উনবিংশ শতকের বাঙালী অন্তত এই সত্য জানিত যে সংস্কৃত-সাহিত্য শ্লাঘার বস্তু। সেই যুগে ভারতীয়ের আত্মমর্যাদাকে ইংরেজ নানা প্রকারে ক্ষুণ্ণ করা সত্ত্বেও পৃথিবী তখন স্বীকার করিয়াছে যে সংস্কৃত সাহিত্য পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য — যে গ্রীক সাহিত্য লইয়া ইউরোপ এত গর্ব করে, তাহার সঙ্গে সংস্কৃত অনায়াসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে পারে এবং লাতিন অপেক্ষা সে বহুলাংশে বিত্তবান।
বাঙ্গালার অনুপ্রেরণা সংস্কৃত হইতে আসে; সুতরাং বাঙ্গালা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বাঙালীর অল্পবিস্তর আশ্বাস ছিল। তদুপরি বহু ভাষার সুপণ্ডিত মধুসূদন যখন সর্বভাষা বর্জন করিয়া বঙ্গবাজারে সার্থক রস সৃষ্টি করিলেন, তখন বাঙালীর আত্মবিশ্বাস দৃঢ়তর হইল।
কিন্তু অন্যান্য কলাসৃষ্টিতে বাঙালী তথা ভারতীয়র কণামাত্র উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল না। বাঙালী যে চিত্র কিম্বা ভাস্কর্যে নিজস্ব কোনো প্রকারের রসানুভূতি প্রকাশ করিতে পারিবে কিম্বা বিশ্বের সম্মুখে নিজস্ব চারুকলা উপস্থিত করিয়া বিশ্বজনের প্রশান্তি অর্জন করিতে পারিবে এই বিশ্বাস যে বাঙালীর ছিল না তাহাই নহে, সামান্য যাহা বাঙালীর নিজস্ব কলাশিল্পরূপে তখনও বিদ্যমান ছিল বাঙালী তাহার সম্মুখে লজ্জায় অধোবদন হইত। কালীঘাটের পটকে সম্মান দেওয়া দূরে থাকুক বাঙালী তখন তাহার অস্তিত্ব সম্বন্ধেই অচেতন।
তাই অবনীন্দ্রনাথের সাহস দেখিয়া স্তম্ভিত হই। আজ অজন্তা আর্ট, মোগল চিত্রশিল্প বিশ্বরসিকের কাছে সুপরিচিত। আজ চিত্রকলার প্রামাণিক ইতিহাস পুস্তক পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তেই প্রকাশিত হউক না কেন তাহাতে অজন্তা মোগল চিত্রের উল্লেখ না থাকিলে সে-পুস্তক অসম্পূর্ণ বলিয়া গণ্য হয়, গ্রন্থকারের সঙ্কীর্ণ সীমাবদ্ধ রসবোধ নিন্দিত হয়। কিন্তু যে-যুগে অবনীন্দ্রনাথ ভারতীয় ঐতিহ্যগত কলাশিল্পে অনুপ্রাণিত হইয়া রসসৃষ্টির নব নব অভিযানে বহির্গত হইলেন, সে-যুগে অজন্তা বঙ্গদেশে ন্যায্য সম্মান পায় নাই। আজ অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব্যক্তি মাত্রই স্মরণ করিতে পারিবেন, অজন্তা চিত্র প্রকাশ করার জন্য ‘প্রবাসী’ পত্রিকাকে কতখানি হাস্যাস্পদ হইতে হইয়াছিল। সেই বিড়ম্বিত অজন্তা সেই লাঞ্ছিত মোগল চিত্রের আদর্শ সম্মুখে লইয়া চিত্র অঙ্কন করিবার মতো দুঃসাহস অসাধারণ পুরুষেই সম্ভব।
জানি, অবনীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্কন না করিলেও অজন্তা মোগল একদিন তাহাদের ন্যায্য সম্মান পাইত, কিন্তু একথা আরও নিশ্চয়রূপে জানি, অবনীন্দ্রনাথ না থাকিলে অজন্তা মোগল নবজীবন লাভ করিয়া আমাদের শতশত শিল্পীকে উদ্বুদ্ধ অনুপ্রাণিত করিতে পারিত না। নবভগীরথ অবনীন্দ্রনাথ কলাক্ষেত্রে যে জাহ্নবী অবতরণ করাইলেন তাহার “সোনার ধান” বঙ্গদেশের ভাণ্ডার সম্পূর্ণ করিয়া এখন সমস্ত ভারতবর্ষের অন্নদান আনন্দদান করিতেছে।
আজ যে ভারতবর্ষের সুদূরতম প্রান্তে ভারতীয় শিল্পী চিত্রাঙ্কন করিবার ‘ভাষা’ পাইয়াছে, তাহার পশ্চাতে অবনীন্দ্রনাথের কী অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অবিচল নিষ্ঠা ছিল সে-কথা কয়জন শিল্পী কয়জন শিল্পরসিক হৃদয়ঙ্গম করিত পারে, কিম্বা সশ্রদ্ধ স্মরণ করে?
অবনীন্দ্রনাথ প্রথম যৌবনে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে চিত্রাঙ্কন করেন এবং পরবর্তী যুগে নিজস্ব শৈলীতে রসবিকাশ করিয়া স্বদেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন একথা সকলেই জানেন, কিন্তু নিজস্ব শৈলী নির্মাণের জন্য তিনি যে চীন জাপান প্রত্যেক প্রাচ্য দেশের শিল্পে বৎসরের পর বৎসর গভীর সাধনা করিয়াছিলেন তাহার সন্ধান তাহার প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করেন আজ কয়জন শিল্পী-ঐতিহাসিক?
জাপানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী টাইকান ভারতবর্ষে আসেন প্রথম যৌবনে — অবনীন্দ্রনাথও তখন যুবক। একদিকে টাইকান যেরকম অবনীন্দ্রনাথের সাহচর্যে ভারতবর্ষের সর্ব চারুকলা বিকাশ প্রচেষ্টার সাথে সংযুক্ত হইয়া আপন শৈলী সর্বাঙ্গ-সুন্দর করিতে সমর্থ হন ঠিক সেইরকম অবনীন্দ্রনাথও জাপানী শৈলী হইতে এমন সব কলাকৌশল আয়ত্ত করেন যাহার প্রসাদে তাঁহার অঙ্কনপদ্ধতি বহু রসের সংমিশ্রণে অপূর্ব সামঞ্জস্য ধারণ করে। অবনীন্দ্রনাথের প্রধান কৃতিত্ব ছিল এইখানে। যে-কোনো কলানিদর্শন দেখা মাত্রই তিনি তাহার প্রকৃত মূল্য বুঝিতে পারিতেন এবং সেই নিদর্শন হইতে কোন বস্তুটি তাঁহার শৈলীতে সম্পূর্ণ এক হইয়া তাহাকে সমৃদ্ধশালী করিবে সে-রসবোধ ছিল তাঁহার অসাধারণ। তাই যখন অবনীন্দ্রনাথের চিত্র বিশ্লেষণ করি তখন আর বিস্ময়ের অবধি থাকে না যে এই সঙ্কীর্ণ মানবজীবনে একজন মানুষ কি করিয়া এতখানি কলাকৌশল আয়ত্ত করিতে সক্ষম হইল।
তাই বোধ হয় অবনীন্দ্রনাথের কৃতী শিষ্যগণ এত ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে চিত্রাঙ্কন করিয়া বঙ্গদেশের কলাজগতকে এতখানি চিত্রবিচিত্রিত করিতে সক্ষম হইয়াছেন। যে-গুরু বহুবিধ সাধনা করিয়া সত্যরস পাইয়াছেন, একমাত্র তিনিই প্রত্যেক শিষ্যের আপন বৈশিষ্ট্য সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়া তাহাকে সেই পন্থাতেই কত নব নব অভিজ্ঞতা কত নব নব বিকাশ আছে তাহার সন্ধান দিতে পারেন। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের মত সার্থক গুরু এই সংসারে সর্বত্রই সর্বযুগে বিরল। আজ ভারতবর্ষে এমন প্রদেশ নাই যেখানে অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য বিরল; কারণ অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য নন্দলালের কাছে যাঁহারা কলাশিল্প আয়ত্ত করিয়াছেন, তাঁহাদের গর্বের অন্ত নাই যে অবনীন্দ্রনাথ তাঁহাদের গুরুর গুরু।
স্পর্শমণির স্পর্শলাভ করিয় মৃত্তিকা স্বর্ণ হয়, কিন্তু সেই স্বর্ণ তো স্পর্শমণির মতো অন্য মৃত্তিকাকে স্বর্ণরূপ দিতে পারে না। অথচ যে-প্রদীপ অন্য প্রদীপ হইতে একবার অগ্নিশিখা আহরণ করিয়া প্রদীপ্ত হইয়াছে সে পৃথিবীর সর্বপ্রদীপকে প্রজ্বলিত করিতে পারে। সাধনাতে সিদ্ধিলাভ সংসারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃত্তিকায় স্বর্ণরূপ প্রাপ্তির ন্যায়। তিনি কিন্তু তাঁহার সাধনার ধন অন্যকে দিতে পারেন না। অবনীন্দ্রনাথের সাধনা দীপ্ত সাধনা। তিনি আপন জীবনে যে রসের সন্ধান পাইয়া নিজকে প্রদীপ্ত করিয়াছিলেন, সেই অগ্নি দিয়া বহু শিষ্য আপন আপন অণুদীপ প্রজ্বলিত করিয়াছেন। আজ তাই বঙ্গদেশে তথা তাবৎ ভারতবর্ষে চারুকলার যে অনির্বাণ দীপান্বিতা প্রজ্বলিত হইয়াছে তাহার প্রথম প্রদীপ অবনীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলা-বিশ্লেষণ অদ্যকার কর্ম নয়। তাঁহার রসবোধ, তাঁহার চিত্রাঙ্কনপদ্ধতি আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলাকে কতখানি প্রভাবান্বিত করিয়াছে সে-আলোচনা করিবার দিন এখনও আসে নাই। কারণ তাঁহার অনুপ্রেরণা আরো বহু বৎসর ধরিয়া ভারতীয় চিত্রকলাকে সম্মুখের দিকে অগ্রসর করিবে — তাঁহার আসন গ্রহণ করিত পারে, এমন কোনো পুরুষকে এখনও দিকচক্রবালে দেখিতে পাইতেছি না।
কিন্তু একটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আর্কষণ করিবার প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারিলাম না।
অবনীন্দ্রনাথের চিত্রে এক অদ্ভুত আস্বচ্ছ রূপ আছে — এরূপ পৃথিবীর অন্য কোনো চিত্রে দেখিতে পাওয়া যায় না।
এই অবর্ণনীয় রূপ তিনি সংগীত হইতে গ্রহণ করিয়া চিত্রে প্রকাশ করিয়াছেন। সকলেই জানেন অবনীন্দ্রনাথ বহু বৎসর ধরিয়া সংগীত সাধনা করেন। সংগীতধ্বনি দৃষ্টিবহির্ভূত; তিনি ধ্বনিকে রূপায়িত করিয়াছেন — তাই তাঁহার চিত্রের এই আস্বচ্ছ শৈলী।
অদ্যকার দিবসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহা স্মরণ করি : —
“যখন আমি ভাবি বাঙ্গালায় শ্রদ্ধালাভের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ব্যক্তি কে তখন প্রথমেই আমার যে নামটির কথা মনে আসে, তাহা হইতেছে অবনীন্দ্রনাথের। দেশকে আত্মগ্লানির পাপ হইতে তিনি রক্ষা করিয়াছেন। অপমানের পঙ্ক হইতে টানিয়া তুলিয়া দেশকে তিনি উহার ন্যায্য সম্মানজনক স্থানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। শিল্পচেতনার পুনরুন্মেষেণার মধ্য দিয়া ভারতে এক নবযুগের অভ্যুদয় হইয়াছে এবং তাহার নিকট হইতে সমগ্র ভারত নুতন করিয়া তাহার পাঠ গ্রহণ করিয়াছে।”
‘অবনীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক এই রচনাটা আমরা আলীর রচনাবলির একাদশ খণ্ড থেকে নিতেসি। ‘সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী’ (একাদশ খণ্ড) মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক বৈশাখ ১৩৯০ বঙ্গাব্দে শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট কলিকাতা থেকে পাব্লিশড। এই খণ্ডটা অপ্রকাশিত রচনার, পুস্তানির ইমিডিয়েইট পরের পেইজে এই তথ্যটা দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে দেয়া। তার মানে, এর আগে এইগুলা আলীর জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে বেরোয় নাই। কিন্তু প্রত্যেকটা রচনার অন্তে না-হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূর্বপ্রকাশের স্থল হিশেবে বিভিন্ন পত্রিকা/সাময়িকী ইত্যাদির নাম ও দিন-ক্ষণ দেয়া আছে, এর মধ্যে আনন্দবাজার পত্রিকাতেই ছাপানো রচনা বেশি লক্ষণীয়।
অপ্রকাশিত মুজতবারচনারাশির এই তিনশতাধিক পৃষ্ঠার বইটি সম্পাদনায় গজেন্দ্রকুমার মিত্র সহ চারজনের একটা প্যানেল কাজ করেছে এবং তাদের তরফ থেকে একটা সম্পাদকীয় বইয়ের শুরুতে সেঁটে দেয়া আছে। আর, আরেকটা কথা এ-ই যে, কেবল এইটাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়া আলীর একমাত্র রচনা নয়; তাঁর রচনাবলি সংকলনের পূর্ববর্তী খণ্ডগুলায় অবনীন্দ্রনাথকেন্দ্রী অনেক রচনা রয়েছে যেইগুলা পাঠ-অপরিহার্য ও চমকপ্রদ রসজারিত। পুনর্পাঠের ক্ষেত্রে এই রচনাটাই বেছে নেয়ার কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদনা নাই স্বীকার্য। পুনর্পাঠের একটি নিয়মিত না-হলেও অনিয়মিত প্রচেষ্টা গানপার থেকে চেষ্টা থাকে করবার, এইটা তারই ধারাবাহিকতা।
— গানপার
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS