আজন্ম বিপ্লবী প্রয়াত গণসংগীতশিল্পী ভবতোষদার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ১৯৯৪ সালের পৌষের এক অদ্ভুত সন্ধ্যায়। আমার বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ। স্থানীয় বাজারের এক ছোট কক্ষে মোমবাতির ম্লান আলোয় লম্বা জুলফি আর গোঁফওয়ালা ক্ষ্যাপাটে একটি লোক মানবমুক্তির কথা বলছে, শিল্পের কথা বলছে, সাহিত্যের কথা বলছে বাংলা গানের কথা বলছে, সংস্কৃতির বিকাশের কথা বলছে। সদ্য কৈশোরে পা রাখা আমি সম্মোহিত হয়ে ছিলাম সদাহাস্য ক্ষ্যাপাটে এই লোকের সাথে কথা বলে। এমন মানুষের সাথে এর আগে কখনোই দেখা হয়নি আমার। এর আগে এত সহজ করে এমনভাবে কোনোদিন শুনিনি কাউকে বলতে — “এ জীবন মানুষের তরে, এ জীবন শোষণমুক্তির তরে, এ জীবন দিনবদলের তরে …”
ঢাকাদক্ষিণস্থ শ্রীচৈতন্যদেবের বাড়ি থেকে মাইলতিনেক দূরে পুরকায়স্থবাজার। পুরকায়স্থরা দেশছাড়া হয়েছেন সেই কবে কিন্ত নামখানা রয়ে গেছে এখনো। সেই বাজারে স্থানীয় কয়েকজনের সহযোগিতায় ভবতোষ চৌধুরী ‘চৈতন্য সংগীত বিদ্যালয়’ নামে একটি গানের স্কুল খুলেছিলেন। প্রতি সপ্তাহে প্রায় দেড়ঘণ্টা বাসে চেপে ক্লাস নিতে আসতেন ভবতোষদা। নানা কারণে স্কুলটি বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু ভবতোষ চৌধুরী মাত্র কয়েকদিনের কথোপকথনে আমার মনন বদলে দিতে পেরেছিলেন। এর প্রায় সাতবছর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে সিলেট শহরে আস্তানা গাড়ার পরে ২০০১ খ্রিস্টাব্দের দিকে সিলেট উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হই এবং খুঁজে পাই আমার দ্রোণাচার্য ভবতোষদাকে।
নতুন করে আবিষ্কারের পরে ভবতোষদাকে প্রথম প্রশ্ন করি, — আপনি তো বিপ্লবী গণসংগীতশিল্পী, কোনো বিপ্লবী নাম না দিয়ে চৈতন্যদেবের মতো ধর্মপ্রচারকের নামে কেন সংগীতবিদ্যালয় করেছিলেন? উত্তরে একগাল হেসে ভবতোষদা বলেছিলেন, এই চৈতন্য সেই চৈতন্য নয় রে পাগলা। এই চৈতন্য হলো অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর চৈতন্য, এই চৈতন্য হলো শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের চৈতন্য, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির চৈতন্য, পুঁজিবাদীর বিরুদ্ধে দিনমজুরের চৈতন্য …
ভবতোষ চৌধুরীর গণসংগীত মহাসমাবেশে মানুষের মনে প্রতিবাদের ঢেউ তুলত। প্রচলিত গানের সুরের সাথে প্যারোডি করে উপস্থিত গণমানুষের পাল্স বুঝে তিনি তাৎক্ষণিক কথা বসাতেন; — তেমনি একটি গান হলো :
গর্জে ওঠো বাংলাদেশ, লাখো কণ্ঠে বলো ভাই,
বোয়ালের গণতন্ত্রে পুঁটিদের মুক্তি নাই …
অথবা বাউল আবদুল করিমের বিখ্যাত গান ‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী’-র সুরে ভবতোষ চৌধুরীর রচনা-করা গান :
আমি বাংলাদেশের বাঙালি
আমারে ডর দেখাইয়ো না বুলবুলি।।
সাগর-সাগর নদী-নদী
ঢালছে রক্ত নিরবধি।।
আমার আগের যত বাঙালি
আমারে ডর দেখাইয়ো না বুলবুলি …
সিলেট উদীচীর সতীর্থদের কাছে শুনেছি ভবতোষ চৌধুরী বলতেন মঞ্চে উঠে যদি ভয় পাও তবে বিপ্লব করবে কেমনে! মঞ্চ হলো রাজপথের মতো। যত আত্মশক্তি নিয়োগ করে মিছিল ধরবা সহযোদ্ধারা ততই উজ্জীবিত হবে। ঠিক তেমনি মঞ্চে উঠে ভয়হীন চিত্তে বজ্রকণ্ঠে ধরতে হবে মুকুন্দ দাশের গান :
ভয় কি মরণে
রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গিনী মেতেছে
আজ সমর-রঙ্গে …
আমাদের মহান স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি ভবতোষ চৌধুরীর ছিল আপ্রাণ আনুগত্য। যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের প্রতি ছিল অগাধ ঘৃণা। তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার হোক। আশির দশকের বৈরী সময়ে ভয়হীন কণ্ঠে গলা ফাটিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে গেয়েছেন নিজের লেখা গান —
ধর ধর ধর ধর রে তোরা রাজাকাররে ধর
তেলচোরারে ধর, গমচোরারে ধর, আমলারে ধর
তার মনিবরে ধর।।
মা-বইনেরে যারা দিছে পাঞ্জাবিদের হাতে
তারা দেখি হাসে এখন বইসে রাজসভাতে
ধর্মের কথা শোনায় তারা মঞ্চে উইঠা গরগরগর।।
একাত্তরের পরে যারা কিনছে জমি-বাড়ি
ভুখাফাঁকার দেশে যারা চালায় রঙিন গাড়ি
টাকাপয়সা কই পাইল সে একবার তারে জিজ্ঞেস কর।।
গণমানুষের কথা বলবার জন্য, গণমানুষের কাতারে দাঁড়ানোর জন্য ভবতোষ চৌধুরী অন্য কোনো পেশায় থিতু হতে পারেননি। তাই নানা সময়ে সম্মুখীন হয়েছেন জীবনের কঠিন বাস্তবতার। তবুও দমে না থেকে বিপুল উদ্দীপনায় গেয়েছেন :
যেমন ধরেন বাঁশের লাঠি একটা ভাঙন যায়
দশটা লাঠি এক হইলে ভাঙা বিষম দায়
ইটের পরে ইট বানাইয়া ঘরদালান কত বানাই
ঐক্যের মতো বড় বল আর নাই …
শুধু উনার নিজের লেখা গান নয়, বরং সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, গণনাট্য সংঘ অথবা কলকাতা ইয়োথ ক্যোয়ারের গানও উনার কণ্ঠে পেত অন্য মাত্রা, জাগ্রত করত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চেতনা।
ভবতোষ চৌধুরী প্রথমবার যখন উচ্চরক্তচাপজনিত রোগে শয্যাশায়ী হলেন তখন সিলেট উদীচীর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনির হেলাল, সতীর্থ অনুপ নারায়ণ তাকুলদার এবং আমি গিয়েছিলাম উনার বাসায়। যদিও কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল তবুও আজন্ম-আড্ডাপ্রিয় ভবতোষদা অনেকক্ষণ জমিয়ে গল্প করেছিলেন আমাদের সাথে। এর কিছুদিন বাদেই বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমালাম আমি বিলাতের উদ্দেশে। ওই দেখাই শেষ দেখা হয়ে রইল।
সময় বয়ে যায় সময়ের নিয়মে। সবাই ছুটছি আপন গতিতে। সময় বসে থাকে না। বদলায়। কিন্তু কর্ম থাকে মধ্যসূর্যের মতো জাজ্বল্যমান। আমরা ধীরে ধীরে আত্মকেন্দ্রিক থেকে আত্মকেন্দ্রিকতর হই। আশেপাশের বঞ্চিত-শোষিত মানুষের দিকে ফিরে তাকানোর সময়ও হয়তো নেই। কিন্তু তারপরেও একজন ভবতোষ চৌধুরী থাকেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ গল্পের নবকুমারের মতো দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন। একজন ভবতোষ চৌধুরীর জাগতিক দেহাবসান হয় ঠিকই, তবে অবসান হয় না তাঁর লিগ্যাসি। অবসান হয় না তাঁর ছড়িয়ে-যাওয়া মানবমুক্তির মন্ত্র। অবসান হয় না শোষিত মানুষের জন্য তাঁর কর্মগুলো। অবসান হয় না আজীবন ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং লাভের আশা না করে নিঃস্বার্থভাবে নির্ভয়ে গাওয়া গণসংগীতগুলো। ভবতোষ চৌধুরীর মতো আরো অসংখ্য অগ্রজ যারা নানা সময়ে তাদের উত্তরসূরিদের অক্লান্ত সাহস যুগিয়েছেন, সেই সাহসের প্রতিফলনই হলো ২০১৩ সালের গণজাগরণ। যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ। ভবতোষদা হয়তো রাজাকারদের বিচার দেখে যেতে পারেননি, অথবা বোয়ালের গণতন্ত্রে হয়তো আজো পুঁটিদের মুক্তি হয়নি, তবে কাজ করে গেছেন এক প্রত্যয়ী প্রজন্ম বিনির্মাণে যারা দেশমাতৃকার জন্য সংকটে-সংগ্রামে এক হয়ে আজও আওয়াজ তোলে —
আমি বাংলাদেশের বাঙালি
আমারে ডর দেখাইয়ো না বুলবুলি …
… …
- দিবারাত্র দুর্গাপুজো || অসীম চক্রবর্তী - October 5, 2019
- ঠাকুরবন্দনা || অসীম চক্রবর্তী - August 9, 2019
- জলধামাইল || অসীম চক্রবর্তী - August 1, 2019
COMMENTS