ভাষাসৃষ্টির পাকদণ্ডি পেরিয়ে… || আহমদ মিনহাজ

ভাষাসৃষ্টির পাকদণ্ডি পেরিয়ে… || আহমদ মিনহাজ

পূর্বপরিচ্ছেদ / লোক দশকতামামি ১১ : নব্বইয়ের অতিকল্পনা

ভাষাসৃষ্টির পাকদণ্ডি ঘোরানোর নেশায় বিভোর নব্বই (*সেই ভাষা গতায়ু কিংবা সমকাল যেখান থেকে কবি তুলে আনুক না কেন।) তার নিজেকে প্রশ্নটি এখনো করে উঠতে পারছে না, নানা ছন্দে বহমান এই ভাষা কি অবিশ্বাস্য গতিতে ধাবমান সময়ের সর্পিল গতি ঠিকঠাক পড়তে পারছে? পশ্চিম গোলার্ধে ষাট ও সত্তুরের দশকে সৃষ্ট এবং নয়ের দশকে পুনরায় সরব হয়ে ওঠা কবিতা আন্দোলন ‘দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট’ (The Language Movement) প্রশ্নটি উঠিয়েছিল। ‘মার্শিয়ান মুভমেন্ট’-র মতো ক্ষণস্থায়ী না হলেও ‘দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট’ প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য পালাবদলের তোড়ে প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে বেশি দূর পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারেনি; এতদসত্ত্বেও কবির ভাষা তাকে কতটা নিশ্চয়তার যোগান দিতে সক্ষম এই সওয়াল সেখানে উঠেছিল। ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট প্রশ্নগুলো তুলেছিল :—

চেতন-অবেচতনে অবিরত যেসব স্নায়বিক উদ্দীপনার সঞ্চালন ঘটে ব্যক্তির ভাষাজগৎ কি তার ফসল? ভাষাকে অস্পষ্ট ও ঘোলাটে ব্যাপারস্যাপার দিয়ে কে বা কারা নির্ধারণ করে যায়? ভাষা কার অধীন থাকে? ব্যক্তি ‘আমি’ নাকি ব্যক্তিসমগ্রর? অথবা সময় নামক বায়বীয় আপেক্ষিকতার? ভাষা কি আইনস্টাইনের সুবাদে পাওয়া তত্ত্বের অনুগামী? নিউটনের ধ্রুপদি বাস্তবতায় বিদ্যমান স্থানকাল কি তবে তার অন্তিম ঠিকানা? মানুষ এখন বোঝে শক্তির গতিশীল তরঙ্গ থেকে সৃষ্ট স্থানকাল নিউটনের সূত্র মেনে ক্রিয়াশীল থাকলেও গতির সামান্য হেরফেরে চেনা ছবি নিমিষে পাল্টে যেতে পারে। যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে ভাষা কি এরকম থাকবে অথবা পাল্টে যাবে?

কবিতার ভূতভবিষ্যৎ নিয়ে ধান ভানতে বসে ‘দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট’-র কবি মিশেল পামার তাঁর কবিতাকে কীভাবে নির্ণয় করবে ভেবে না পেয়ে প্রশ্নগুলো রেখে যায় :—

Was poetry the object
Was there once a road here ending at a door
Thus from bridge to bridge we came along…

Whose words formed difficult curves
Have the exaggerations quieted down…

My life now is very economical
I can say nothing of my feeling about space
Nothing could be clearer than what you see on this wall
Must we give each one a name
Is it true they all have names…

Who told you these things
Who taught you how to speak
Who taught you not to speak
Whose is the voice that empties…
(Notes for Echo Lake 4; Michael Palmer) 

পামারের সহজছন্দে বোনা দীর্ঘ কবিতার আংশিক উদ্ধৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে বিগত তিন দশকে বাংলাদেশের স্থানকালে যুগপ্রভাবে বিচিত্র অনুষঙ্গ বেনো জলের মতো ঢোকার ফলে কবিতার ভাষাকেন্দ্র জোর ধাক্কা খেয়েছে, যদিও তার অর্থস্তরে এখনো সেই ধাক্কাটি এসে লাগেনি যার চাপে কবি নিজেকে জিজ্ঞেস করতে পারে,— শূন্যগর্ভ কণ্ঠস্বরটি কার যে তোমাকে শেখায় কী বলতে হবে আর কী নয়! সম্ভবত, এই কণ্ঠস্বরের জনয়িতাকে চিনে নিতে নব্বইকে আরো বহু দূর পাড়ি দিতে হবে!

নব্বইয়ের যাত্রাবিন্দু যতদূর স্মরণ হয় চেতনপ্রবাহ থেকে উঠে আসা অন্তর্মগ্ন অনুভূতি ধারণের স্বপ্ন দিয়ে শুরু হয়েছিল, যার কাফেলা সাধ্য অনুসারে সকলেই বহনের চেষ্টা করছেন। গদ্যের অন্তিমে এসে ত্রিশ বছর ব্যাপী সময় চোখের সামনে চকিত ছবির মতো ভেসে যাচ্ছে। টুটাফাটা ছবি, সময় নামের কিতাব থেকে কেটে নেওয়া বিচ্ছিন্ন পঙক্তির টুকরো, অসম্পূর্ণ দিনলিপির মাঝে উড্ডয়নে ব্যাকুল একঝাঁক ঝড়ো পাখি, অথবা জটিল ধাঁধার মতো দুর্বোধ্য মানচিত্রে বনবন লাটিমের মতো পাক-খাওয়া মুখগুলো স্মৃতিকে জ্বালাতন করছে! সকলকে আমি কোনো একদিন হয়তো ঠিকঠাক চিনতাম যখন তারা কবিতায় অনতিকিশোর ছিলেন। বয়স্যকালে তারা যখন আরো পরিণত ঠিক তখন মুখগুলো স্মৃতিতে ঝাপসা! ঝাপসাচোখে নব্বই অবলোকন কতটা সঠিক গন্তব্য পাবে সে-ব্যাপারে রচয়িতা নিজেই সন্দিহান। যে-কারণে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে যা বলার চেষ্টা করেছি তাকে পাঠকের ব্যক্তিগত অভিমত হিসেবে বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে রাখি, যেখানে বুঝের গলতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে এ-কথা কবুল যাই, স্বকীয়তা যাচাইয়ের প্রশ্নে অনুভবসংবেদি কবিতার জোয়ার নব্বই কতটা তুলতে পেরেছে তাকে পাঠপদ্ধতি করে তোলা প্রয়োজন। বাকি যা রইল, যেমন দশকি-ছকে কবিতার স্বকীয়তা অনুসন্ধানের প্রথাটিকে স্বলিখিত অনুপল দিয়ে যাচাই করে নিতে চাই। পাঠক কবির কাছে জানতে চাইছে, ‘তুমি যা লিখেছো সেটা কি নতুন?’ কবি উত্তরে হাসে, — ‘নতুন শব্দ জেনো নিজেই পুরাতন।’

পুরাতনকে নতুনের দীপায়নে অবধান করতে পেরেছেন সে-রকম সংবেদি বয়ান পাঠের আশায় দীর্ঘ প্যাঁচালের ইতি ঘটাই এখন।


গানপার ম্যাগাজিনরিভিয়্যু
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you