নব্বইয়ের অতিকল্পনা || আহমদ মিনহাজ

নব্বইয়ের অতিকল্পনা || আহমদ মিনহাজ

পূর্বপরিচ্ছেদ / লোক দশকতামামি ১০ : স্পর্শপ্রতীক্ষায় নির্ঘুম নব্বইয়ের কবিতা

মিথ বা অতিকল্পনা নব্বইয়ের কবিতার অগ্রগণ্য উপাদান। দশকবৃত্তের কবি মাত্র অতিকল্পনার রাজ্যে নিজের কাব্যভাষার স্বকীয়তা সন্ধান করেছেন। অতিকাল্পনিক অনুষঙ্গের প্রয়োগ তাদের কবিতায় সেই অভিজ্ঞতার স্মারক হয়ে আসে যেখানে গ্রামীণ জীবনধারা আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, ফলে সেখানে এই অনুষঙ্গ প্রতিস্থাপনের তাগিদ স্মৃতিকাতর বেদনা জাগিয়ে পাতালে ডুব দেয়। স্মৃতিকাতর উসকানির সঙ্গে আবহমান বাংলার স্থানিক অনুষঙ্গ পুনরাবৃত্তির ছন্দে জিগির তোলে হেনরী স্বপন, খলিল মজিদ, মাহবুব কবির, রিষিণ পরিমল, তাপস গায়েন, বায়তুল্লাহ কাদেরী, রহমান হেনরী, বায়েজীদ মাহবুব, মুজিব ইরম সহ এই ধারায় সচল কবির কাব্যভাষায়। নাগরিক জীবনধারার নাভিশ্বাসচাপে পাল্টে যাওয়া সময়ে তাঁরা সেইসব প্রত্নতত্ত্বের তালাশ করেন যাদের প্রভাবে বাংলাদেশ সুদীর্ঘকাল সবুজে শ্যামল নদীপাখিমেঘ পরিবেষ্টিত পল্লীবহুল জনপদ ছিল। উল্টোস্রোতে গমন-ইচ্ছুক কবি অবশেষে যে-জনপদে পৌঁছায় যেখানে কিছুই আর অতীতে দাঁড়িয়ে নেই, যদিও কবি বিশ্বাস করছেন সবকিছু ‘অবিকল’ রয়েছে যেমনটি তার থাকার কথা ছিল!

যখনো কবিতা হয়ে ওঠেনি কোকিলের কানকথা
শব্দেরা কাকের কালো রঙই কেবল গায়ে পরতো না
ধারণ করতো তার কড়া সত্যবাদিতা;

তখন আমার ধমনীর লাল অন্ধকারে বেজে ওঠে পাঠশালার ঘণ্টা
আর যৌথতার সফেদ চুক্তির মতো লেখা হয় চিরবর্ষার গীতিকা
এ কোনো উদবোধন নয়
নয় নতুন কোনো পরিচয়।
(ফলশ্রুতি; খলিল মজিদ)

কাউট্টা দেখি
ধীরে ধীরে ধীরে চলছেই ধীরে
বাড়ির ভিতর থেকে বাড়ির
বাহিরে, আজীবন এক
কাউট্টা ধীর পদার্পণে চলেছে,
চলেছে বিষম কুঁজো এক কালো
কাউট্টা,
খাতার মলাটে ওঠে কাউট্টা
অবশেষে বইয়ের তাকে
কিংবা কখনো
একদল মেঘ পিঠে বয়ে নেয়
বুড়ো কাউট্টা, দেয় না তেমন
দুগ্ধ, দেয় না। কাউট্টার দুগ্ধে
ভরে না পাতিল।
(এ কোন শহরে এসে থেমে গেলে কাউট্টা সহ, কোন শহর?; দেহরজ্জু, শীতাভ সনেটগুচ্ছ অন্যান্য; বায়তুল্লাহ্ কাদেরী)

ও বাংলার নদনদীদল, ওহে সখা!
তোমাদের জলাঞ্চল জলস্রোতে স্পর্শাতীত মরীচিকা
জলহীন ধূসর মরীচিকায় তো নদী বলা দায়
হায়! তবুও তোমরা নদী নদীমাতা করুণ বাংলায়…
(নদদীদলে চৈত্রদাহ; রিষিণ পরিমল)

দিবারাত্রি খোলা রাখি বংশের দোকান। মুনাফা করি না কোনো, দোকানি হয়েছি শুধু তোমার করুণা পাবো, তাই এই তেজারতি, তাই এই আড়তি আমার!

এ-জীবনে হায় বাকি চাহিয়া অনেক লজ্জা জমা করিয়াছি, তবু তোমার অপেক্ষা করে আগলে রাখি বংশের গদি, ঋণের আড়ত। ফতুর হয়েছে যারা ঘুরেফিরে বাজারে-টাউনে, তাদের নিকটে গিয়ে বাড়িয়েছি আরো আরো কারবারি দেনা, ইরাদা আমার!

পাইকারিতে ধরে না মন, গোষ্ঠীপ্রীতি রক্তে মিশে রয়। শরমিন্দা এ-আমি তবুও খোলা রাখি বংশের গদি, তোমার তরিকা।
(বংশের দোকান; মুজিব ইরম)

আজও পাহাড় দেখার তীব্র বাসনার কথা মনে হলে
চুপিচুপি তোমাদের গ্রামে যাই। আজ হাটবার…
প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ুতে থাকি—
বড় রাস্তা থেকে আলপথ
আলপথ থেকে ক্ষেতের কোনাকুনি…

শস্য কাটা হয়ে গেলে পড়ে থাকে হাহাকার…
(দূরাগত পাহাড়ের গান; শামীমুল হক শামীম)

এখানে দুষ্প্রাপ্য অনেক শামুক মরে গেছে
খোলস রয়েছে সেইসব বিস্মৃতির!

বালুপড়া এই তীরে আরও অনেক ঢেউ এসেছে
একবার ভাসমান জলে, একটি জোনাকিও যদি জ্বলে ওঠে?
(বলেশ্বর; হেনরী স্বপন)

এই পথ মিশে গেছে ব্যমদের উত্তীর্ণ পাড়ায়
মেঘেদের কাছে
চাকার শব্দের দাগ
এই পাহাড় পলির কাছে এসে
হঠাৎ পথ হারায়…
(সম্পর্কহীনা নারী; জেনিস মাহমুন)

দিগন্তে গিয়ে দেখলাম
দিগন্ত নেই
পড়ে আছে দুটি যমজ ছায়া
অতঃপর
দিগন্তে গিয়ে দেখলাম
দিগন্ত নেই
পড়ে আছে দিগন্তাক্রান্ত প্রাগৈতিহাসিক রাত্রি…
(দিগন্ত; মাহবুব কবির)

স্মৃতিকাতর শব্দপুঞ্জের বাহারে কার্যত নিরুদ্দেশকে ফিরিয়ে আনার চল আল মাহমুদের ‘কাবিননামা’-র প্রেরণা দিয়ে রাঙানো হলেও ভাষিক বিবরণ নব্বইয়ের ধাঁচে গড়া। এই ধারায় স্থিত নব্বই প্রকারান্তরে পাঠককে ফেরত নিতে চায় আবহমান বৃত্তে, যেটি পালাবদলের তুঙ্গ স্রোতে তামাদি হতে বসেছে! অতিকল্পনার বিশ্বে নিমজ্জিত নব্বইয়ের পরাভাষায় জোসেফ ক্যাম্পবেলের মিথ বিষয়ক সজ্ঞার সারার্থ অবশ্য কদাচিৎ মিলে। ক্যাম্পবেল শিখিয়েছিলেন মিথকে কী করে পাঠ করতে হয়। অতিকল্পনা কেবল প্রাচীন ইতিহাসের অন্তর্গত নয় বরং সকল যুগ ও দেশকালে প্রবহমান ঘটনাস্রোতে তাকে জন্ম দিয়ে যায়। পরিপার্শ্বে প্রতিনিয়ত সক্রিয় চিহ্নসূত্রে মিথের উপাদান সংগুপ্ত থাকে। বাস্তবতার রূঢ় পরিধিসীমায় কাফকার ‘পোকা’-রা যখন-তখন জন্ম নিতে পারে। সিনেপর্দায় ‘র‌্যাম্বো’-র মতো ক্যারেক্টারগুলো জীবনের চেয়ে বৃহৎ কাণ্ডকীর্তির জোরে একালে মিথের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। সৃষ্টিরহস্যের কিনারা পেতে গলদঘর্ম বিজ্ঞানীর হাইপোথিসিস মিথের জন্ম দেয়। তথ্যপ্রযুক্তির বিচিত্র গতিধারায় সৃষ্ট আজকের রোবট, সাইবর্গ আর হাস্যকর চ্যাটবুটগুলোয় নিহিত ফ্যান্টাসি মিথের আভাসে মহার্ঘ হয়ে ওঠে। কল্পবিজ্ঞানের জগতে মানব ও অ্যালিয়েনের মিলন-সংঘাত মিথের মুহূর্ত তৈরি করায়। অনুজীববিজ্ঞান ও জিনপ্রকৌশলের কারিকুরি জীবাশ্মে পরিণত প্রাণকে পুনরায় জাগিয়ে তোলার ঘোষণা দিলে দুঃস্বপ্নের মুহূর্তে আকাশে-পাক-খাওয়া ড্রোনকে টেরোডাকটাইলের পিচ্চি সংস্করণ ভেবে কেউ যদি আতংকে চিৎকার দিয়ে ওঠে…মিথ তাৎক্ষণিক জন্ম নেয় সেখানে। ফসলের মাঠে কৃষ্টিদোগলা সবুজের অফুরন্ত সমারোহ এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গুলজার শপিংমল, ক্যাফে কিংবা রেস্তোরাঁয় সুবেশ নারী-পুরুষের হল্লা যেসব কুহকি ঘোর তৈরি করায় অতিকল্পনা সেখানে চুপচাপ ঘাপটি মেরে থাকে। বিগত তিন দশকের বিশ্বে এ-রকম অজস্র অনুষঙ্গের মিথষ্ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট অতিকল্পনার সঙ্গে বিগত দিনের অতিকল্পনা, ঐতিহ্য ও আবহমানতার সংযোগ বা বৈপরীত্যকে ভাষা দানের কাণ্ড কি নব্বইয়ের কবিতায় সফলভাবে ঘটেছে? প্রশ্নটি তোলা রইল সদুত্তর পাওয়ার আশায়।


গানপার ম্যাগাজিনরিভিয়্যু
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা

COMMENTS

error: