রবিকবির পরব্রহ্ম ৫ || আহমদ মিনহাজ

রবিকবির পরব্রহ্ম ৫ || আহমদ মিনহাজ

পঞ্চম বাখান : রবিকবির কালিদাস : নদের নিমাই আর বাউলের রাধাভাব
ভারতবর্ষে ভক্তি ও প্রেমরসের যে-ঢেউ চারদিকে উতলায় সেখানে আবেগের বাহুল্য থাকলেও মেডিটেশনের ফলস্বরূপ সেই আবেগ নিমাইয়ের স্ব-চেতনসত্তায় একদিন উদ্ভাসিত হইছিল। গেরুয়া বসন, ন্যাড়া মস্তক আর খোল-করতাল-খঞ্জনির সমাবেশে বল্গাহারা ভাববিভোল গীতিনৃত্যের মধ্যে পরব্রহ্মর প্রেমে মজনুন বৈষ্ণবধারার চিন্ সমাজে স্থায়ী ও প্রভাবশালী স্মৃতিসংকেত হইয়া ওঠে এবং কীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলির জন্ম দিয়া যায়। রাধাকৃষ্ণলীলায় যে-স্মৃতি নিমাই জাতিকে অনুশীলনে বাধ্য করে ভূবর্ষের সংস্কৃতিতে সেইটা কালের ধারায় স্থায়ী সিগনেচার হইতে পারছে। রাধাকৃষ্ণলীলার মধ্যে কামবাই, পরকীয়া ও অজাচারের শারীরিক চিহ্নগুলা বিদ্যমান থাকলেও কালিদাসের ‘মেঘদূত’, ‘কুমারসম্ভব’, ‘ঋতুসংহার’ ও ‘রঘুবংশ’ দেহে যৌনতাড়নার যে-জোয়ার বহায় এবং কামবাইয়ে বিভোর হইতে জাতির মস্তিষ্কে অবিরত সংকেত পাঠাইতে থাকে, নিমাইয়ের চিহ্নগুলা সেই তুলনায় ম্রিয়মান এবং মস্তিষ্কে কেন-জানি প্রবল হইতে পারে না

কালিদাসে দেহ বারবার দ্রষ্টব্য ঘটনা হইয়া আসে; প্রেম-বিরহ-মিলন দৈহিক সংকেতের জোয়ারে থরথর কাঁপে, এবং সেই কাঁপনের ধাক্কায় পরব্রহ্মর জগতে দেহের নির্গমন ঘটানোর বৈদিক পন্থা অবিরত উহ্য ও বিলোপ হয় সেখানে। শিবলিঙ্গের মেটাফরে পরব্রহ্মর লগে আলাপ সারনের জন্য দেহে রুদ্র কামবাই জাগানোর ব্যাপারটা হিমালয় হইতে কন্যাকুমারিকা অবধি বিস্তৃত জাতির মস্তিষ্কে যুগ-যুগান্তর ধরে স্বাভাবিক বইলা স্বীকৃত। এখন কালিদাস সেই ব্রহ্মাস্ত্র ফিরা-ফিরা ব্যবহার করায় বিরহ ও ভালোবাসার আর্তি সেখানে দেহকে মোক্ষম একখান টেক্সট রূপে হাজির হইতে সহায়তা করে। দেহকে জাগানোর শিল্পকলায় কালিদাসের অতুল কুশলতার ভক্ত হইলেও নিজের সৃষ্টিতে সেই কুশলতা ব্যবহারে রবিকবি তেমন সুবিধা করতে পারে নাই। কামবাইয়ের রুদ্র রস হইতে জাগরিত দেহের নির্গলনে স্ব-চেতনসত্তার অবলুপ্তি ঘটে। দেহ তখন ‘শূন্য’ ও নির্বিকার চেতনসত্তায় অটল হয়। শিব যেমন পার্বতীকে সম্ভোগ শেষে স্থির হয় সেই ‘পরব্রহ্ম’-এ যেখানে সকলই মৌন শ্মশান! দেহের এই সিগনেচার রবির মস্তিষ্ক বেশিখন নিতে পারে না বইলা কালিদাসকে মালবিকা-নটী-বারাঙ্গনা পরিবেষ্টিত রঙ্গরসভরা শান্ত-সুবোধ-সুস্থির সময়ের প্রতিমায় কাল্পনিক করে সে এবং সেখানে ফেরত যাইতে না পারার দুখে বিদীর্ণ হয় :

আমি যদি জন্ম নিতাম / কালিদাসের কালে। / …চিন্তা দিতেম জলাঞ্জলি, / থাকত নাকো ত্বরা—/ মৃদুপদে যেতেম, যেন / নাইকো মৃত্যু জরা। / ছটা ঋতু পূর্ণ করে / ঘটত মিলন স্তরে স্তরে / ছটা সর্গে বার্তা তাহার / রইত কাব্যে গাঁথা। / বিচ্ছেদও সুদীর্ঘ হত, / অশ্রুজলের নদীর মতো / মন্দগতি চলত রচি / দীর্ঘ করুণ গাথা। / আষাঢ় মাসে মেঘের মতন / মন্থরতায় ভরা / জীবনটাতে থাকত নাকো / কিছুমাত্র ত্বরা। …আমি যদি জন্ম নিতেম / কালিদাসের কালে / বন্দী হতেম না জানি কোন্ / মালবিকার জালে। [সেকাল : ক্ষণিকা]

কালিদাসে রুদ্ররসের বন্য তোড় দেহের স্খলন ও নির্গলনের সড়ক দিয়া গমনের পর ‘পরব্রহ্ম’-এ নিজেকে অটল ও মৌন হইতে দেখে; — জাতির মস্তিষ্কে স্থায়ী সে-স্মৃতির সঙ্গে রবির সুস্থির রসের মালবিকারা তাই অহর্নিশ ঝামেলা পাকায়। নিজ টেক্সটের প্রতিসর্গে দেহ নিয়া কালিদাস তুলকালাম কাণ্ড করে। স্মৃতি প্রতারক না হইলে কাণ্ডখান ‘কুমরাসম্ভব’-এ ঘটে :— শিবের উগ্র কামবাই পার্বতীর সঙ্গে রমণের ক্ষণে বীর্যপাতের তুঙ্গ মুহূর্তে পৌঁছাইছে। পার্বতী ছাড়া জগতে কারও সাধ্য নাই লেলিহান সে-রেতঃপাত ধারণ করে সৃষ্টিকে বারবার প্রসব ও লালন করে! তুঙ্গ ক্ষণে শয়নকক্ষে বেআক্কেল অগ্নিদেবতা ঢুকল দেখে পার্বতী শরমে মুখ লুকায়। বেআক্কেলটা শিবকে অপ্রস্তুত ও ক্ষুব্ধ করে তোলে। বিব্রত ও দিশেহারা শিব নিজের উচ্ছ্রিত বীর্যধারা নিঃসরণের জন্য পার্বতীর পরিবর্তে অগত্যা অগ্নিকেই মাধ্যম করে। শিবের তেজি বীর্যে অগ্নির দেহ ছারখার হওয়ার উপক্রম হইতে থাকে এবং অসুখে পড়ে। অগ্নি অসুখ বাঁধানোর কারণে সংসারের দৈনন্দিন কাজকাম সেই সময় মাটি হইতে বসছিল। অগ্নি এই-যে অসুস্থ হওনের জেরে জগৎসংসারকে লকডাউনে যাইতে বাধ্য করে, — এই ছবিখানায় ইজাকুলেশনের মাধ্যমে দেহের নির্বিকার অটলে নির্গমনের রূপ কালিদাসে তীব্র হইয়া ফোটে এবং কামবাইকে ‘পরব্রহ্ম’ সাধনার স্থায়ী স্মৃতি রূপে অনুশীলনে জাতিকে প্ররোচিত করে সে; — রবির ব্রাহ্ম ও বৈষ্ণবরসে সিক্ত মনের পক্ষে সেই চাপ তখন দুঃসহ বোধ হইতে থাকে। সে তাই নিজেকে অবিরত নিমাইয়ে নিঃশেষ করতে বাধ্য হয়। পরকীয়া-অজাচার-অশ্লীলতার সাইনগুলা সেখানে তরঙ্গ তুলনের পরেও কামগন্ধহীন চিহ্নের দ্যোতনায় রবিকাব্যের ‘মালবিকা’ হয়।

শ্রী চৈতন্য ওরফে নিমাই সন্ন্যাসীর জগতে পরকীয়াটা হইছে ‘পরব্রহ্ম’-র সঙ্গে নিজের ডায়ালগ সারার বাহানা। অনুধ্যানের মুহূর্তে নিমাই যার অনুভবে পৌঁছায় :— ভেদ-বিচার ইত্যাদি দিয়া পরব্রহ্মর নাগাল পাওয়ার বদলে প্রেম ও ভক্তিরসে অটল হইতে পারলে তারে সহজে পাওয়া সম্ভব। সে-অনুভবের জায়গা থিকা নিমাইয়ের মস্তিষ্কে রাধাকৃষ্ণ লীলার ঘটনাখান স্থায়ী স্মৃতির রূপ পাইতে শুরু করে। কীর্তনের সুরতালে দেশ মাতানোর কামে নেমে জাতির মস্তিষ্কে রাধাভাবে কৃষ্ণ আবেশে বিভোল ন্যাড়া গৌরাঙ্গের রূপও সেইসঙ্গে স্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত হয়। শৈবধারার মধ্যে অমিষভাবিক যে-শক্তি নিজের রুদ্র কামবাই দিয়া জগৎসংসারকে রমণ ও দেহকে নিঃস্ব করতে কয় অথবা সে-রমণের মধ্য দিয়া নিঃস্ব দেহখান ‘পরব্রহ্ম’-এ নিজের বিনাশ ঘটায়, নিমাইয়ের বৈষ্ণবভাবে মধুর কামরস এহেন শক্তিসাধনায় দেহ নিঃস্ব বা শূন্য করার পন্থাটারে অ্যালাউ করার বদলে ইগনোর ও এনকাউন্টার করে। রাধাকৃষ্ণ লীলায় মদনবাণে জর্জরিত কৃষ্ণের প্রতিটা ম্যুভমেন্ট থিকা কামবাই উপচে পড়ে, গোপিনীগো লগে রঙ্গের ক্ষণে তার আচরণ স্থূলতা ও অশ্লীলতার সকল সীমা ছাড়ায়, কিন্তু এইসব কামবাই ও অশ্লীলতার গহনে ভক্তিরসের প্রবল স্রোত প্রবাহিত হওয়ার কারণে বাড়াবাড়ি ও স্থূলতাটা কেন জানি চোখে লাগে না এবং নিমাইয়ের উদ্দেশ্য সেখানে চরিতার্থ হয়।

বৈদিক পরব্রহ্মর সিগনেচারটা কালিদাস কৌশলে উপেক্ষা করায় কামসূত্রর বডিল্যাঙ্গুয়েজ ব্যাপকভাবে নিজের সৃষ্টিতে সে ব্যবহার করতে পারছিল। অন্যদিকে রাধাকৃষ্ণের পরকীয়া রোমান্স ও গোপী নিয়া রঙ্গ-তামাশার মূলে পরব্রহ্মর সিগনেচার মার্কে নিজেরে বিলীন করার ধান্ধা থাকার কারণে অজাচারটা সেখানে শেষতক আর অজাচার হইয়া উঠতে পারে না এবং ওইটারে তখন প্লেটোনিক মনে হইতে থাকে। রাধা রাতবিরাতে আকুল হয়ে কৃষ্ণের পানে ধায়, রঙ্গ-তামাশা আর মান-অভিমান-বিরহ-বিবাদ সকলই ঘটে, পরকীয়ার নেশা উছলায় নদীতীর ও কদম্বতলে, কিন্তু কৃষ্ণ যখন রাধার দেহে ঢুকনের পাঁয়তারা করে সে-মুহূর্তে তার সকল কামবাই নিস্তেজ হইয়া আসে; শরীরের সে-আবেগটা আর থাকে না কিংবা কালিদাসের মতো ইজাকুলেশনের সংকেত দিতে মস্তিষ্ককে বাধ্য করতে পারে না। উলটা জয়দেবের ‘দেহি পদপল্লব মুদারম’-এর ভক্তিরসের তোড়ে দেহলীলা বায়বীয় পরব্রহ্মলীলার দ্যোতক হইয়া ওঠে। রবির কামবাই সাধনায় এই প্রভাব বড় হওয়ার কারণে ব্রজবুলি ভাষায় রচিত ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী হইতে পরকীয়া নামক টাবুখান নিয়া রচিত রবিসাহিত্যে লুকোচুরি ও নিঃস্ব হওয়ার হাহাকার প্রধান হইয়া উঠছে। 

জয়দেবের ‘দেহি পদপল্লব মুদারম’ স্মরণ করায়, কামাতুরা কৃষ্ণ মদন-অনলে দগ্ধ হওয়ার পরেও রাধার পদযুগল মাথায় নিয়া কামনাশ করতে ব্যাকুল হইছিল। পার্বতীর দেহে নিজের অনুপ্রবেশ ঘটাইবার ক্ষণে শিব রাখঢাক মানে নাই। রাধার দেহে ঢোকনের ক্ষণে কৃষ্ণের সব এলোমেলো হইয়া যায়। তার মনে অনুধ্যান জাইগা ওঠে; স্থূল কায়ার মায়া ত্যাগ করে অদ্বৈতরসে বিলীন হইতে চায় সে; এবং রাধার পদযুগল দেহের একখান গুরুত্বপুর্ণ অঙ্গ থিকা বায়বীয় চিহ্নে রূপান্তরিত হয়

কৃষ্ণের মনে এই ভাব জাগে, — মদন প্রকোপে যে-রাধার মধ্যে অনুপ্রেবশ করতে দেওয়ানা হইছে সে-রাধা তার নিজের নারী-স্বরূপ ছাড়া আর কি? যেখানে সকল কায়ার অবসান ঘটে চিরতরে সে-জগৎ হইতে আগত রাধা কিংবা কৃষ্ণ তো শেষাবধি কায়াহীন অরূপ রূপের স্মারক মাত্র! তাই যদি হইয়া থাকে তবে রাধার উথালপাতাল দেহে ঢুকনের মাধ্যমে শ্যামকালিয়ার কামবাই হয়ত মেটে এবং রাধাও রাগমোচনে শান্ত হয় কিন্তু স্খলনের নেশায় মন লগ্ন থাকায় কায়া নামের মায়ার খেলা শেষ হইতে চায় না, আর সেইটা শেষ না হওয়া অবধি দেহ কী করে ‘পরব্রহ্ম’-এ সূক্ষ্ম হয় সেই বোধের তল মিলে না। অগত্যা কৃষ্ণ রাধার লগে মিলনের ক্ষণে তার পেলব পদযুগল মাথায় নিয়া মায়ার খেলার ইতি টানে : — ‘স্মর-গরল খণ্ডিয়া / এ শির মম মণ্ডিয়া /প্রসার রাধে, উদার পদ-পল্লবে। / মদনে যেন অনল জ্বালা, / এখন তাহে নিভাও বালা / করগো আজি শীতল তব বল্লভে।।’ [গীতগোবিন্দ : জয়দেব; ভাষান্তর : কবি বিজয়চন্দ্র মজুমদার, ১৯২৫]

কায়াবিহীন অদ্বৈতরসে বিলীন হওনের ভাব নিমাই সন্ন্যাসীর রাধাকৃষ্ণ লীলায় প্রবল হয় বইলা দেহ সেখানে সিগনেচার হইতে পারে না। এই বিশ্বাস তখন আর জাগে না ভূবর্ষে একদা কামসূত্র রচিত হইছিল, অজন্তা-ইলোরা-খজুরাহোয় কামবাইয়ের স্মারকচিহ্ন জাতীয় জীবনে অনায়াসলভ্য ছিল, যেহেতু নিমাইয়ের রাধাকৃষ্ণ সেইটারে এনকাউন্টার করে। নির্জলা কামবাইয়ের উচ্চণ্ড শক্তিরসের সাহায্যে শিবত্ব লাভ এবং সেই কামবাইয়ের আবেশে নিজেকে খালি বা এম্পটি করার মধ্য দিয়া দেহটারেই বাতিল ও কায়াহীন গণ্য করার ধারা নিমাইয়ে আইসা ম্লান হয়। দেহ বা কায়া সেখানে ভক্তিরসের রূপক হইয়া মধুর রঙ্গে মাতে। যে-কারণে এইটা বোধহয় কওন যায়, দেহ নিয়া অঢেল রঙ্গ-তামাশা শেষ হইলে পরে জাতির মস্তিষ্কে সেইটা ভুইলা যাওনের সংকেত পাঠায় নিমাই। দেহ স্ব-চেতনায় জাগ্রত থাকলে ভেদ বা দ্বৈততার ভ্রম দূর হয় না। কামবাইয়ের মধ্যে এর নিঃস্ব ও বিলোপ হওয়ার সুযোগ নিমাই তাই দেখে না। কীর্তনের সুরে প্রবাহিত নিমাইয়ের রাধাকৃষ্ণলীলা তাই দৃশ্যত নাচেগানে ভরপুর হিন্দি বা বাংলা সিনেপর্দায় নদীপার ও গাছের তলায় সখীগো নিয়া নায়ক-নায়িকার দেদার জড়াজড়ি, ঝাপটাঝাপটি, চুম্মাচাট্টি ও লুকোচুরি খেলার স্মারক হওয়ার পর ফেরত যায় গীতগোবিন্দের ‘দেহি পদপল্লব মুদারম’-র বায়বীয়তায়।

ভারতীয় কামবাইয়ের ইতিহাসে রাধা সেই অভাগিনী যার দেহ তার নিজের না! এভাবেও কওন যায়, রাধারে ভাবতে বাধ্য করা হয় নিজের দেহটারে অন্যের বইলা ভাবতে। রাধা সেই ভাব নিয়া নিমাইয়ের স্ব-চেতনায় একদিন প্রবেশ করে। আবেশ বিভোর নদের নিমাই সেই দেহ নিয়া তখন পথেঘাটে কীর্তনের বোল উঠায়। লোকে দেখে নিমাইয়ের মধ্যে এক নারী এসে ভর করছে, রাধা যার নাম। কে সেই রাধা? সেই রাধা অতুল যৈবতী! তার দেহের খাঁজেভাঁজে পুরুষকে ঘায়েল করার ব্রহ্মাস্ত্র মজুদ এবং সে স্বৈরিণী বটে। সমাজের বিধি পায়ে ঠেলে রাতবিরাতে অভিসারে যায়। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে পরপুরুষের বিরহে কাতরা হয়। তার দেহ খাঁচায় আটকা বন্য পাখি। কামজোয়ারে খালি ছটফট করে!

নিমাই সন্ন্যাসীর দেহে ভর করনের পর রাধা তাঁরে স্থানে-কুস্থানে গমন করায়। উদ্দেশ্য? — ভগবান রূপে অতুল সেই পুরুষকে দেহে টানা ইতিহাস যারে ভগবান বিষ্ণুর মানব-অবতার কৃষ্ণ নামে চেনায়। যে-কৃষ্ণ সেই কবে দ্রৌপদীর সখা ছিল বলে বিদিত জগতে! কৃষ্ণ এখন কুরুক্ষেত্রের জগৎ-সংহারী কুটিল চাণক্যের পার্টে ইস্তফা দিয়া চিকন কালা হয়ে প্রেমিকের বেশ ধরছে। রাধাভাবে দিওয়ানা নিমাইকে পথেঘাটে ঘুরায় তারে দেহে টানতে। নিমাই নিজেও হয়ত টের পায় না টানাটানির এই খেলায় রাধা নামের আহির জাতির কন্যার যৌবন উত্তাল দেহখান ক্রমে শুকায়া যায়! রাধা তো সরলা পাহাড়ি বালিকার অধিক বৈ কিছু ছিল না এবং ভানুসিংহ নামের রবিকবি তারে তখন বিলক্ষণ চিনত :—

হম সখি দারিদ নারী!
জনম অবধি হম পীরিতি করনু
মোচনু লোচন-বারি।
রূপ নাহি মম, কছুই নাহি গুণ
দুখিনী আহির জাতি,
নাহি জানি কছু বিলাস-ভঙ্গিম
যৌবন গরবে মাতি।
অবলা রমণী, ক্ষুদ্র হৃদয় ভরি
পীরিত করনে জানি; [হম সখি দারিদ নারী : ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী]

কালার পিরিত শেষতক ফাঁদ হইয়া ওঠে টের পাইলে আহিরকন্যা হয়তো সেই ফাঁদে কভু পা দিত না। এইটা সেই ফাঁদ যেখানে ঢুকলে নারীর দেহখান আর দেহ থাকে না। ওইটা ‘পরব্রহ্ম’ নামক এক আজিব ঘটনার উপকরণে বায়বীয় হইতে শুরু করে। সীতা ও দ্রৌপদীর সঙ্গে রাধার তফাৎ এখানেই! নিজের দেহখান তার নিজের নয় বরং ওইটা পঞ্চপাণ্ডব বা সখা কৃষ্ণের ভোগের বস্তু এই ভাব দ্রৌপদীর মনে জাগে নাই বা জাগানোর প্রয়োজন হয় নাই। রাধা যে কিনা আহির জাতির যৈবতী কন্যা ছিল এবং সহজছন্দে দেহের খিদা মিটানোর মধ্যে প্রেমের সুখ মিটে বইলা জানত, সেই সহজ রাধার জীবনে কৃষ্ণ তাই আসে অভিশাপ হইয়া। রাধাকে সে প্রেম ও বিরহের অনলে পুড়ায় ঠিকই, ঘাটে-আঘাটায় বেহায়া-বেশরম হইতে বাধ্য করে, কিন্তু এইসবের প্রতিদান দেওনের ক্ষণে চতুর কানাই রাধার কায়া হইতে নিজেকে প্রত্যাহার করায়। প্রত্যাহরের এই ধরনটা গুরুতর, যেহেতু এর মধ্য দিয়া ভারতীয় হিন্দুত্ব-র দেহে অনুধ্যানে প্রাপ্ত বৈদিক পরব্রহ্মর শুদ্ধ অনুভবে কেমনে পৌঁছান যায় তার রূপক হয়ে রাধাকৃষ্ণ লীলা জাতির মস্তিষ্কে স্থায়ী আকার নিতে থাকে, সেইসঙ্গে ভারতীয় রমণীর চিরায়ত সহজ ছন্দে বিচ্ছেদ ঘটায়। অর্থাৎ রাধা সেই মিথোলজির অংশ হইয়া ওঠে যেখানে রমণী সংসারে অবস্থানের পরেও সেখানে তার চিরায়ত ভূমিকা গৌণ হইতে থাকে

সে এমনকি হিমালয়কন্যা উমা বা পাবর্তীও না; যে কিনা শিবের মতো আউলাঝাউলা একটা ভগবানের লগে ঘর করনের হিম্মত রাখে। এই উমা বাপের লগে বরের বিরোধ মিটাইতে ব্যাকুল থাকে। গঙ্গার লগে পশুপতির আশনাই আছে বইলা সন্দেহ করে এবং এই নিয়া তুলকালাম ঘটাইতে তার বাঁধে না। নিজের ছানাপোনার ঝক্কি ও আবদার যেমন সামলায় বোম ভোলানাথ শিবের কামবাই মাথায় উঠল দেখে সংসারের শতেক ঝামেলার মধ্যেও তারে রমণসুখ দিতে কৃপণতা করে না। আবার সেই পার্বতী মাথায় রোখ চাপলে শিবের বুকের উপরে পা দিয়া সংহারী কালী হইতে তিলেক দ্বিধা রাখে না। সোজাকথা রমণী-জননী-দেবী সকল রূপের মিলনে ক্লাসিক একখান ক্যারেক্টার রূপে পার্বতী একদিন কালিদাসের দেহে ঢুকে এবং তারে দিয়া কুমারসম্ভব  লেখায়। রাধার আগমন সেই সহজাত ধ্রুপদিছন্দে পরব্রহ্মর সুলুক পাওয়ার রাস্তায় ক্রমশ প্রাচীর হইয়া ওঠে এবং রমণীর দেহকে একটা নিষিদ্ধ বা ফরবিডেন যৌনপুতুল বইলা জাতিকে ভাবতে বাধ্য করে। রাধা হইছে সেই যৌনপুতুল যে কিনা শারীরিক বা ফিজিক্যাল হইলেও তার লগে সেক্স করতে মানা।

নিমাই সন্ন্যাসীর দেহে সেই যৌনপুতুল অতিকায় এক কল্পপ্রতিমা রূপে একদিন প্রবেশ করে এবং পরব্রহ্মর লগে বায়বীয় যৌনতায় লিপ্ত হইতে তাঁরে অবিরত উসকানি দিয়া যাইতে থাকে। অতঃপর সে বাউলের দেহে গিয়া ঢুকে এবং তারে দিয়া নিজের দেহ রমণের মাধ্যমে ‘পরব্রহ্ম’ অনুভবের সুখে উতলা করায়। ঘটনার আপাত পরিশেষ ঘটে রবিকবির দেহে তার অনুপ্রবেশের ভিতর দিয়া। কিশোর রবি ওরফে ভানুসিংহকে সে প্রথমত ‘উপেখার অতি তিখিনী বাণে / না দিহ না দিহ জ্বালা।’ ইত্যাদি বইলা উত্যক্ত করতে শুরু থাকে এবং শেষতক তাঁরে দিয়া ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য-র প্রত্নপ্রতিমা তৈরি করায়সেই লাবণ্য রবিসৃষ্ট সকল ‘মানসী’র মধ্যে যে-নারী সম্ভবত শ্রেষ্ঠ ও পরিণত যৌনপুতুল বইলা নিজেরে দাবি করতে পারে। রবি নিজের দেহমাঝারে এক দিঘি বইলা তারে কল্পনা করে। এখানে প্রশ্ন হইল এই দিঘির কামটা কি? উত্তর :— লাবণ্য হইছে সেই দিঘি যেখানে রবি মনের সুখে ডুব দেয় এইটা মাথায় নিয়া :— এই দিঘিতে আর যাই ঘটুক রেতঃপাতে মানা!

যারা মনে করেন রাধাকৃষ্ণলীলা ফেমিনিনিটি বা স্ত্রীভাবিক রূপ ধারণের মাধ্যমে ভারতীয় মরমিবাদ ও বাউলগো সহজিয়া ভক্তিরসে পরব্রহ্মর লগে মিলনের সূত্রপাত ঘটাইছিল, অথবা যাঁরা পরিতৃপ্ত মন নিয়া ভাবেন রমণীকে এই প্রথম অতুল মর্যাদার আসনে বসানো হইছে, তাঁদের হয়তো খিয়াল থাকে না ভারতীয় রমণীত্বের জগতে রাধা হইছে সেই বিচ্ছেদরেখা যার মধ্য দিয়া রমণী পরব্রহ্মলীলার বাহানায় তাঁর নিজের দেহের স্বত্ব চিরতরে হারায় যেইটা এমনকি উমা, সীতা, দ্রৌপদী কারও বেলায় ঘটে নাই। তারা সমাজের নিয়মদোষে বহুভাবে পুরুষশক্তির পুতুল রূপে ব্যবহৃত বা নিগৃহীত হইছে কিন্তু নিজের সহজাত রমণীত্ব তাদেরকে হারাইতে হয় না। রাধা সম্ভবত প্রথম বায়বীয়তা যার দেহ আর দেহ ছিল না, ওইটা পুরুষের শূক্রপাত নিঃসরণের পরিবর্তে দমনের হাতিয়ার হইছিল

রাধাকৃষ্ণ লীলা সেই অর্থে ভারতবর্ষে দ্বিতীয় মুনসংহিতা যেখানে দেহ আবারও টাবু হইয়া ওঠে এবং ইনসিগনিফিকেন্ট গণ্য হইতে থাকে। সেইসঙ্গে টাবু ভঙ্গে উদ্ধত বামাচারী শক্তিসাধনায় ব্যবহৃত পঞ্চমাকার-প্রীতির (মদ্য, শস্য, আমিষ (মাছ-মাংস) ও মৈথুন বা কামকুণ্ডলিনী দমনে নারীশক্তি নিয়া সাধনা) ট্রেন্ড সে একইভাবে প্রত্যাখ্যান করে। এই প্রত্যাখ্যান দেহকে পরব্রহ্মর আধার গণ্যকারী শৈব ও তান্ত্রিক ধারার সঙ্গে নিমাইয়ের বিচ্ছেদ ঘটাইতে বাধ্য করে। এইটা আবার ভারতের ইতিহাসে পার্বতীর স্বতন্ত্র ও ভয়ংকরী যে-রূপ কালী হইয়া সৃষ্টি ও বিনাশের খেলা খেলে সে-কালীরে জনতার স্মৃতিতে গৌণ করায়। সবকিছুর মূল হইয়া ওঠে এই বিষয়টি :— নারীদেহকে দেহ বলে ভাবলে কামের বাই জাগে চিত্তে এবং সে-দেহ অতিক্রম করে নিজের ভিতরে কায়াহীন অভেদের বোধ জাগ্রত হয় না, সুতরাং বায়বীয় ভালোবাসার মধ্যে দেহের বিনাশেই সিদ্ধি। রবির গানে-কবিতায়-নাটকে তাই দ্বিরুক্তির ছলে ফিরে-ফিরে দেহ বিলোপকারী বায়বীয় রূপের প্রতি ভালোবাসা উতলায় :—

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। / হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে॥… / জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি, তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি, / যত পাই তোমায় আরো তত যাচি, যত জানি তত জানি নে। / জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর  লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তর / তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে॥’ [গীতবিতান, ৪৮৭]

রবিকবির সাহিত্য সামগ্রিকভাবে টটোলজি বা দ্বিরুক্তির সমাবেশ এবং দ্বিরুক্তি ছাড়া নিমাই তাঁরে সাকার থিকা নির্গুণে দেহ-বিলোপ করার যে-তরিকা শিখাইছে সেইটা সে প্রকাশ করতে পারে না। রবির আজীবন বৈষ্ণব প্রীতির কারণ যে-নিমাই তাঁর হাত ধরে ভারতবর্ষের জাতীয় ইতিহাস ও আমজনতা কালিদাসের যুগ থিকা নিজেকে বিচ্ছিন্ন হইতে দেখে। যৌনকামনার মধ্য দিয়া পরব্রহ্মর লগে আলাপের যে-সম্ভাবনা রাধাকৃষ্ণলীলা তৈয়ার করছিল একদিন নিমাই সন্ন্যাসীর কারণে সেইটা আর দৈহিক থাকে না। ওইটা তখন মেটাফিজিক্যাল হইয়া ওঠে ও ভক্তিরসের মধ্যে বিলীন হয়। রবিকবির স্মৃতির মধ্যে নিমাই জাগ্রত থাকায় সে যখন পরকীয়া-কামবাই ইত্যাদি নিয়া বাখান জুড়ে সেইটা রক্তমাংসে দেহে পরিণত হইতে তাঁরে বাধা দেয়

‘শেষের কবিতা’ যেমন ক্লিয়ার করে ভারতীয় নারীদেহকে রবি সিগনিফিকেন্ট বইলা দাগাইতে চায় না; সেই নারী তাঁর কাছে আসে কামগন্ধহীন বায়বীয় ভালোবাসার সুরভী নিয়া, যার আঁচলের তলে সে জিরান লইতে চায় কিন্তু ভোগ করতে রুচি হয় না। ভারতীয় মালবিকাগো মধ্যে যারা এখন মেমসাহেব হইতে চান তাদের নিয়া রবির রঙ্গ, ঠাট্টা আর আপত্তি তাই নানান ছলে বাহির হইয়া পড়ে। রবির কাছে ভারতীয় নারী গ্রাম্য সরল বালিকার রূপে আসে যে এখনও সভ্যতার বাইরে ‘কালোহরিণ চোখ’ নিয়া ময়নাপাড়ার মাঠে তাঁরে দেখা দেয়। নতুবা সে-নারী ক্যামেলিয়া বা লাবণ্য-র প্রতীক হইয়া আসে, যার মধ্যে সভ্যতা আলো ফেলছে ঠিকই কিন্তু তার চিরন্তন নারীত্বের হানি ঘটাইতে পারে নাই। এই দুইয়ের মাঝখানে যারা অবস্থান করে রবির কাছে তারা হইছে নিছক কাজের জিনিস, সংসারে করতে গেলে লাগে এবং লোকে ব্যবহার করে; নতুবা তারা খেলনা, আধুনিক হওয়ার চেষ্টায় মনে চটক জাগাইতে চায় এবং ফেলনা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে শেষতক। নিজের এই নারীভাবের জগতেও নিমাই তাঁকে নেপথ্যে প্রভাবিত করে যায়‘শেষের কবিতা’-য় বিদেশি কেতায় দড় কেতকী আর দেশি লাবণ্যের মধ্যে তুলনা টানতে গিয়া অমিত তাই রবির হয়ে মার্কিংটা সারে :—

কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই; কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার ভালোবাসা, সে রইল দিঘি; সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।

রবি এই ক্লিয়ারেন্স নানান ছলে জানাইতে থাকে, চিরন্তন ভারতীয় রমণী তাঁর মতো পুরুষের সাধনসঙ্গিনী হওয়ার বিষয় নহে। কামবাই মিটানোর বস্তু সে হইতেই পারে না। তার দেহে রাধার লক্ষণ বিরাজিত থাকনের পরেও পুরুষ তার কাছে যা চায় সেইটা মিটানোর শক্তিতে অতুল না হইলে সে হয়ত কেতকী, কভু লাবণ্য বা রাধা নহে। ভূদেশ চষেও এরকম একখান লাবণ্যর দেখা বাস্তবে পাওয়া সম্ভব নয় দেইখা দিঘির প্রত্নপ্রতিমায় সে এই রমণীর অনুধ্যান করে। রবির চিরন্তন নারী তাই যতটা বাস্তবিক তার-অধিক কল্পনাসম্ভূত ‘মানসী’! কবি তারে আপন খেয়ালে গড়ে। সে তারে ভালোবাসে ও বাসনা জানায়। রমণীর জন্য তাঁর দেহকোষে কামবাই উপচায়, কিন্তু দিনের শেষে অভোগ্যা রাধা হওনের মধ্য দিয়া সে কবির মানসপ্রতিমা হইয়া ওঠে। রবির চিরন্তন নারী তাই আধখান মানবী আর বাকি আধখান ‘কবির কল্পনা’!

পরব্রহ্মর লগে মোলাকাতে রবি তাই বাস্তবের রমণীগো নিজের দেহে জুড়তে আপত্তি জানায়। যেহেতু তারা কেতকী, দিঘির জলে সাঁতার কাটার মতো অতল কোনও লাবণ্য নহে। পরব্রহ্মপ্রীতি হইছে সেই নিষ্ঠুরতা যেখানে দেহের সমাধি সঙ্গিনী নিয়া কামবাইয়ের পরীক্ষা দেওনের মধ্যে ঘটে না, এটা সেই অনুধ্যান যেখানে দেহের লীলা কোনও রমণীকে আধার রূপে ব্যবহারের অধিকার রাখে না। রাধাকৃষ্ণলীলায় নিমাই কীর্তনের সুরে সেই ম্যাসেজটা রাইখা যায় এবং রবি সেটা রিপিট করে বলে বাউলের পরব্রহ্মপ্রীতি তাঁরে প্রীত করলেও সাধন-ভজনের পদ্ধতি ও সেখানে নারীর ব্যবহার সে মন থিকা অনুমোদন করে না।

তো এই বিষয়গুলা বিবেচনার পর বুঝতে বাকি থাকে না রবি কেন বাউল আচার-উপাসনাকে অবহেলা করে। খেলা যেখানে মগজের সেইখানে আচার গৌণ। বাউলারা যে-অজুহাতেই সেইটা করুক ব্রহ্ম-উপলব্ধির মধ্য দিয়া অটলভাব ধারণ বা সেই সদাচার রপ্ত করনের জন্য মানসিক অনুশীলনই শেষ কথা এবং সেখানে নিজেকে একলা ও পৃথক না করলে ভাবে একাগ্রতা আসে না। রবির গানে এ-কারণে একলা হওনের মর্ম এত বেশি প্রকাশ পায়। সকল আচার-অভ্যাসের মধ্যে অবিরাম গমন ও বিচরণের পরেও সে একলা হইতে প্রতিদিন ভোরে উঠতে চেষ্টা করে এবং অবিরাম লিখে। কাগজে অক্ষরের কাটাকুটি খেলাটাই তাঁর মেডিটেশন যা তাঁর মগজের আলোসংকেতগুলারে অবিরত জ্বালায়-নিভায়।

রবিকবির সাধনপদ্ধতি তাঁরে নিঃসঙ্গ ও একক করে; সমস্ত দিনের শেষে সব প্রত্যাখ্যান করে তাঁরে ফেরত যাইতে হয় নির্জনতায়! যদিও সমাজ এই জায়গা থিকা রবিকে আজও রিড করে বইলা একিন হয় না। সুধীর যেমন কষ্ট পাইছেন এইটা ভেবে, রবিকবি বাউলগো ব্যবহার ও প্রমোট করছেন কিন্তু বোঝার চেষ্টা করেন নাই; হইতে পারে জমিদার ও সেলিব্রেটি ছিলেন বইলা তাদের কুটিরের ভিতরে তিনি সুধীরের মতো করে ঢুকতে পারেন নাই। তাঁর ক্লাস (আমাদের অনেক বামাখ্যাপা বামরা যেইটা স্বতঃসিদ্ধ মনে করেন) সেখানে বাধা হইয়া উঠছিল ইত্যাদি। সুধীরের মনোভাবে সমাজসত্য আছে তবে রবির ক্ষেত্রে কারণটা সহজ :—

দেহধারী সমাজ-সংসারে কলুর বলদের মতো দায়িত্বের চাকায় ঘুরতে-ঘুরতে যখন নিজের নিষ্ক্রমণের রাস্তা খোঁজে তখন পরব্রহ্মর লগে আলাপ জুড়ন ছাড়া রবির উপায় থাকে না। বেদ-উপনিষদ থিকা যে-ব্রহ্মকে সে নিষ্কাশন করে জীবনবোধের কিনারা করার তাগিদে, সেখানে বাউল-দর্শনে ফেরত যাওয়া মান ওইটার আধখ্যাঁচড়া অনুকরণ। রবির সেই বোধ ছিল বইলা বাউল ও লোকায়ত ধারায় যত মর্ম প্রকাশ পাইছে তার সবখানি নিজের তৈরি ভাষায় সে Interchange করছে। এইটা একদিক হইতে তাঁর Encounter বইলাও ধরা যায়। সে সবকিছুর মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করায়, এইগুলা আত্মস্থ করে, ভালোবাসা জানায়, প্রেম করে, লালনপালনের ব্যবস্থা করে (পূর্ণদাস বাউলের পিতা এবং সাক্ষাৎ যোগী ও সন্ন্যাসী নবনী দাস বাউলকে যেমন শান্তিনিকেতনে অবাধে বিহার করার সুযোগ করে দিতে তিলেক দ্বিধা করে নাই), কিন্তু দিনশেষে এইসব তাঁর কাছে সেই প্রত্নতত্ত্ব যা সে ছেদন করে নতুন ভাষাবোধের জগৎ তৈরির জন্য।  

এই স্বার্থপরতা রবিকবিকে সকলের মধ্যে অনন্য ও আলাদা করে তুলছে, যার ঘাটতি তাঁর মতো বা তাঁর থিকা প্রতিভাধর আরও বহু রবিকে চিরকালের জন্য দীনহীন বা বাতিল হইতে বাধ্য করছিল। Interchange ঘটানোর খিদায় সমগ্র ভারতবর্ষ এমনকি বৈদেশে হাজার বছর ধরে যে-সংস্কৃতি ফলবান হইছে তার সবখানি অতিকায় প্রত্নতত্ত্ব রূপে সে শান্তিনিকেতনে হাজির করে এবং সেখান থিকা নতুন ভাষার জন্ম হয়, যা ওইসব প্রত্নতত্ত্বের প্রতিধ্বনী হওয়ার পরেও সম্পূর্ণ নতুন ভুবনের দিকে জাতিকে যাইতে বাধ্য করছে। প্রত্নতত্ত্বের এমতো ব্যবহারের মধ্য দিয়া রবি স্বয়ং ফুকোর বিখ্যাত বচনের যোগ্য করে নিজেকে :— ‘Knowledge is not for knowing: knowledge is for cutting.’ এই ছেদনবিদ্যা প্রত্নতত্ত্বের ভাষাপৃথিবী বা সেইটার দাসত্ব থিকা রবিকে মুক্ত ও নতুন ক্ষমতার জনক কইরা তুলছে, যার তুল্য ঘটনা ভূ-বর্ষে আজও অধিক ঘটে নাই।

রবি হইছে সেই ক্ষমতাকেন্দ্র যাঁরে রিড করতে চাইলে সে কোথা থিকা কোন সুর সংগ্রহ করে নিজের ভাষায় জুড়ছে সেই খতিয়ান হয়তো একজন মারাত্মক চাল্লু Exploiter হিসেবে তাঁকে ধরতে সাহায্য করে কিন্তু সেখানে এই অবধান আরও বেশি গুরুতর হয় :— দেশি কিংবা বৈদেশি সমুদয় প্রত্নতত্ত্ব নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহারের পর যে-ভাষার একচ্ছত্র মালিকানা সে লাভ করছে ও জাতির মস্তিষ্কে স্থায়ী বা অবিচ্ছেদ্য বলে নিজেকে প্রমাণ করছে তাঁর সেই ভাষা-প্রকাশের জগৎকে যদি এখন প্রত্নতত্ত্ব ঠাউরাই, তখন প্রশ্নটা কিন্তু ওঠে, — রবিকবির প্রত্নতত্ত্ব ছেদ করার মতো জ্ঞান কি বঙ্গ ও সমগ্র ভারতবর্ষে যথেষ্ট পরিমাণে তৈরি হতে পারছে, নাকি সমাজ এখনও তাঁর ভাষাকে ‘Suck’ করে বা চোষে কিন্তু ‘Absorb’ বা শোষণ করতে পারে না?

‘চোষণ ও শোষণ’ নামের ক্রিয়া দুটি প্রায় সমার্থক মনে হইলেও তাদের ভাব আলাদা। ক্রিয়াপদের হিসাবে চোষায় জিভের আরাম হয় বা মস্তিষ্ক সেই আরামের সংকেত উঠায় দেহে। শোষণও তা-ই; তবে দেহের ভিতরে ঢুকে পরিপাক হইতে না পারলে সেইটা বিপাকের কারণ হয়। চোঁয়া ঢেকুর উঠতেই থাকে সারাদিন। রবিকবির এই ক্ষমতাটি বোধহয় ছিল, জীবনে সে যা-কিছু চুষছে তার সবটা কমবেশি শোষণ ও পরিপাক করতে পারছে! যে-কারণে জাতি তাঁরে সর্ব বিষয়ে প্রভাবিত হইতে দেখে কিন্তু সেই প্রভাব নতুন একখান জিনিস বইলা স্বীকার না করে উপায় থাকে না রৈবিক যুগ পরবর্তী প্রত্নতত্ত্ব চোষণ না শোষণ কোন অবস্থায় রবিকবির ছেদনে নিয়োজিত তার আন্দাজ করা না গেলে এই কবি যে-চূড়ায় বসে বঙ্গ ও ভারতবর্ষকে নির্ণয়-নির্ধারণ করে যায় সেইটার নাগাল পাওয়া কঠিন হইয়া ওঠে।

রবিকবির এই নির্ধারণে ফাঁকফোকর থাকলেও সিন্ধু সভ্যতা নামে বিদিত ভারতবর্ষের নতুন চেহারা দেওয়ার চেষ্টায় সে ত্রুটি রাখে নাই। এই ভারতবর্ষ সময়ের প্রয়োজনে সাহেবগো থিকা অনেককিছু ধার করলেও অতীতের সঙ্গে নিজেকে একত্রে জুড়নের খ্যামতা রাখে। কবতে কিংবা গল্প-উপন্যাস-নাটক যা-কিছু সে লিখছে সেখানে এই আকাঙ্ক্ষা সমানে ব্যক্ত হওয়ার কারণে রবিকে মাঝেমধ্যে পাড় ন্যাশনালিস্ট এবং ইতিহাসের একপেশে পাঠে প্রভাবিত বিফল হিন্দুইস্ট মনে হওয়া বিচিত্র না। কিন্তু এইসব ছাপাইয়া বিবেচ্য হওয়া উচিত, যা দিয়া এই বাখান শুরু হইছিল :— অকালপক্ক রবি পশ্চিম সাগরতীরের চলমান যজ্ঞে নিজের সত্তা কতখানি বিজড়িত করতে পারছিল এবং না পারলে তাঁর দুরস্ত সেখানে কী ছিল। কোন সে-ভাবের ফান্দায় তাঁর পশ্চিম সফর শেষতক পুবের ঘরজানালায় নিজের বিরাম খুঁজে মরে? কেন মনে হয় সে বব ডিলানের পাথরখানার মতো গড়াইতে-গড়াইতে দেশে ফিরতেছে ‘with no direction home’-র বিষাদ নিয়া? যেন কিশোর কবি সুকান্তের ‘বাতিওয়ালার’ উপমা সে! যে-কবিতাখান সুকান্ত হয়তো তাঁর কথা ভেবে লেখে না অথবা হইতেও পারে কিশোর কবির মনে রবির যে-ছবি চিরজাগরুক সেইটা তাঁর অবচেতনে কাজ করে এবং ‘বাতিওয়ালা’-র স্বদেশ ফেরার বিৃবতিখানা লিখে যেতে বাধ্য করায় :—

সীমান্তে আজ আমি প্রহরী / অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে / আজ এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি / স্বদেশের সীমানায়।… / পরের জন্য যুদ্ধ করেছি অনেক, / এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।… / আমি যেন সেই বাতিওয়ালা— / যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে / অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য / নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার[প্রিয়তমাসু : সুকান্ত ভট্টাচার্য; ঘুম নেই]

রবি সেই ‘বাতিওয়ালা’ যে জীবনভোর দেশ-বিদেশ করছে সতেজ ‘আলোকরশ্মি’ পাওনের আশায়! সেই আলো সে পাইছেও হয়তো-বা কিন্তু ঘরে-ঘরে জনে-জনে সেইটা বিলানোর আগেই তাঁরে ফিরতে হইছে নিজের দেহের অন্ধকার কক্ষে। সে ফেরত গেছে মরণের অন্ধকারে; প্ল্যানচেটে অকালপ্রয়াত শমি-র আত্মাটারে অন্তত একবার তাঁর কক্ষে নামানোর অন্ধকারে; রবি ফেরত গেছে একাকিত্বের সেই অন্ধকারে যেখানে স্ত্রী মৃণালিনী মৃত; কন্যারা একে-একে মরেছে তাঁর কোলে মাথা রাইখা; কিংবা সে হয়তো ফেরত গেছে ঠাকুরবাড়ির সেই ঝাপসা-হয়ে-আসা শয়নকক্ষে, যেখানে একদিন কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যায় নিজেকে শেষ করছিলেন; হইতেও পারে রবি ফেরত গেছে প্রথম প্রেমের সুবাসের মতো সেই যুবতী আন্না তড়খড়ের কাছে মুম্বাইয়ে, যে তাঁরে ইংরেজির পাঠ শিখাইছিল; আর এইসব অন্ধকার একদিন তাঁরে বাধ্য করছিল তুলি ও ক্যানভাসের লগে কথা কইতে। সময় হইছে রবির সেই জগতের দিকে ফিরার যেখানে সে কবি ও গানওয়ালা হওয়ার সঙ্গে তাল দিয়া ছবিওয়ালা হইয়া উঠছিল!

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you