তিসরা বাখান : রবির ‘হিন্দুত্ব’ ও মুসলমানের ইসলাম
তিসরা বাখানের শুরুতে বইলা রাখতে চাই প্রাচীন ভারতে চারিবর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র-এ বিভক্ত কর্ম-বিভাজনের সহজ ছকটি পরে কী হেন কারণে বর্ণ-বিভাজনের উপায় হইয়া বিকারগ্রস্ত কুৎসিত আকার ধারণ করছিল এবং মানবআত্মার সে-অপমান ও নিপীড়িত দশাটারে রবিকবি কীভাবে পাঠ করছে সেই সুলুক ফাঁসিকাষ্ঠে তাঁরে ঝুলানোর আগে বিচার করা প্রয়োজন। হয়ত অপ্রাসঙ্গিক তবু বলা প্রয়োজন :— ভারতীয় বর্ণ-বিভাজন নিয়া দেশ-বৈদেশে বহু মুনি মতামত দিছেন, যার ষোলোআনা শূদ্রের অপমানটারে বড় করে দেখানোর মাঝে নিজের দম নিঃশেষ করছে। অভিযোগ মিথ্যা এমন নয়; তবে ভারতবর্ষ কী কারণে কর্ম-বিভাজনের সহজ ছক ত্যাগ করে বর্ণ-বিভাজনের জটিল ব্যবস্থার মধ্য ঢুকছিল এবং এর প্রাসঙ্গিকতা কেন পরে অমোঘ হইছিল বা এইটা একদিক থিকা সমাজ নামক কনটেক্সটটারে সভ্যতা যে-জায়গা থিকা দাগায় তার সাপেক্ষে অনিবার্য হয় কি না সে-বাখান দেশি পণ্ডিতগো চাইতে বোধহয় আধপাগলা ফ্রিডরিখ নিৎশে অধিক গভীরতার সহিত ব্যাখ্যা দিতে পারছিল। আগ্রহীরা নিৎশের ‘প্রতিমাগো গোধূলি’ (Twilight of the idols) বহিখানা নজর করিতে পারেন।
ফাঁকতালে এই কথাটাও মনে রাখা প্রয়োজন, পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বৃত্তে যে-জিপসিরা আজও ঘুরপাক খায় এই ভূবর্ষে তারা একদিন দেদার পাক খাইছিল। টনি গাটলিফ-এর Latcho Drom যেমন নানা দেশে জিপসিগো অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়া কালবেলিয়াকে রাজস্থানে খুঁইজা পায় এবং তাদের জিপসিসুর ক্যামেরায় ধারণ করে। এইসব হাজারবিজার জাতি-বর্ণ-গোষ্ঠীর সংকরায়ণে যে-হিন্দুত্বের জন্ম এই দেশে একদিন ঘটছিল সেইটারে ব্যবচ্ছেদ করলে ‘পরব্রহ্ম’-র যে-ভাবনা মনে একত্ব ও সংহতি জাগ্রত করায় এবং মহাবৈশ্বিক পরমে লীন হইতে বাধ্য করে, রবিকবির বক্ষে এই ছবিখান টেকসই হইতে পারছিল। তাঁর মনে হইছিল এই ছবির মধ্যে ভূবর্ষে কালের ফেরে হিন্দু, অতঃপর বৌদ্ধ, এবং এভাবে শিখ, জৈন, পাহাড়ি ও মুসলমান পরিচয়ে স্বীকৃত তামাম জনগোষ্ঠীরে বাঁধাই করা সম্ভব। এইটা যদিও কবুল, ভারতবর্ষে হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-শিখ-মুসলমান ইত্যাদি রূপে বিবর্তিত জাতীয় ইতিহাসে বিশুদ্ধতা নামে কোনও ব্যাপার কস্মিনকালে ছিল না, এবং ‘জনগণমন অধিনায়ক’-এর জাতীয় সংগীতে রবি সেইটা স্বীকারও করে, তখন কী খেয়ালে আর্য হইতে জাতির ইতিহাস সে দাগাইতে চায় সেইটা নিয়া জল ঘোলা করা যাইতে পারে এবং করা উচিত।
জল ঘোলা করার এই কামে ‘রক্তের দাগ’ মুছন টাইপের ইমোশন দিয়া যারা রবিকে পয়লা নাম্বারের হিন্দু ও সাম্প্রদায়িকতার চর প্রমাণের মওকা খুঁজতে ব্যস্ত থাকেন তাগো কথায় কান না দেওয়াই উত্তম। রবি ও ইকবাল আমাদের কনটেক্সটে স্তম্ভ স্বরূপ এই কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। ইকবাল কী কারণে খুদির মাঝে সত্তার বিলোপ দেখে? কোন সে-ফিকির ‘মুসলমান’ শব্দের মধ্যে উম্মতের নিশানা খোঁজার ফান্দায় তাঁরে নাচায়? ইত্যাকার প্রশ্নগুলা, বিনয়বচনে কই এর উত্তর ‘ইকবাল একজন দীনদার আলেম ছিলেন’ অথবা একুনে অতিরিক্ত মাত্রায় প্রগতিশীলদের ‘লোকটা সাম্প্রদায়িক ছিল’ এইসব ছকের মধ্যে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। উপমহাদেশের আমহিন্দুর মনে জাগরূক হিন্দুত্বের আবহ ও স্মারকগুলার লগে রবির যেমন নিঃশব্দ বিরোধ ছিল, উপমহাদেশীয় মুসলমান যেসব স্মারকে গমনের মধ্য দিয়া ইসলামকে ধারণ করে ও মুসলমান হইতে চায় তার লগে ইকবালের মতবিরোধও সেই সময় তীব্র হইয়া উঠছিল। বাঙালি জাতিসত্তার বাইরে ধর্মীয় যে-পরিচয় একজন মুসলমান লালন করে সেখানে নবির ‘উম্মত’ ও তাওহিদের ভাগিদার রূপে ইসলামের বৈশ্বিক কওমিয়াত তারে কোন চোখে নজর করে সেইটার দাড়াদিশা পাইতে ইকবাল ছাড়া তাই আগানো কঠিন।
তো সে যা-ই হোক, কালের ফেরে হিন্দু ধর্মের মতো ইসলামেও বহু ভার্শন তৈরি হইছে। দেশকাল ভেদে যার চর্চার গতিবিধি বিচিত্র। কোরান-হাদিস-সুন্নাহর চিরন্তন ফ্রেমে বিশ্বস্ত থাকা এবং সেই ফ্রেম হইতে পিছলানোর ধান্দা অর্থাৎ উভয়ের মিলন-সংঘাত হইতে যে-ইসলাম যুগে-যুগে সম্ভব হইছে সেইটা অতিকায় এক Hermeneutics বা ব্যাখ্যাবিজ্ঞান বা তফসির ভিন্ন অন্য কিছু নহে। আমমুসলমান নিজের অজান্তে সেই ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের জগতে ঘুরেফিরে ও দীনের চর্চা জারি রাখে। হজসনের মতো পণ্ডিতরা এই জায়গা থিকা তাই প্রশ্নটি অকাতরে উঠাইতে পারেন :— ইসলাম কি সত্যি Islam নাকি Islams? মানবসংসারে ইসলাম কায়েম করতে গিয়া সে কি Islamic হয়ে উঠছিল নাকি Islamicate-এ পরিণত হইছে? বিশ্বব্যাপী ইসলামের যে-স্বরূপ সেইটা কি Christendom বা খ্রিস্টানসংঘ টাইপের কোনওকিছু, যারে Islamdom নামে ডাকা যাইতে পারে? হজসন এই অভিধাগুলারে তাঁর নিজের ভাষায় ব্যাখ্যাও করছেন। তাঁর মতে Islam হইছে সোজাসাপ্টা কোরান-সুন্নাহ-হাদিস এবং শরিয়া কর্তৃক নির্ধারিত অনুশাসনের পাবন্দদারি। Islamic হইছে দেশকালজাতিগোষ্ঠীর জগতে ইসলামের মূল স্তম্ভগুলার সাংস্কৃতিক অভিক্ষেপণ। মাযহাবের সূত্রে শরিয়াচর্চা দেশকাল ভেদে যেসব বিচিত্র রূপ ধারণ করছে, জাতিগোষ্ঠীর স্থানীয় আচার ও সামাজিকতার লগে শরিয়ার মিলন ও সংঘাত হইতে উত্থিত যেসব ঢেউ মুসলমান জাতিকে একত্বের মাঝেও ভিন্নতা প্রদান করছে, সেইসব একত্ব ও ভিন্নতার চিন্ জড়ো করলে ইসলামের যে-রূপ চোখে ভাসে তারে Islamic সম্বোধন করা যাইতে পারে। আর মুসলমানগো মধ্যে যাঁরা যুগের লগে তাল রাখতে গিয়া কোরান-সুন্নাহ ও হাদিসের নতুন ব্যাখ্যায় ঝাঁপাইয়া পড়েন, নতুন রূপে ইসলামকে সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও নির্ধারণ করেন, এবং অনেকসময় শরিয়ার অনড় কাঠামো হইতে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পরেও অক্লেশে নিজেকে মুসলমান বইলা আওয়াজ উঠান, সরলবাক্যে সেই লোকেরা Islamicate-এর জনক ও পাবন্দ।
এই পাবন্দরা নিজেগো ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের লগে সরলবিশ্বাসী আমমুসলমানগো বিজড়িত হইতে বাধ্য করেন। আমমুসলমান নিজের অজান্তে সেই Hermeneutics বা ব্যাখ্যাবিজ্ঞান হইতে উৎসারিত স্মারকগুলা ইসলামি ঐতিহ্যের নিদর্শন বইলা গর্বে বুক ফোলায়। তারা এইভাবে রুমি-হাফিজ-খৈয়াম-সাদি-র জগতে বিচরণ করে। ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ নিয়া বড়াই করে। ইকবাল তো আছেনই, এমনকি মনসুর হাল্লাজ ও গালিবরে বুকে টানে। সেই গালিব আল্লার ঘরে শরাবের বোতল হাতে যে কিনা একদিন ঢুকে পড়ছিল! মুসল্লিরা পাগলা কবির কাণ্ডে আগুনরাঙা ক্রোধে তাঁরে জিগায় : — ‘ইয়ে কোই শরাব পিনে কা জাগা হ্যায় কিয়া! খোদা-কি ঘরমে শরাব পি রাহে হো। নাফরমান!’ মুসল্লিদের লেলিহান ক্রোধে গালিব সকৌতুক হাসে :—
‘কিউ ভাই। মেরা কিয়া কসুর? আগার কসুর হ্যায় তো খোদা-কি! ইস দুনিয়ামে কোই জাগা হ্যায় কিয়া, জিসমে ও রাজ নেহি করতি? বাতাও মুজে, ঘর হ্যায় কিয়া জিসমে ও নেই মিলতা? মসজিদ আওর শরাবখানা! আগার খোদা-কে বাত পুছো তো ক্যয়া ফারাক হ্যায় ভাই? মুজে বাতাও!’
গালিবের এই কাহিনি জল্পনা হইতেও পারে, তবে জল্পনার পেছনে কারণ থাকে এবং গালিবের জীবনধারায় শরাব নিত্যসঙ্গী ছিল বটে। যে-ঘটনাপরম্পরায় শরাব পানে নিষেধাজ্ঞার ওহি জারি হইছিল, ইসলামের রাজন্য হইতে ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের জনকরা সে-ওহি সম্পর্কে অবগত হইলেও কমবেশি মাত্রায় শরাবি ছিলেন।
শরিয়তের ফ্রেম থিকা বিচ্যুত হওনের পরেও মসজিদকে নিজের জায়গা ভাবতে পারে যে-গালিব ও যারা সেই গালিবরে প্রত্যাখ্যান যায় এবং উভয় পক্ষের সংঘাত হইতে যে-কালচার সেখানে ঠিকরাইয়া বাহির হয় সেই সামষ্টিক কালচারটারে Islamdom ডাকা যাইতে পারে। এইটা কোনও সভ্যতা নয়; ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী এবং সেই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে যেসব স্ববিরোধী ব্যাখ্যা-আচার-অনুশাসন তথা সংস্কৃতি আবর্তিত হইছে যুগ-যুগ ধরে Islamdom হইছে তাগো সমষ্টি। রাজা-প্রজা সহ আগেপিছে যত মানবগোষ্ঠী মতপথের ভিন্নতা সত্ত্বেও নিজেগো মুসলমান ও ইসলামের অনুসারী ভাবেন তারা সেই রাজ্যের রাজা-উজির বটে। ঘটনা যারা বুঝতে আগ্রহী তারা অকালপ্রয়াত সাহাব আহমদের ‘ইসলাম কারে কয়?’ (What is Islam? The Importance of being Islamic) বহিখানা চাইলে এস্তেমাল করতে পারেন।
বলা আবশ্যক, সাহাব তাঁর বহিতে হজসনের বক্তব্যের কতিপয় অংশ যেখানে তিনি Islamdom-এর অজুহাতে ইসলামকে সভ্যতা বইলা অস্বীকার যান তাঁর সেই জায়গাটারে সরলীকরণ বইলা তুলাধুনা করছেন; যদিও মোটের ওপর সাহাব নিজেও ইসলামকে Hermeneutics বা ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের একখান অতিকায় সংক্ষুব্ধ অভিধান বইলা স্বীকার গেছেন। সাহাব তাঁর বহিতে ইসলামকে নজর করছেন সেই প্লুরালিটির মধ্যে যেখানে Islam-এ নিহিত Singualrity দেশ ও স্থানিকতায় চর্চিত সংস্কৃতির মধ্যে অবগাহনের মধ্য দিয়া অবিরত Islamic হইতেই থাকে। এখন সেই Islamic হইতে উৎসারিত স্বরূপগুলা একত্রে জোড়া দিলে যে-রূপ ফুইটা বাইর হয় সেইটা কিন্তু ফেরত যায় অনন্য সেই Singularity-র জগতে; আমমুসলমান হইতে কোরানে হাফিজ, তালিবে ইলম, মুফতি-আলেম-মুফাচ্ছির-শেখ কিংবা আসহাবুল হাদিস নামে দাগাঙ্কিত ব্যক্তিরা যারে Islam নামে চিনে-জানে ও মান্য করে; একদিন যার জন্ম হইছিল হেরা গুহায় এবং পরে যেটি বহুরঙে তামাম দেশ-বিদেশে ছড়াইছে।
এইটা সেই ইসলাম যে কিনা দূত মারফতে নবির নিকটে আগত খোদার ফরমান অর্থাৎ ওহিকে Pre-Text বইলা স্বীকার যায় এবং ‘কালামতত্ত্ব’-এ (Kalam Theology) প্রস্তাবিত যুক্তির লগে নিজেকে অভিন্ন করে; সেখানে বলা হইছে, — খোদা মারফত গায়েবি হইতে আগত টেক্সট নিয়া সওয়াল করা বৃথা, কারণ এইটা প্রমাণসাপেক্ষ নয়; প্রমাণ-অপ্রমাণের বাইরে অবস্থানের কারণে এইটা Pre-Text এবং সেই কারণে ‘বি-লা-কাইফ’ :— সওয়াল না করে ফেরেশতা মারফত গায়েবি হইতে আগত খোদার ফরমানে বিশ্বাস যাও। Pre-Text নবিগো মাধ্যমে যখন আমজনতায় পৌঁছায় ও অনুশীলনের অধীন হয় তখন সেইটা Text-এ রূপান্তরিত হয় এবং সাহাবের ইসলাম সেই টেক্সট হইয়া উঠনের ইতিহাসকে স্বীকার যায়।
প্রি-টেক্সট ও টেক্সটের মিলন হইতে সৃষ্ট নতুন বিশ্বাস বা ধর্মীয় আচারপদ্ধতি নিজেকে যেখানে অবস্থিত ও নির্ণীত হইতে দেখে সাহাবের ভাষায় সেইটা হইছে Con-Text; কন-টেক্সট এখানে সেই সমাজ ও সংস্কৃতির ইশারা উঠায় যা আগে হইতে সমাজে বিদ্যমান ছিল এবং এখন প্রি-টেক্সট ও টেক্সট-এ নিজেকে শরিক করছে। এই শরিকানার ফলে পুরাতন আচার ও মূল্যবোধ এতদিন যে-বিশ্বাসকে লালনপালন ও অনুশীলন করছে এর সঙ্গে নতুন বিশ্বাসের সন্ধি ও সংঘাতের ক্ষেত্র সমাজে তৈরি হইতে থাকে, যার মধ্য দিয়া নতুন বিশ্বাসের অনুশীলন বা সেই সংস্কৃতি একসময় সমাজ অভ্যাস করতে শুরু করে এবং হৃদয়ে জায়গা দিয়া নিজের করে। সাহাব তাই মনে করছেন ইসলাম হইছে ত্রয়ীর (Pre-Text, Text ও Con-Text) মিলন ও ব্যাখ্যা হইতে উদ্ভূত জীবনব্যবস্থা; এবং Islam ও Islamic-এর যোগফল থিকা শেষতক Islam নামের সিঙ্গুলারিটি বা একত্ব-এ (লা শারিকা লাহু) সে ফেরত যায়।
এই জায়গা থিকা সাহাবের মনে হইছে ইসলাম ও মুসলমান এক পরস্পরচ্ছেদি ঘটনা; যেখানে ইসলাম যেমন মুসলমানকে নির্ধারণ করে বা তারে মুসলমান নামে দাগায়, মুসলমানও সে-ইসলাম যাপন করতে গিয়া নতুন সব ভাষা সেখানে যোগ করে ও ইসলামকে এভাবে নির্ধারিত করে; সুতরাং টেক্সট ও মিনিং তৈরির পারস্পরিক প্রক্রিয়াটাকে ‘Islamic Con-Text’ বইলা গণ্য করা উচিত। Con-Text প্রসঙ্গে সাহাব যে ইশারা তাঁর বহিতে দিতে চাইছেন সেইটা খোলাসা করার স্বার্থে এ-বিষয়ে লেখকের মূলভাব অপটু ভাষান্তরে পরিবেশন করা যাইতে পারে :—
Con-Text বা প্রসঙ্গ-র অংশ হইতে চায় এমন কিছুর বিচারে ইসলাম সবসময় মুসলমানকেই আগে বাড়তে কয়। সুতরাং আমি সেই গতির উপরে জোর দেই যেখানে ইসলাম যেমন মুসলমানদের জন্ম দিয়া থাকে তেমনি মুসলমানরাও ইসলামকে তৈয়ার করে; মোদ্দা কথা সমুদয় মিনিং বা অর্থ অনিবার্যভাবে মুসলমানরাই জন্ম দিয়া থাকে; প্রথমত, সেই জায়গা থিকা Con-Text বা ‘প্রসঙ্গের অংশ হইতে চায়’ কথাটার মানে হইল ইসলাম সবসময় মুসলমানকেই অগ্রসর হইতে কয়; এমনকি ইসলামের বিচারে নতুন কিছু যোগ করার জন্য সেই মুসলমান যখন পা বাড়ায়, — তখনও। কারণটা হইছে ‘মুসলমান কী’ এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমাগো দিতেই হয় সেক্ষেত্রে ‘ইসলাম কী?’ সেই প্রশ্নের জবাবটা জরুর দেওন লাগে। ইসলামকে দিয়া আমাগো অবশ্যই শুরু করতে হবে, যেহেতু ইসলামের লগে মুসলমানের শুরুয়াত হইছিল; এমনকি এই ইসলাম যেখানে গিয়া থামে সেইটা সূচনাযুগের অর্থাৎ ইসলামের যে-ক্ষণ হইতে মুসলমানের উৎপত্তি ঘটে তার থিকা ভিন্ন হইতেও পারে; এবং সেই ইসলাম যেখান থিকা আরেকখান মুসলমানের সূত্রপাত ঘটে ও সে যেখানে গিয়া দম লয় — সেইটা থিকাও। সুতরাং এই কথা বলাই সংগত লোকে যেমনটি কইয়া থাকে :— মুসলমানগো ছাড়া কোনও ইসলাম নাই, সমান জরুরি এই কথাটাও মনে রাখন যে, — ইসলামকে বাদ দিয়া মুসলমানও হয় না। [What is Islam? The Importance of being Islamic by Shahab Ahmed, 2016)
সাহাবের এই ব্যাখ্যাবিজ্ঞান মুসলমানরা কেমনে ওয়াইন পান করার পরেও দূরের সেই তাবে-তাবেঈনদের শুদ্ধ দীনচর্চার সঙ্গে নিজের সংযোগ ঘটায় ও শেষতক মুসলমান থাকে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। কট্টর শরিয়াপন্থীরা যদিও তাঁর এই বহিখানারে আগা খান ও শিয়াদের আরেকটি ষড়যন্ত্র বইলা বাতিল করছেন। কথা সেখানে না, রবি কিংবা ইকবালের মতো গ্রান্ড ফিগারদের হিন্দুত্ব ও মুসলমানিত্বের খতরা বুঝনের খাতিরে হইলেও আমাদের বুদ্ধিজীবীগো হয়তো উচিত হিন্দু ও ইসলামের Hermeneutics বা ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের ধরন-ধারণ এবং সেইটার লগে সম্পর্কের ইতিহাসে সফর করা। অন্যথায় রক্তের দাগ মুছনেই বেলা কাবার হইব।
ভাগ্যের বিচিত্র খেলায় কে হিন্দু আর কে-ই-বা মুসলমান! এইটা যদি জল্পনা না হইয়া থাকে, যদি তিলেক সত্য সেখানে থাইকা থাকে তাইলে রবিকবির বংশলতিকা এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। শোনা যায় তাঁর পরিবারের আদি সুলুক নাকি ছিল কাশ্মির। বিধির ফেরে পৈতাধারী বামুনের বেশে সেখানে টিকতে না পেরে ঘর ছেড়ে পথে নামছিল একদিন। কবির বংশলতিকার একটি শাখা দিল্লিতে ঢুকনের পথে মুসলমান হইছিল বইলা শোনা যায়। সেই শাখাটি কালের প্রবাহে নিখোঁজ ও নীরব। অন্য শাখা সুতানটি দিয়া ঢুকবার ক্ষণে কাশ্মিরি থেকে কাঠবাঙাল হয় এবং পরে জমিদার ও সেকালের এলিট এন্টারপ্রেইনার রূপে উদয় হয় বঙ্গে। দ্বারকানাথের বণিক ও শিল্প-উদ্যোক্তা হওয়ার বেজায় শখ ছিল এবং ফ্রান্সের রানি তাঁরে সেকালে লাল গালিচায় বরণ করছিল। সময়ের ধারায় সেই ঠাকুর পরিবার চৌদ্দআনা সাহেবি কেতা রপ্ত করনের পরেও অভিনব বাঙাল ছিল বটে! অবনীন্দ্রনাথের মাথায় যখন বেঙ্গল আর্টের বাই চাপল তখন বাড়ির ভিতরে লটকানো বিদেশি চিত্রকরগো দামি ও অমূল্য সব ছবির নাকি ভাগাড়ে ঠাঁই হইছিল!
এলিট তারে কয় যে বহুভাবে সাহেব হওয়ার পরেও নিজের দেশকালজাতির লগে সংযোগ রাখতে পারে। যে-ক্ষমতা কাউন্ট তলস্তয়ের ছিল রাশিয়ায়। জগতের প্রান্তিকজনের দুখে দুখী অথবা এলিটগো পোন্দাইয়া যারা ক্রেডিট নিতে চান তাদের মনে রাখন উচিত হয়, তারে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমনকিছু খাড়া করতে না পারলে সেই এলিটের লগে দৌড়ে নামা বিপজ্জনক, যেহেতু দম ধইরা রাখা তখন কঠিন হয়; এবং শেষমেশ ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি কওন ছাড়া উপায়ন্তর থাকে না। ঠাকুরবংশের এই হ্যাডম ছিল বইলা বাঙালি শিক্ষিত কিংবা ভদ্রলোকদের জগৎ তারা নির্ধারণ করে দিতে পারছে এবং রাষ্ট্রের কলকব্জায় দ্রষ্টব্য ঘটনা হইতে পারছে। এই পরিবারটারে প্রত্যাখ্যান করা যেমন সহজ অস্বীকার করা ততই কঠিন।
ওপরের কথাগুলা কওনের উদ্দেশ্য হইল সংকরায়নের যজ্ঞে হিন্দু কে আর মুসলমান কে সে-প্রশ্নের সুরাহা বড়ই কঠিন! রবিকবির মনের তারে এইরূপ ভাব উদয় হইছিল কি না সেইটা এখন জানার উপায় নাই; তবু বলা যায় :— সিন্ধুতীর হইতে যাত্রা শুরুর কর্মযজ্ঞে হিন্দু-মুসলমানের ছক থিকা বাহির হওয়া এই লোক হিন্দু প্যাগানিজমকে পাশ কাটাইয়া পিতার সূত্রে পাওয়া ব্রাহ্ম ধর্মের পরব্রহ্মকে দিলের ভিতরে কবুল করছিল এবং গোটা জাতিকে সেইথানে ফিরাইতে ব্যাকুল ছিল। তাঁর হিন্দুত্ব হইছে ব্রাহ্ম বা ব্রহ্মবিদ্যার রসে চোবানো পরিশীলিত হিন্দুত্ব। এই হিন্দুত্ব বাউল হইতে তামাম লোকায়ত রস নিজের ভিতরে শোষণ করে এবং এইগুলা ক্রমশ তাঁর নিজস্ব Contextual রূপে সেখানে বি-নির্মিত হইতে থাকে। রবিকবির হিন্দুত্বের মামলা বুঝতে গেলে বিষয়টি নজর করা আগে প্রয়োজন।
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS