সন্ধ্যা ফুরিয়ে গিয়েছে ঢের আগে। জানালা গলিয়ে বাইরে তাকালে দেখি থিকথিকে নিবিড় অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভেতর দুই-একটা আলো জুনিপোকার মতো জ্বলে উঠেই নিভে যায়। হয়তো তখন আমরা কোনো ছোটমোট রেলস্টেশন পেরিয়ে যাই। তীব্র ঝড়ো হাওয়ার বেগে ছুটে-চলা রেলগাড়িতে বসে স্টেশনের নাম পড়তে পারি না। দামাল হাওয়ায় আমাদের চক্ষে ঘুমের ঝিমুনি ঢুকে পড়ে। আমরা চোখ খুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। ‘ঝুক্কুর ঝুক্কুর মমিসিং / ঢাকা যাইতে কতদিন / একমাস চল্লিশ দিন’ করে করে গাড়ির গতি ক্রমে শ্লথ হয়ে আসে। আর আমরা ততক্ষণে ঘুমের দেশে ঢুকে পড়েছি। গাড়ি হঠাৎ থেমে যাওয়াতে আমাদের ক্ষণিক-নিদ্রা টুটে যায়। আর কানে ভেসে আসে ‘এই কুলি কুলি’ … সঙ্গে সাগরকলা ও ডিমওয়ালার হাঁকডাক। চোখ ডলে ঘুম মুছে দেখি আমাদের গন্তব্য এসে গিয়েছে।
আবছা আলো-আঁধারের মাঝে শাদা রঙে বড় বড় করে লেখা ‘সিলেট’। আহা! এই তাহলে সিলেট! আব্বার মুখে এই শহরের কথা কত্ত শুনেছি। আব্বা ছুটিতে বাড়ি গিয়ে আমাদের কত গল্পই-না করেছে এই শহরকে নিয়ে। অথচ আমার লেখবার স্লেটটির দিকে কতবার তাকিয়ে ভেবেছি — সিলেট শহরের রঙ বুঝি এমন? এমনই ধূসর আর হিম! যে-শহরে বুঝি পেন্সিল দিয়ে নিজের নাম লিখতে হয়?
না, সেসবের কিছু নেই। আলোআঁধারির মাঝে শাদা রঙে লেখা এক শহরের নাম। রেলস্টেশনের চারপাশ খোলা আর মাথার উপর টিন-লোহার ছাউনি। প্রায় ঘোরঘুট্টি অন্ধকারের মাঝে হলদে-রঙা টিমটিমে আলো। দেখে ভূতের-আলো মনে হয়। আমাদের মনে তখন বদ্ধমূল ধারণা, ভূতেরা রাতের বেলায় হলুদ আলো জ্বালিয়ে পথ চলে। আরে বাপ! এ কী মুছিবত রে বাবা! সেই কোন সুদূর গাঁয়ের ভূতপ্রেত ফেলে আমরা কি-না খোদ ভূতের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম? টিমটিমে হলদে আলোর নিচে কোনো ভূত অবশ্য দেখতে পেলাম না। ভূতের বদলে ত্রস্ত মানুষের চলাচল। তারা ছুটছে কুলির মাথায় বাকশোপেটরা চাপিয়ে। অন্য কোনোদিকে তাকানোর অবকাশ তাদের নাই।
বড়চাচিমা আমাদের দলবল নিয়ে ট্রেন থেকে নামতেই দেখি চাচাজান দাঁড়িয়ে আছে। তার গৌর কপালের ওপর একথোকা কালো কোঁকড়ানো চুল পড়ে আছে। স্বল্পভাষী চাচাজানের সঙ্গে আমার বড়ই ভাব। সে তো আমার ‘চান্দের বুড়ি’। আর আমি তার ‘কটাশাশুড়ি’! লাল উর্দিপরা বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলির দল আমাদের ঘিরে ধরেছে। চাচাজান দুইজনকে ডেকে মালসামান তুলে দিলো। আমাদের সঙ্গে নিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেটে দেশলাইয়ের আগুন ধরাল সে। এতে করে আমাদের ভূতের ভয় কিছুটা দূরীভূত হলো। আগুন দেখলে ভূতেরা আর কাছে ঘেঁষতে পারে না। আমরা রেললাইনের স্লিপারের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলে নিচ্ছি। আমাদের পাশের লাইন ধরে রেলগাড়ির ইঞ্জিন চলে গেলে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। বলা তো যায় না, ইঞ্জিনটা আমাদের গায়ের ওপর ঢলে পড়তে কতক্ষণ? যদি ইঞ্জিনটা লাইন থেকে পিছলে যায় তাহলে কী হবে ভেবে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবার উপক্রম।
আমরা হাঁটতে থাকি, হাঁটতেই থাকি, পথ আর ফুরোয় না। আমাদের আগেপিছে লাল রঙের উর্দিরা মাথার বোঝার ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর আমরা একটা বাসার সামনে চলে আসি। বাঁশ দিয়ে জালির মতো করে বানানো গেট। গেট খুললে পাকা রাস্তা দরোজা পর্যন্ত চলে গেছে। রাস্তার দুপাশে ইট বাঁকা করে গেঁথে বেশ একটা জ্যামিতিক নকশা নজরে পড়ে। রাস্তার পাশের বাদামি মাটিতে ছিটকি ছিটকি পাতাবাহারের সারি। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে এসব আমাদের চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চাচাজান আগে আগে গিয়ে দরোজা নক করলে একজন নারী দরোজা খুলে দেয়। ছোটখাটো উচ্চতার বেশ ভারী দেহের সে। ফ্যাকাশে মুখাবয়ব। চুল চুড়ো করে বাঁধা। কপাল ও কানের পাশে কিছু কালো কুন্তল সরলরেখার মতন পড়ে আছে। মুখভর্তি পানের রস সামলে সে কলকলিয়ে ওঠে — আফায় আইয়া পড়ছে! আহুন আহুন! — বলে সে লাল উর্দিদের ভেতরে যাবার পথ করে দেয়। বাকশোপেটরার স্তূপ একপাশে রেখে লাল উর্দিরা মাথায়-বাঁধা গামছা খুলে ফেললে তাদের রুখু চুল ঝামলে পড়ে। চাচাজান মানিব্যাগ খুলে ওদের পাওনা মিটিয়ে দিলে নিমিষে লালরঙ মিলিয়ে যায়।
এতক্ষণে আমরা বাসাটা ঘুরে দেখার সুযোগ পাই। আড়াইখানা কক্ষের বাসা। আলাদা পাকঘর। আলাদা স্নানঘর আর আলাদা টাট্টিখানা। পাশাপাশি দুইখানা ঘর। একটা ঘরলাগোয়া ওই আধখানা ঘর জানালা-দরোজাবিহীন। পাশে আধখানা খোলা বারান্দা। বারান্দার সামনে প্রশস্ত উঠান। কিন্তু সব পাকা করা। অর্থাৎ ইট-সিমেন্টের শক্ত আবরণ। সারা বাসার কোথাও কাঁচামাটির চিহ্নমাত্র নাই। হায়! এ কোথায় এলাম? চট করে মনে উদয় হয় —
কোথা সে-ঘাট সই
কোথা সে-জল?
কোথা সে-অরুণিমা!
সায়র অতল!
কই রেখে এলাম আমার আদিগন্তবিস্তারী জলের ঘাট? সবুজ গাছলতার নিবিড় সন্নিবেশ? আর ছায়াচ্ছন্ন বকুলতলা? ঝড় এলে কলার পাতা ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়া? দমকা হাওয়ার সবুজ-হলদে-কমলা পাতাদের পথে পথে ওড়াউড়ি! ঢেঁকিশাকের জঙ্গল, গুঁইসাপেদের লেজ আছড়িয়েপাছড়িয়ে চলে যাওয়া!
একদুয়ারী বাড়িতে বাদামি মাটিতে ভর করেই আমরা হেঁটে বেড়িয়েছি। শীতের মরশুমে বাইর-বাড়িতে পরবের সেমাইয়ের মতো দূর্বাঘাসের ওপর টলটলে শিশির দেখে দিদি স্যান্ডেল খুলে ফেলে হেঁটে বেড়াত। হাঁটতে হাঁটতে আপন মনেই বলত —
উশের পানি পায়ে লাগলে চক্ষের জ্যুতি বাইড়া যায়, আহো বইন, জুতাডা খুইল্যা আমার নগে হাঁটো।
দিদির সাথে হেঁটে হেঁটে উশের পানি আর মরা দূর্বাঘাসে দুইপা মাখামাখি করে ফেলেছি। মরা ঘাসে পা চুলকাতে শুরু করলে হাঁটা ক্ষান্ত দিয়েছি। হায়! এ কোন অচেনা দেশে এলাম আমরা? যেখানে ঘাস দূরে থাকুক, সামান্য মাটি পর্যন্ত নাই!
রান্নাঘরের কেরোসিনের স্টোভে রান্না করছে ওই মানুষ — যে আমাদের দরোজা খুলে দিয়েছিল। চাচাজানের রান্নার বুয়া — মর্জিনার মা। খুশবু ছুটিয়ে মশুরের ডাল সম্ভার দিচ্ছে! ডাল সম্ভারের সুঘ্রাণে আমাদের পেটের ভিতর খিদে জেগে উঠছে। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা হতে চলেছে আমাদের ভাত খাওয়া হয় নাই। ট্রেনের পুরো রাস্তা আমরা খেয়েছি পাউরুটি আর সাগরকলা। ডিম, চানাচুর ইত্যাদি। মর্জিনার মা চুল চুড়ো করে বেঁধে আমাদের জন্য রান্না করছে।
আমরা কান খাড়া করে আছি — ভাত খাওয়ার ডাক কখন আসবে।
আমাদের কাছে মনে হচ্ছে কত যুগ পেরিয়ে গিয়েছে আমাদের ভাত খাওয়া হয় নাই। আমাদের উথলানো খিদের মাঝে এক বালিকা এসে দাঁড়ায়। লম্বায় প্রায় আমার মাথাসমান। পরনে সালোয়ার-কামিজ-ওড়না। সুতির ওড়নাটা দিয়ে সে খুব ভালো করে শরীর ঢেকেঢুকে রেখেছে। এসেই আমাকে বলে,
— এই তোমার নাম কি?
আমি স্বর নিচু করে বলি, — পাপড়ি।
— পাপড়ি? এইডা আবার কিমুন নাম?
কি বলব আমি? আমার নাম পাপড়ি কেন বা এটা কেমন নাম সেসব কিছুই তো আমি জানি না।
বালিকার চুল খুব করে তেল দিয়ে কষে দুইবিনুনি করা। কানের পাশে লাল ফিতার ফুল ফুটে রয়েছে! আমি আদতে তার গায়ের জোব্বা দেখে ভয় পেয়ে গেছি। কি বলব বুঝতে পারছি না। এমনিতেই আমি অনর্গল কথা বলে যাই। বা বলতে পারি। কিন্তু এই প্রায় গাঢ়-হয়ে-ওঠা রাত্তিরে আমি যেন খামাখাই তব্দা মেরে গিয়েছি। বালিকা ধবধবে শাদা দাঁতে হেসে বলে,
— চল চল আমাদের বাসায় চল।
আমি কুঁকড়ে উঠি। আমি তাকে কোনোদিন দেখিনি, চিনি না, তার বাসায় কীভাবে যাব? তাও এই রাত্তিরে?
বড় চাচিমা চোখ ইশারা করে বলে, — যাও।
বালিকা হেসে বলে,
— আমি তোমাদের পাশের বাসায় থাকি। আসো আমার সাথে।
সংকোচে আমার পা জড়িয়ে আসে। যাব কি যাব-না’র দ্বন্দ্ব আমাকে আটকে রাখতে চায়। আর আমি এটাও বুঝে উঠতে পারি না এ-রকম ঘন রাত্তিরে কেউ এসে কীভাবে তার বাসায় আমাকে যেতে বলে?
বালিকার সাথে বের হলে দেখি তাদের বাসা সত্যি আমাদের পাশেই। মাঝে খালি জায়গায় অজস্র ঘাস জন্মে আছে। রাতের বেলায় স্পষ্ট করে অবশ্য বোঝাও যায় না সেইসব শুধু ঘাস নাকি জলা-জংলা?
চলবে
- সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান - July 8, 2020
- সুরমাসায়র ১১ || পাপড়ি রহমান - July 2, 2020
- সুরমাসায়র ১০ || পাপড়ি রহমান - June 23, 2020
COMMENTS