা পাতার তৈরি তিরের ফলা অগাধ বিশ্বাসে নিক্ষেপ করতাম নিজেদের ক্ষেতে। যাতে মা লক্ষ্মী এবং সুন্দা-মেথি, চালতা পাতা আর নলখাগড়ার আশীর্বাদে একেকটি ধানের শীষ হয় আড়াইহাত লম্বা এবং এক কিয়ার (২৯ ডেসিমেল) জমিতে নয়ভাঁড়ার ধান হয়।

কার্তিকের মাঝামাঝিতেই সবুজ ধানগাছের বুক চিরে বেরোতে থাকত কচি ধানের শীষ, ধীরে ধীরে সেই শীষে জমত দুধ, দুধ থেকে ক্ষীর এবং সবশেষে আরাধ্য চাল। ইত্যবসরে বার্ষিক পরীক্ষাও শেষ। দেখতে দেখতে চলে আসলো ধানকাটার মৌসুম। শুরু হতো ছিঁচকে চোরের উপদ্রব। যদিও আমরা মনে মনে চাইতাম একটু-আধটু চুরি হোক, তাহলেই আমরা পাবো আমাদের আরাধ্য উড়াবাসের সুযোগ।

অগ্রহায়ণ মাসে ধানকাটার মৌসুমে ক্ষেতের ধান চুরি রোধ করতে ক্ষেতের পাশে একটু উঁচু জায়গায় উরা (অস্থায়ী কুঁড়েঘর) বানানো হতো। সেই উরায় সন্ধ্যা রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গানবাজনা আর তাসখেলা চলত।

বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার দিবাগত রজনী ছিল হাজারো আরাধ্য রজনীর একটি। যে-রজনীতে সেইসব বড়ভাইদের সাথে উরায় বসে গানবাজনা, দাবা, পাশা, তাস খেলতাম — আমাদের ছেলেবেলায় যারা ছিল সাহসিকতার জ্বলন্ত উদাহরণ। যারা গালগল্পে অনায়াসে শ্মশানের পাশের রাস্তায় কালো বিড়ালের রূপধরা ভূতকে একলাথে রাস্তা থেকে ক্ষেতে ফেলে দিব্যি বাড়ি চলে আসতে পারতেন। অথবা নারীরূপী পেত্নিকে বামহাত দিয়ে ধরে আছাড় মেরে কোমর ভেঙে দিতে পারতেন। যারা ডুব দিয়ে জ্যান্ত মাছ ধরতে পারতেন আর ঢোঁড়া সাপের লেজ ধরে ভনভন করে ঘুরিয়ে জাহির করতেন বীরত্ব। নানা অভিজ্ঞতায় সিদ্ধহস্ত সেইসব বড়ভাইরা ফিতা-ছিঁড়ে-যাওয়া ক্যাসেটের ফিতা বেরকরে স্কচটেপ অথবা আঠা দিয়ে ফিতে জোড়া লাগিয়ে দিব্যি বাজাতে পারতেন। তারাই হয়তো আবিষ্কার করেছিলেন কাগজে ছেপ (থুতু) লাগিয়ে কিভাবে ভিডিয়োপ্লেয়ারের হেড পরিষ্কার করতে হয়।
আমাদের ছেলেবেলায় পাম্পলাইট জ্বালানো ছিল নায়কোচিত একটি বিষয়। আমাদের সেইসব বড়ভাইরা যখন জগদ্বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারের মতো পাম্পলাইটের মেনতেলে আগুন দিয়ে আস্তে আস্তে বলগা ঘোড়ার মতো জ্বলে-ওঠা আগুনকে সামলে নিয়ে পাম্পলাইট জ্বালাতেন তখন আমাদের চোখ ঝলঝল করে উঠত।

অবশেষে উপনীত হলো ধানকাটার উৎসব, সনাতন গৃহস্থের বাড়িতে আনন্দের ধুম। অগ্রহায়ণের কোনো-এক বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ির জুনিয়র সদস্যকে স্নান করিয়ে ভেজা গামছা পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পাকা ধানের ক্ষেতে মা লক্ষ্মীর নাম নিয়ে কয়েকগোছা সোনালি ধান কেটে মাথায় করে বাড়িতে এনে বরণ করা হয়ে ধান-দূর্বা-তেল-সিঁদুর দিয়ে এবং রাখা হয় ঘরে স্থাপিত মা লক্ষ্মীর বিগ্রহের পাশে, এবং এই কর্মসূচির মাধ্যমেই শুরু হয়ে যায় ধানকাটা উৎসব। কৃষকের উঠোন ভরে ওঠে সোনালি ফসলের বহরে। চলে ধান মাড়াই এবং ধান প্রক্রিয়াজাতকরণের মহাসমারোহ।

ধান মাড়াই, ধান প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাড়া জোড়ানো, নবান্ন, বিহু, ক্ষেত জোড়ানো এবং সর্বশেষে ক্লান্তশ্রান্ত গৃহপালিত পশু গরুকে তেল-সিঁদুর দিয়ে বরণ করার আরো সংস্কার অথবা সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তারিত লিখব অন্য কোনো-একদিন। তবে একটা প্রশ্ন বার বার মনের মধ্যে আসে, আমরা কি আমাদের গ্রামকে গ্রাম হিসাবে দেখতে চাই নাকি আধুনিকতার সর্বোচ্চ প্রয়োগে গ্রামকেও শহর বানাতে চাই? সিদ্ধান্তটা আমাদেরকেই নিতে হবে। আশা করি পাঠককূল এই বিষয়ে মতামত দেবেন। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, আধুনিকতার ছোঁয়া অবশ্যই অতি প্রয়োজনীয়, ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তা অবশ্যই জনগুরুত্বপূর্ণ, কৃষক যাতে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে কম খরচে বেশি পণ্য উৎপাদন করতে পারে সেই বিষয়েও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। সাথে সাথে গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের ইকোসিস্টেমের প্রতি। আমাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যাতে আমাদের খাদ্যশৃঙ্খল এবং ইকোসিস্টেম ধ্বংস না করে। আমাদের কৃষক যাতে জৈব সারের পরিবর্তে বিধ্বংসী হরমোন ব্যবহার না করেন।

বিশ্বজোড়া প্রযুক্তির জয়জয়কারে দিন পাল্টেছে, পাল্টেছে সময়। শহুরে হওয়ার প্রতিযোগিতায় হয়তো গ্রাম আর আগের গ্রাম নেই। অথবা হয়তো তার উল্টো। হয়তো এখনো উরায় বিচ্ছেদগানের সুরে হাহাকার ওঠে প্রান্তরময়, , তাসখেলার মুনশিয়ানায় গ্রামের সেইসব বড়ভাইরা ছোটভাইদের তাক লাগিয়ে দেন। অথবা ভূতের গল্পে হিম করে দিয়ে বড়ভাইয়েরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন সাহস কাকে বলে।

সময় হলো সেই দুষ্ট বুড়ো, — যে অশ্রান্ত হেঁটে চলে মহাকালের পথে, পাশকাটিয়ে একটু দূরে চলে গিয়ে দুষ্টু হেসে বলে, কেমন দিলুম বলো তো ?

আমাদের কমলা রঙের আকাশ ছিল
বাতাস ছিল সুগন্ধময়
নদী, পাখি, জ্যোৎস্না ছিল
শৈশব ছিল দুরন্তময় …

… …

অসীম চক্রবর্তী

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you