ছোটবেলায় ঈদের যেমনটা আনন্দ ছিল, সশরীর উদযাপন যত, বড়বেলায় তা অধিকাংশ অন্তর্হিত। অভিজ্ঞতায় যা-কিছু জমা হয় সেগুলো মোটামুটি থার্টির পরে আমরা ছোটবেলা-বড়বেলা যুগ্মবৈপরীত্য দিয়া মাপিয়া থাকি। কিছুই করার থাকে না। বাইনারি-অপোজিশনের খপ্পর থেকে রেহাই নাই। কিন্তু বড়বেলায় এসে এই ছোটবেলাস্মরণের ব্যাপারটা স্বাভাবিক ধরে নিলে এঞ্জয়মেন্ট বাড়ে বৈ কমে না।
আমাদের ছোটবেলায় ঈদ ছিল দুইটা, এখনকার ছোটবেলায় ঈদ কয়টা জানি না, একটাকে আমরা বলতাম রোজাঈদ এবং আরেকটা এই বখ্রাঈদ। কুর্বানিও বলতাম অবশ্য। তবে সিলেট অঞ্চলে সেকালে বখ্রা শব্দটাই ছিল বেশি চালু কুর্বানির বদলে। সেইসময় আমরা ভাবতাম বখ্রা মানে হচ্ছে মেষ/ছাগ/দুম্বা ইত্যাদি। পুংলিঙ্গ। ‘বক্রা’ বলত অনেকেই। স্ত্রীলিঙ্গার্থে যেয়ে হয় বক্রি। স্ত্রী ছাগ আর পুং ছাগ। বক্রিঈদ বলতে শোনা যায় এখনও পুরানা মানুষদেরে। ব্যাপারটা আদৌ সহি ছিল না।
তা, সহি-গলতের চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে লোকে এইভাবে বলত বা ভাবত। বড় হতে হতে একসময় ক্যাপ্চার করেছি জিনিশটা। বখ্রা মানে হচ্ছে হিস্যা, ভাগ, ন্যায্য বণ্টন তথা ভাগবাটোয়ারা। আমার বখ্রা আমি রাখব, তোমার বখ্রা তুমি পাবে, তার বখ্রা তারে বুঝায়ে দেবো। বখ্রা ভাগযোগের ম্যাথেমেটিক্যাল দিকটা নিয়া আলাপ তুলছি না, জ্ঞাত সকলেই ধরে নিচ্ছি। কিন্তু বখ্রাঈদ নামটার মধ্যে একটা ব্যাপার ছিল, সমাজে এই ডাকনাম যখন চালু ছিল তখনকার পরিস্থিতি আর এখন যখন ওই নামে অখ্যাতি তখনকার সমাজপরিস্থিতি এক ও অভিন্ন নয়। ডাক বদলেছে, যেহেতু সমাজও।
কুর্বানি জিনিশটা নিয়া তর্কাতর্কি এড়িয়ে যেয়ে এমন অনেক ইশ্যুজ্ সামনে আনা যায় যেগুলো কুর্বানিকালচারের অভীষ্ট লক্ষ্য প্রতিসরিত হতে হতে এখন প্রায় বিকৃতির দিকেই যেতে লেগেছে কি না ভাবাতে বসাবে আমাদেরে। কুর্বানি শব্দটার শাব্দিক মিনিং তো বলে দিতে হবে না, তারপরও বলি আরেকবার; কুর্বানি মিন্স উৎসর্গ। বিলিয়ে দেয়া রাহেলিল্লা। আল্লার ওয়াস্তে, পরম কর্তার নামে, নিজের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করার অভিপ্রায় থেকেই রিচুয়ালটার উদ্ভব। শুধু শুধু উৎসর্গ? শুধু শুধু পশুজবাই? না, সামাজিক একটা লার্নিং ফ্যাসিলিটেইট করা হয় এর মধ্য দিয়া। যারা অবস্থাপন্ন নয়, যারা হালতে অনুন্নত, তাদের ন্যায্য হিস্যা ন্যায্য পাওনা বুঝাইয়া দেয়ার ব্যাপারটা বারবার প্রতিবছর অবস্থাপন্নরা ইয়াদ করবে এই রিচুয়ালের মাধ্যমে। সেইজন্যেই এই কন্টিনেন্টের ল্যান্ডে ব্যাপারটা বখ্রা শব্দে জ্ঞাপন করা হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। অন্যত্র কেমন অবস্থা জানি না, আমাদের ল্যান্ডে কুর্বানি জিনিশটা বখ্রা আদায় করার একটা মোক্ষম শিক্ষা।
এই শিক্ষাটাই বোধহয় এখন সমাজব্যবস্থা থেকে লোপাট করবার পাঁয়তারা চলছে। এখন কুর্বানি বিষয়টাকে স্রেফ পশুমাংশপিণ্ড বস্তিবাসীদের লঙ্গরে বসায়ে একচিমটি বিলিয়ে দেয়া আর বাদবাকি আস্ত পশু বছরওয়ারী কিচেনে ঢোকানোয় সীমিত বা আর্থ-বিবেচনায় এনলার্জ করা হতেছে। ন্যায্য হক্, সুষম বণ্টন, গরিবের পাওনা ভাগবাটোয়ারা ইত্যাদি আওয়াজের রাজনৈতিকতা আজকাল ওলামা-মাশায়েখরাও কৌশলে টেম্পার করছেন বোধহয়। অ্যাভেইলেবল দুই-চাইর হুজুর কিসিমের লোকেরে দেখেছি জিগ্যেশ করে, এরা ম্যাথমেটিক্স নিয়া ফাল পাড়েন যতটা, একদম চোখের সামনে কেউ কেউ দেখিয়েও দেন যে তিনভাগা না করেও পুরা পাঁচমণা ক্যাটলের গোশ্ত ইয়ারদোস্ত লইয়া আপনি ইমানদার মুমিন হিশেবে এস্তেমাল করতেই পারেন, ইহাতে বাধা নাই, কিন্তু হুদা গাণিতিকতার বাইরে যেয়ে এর যে রাজনৈতিকতা সেইটার মর্ম বোধহয় আল্লামা-মাশায়েখরা হয় বোঝেন না বা বুঝেও ধনিক ক্লাসের কোলাবোরেটর থাকেন অজ্ঞান/সজ্ঞান।
বখ্রাঈদ সম্বোধনে এই ঈদুল আযহা উৎসবের অনুষ্ঠানকৃত্যগুলোকে ডাকা আর এই ডাক ভুলিয়া যাবার মধ্যবর্তী কালপরিসরে সমাজে ঘটে গেছে আরও বহুকিছু, যা নিয়া আলাপ করা আমাদের সমাজগড়ন বুঝতে এবং হেলে-পড়া গাড়িটাকে ট্র্যাকে ফেরাতে হেল্পফ্যুল হতো। সমাজে একলা খাবারদাবারের কালচার ডেভেল্যপ করার ভিতর দিয়া আগাচ্ছি আমরা, আখেরে খেয়োখেয়ি জিনিশটা আমাদেরেই নিচ্ছে খেয়ে ফাঁকতালে।
লেখা : সুবিনয় ইসলাম
… …
- গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা - February 2, 2021
- গান ও গঞ্জনা - December 1, 2019
- নগরনাট সঞ্জীবস্মরণ - November 21, 2019
COMMENTS