পূর্ব পরিচ্ছেদ / লোক দশকতামামি ৪ : বাংলাদেশের কবিতার আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা
আলোচনার এই পর্যায়ে এসে হয়তো বলা যায় প্রতিটি দশক নিজের মতো করে শ্রেষ্ঠ ও বাক্যের মধ্যস্থলে শূন্যস্থান পাঠের অপেক্ষায় বিরাজিত, এবং একে পাঠ যাওয়া কবিতার স্বকীয়তা বিচারের মাপকাঠি করা প্রয়োজন। কবিরা সকল যুগে নিজের রচনায় শূন্যস্থান রেখে যান। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ অবধি রেখে যাওয়ার ঘটনা একভাবে ঘটেছে, পরবর্তী সত্তর অবধি সেটি ভিন্ন আঙ্গিকে সাধিত হয়েছে। সুদীর্ঘ এই কালপর্বকে এখন কীভাবে এক-কথায় নব্বইয়ের ধোয়া তুলে গৌণ করি? কোন অধিকারে বলা যায় :— ‘বিস্ময়কর নয় যে, গত ত্রিশ বছর ধরে ফের চলছে নব্বইয়ের দশকের কবিতারই ধারাবাহিকতা।’—এহেন ঘোষণা নব্বই পরবর্তী দুই দশকে দেখা দেওয়া কবিগণকে খাটো করে। অধমের যৎসামান্য পাঠে মনে হয়নি অনুজ দুটি দশক নব্বইয়ের অনুলিপি হওয়ার জন্য ব্যাকুল। এই দশকপর্বে সক্রিয় কবিরা সেইসব কবিতা লেখার কোশেশ করছেন যেটি সময় তাঁদেরকে লেখার প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রণোদনা থেকে রচিত কাব্যে নব্বইয়ের সঙ্গে বহু ব্যাপারে নিবিড় ঐক্য রয়েছে, আবার পার্থক্য বা বিচ্ছেদও কম নেই। নব্বই পরবর্তী দুই দশকের কাব্যপ্রয়াসে সময়-পরিপার্শ্বকে সম্যক রূপে উপলব্ধির খামতি হয়তো রয়েছে, যুগের বাও রপ্ত করার ঘটনায় অনেকটা পথ এখনো পাড়ি দেওয়া বাকি, তবে এইসব অপূর্ণতা অচিরে কেটে যাবে সে-বিষয়ে সন্দেহের কারণ দেখি না। সকল যুগের কবিতায় ঘটনাটি ঘটেছে। সুতরাং নব্বই পরবর্তী কবিদের ব্যতিক্রম হওয়ার যুক্তি নেই। নিজের অবধানশক্তিকে ব্যবহার করে তাঁরা দুহাত ভরে লিখছেন। দুই বাংলার কবিতায় বিদ্যমান অতীত দশকগুলো হয়তো সেখানে প্রেরণা অথবা নয়। দিনশেষে তাঁদের কবিতা কিন্তু সেই চেহারা ধারণ করবে যে-রকম হলে পরে একুশ শতকের কবিতা রূপে পাঠকের তাকে চিনে নিতে বেগ পেতে হবে না।
এখন পাঠক যদি কবিতার উদ্ধৃতি ঠুকে নব্বই থেকে পরের দুই দশক কেন ও কীভাবে আলাদা সেই ব্যাখ্যা হাজির করতে বলেন তো সেদিকে পা না বাড়ানো উত্তম, কারণ এভাবে তুলনায় গমন হাস্যকর। কবি তার পূর্বে বিরাজিত মহাজনদের ভাষার বনেদ ধসিয়ে নতুন ভাষা সৃষ্টি করছেন;—এই ভুল ধারণার অবসান বরং আগে ঘটা প্রয়োজন। না, তিনি কিছু সৃষ্টি করছেন না। তার সেটি করার জো নেই। কবি কেবল নিজের যুগ-কাল-দেশ তথা পরিপার্শ্বের নফর। সময় তার মস্তিষ্কে আপনা থেকে নতুন ভাষাবোধের তরঙ্গ বহায়। এখন সেই ভাষাবোধ কলম দিয়ে নামানোর পরীক্ষাটি তাকে দিতে হচ্ছে। যার অবধানশক্তি প্রখর তিনি সেখানে অধিক মেধাবী। যুগের ভাষা রপ্ত করার পরীক্ষায় এই কবি অনায়াসে পাশ যান এবং সময়ের সেরা দৌড়বাজ বলে নাম কিনেন। এহেন কামিয়াবি কবিতায় প্রধান ও গৌণ কবির ফারাক তৈরি করে এবং সেখানে প্রধানের শংসায় আপত্তির কিছু নেই। ওদিকে যিনি ব্যর্থ হলেন যুগ তাকে মনে রাখে না। সুতরাং নব্বই পরবর্তী দুই দশক সম্পর্কে অকাট্য মন্তব্যের সময় এখনো আসেনি। তাঁদের অনেকে চমৎকার লিখছেন এবং অদূর ভবিষ্যতে দূরগামী হয়ে উঠবেন। এর অধিক মন্তব্য যোজনা সেখানে অনুচিত হয়।
মনে রাখা প্রয়োজন নব্বইয়ের সূচনালগ্ন শূন্য ও অনুবর্তী দশক থেকে ভিন্ন ছিল না। শুরুর অনধিক দশ বছরের খতিয়ান কি সকলে ভুল মেরে দিয়েছি? মনে পড়ছে ফরহাদ মজহার শূন্য দশকের সূচনায় ষাটের অহংবৃত্তে বসে নব্বইয়ের তরুণ তুর্কিদের কামান দেগেছিলেন। অভিযোগ শুনতে হয়েছিল নব্বইয়ের কবিরা নাকি কলকাতার দিকে মুখ করে কবিতা লিখে চলেছেন। ঘটনা যদিও বিপরীত ছিল! বিগত এক শতকের কালপর্বে দেখা-দেওয়া কলকাতার কবিগণকে বাংলাদেশের নব্বই পাঠ করলেও অনুকরণের তাড়া বোধ করেনি। প্রবীণ মণীন্দ্র গুপ্ত অথবা নিকটবর্তী সত্তর-আশির মৃদুল-জয়-রণজিৎদের মুগ্ধ পাঠের অর্থ এই ছিল না উনাদের প্রতিধ্বনি হওয়ার তাড়নায় নব্বইয়ের কবিরা অধীর ছিলেন। না তাঁরা ফেরত যেতে চাইছিলেন আরো পেছনে বিরাজিত শক্তিমান কবিদের কোটরে। নব্বই (*আজকের শূন্য ও পরবর্তী দুই দশকের কবিদের ন্যায়।) ঠিক সেই ভাষায় লিখছিল যা সময় তাকে লিখতে বাধ্য করছিল। পেছনের মহীরুহদের সঙ্গে মিলন ও বিরোধ দুটোই সেখানে বিরাজ করছিল, যদিও দিনের শেষে ভাষাটি ছিল নব্বইয়ে বিরাজিত সময়ভাষ্যের অনুগামী।
এ-কথা কবুল করা উচিত, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে নব্বইয়ের সিংহভাগ কবি সূচনায় ফেনিয়ে-ওঠা ভাষাতরঙ্গে ডুবুরি হওয়ার দক্ষতা অর্জনে সময় নিচ্ছিলেন; নিজেকে পাকাপোক্ত করার লড়াইয়ে মেহনত হচ্ছিল বৈকি। পরের কুড়ি বছরে তাঁরা শিখে গেলেন নব্বইয়ের ভাষার ভাও রপ্ত করে কীভাবে পরের দশকে পা রাখা যায়। সুতরাং আজকে মজনু শাহ যে-ভাষায় কাব্য রচনা করেন তার জন্ম নব্বইয়ে হলেও বিগত দশকের বৃত্তে সে এখন দাঁড়িয়ে নেই, যেমন থেমে নেই ‘লীলাচূর্ণ’ থেকে ‘বাল্মীকির কুটির’-এ আবর্তিত কবির কাব্য-স্বকীয়তা। উদাহরণটি বিগত ত্রিশ বছরের কবিতাযাত্রায় নব্বইয়ের যেসব কবি উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছেন তাঁদের সকলের ক্ষেত্রে কমবেশি খাটে। যুগ-পরিপার্শ্বের ঊর্মিমুখর তরঙ্গ পাঠে সকলে সমান মেধাবী ছিলেন এমন নয়, তা-বলে শুরুর বৃত্তে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। নব্বই নামে দাগানো দশ বছরের কালপর্ব পেরিয়ে পরবর্তী কুড়ি বছরে নিজস্ব ভাষাভঙ্গি ও কাব্যাদর্শে তাঁরা কতখানি রদবদল ঘটাতে পেরেছেন যেটি তাঁদের কবিতাকে সময়-প্রাসঙ্গিক করে তুলছে…পাঠক এখন সেই ঘটনা নিরিখনে বরং অধিক আগ্রহী। নব্বইয়ের প্রস্তুতিলগ্নে বিরাজিত ভাষা ও কাব্য-স্বভাবের সঙ্গে টক্করের দিন কুড়ি বছর আগে বিগত হয়েছে। পরবর্তী দুই দশকে বিকশিত ভাষার গহ্বরে ঢুকে তাঁরা কে কী এস্তেমাল করলেন সেই বিবেচনা এখন অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, যেখানে শূন্য ও প্রথম দশকে আবির্ভূত কবিরা একইসঙ্গে তাঁদের মিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বী বটে!
নব্বইয়ের কবিতার ত্রিশ বছরের সালতামামি যদি করতেই হয় তবে এর আদি থেকে সাম্প্রতিক বিবর্তনকে পাখির চোখ করা চাই। এই দশকে জন্ম-নেওয়া কবিরা পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক অবধি বিকশিত কবিতার ধারায় লিখতে আগ্রহ বোধ করেননি, যেহেতু আশির মধ্যভাগে এসে বাংলা কবিতা অগ্রজ দশকে লিপিবদ্ধ ভাষার বৃত্ত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিল। ওই সময়ে পা রাখা কবিদের এছাড়া উপায় ছিল না। দেশবিদেশ জুড়ে বিরাজিত ঘনঘটার প্রতিক্রিয়ায় আশির গোড়ায় সচল ভাষাভঙ্গি মধ্যপর্বে এসে স্বাভাবিক ঠেকছিল না। ময়ূখ চৌধুরী, ফরিদ কবির, মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, জুয়েল মাজহার, বিষ্ণু বিশ্বাস, শোয়েব শাদাব, কাজল শাহনেওয়াজ, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার এমনকি সত্তুরেই পরিণত সাবদার সিদ্দিকী ছাড়াও খ্যাত-অখ্যাত কবিরা নব্বইয়ের অনতিকিশোর কবিদের মনোজগতে চাপ রাখছিলেন বৈকি।
গানপার ম্যাগাজিনরিভিয়্যু
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা
- কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ - January 14, 2025
- মুরারিচাঁদ কলেজ, অশোকবিজয় রাহা এবং একটি অগ্রন্থিত রচনা || মোহাম্মদ বিলাল - January 14, 2025
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
COMMENTS