রচনাবিরতি, প্রকাশবিরতি, সৃজনবিরতি

রচনাবিরতি, প্রকাশবিরতি, সৃজনবিরতি

খ্রিস্টাব্দ দুইহাজার সমাপনলগ্নে ওয়াইটুকে/মিলেনিয়ামবাগজনিত ভয়ভীতি, নস্ত্রাদামাসের প্রলয়পূর্বাভাস, ইত্যাদি বিচিত্র হুল্লোড়-হুজ্জোতির সঙ্গে একটা ব্যাপার অলক্ষেই ঘটছিল। গোটা আশি এবং নব্বইয়ের দশক জুড়ে ব্যান্ডসংগীত বাংলাদেশে যে-সৃজনোল্লাস চালায়, দেখি আমরা বাংলাদেশের মিউজিকসিনে ব্যান্ডসংগীতকে যেই সৃজনোল্লাস চালাতে, সেই স্রোতে ধীরে ভাটার টান শুরু হয় এই সময়েই। বিবিধ কারণ রয়েছে এর পেছনে, এসব নিয়া ত্যানা প্যাঁচানো অন্যত্র হতে পারে, এই নিবন্ধিকায় ব্যক্তিকেন্দ্রী সৃজনবিরতির এক-দুটো ঘটনা টানা যাবে বিষয়ের অভিমুখ খেয়ালে রেখে।

এই সময়টাতেই প্রাযুক্তিক স্ফীতি ও অন্যান্য উন্নয়নের ফলে বাজার ও বিপণনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে দেখা যাবে। এতদিনকার বাজার ও বিপণনকাঠামো, রেকর্ডিং-ব্রডকাস্টিং-টেলেকাস্টিং প্রক্রিয়াও, বদলাতে থাকে দ্রুত। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এই সহসা পরিবর্তমান পরিস্থিতির অভিঘাত লক্ষ করা যাবে ভারতীয় বঙ্গের বাংলা গানেও। অনেকদিন পর্যন্ত সুমন চট্টোপাধ্যায় (ধর্মান্তরণের পর কবীর সুমন) রেকর্ডিং করা বা নতুন গানবাঁধা থেকে বিরত থাকতে দেখা যাবে। এরপর সুমন প্রচুরভাবে গানে নিয়মিত হবেন অবশ্য, পুরনো কায়দায় রেকর্ডিং স্টুডিয়ো ব্যবহার করতে দেখা প্রায় যাবে না বলতে গেলে, অনলাইন অ্যাক্সেস্ যারা রাখেন তারাই পরিবর্তিত সুমনের সংগীতসৃজনের নিয়মিত খোঁজপাত্তা পাবেন এবং উপভোক্তা হবেন। কুড়ি বছর প্রায় একটানা অ্যালবাম প্রকাশ করেন না মৌসুমী ভৌমিকও।

সুমনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ডামাডোলের ভিড়ে নানাবিধ সক্রিয়তা চাক্ষুষ হলেও পুরোপুরি বোঝা যাবে না তার গানবিরতির নেপথ্য ঘটনাটা আসলে কোথায়। ফিডব্যাকের মাকসুদুল হকের তীব্রতাও লক্ষণীয়ভাবে স্তিমিত হয়ে যেতে দেখা যাবে এই সময়টায়। ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ড দিয়া ম্যাক দুর্ধর্ষভাবে স্টার্ট করেও দুইদশক প্রায় বিপর্যস্ত স্টুডিয়ো-মঞ্চের বাইরে নেপথ্যে থেকে যেতে দেখা যায়। কেন এই বিরতি, কেন এই নীরবতা, জানি না। আমরা আরও লক্ষ করব, বব ডিলান যেমন তুঙ্গস্পর্শী সাফল্য সত্ত্বেও টানা দুই দশক মঞ্চের বাইরে মিডিয়ার আড়ালে রয়ে গেলেন, পরে অবশ্য নোবেল ইত্যাদি অ্যাওয়ার্ড অ্যাচিভ ও রিসিভ করা নিয়া নাটকে তারে দেখা যাবে যদিও, অঞ্জন দত্তও ক্রমে গানরচনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনে সিনেমাবানানো ও ব্যবসাবাণিজ্যে নিয়োজিত হচ্ছেন দেখব। কোহেনের ক্ষেত্রে একটু অন্যভাবে হলেও রচনা/প্রকাশবিরতি নিতে দেখব বড় লম্বা টাইম পর্যন্ত উনারে, লেনার্ড কোহেন জেনধর্মী নির্জনতায় আশ্রমবাসের দীর্ঘ মেয়াদ পার করে লোকালয়ে এসে ফের বিরতি নিতে দেখব এবং মরার আগে কয়েক বছর অভাবিত অন্য ঔজ্জ্বল্যে স্টেজে ফেরত পাবো। অসংখ্য ব্যান্ডের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে, এই বিরতিজনিত অঘটন সংঘটিত হতে দেখা যাবে।

এই ব্যাপারগুলো ভাবায় আমাকে। কেন এই মুখ-ফিরিয়ে-নেয়া, কেন এই পাশ-ফিরে-থাকা, কেন এই নিরাসক্তি? কিয়দ্দিন বাদে একভাবে গানে ফিরলেও সুমন বলেননি, কিংবা ম্যাক ও অঞ্জনও বলেননি, ডিলানও মুখ খুলেননি এখনো। কোহেন নানা সাক্ষাৎকারে শেষের দিকে সেই নির্জন ধ্যানকাল ও ব্যক্তিগত-বহু-ক্ষয়ক্ষতি-স্বত্ত্বেও প্রশান্তি ফিরিয়া পাবার ব্যাপারে বেশ তার স্বভাবসুলভ মিতভাষী বিস্তারেই বলেছেন দেখব, তবু বলেছেন কি সবটুকু? তবে আমরা, সাধারণ শ্রোতা যারা গান ও গানের প্রাণ নিয়া ভাবিচিন্তি কিঞ্চিৎ, খানিকটা আন্দাজ করতে পারি বৈকি, কেন এই প্রতিভাবানদের চুপচাপ-থাকা।

আমার মনে হয়, অনেকদিন গাইতে গাইতে নিজের একটা ঘরানা নিজের একটা পথ তৈরি করে নেবার পর একজন মাকসুদ বা অঞ্জন বা সুমন বা ডিলানের মতো শিল্পী যখন দেখেন যে পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছুই হচ্ছে না আর, তখনই, বোধহয়, বিরতির সিদ্ধান্ত নেন তারা। আবার, এমনও হতে পারে যে, তাদেরই তৈরি-করা পথে হাঁটতে শুরু করে একদল পথসন্ধিৎসু পথিক বা তীর্থসন্ধিৎসু পরিব্রাজক এবং পেয়ে যায় প্রত্যেকেই বেশ জলাশয়/জলসত্র, কিন্তু পথ কেটে দিলো যেই মিস্ত্রী — তার পানিতৃষ্ণা মেটাতে বাড়িয়ে দেয় না কেউ সোরাহির মুখ! — এইসব দেখেই, হয়তো, অঞ্জন/মাকসুদ/সুমন/কোহেন/ডিলান বা সৎ-প্রতিভাবান/প্রতিভার-কাছে-সৎ-থাকা একজন শিল্পস্রষ্টা অভিমানে ফিরিয়ে নেন মুখ, বালিতে গুঁজে রাখেন মাথা। আবার বাজারের কারসাজিও হতে পারে বৈকি। নিশ্চয়, হ্যাঁ, হতে তো পারে অনেককিছুই।

কিন্তু, যত-যা-কিছুই হোক, গোঁ ধরে থাকেন নিশ্চয়ই, নতুন আরেকটা নির্জন পথ তৈরি করবেন বলে! আমার ও-রকমই মনে হয়। আবার এমনও হতে পারে যে, স্রেফ চণ্ড এক রাগে — চারপাশের মূর্খামি, চারপাশের অকৃতজ্ঞপ্রবণতা ইত্যাদির প্রতি রাগ — বিরত থাকেন তারা তাদের সৃষ্টিক্রিয়া বা গানরচনাধারা থেকে। অথবা গানরচনা বা সৃষ্টি ঠিকই চলে তলে-তলে, রেওয়াজও হয়তো, প্রকাশ করেন না শুধু। লোকালয় এড়িয়ে চলেন। হয়তো, হতে পারে, এই সমস্তই, বা এগুলোর কোনো একটা, কারণ।

তবে একটা ব্যাপার বোধহয় হলফ করেই বলা যায় যে, প্রতিভাবানের পুনরাবৃত্তিও অনেক আলোময়, হীরেময়, মণিমুক্তোময়। যে পায়, মায়েস্ত্রোদের অপরিমেয় অপচয়ের মধ্যেও খুঁজে পায় সে তার ডিজায়ার্ড উপাদান-অনুপানগুলারে। এইটা আমার মনে হয়। ম্যাকের ক্ষেত্রে রিপিটেশন্ অল্প লক্ষ করা গেলেও বর্ণিত অন্যদের গানপ্রচুরতা ম্যাকের চেয়ে বহুগুণে বেশি হবার কারণে তাদের সাংগীতিক ও অন্যান্য পুনরাবর্তনও প্রচুর। এইটা যেমন সুমনে, তেমনি ডিলানে, তেমনি অঞ্জনেও লক্ষ করা যাবে।

অ্যানিওয়ে। একজন মার্গশিল্পীর কাজই হচ্ছে তার স্বভাবের সুলুক সন্ধান করা, তার মেজাজের অনুকূল স্বর খুঁজে ফেরা, তার নিজের স্বাক্ষর রপ্ত করে নেয়া এবং সেই স্বাক্ষর তার সারাজীবনের কাজে রেখে রেখে যাওয়া; আর সেই স্বাক্ষর চোখে পড়া মাত্রই আমরা দেখে উঠতে পারি যেন পূর্ণাঙ্গ তার অবয়ব, এই ব্যবস্থা করা। আর বাজারের ভিতরে থেকেও গোঁ ধরে রাখা। আমরা, সাধারণ বুদ্ধিচালিত পরিবহনেরা, নানাবিধ তফসির-তর্জমান্তরে মেতে রইলেও রচনাবিরতির/সৃজনবিরতির/প্রকাশবিরতির পেছনে ক্রিয়াশীল ব্যাখ্যাটা আদৌ ধরতে পারার দাবি করতে যেয়ে একটু হলেও থমকাব। তবে ট্যা বললেই নির্ঘাৎ ট্যাংরা ছাড়া কিচ্ছুটি বোঝে না যারা, ট্যারান্টিলা বা ট্যারাডিক্টাল বুঝবে এমন তো দূরাশা, তাদের বোঝাবুঝি দিয়াই বিশ্ব দৌড়ায়া আগাবে।


লেখা / জাহেদ আহমদ || প্রচ্ছদচিত্র / সত্যজিৎ রাজন

… …

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you