অপ্রিয় বচনের অবয়ব || নিখিল দেব

অপ্রিয় বচনের অবয়ব || নিখিল দেব

এসব কথনকে ‘প্রবচন’ নামে অভিহিত করা হয়। এসব কথাগুলো প্রথমত ব্যক্তিগত উপলব্ধিজাত। হ্যাঁ। তাই, এসবের ভিতরে ভাবনা, দর্শন, বা আরেকটু কনক্রিট করে বললে নিজস্ব বিশ্বাস, আদর্শ প্রকাশিত।

সব লেখার মতোই, এসব কথিকার দায়ভার অবশ্যই আমার।

কেউ কোনোকিছুতে ব্যাখা চাইলে আমি দিতে রাজি আছি। আর দ্বিমত, অবশ্যই। আমি দ্বিমত পোষণে একমত সবসময়।

অপ্রিয় বচনগুলো


১.
পেঁয়াজ ছাড়া পুঁজিবাদ কাঁদে না।
২.
একটা বিষয়ে আমাদের একতা আছে — আমরা সবাই একা।
৩.
আমাদের বিপুল শূন্যতাকে আমরা প্রমাণ করি অন্যদের বিতর্কিত করে তুলে।
৪.
প্রবল ব্যক্তিত্বই মানুষের একমাত্র পর্দা হওয়া উচিত।
৫.
ব্যক্তি নয়, বক্তব্যে বিতর্ক বাড়ুক।
৬.
ব্যক্তি বলে কিছু নেই, সব ব্যবস্থার উপজাত।
৭.
দ্বিতীয়বার বলে কিছু নেই কেননা কোনোকিছুরই পুনরাবৃত্তি হয় না।
৮.
আবারও বলছি, ধার্মিকতায় নয়, ধর্মান্ধেই আমার আপত্তি। যদিও ধার্মিকেরা কদাচিৎ অধর্মান্ধ।
৯.
‘যা নাই’ সেটা নিয়ে নাস্তিকেরা এত মাতামাতি করে কেন আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
১০.
মানুষ পরিচয়ের আগে অন্যটাকে যারাই স্থাপন করেন তাদের সবাই এক ধরনের সাম্প্রদায়িক।
১১.
সৃষ্টিকর্তা মৃত। — এর মানে এটা বোঝায় না যে সৃষ্টিকর্তা নেই (সৃষ্টিকর্তা মানে ঈশ্বর বুঝলে এই উক্তি আপনার জন্য প্রযোজ্য নয়)।
১২.
সুশীল — সুযোগমতো শীৎকারে লালায়িত।
১৩.
ফেসবুকের বুদ্ধিবৃত্তির জন্ম হয় কোটেশন পড়ে — তাই ওখানে উত্তেজনা একটু বেশি।
১৪.
মানুষকে জাগরণের ভিতর দিয়েই সবচেয়ে সুন্দর দেখায়।
১৫.
ধূলিকণা নিয়ে কথা বলা — তাও ভালো, অন্তত ঈশ্বরের চেয়ে। কারণটা সুস্পষ্ট : যা নেই তারে নিয়ে কথা বলার কোনো মানেও নেই।
১৬.
বিনয়ী হতে হতে কিছু মানুষ কুঁজো হয়ে যায় । তাতে বিনয় ও বিনায়ক দুটোকে অভিনয় ও অভিনেতা বলে মনে হয়।
১৭.
জন্মের কারণটা কোলাহলমুখর হলেও, কবিতা আসলে সমাগম বর্জন করে।

অপ্রিয় বচনের পাঠকযোগ


Swapan Dey : সহমত সবগুলোতেই, জাস্ট ১১নংটা একটু বুঝতে সমস্যা হচ্ছে।

Nikhil Deb : স্বপন, সহমতে প্রীত হলাম। না-হলেও অপ্রীত হতাম না। ব্যাখ্যা করতে চাই না — কারণ ব্যাখ্যা বহুরূপী করা যায় — তবে বক্তব্যগুলো পাঠক যেভাবেই নিক একটা অর্থ দাঁড়ায় বটে। যেমন ১১-র কথাই বলি। এটা একটা দার্শনিক মতবাদ — যে-মতবাদ মনে করে যে লেখক বা যে-কোনো সৃষ্টির কর্তা (স্রষ্টা) মৃত — মানে হলো, লেখা প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই তার মালিক পাঠক হয়ে যান! কারণ, ভিন্ন পাঠক ভিন্ন অর্থে নিতে পারেন লেখাকে — অর্থাৎ পাঠক সৃজনশীল। আমি কেবল সেটাই বলতে চেয়েছি — স্রষ্টা মৃত হলেও তিনি তো ছিলেন! তিনি ছিলেন যেহেতু তিনি একবারে মরেন না। যা-ই হোক, হয়তো বুঝাতে গিয়ে আরও কঠিন করে দিলাম! নো প্রবলেম। ভাবনায় প্যাঁচ লাগারও একটা সৃজনশীল দিক আছে — আর সেটার কৃতিত্ব ভাবনা উদ্রেককারীরও কম নয়। আর প্যারেন্থিসিসে সেটাই লিখেছি — ঈশ্বর নয় — কারণ, তিনি তো নাই-ই, তার আবার মৃত্যুর প্রশ্ন আসবে কীভাবে! ধন্যবাদ।

Zahed Ahmed : লাইনগুলা শার্প, লাইনের ভেতরের লবণ-পাঁচফোড়ন পরিমিত ও সুসিদ্ধ। ম্যাক্সিম/অ্যাফোরিজমের আদলে এর আগে হুমায়ুন আজাদ এই কাজটা আলাদাভাবে করেছেন; ফরাশি লা-রাশফুকোর ম্যাক্সিমগুচ্ছ খুব সুন্দর অনুবাদে হাজির রয়েছে বাংলায়, খুব-সম্ভব চিন্ময় গুহ অনূদিত। হুমায়ুন আজাদের ‘প্রবচনগুচ্ছ’ পুস্তিকার সঙ্গে এখানকার এই সতেরো সূনৃতকথনের একটা ফারাক আবছাভাবে নজরে এল, ভুলও হইতে পারে আমার, মনে হয়েছে আজাদের অনেক প্রবচনপ্রতিম বাক্যের নেপথ্যে নিহিত রয়েছে ব্যক্তিবিরাগ — অনেক ক্ষেত্রে সেই বিরাগ অসঙ্গত নয় জেনেও তো সমকালীন ব্যক্তি কি বস্তুবিরাগ সরাসরি লেখায় এলে এর একটা লিমিটেশন ও বিপদ থাকে এইটা না-স্বীকারের কিছু নাই — নিখিল দেবের এই শাণিত ছুরিকাগুলোতে ব্যক্তিবিরাগ নেই, কিংবা খুব মোহহীনভাবে এইগুলো মুসাবিদাকালে ব্যক্তিবিরাগ ও অসূয়া-ঈর্ষা প্রভৃতি ইরেজ করে পেশ করা হয়েছে পাঠকের সামনে। এইটা খুব জরুরি, ইরেজ করা, লেখকের ব্যক্তিক আবেগের চিহ্নগুলো যথাসম্ভব মুছে দিতে পারাটাই তো অন্য দশ লিখুয়া-কমেন্টার-লাইকারের থেকে একজন সত্তানিমগ্ন অবজার্ভার লেখককে ডিস্টিংক্ট করে তোলে। অ্যাফোরিজম প্রভৃতির মূল শর্তই তো ছুরি দিয়ে চেঁছে ক্যানভাসের বাড়তি রঙগুলো তুলে ফেলা, এক্সেসিভনেস্ ইরেডিকেইট করা, বা ব্যাপারটা তো অনেকটা ওই মিনিয়েচার আর্টওয়ার্ক, খুদে পরিসরে পার্শিয়ান সালতানাত ফুটিয়ে তোলা। প্রবচনাঙ্গিকে এই কাজগুলো উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে, এবং নিশ্চয় আরও হবে।

Nikhil Deb : আপনার কমেন্ট একবার পড়লাম, আবার চোখ বুলানোর আগেই আমি লেখা শুরু করলাম, আপনার কমেন্টের ক্রিয়াজাত — হ্যাঁ, সচেতনভাবে, একটু ফানি হলেও, হয়তো আসলেই যাকে বলে কিডিং করছি, চাচ্ছি না আপনার দর্শন/চিন্তাবলয় আমাকে প্রভাবিত করুক। হা হা হা। আপনার লেখাটির কিছু বাক্যগুচ্ছ এতটাই আমার করে নিতে বা বলতে ইচ্ছে করছে যে সে-কারণেই ভাবলাম — আবার পড়ার আগেই কিছু একটা লেখি। যেহেতু, হয়তো বা প্রসঙ্গতই হুমায়ুন আজাদ চলে এসেছেন, সেক্ষেত্রে আমিও বলতে চাই কিছু- আপনার বলার সাথে কোনো দ্বিমত না-করেই। আজাদের প্রবচনগুচ্ছকে এককথায় আমি বলি, ‘দাবি করা জিনিশ না-পাওয়ায় বাচ্চার চিৎকার-চ্যাঁচামেচির মতো’ — সেখানে সততা থাকে — উপলব্ধি ও প্রকাশে — কিন্তু উত্তেজনাটাই বেশি। হ্যাঁ, অবশ্যই সবগুলো নিয়ে বলছি না — আর বেশিরভাগগুলোই শেষপর্যন্ত এফোরিজম বা উয়েটি সেয়িঙ হয়ে ওঠেনি। হ্যা ২, পড়তে যেয়ে পাঠক হয় তো রসই পায় কিন্তু সে-রসটা আপনি যে বললেন — ব্যক্তিবিদ্বেষের সীমানা ডিঙিয়ে ‘নৈর্ব্যক্তিক’ হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে অবশ্য ‘নৈর্ব্যক্তিক’-এর কদর কম — সেটাও তার মাথায় ছিল হয়তো বা। আমি তাই আজাদের ওগুলোর বেশিরভাগকেই ‘প্রবচন’ মনে করি না। যেমন ধরেন — শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা ‘প্রবচন’-টি — তার উচিত ছিল নামব্যবহার বর্জন করে একটা অ্যাবস্ট্রাকশনে পৌঁছানো, যা কোনোভাবেই তিনি করেননি — ওই যে, হয়তো-বা শামসুর রাহমানকে ব্যক্তিগত আক্রমণের খবরটা সবার কাছে পৌঁছে দেয়াই ছিল তার মূল লক্ষ্য — তাতে সাহস প্রকাশিত হয়, তবে সে-সাহস প্রজ্ঞাকে পরাজিত করেছে। হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। আর তাঁর অনেক প্রবচন, আমার মতে, সেক্সিস্টও — যা যুক্তিসঙ্গত উপস্থাপন ছাড়াই নারীদের অবমাননা করেছে। তা বোঝার জন্য শামসুর রাহমান সম্পৃক্ত প্রবচনটিকে আবার দাঁড় করানো যায় আলোচনায়। ব্যক্তিঅভিজ্ঞতাজাত আমার এখানকার বেশিরভাগও তবে চেষ্টা করেছি, সবসময় যা করি, সুনির্দিষ্ট এসব ব্যক্তিদের ছাড়িয়ে কোনো একটা বস্তুনিষ্ঠতায় সেগুলোকে নিয়ে যাওয়া যায় কি না! সুযোগ হলে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে পরে। ধন্যবাদ।

২০১৩

নিখিল দেব রচনারাশি

COMMENTS

error: