দিন কয়েক বাদে আব্বা আমাকে একদিন অগ্রগামীতে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এল। আবেদা খানম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের চাইতে পাঁচগুণ বিশাল আমার নতুন ইশকুল। অজস্র নতুন নতুন মুখ। আমি তাদের কাউকেই চিনি না। তাদের ভাষাও তেমন বুঝি না। তারা যখন নিজেরা নিজেরা কথা বলে আমি তাদের কথার একবর্ণও বুঝতে পারি না। বোকার মতো হা করে তাকিয়ে থাকি। আবার ক্লাসের টিচারদের কথাবার্তা বুঝতে আমার তেমন অসুবিধা হয় না। কিন্তু নানান কারণে আমি বেজায় সঙ্কুচিত হয়ে থাকি। যেমন ক্লাসে যারা যারা আছে তারা প্রায় একমাস আগে থেকেই ক্লাস করছে। ফলে তাদের সাথে আমার পড়া ধরতে সমস্যা হচ্ছে। তাদের সাথে মিশতেও সমস্যা হচ্ছে। আমার ইশকুলইউনিফর্ম এখনও বানানো হয় নাই। এদিকে আম্মাও করটিয়া থেকে আসে নাই। শাদারঙা ইউনিফর্মের বদলে আমি অন্য রঙের জামা পরে যাওয়াতে আমাকে নিশ্চয়ই দলছুট মনে হয়। আমি প্রায়ই একটা শব্দ শুনি —
‘তুমি বেঙ্গলি তুমার লগে মাততাম নায়।’
আমি এই ‘বেঙ্গলি’ নিয়ে বেশ ধন্দে পড়ি। ‘বেঙ্গলি’ মানে কি? আবেদা খানমে পড়া অবস্থায় আমি ছিলাম সকলের নয়নের মনি। যাকে বলে সর্বেসর্বা। কারণ আমাদের বাড়ির পরিচিতি; — আমার দুই ফুপু এই ইশকুলের টিচার। আমার দুই দাদাও টিচার। ভদ্র ও উঁচু খানদানের মেয়ে বলে আমাকে সবাই যথেষ্টই স্নেহ করেছে। তাছাড়া আমি ছাত্রীও ভালো ছিলাম। পরীক্ষায় প্রথম/দ্বিতীয় হয়েছি। এখন এখানে এসে আমাকে একবারে চুপসানো বেলুন হয়ে থাকতে হচ্ছে। কেউই আমাকে তেমন পাত্তাটাত্তা দিচ্ছে না। উপরন্তু বুলিয়িঙের শিকার হচ্ছি। যেমন আমাকে টিফিন না দেয়া। ক্লাসক্যাপ্টেন বলে দিয়েছে —
‘তুমি বেঙ্গলি তুমারে টিফিন দিতাম নায়।’
এ কী অবস্থা! টিফিন বলতে তো একটা করে কালোজাম, নয়তো বেকারির একটা বিস্কুট, নয়তো চম্পাকলা। সবার হাতে দিতে দিতে আমার কাছে এসে ক্যাপ্টেনের হাতটা যেন থেমে যায়। তার হাত থেকে কিছুতেই মিষ্টিটা আমার হাতে পড়তে চায় না।
তাছাড়া আমি বসিও একেবারে পেছনের বেঞ্চে। কারণ নতুন ক্লাসে উঠে যে-যার মতো করে আগেভাগেই জায়গা বেছে নিয়েছে। আমি পরে এসেছি বলে আমার জন্য নির্ধারিত জায়গা পেছনের বেঞ্চ। আমাকে টিফিন না দিক, আমি কতকিছু যে কিনে খেতে পারি! আব্বা আমাকে প্রতিদিনই আটআনা করে পয়সা দেয় টিফিন খাওয়ার জন্য। তবুও আমার মনখারাপ হয় ক্লাসের টিফিন খেতে না পেরে। মনখারাপ হয় আমার সাথে তেমন-কেউ মেশে না বলে।
প্রায়ান্ধকার একটা ক্লাসরুম। আমার চাইতেও পেছনে বসে একটা মেয়ে। সে একাই একটা বেঞ্চে বসে। আর কেউ তার সাথে মেশে না! আমি তার নাম জেনে নিই — মঙ্গলা।
মঙ্গলার মাথাবোঝাই উকুন। তেলচপচপে কোঁকড়ানো চুলে অজস্র উকুন হেঁটে বেড়ায়। কিন্তু মঙ্গলা একবারও মাথায় হাত দেয় না। মাথা চুলকোয় না। তার সাথেও কেউ তেমন কথা বলে না। পরে জেনেছি মঙ্গলার বাবা ইশকুলের দারোয়ান নাকি দপ্তরী। আমার পেছনে এককোণে অন্ধকারের ভেতর মঙ্গলা যেন আরও খানিকটা অন্ধকার হয়ে বসে থাকে। তার অনুজ্জ্বল পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে যেন আরও গুটিয়েশুটিয়ে। আমি মঙ্গলার সাথে নিজের মিল খুঁজে পাই। মঙ্গলা ইশকুলড্রেস পরে না, আমিও পরে আসি না। আমরা দুজনই সিভিল ড্রেসে ইশকুলে আসি। দুজনেই পেছনের বেঞ্চে বসি। মঙ্গলার সাথে আমি ভাব করতে চাই, কিন্তু সে আমাকে একদম পাত্তা না দিয়ে একা একা বসে থাকে। আমার কথার জবাব পর্যন্ত দেয় না।
এর মাঝে একদিন এক মেয়ে আমাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করে। আমি তার নাম ভুলে গিয়েছি এতদিনে। সে ছিল খুব ফর্শা আর সিল্কি চুলের মেয়ে। অবশ্য অগ্রগামীর বেশিরভাগ মেয়েরাই অদ্ভুত ধরনের ফর্শা ছিল। একেকজন দেখতে একেবারে চিনির পুতুলের মতো। তার হাসাহাসির কারণ আমার ‘বেঙ্গলি ভাষায়’ কথা বলা। তার বুলিয়িঙের জ্বালায় প্রায়ই আমার খুব কান্না পায়। এদিকে আম্মাও আসে নাই। আমি কাউকে কিছু বলতে না-পেরে চুপ করে থাকি। কিন্তু সে আমাকে নিয়ে হেসেই যায়। হেসেই যায়। আমি একদিন জলপাইয়ের আচার খাচ্ছি, সে হাসতে হাসতে বলে —
‘কিতা বেলফই তুমার বালা লাগেরনি?’
আমি ধরতে পারি না সে কি জানতে চাইছে, নতুন একটা শব্দ শুধু আমার কানে ঠং করে বাজে। আমি জিজ্ঞেস করি —
‘কী বললে এটার নাম? জলবেল? ফইবেল?’
এটা-সেটা বলতে বলতে আমি বলে ফেলি —
‘এটার নাম কি জলবাল?’
সে আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। যেন সে কোনো ছেঁড়া ঘুড়ি, ভোকাট্টা হয়ে হাওয়ার টানে দুলছে। তার হাসি কিছুতেই থামে না। আমিও বিব্রত মুখে বসে থাকি। চুপ করে জলপাইয়ের আচার খেতে থাকি। কিন্তু মেয়েটা কি বলল সেটা মাথা থেকে তাড়াতে পারি না।
আমাদের বাড়িতে জলপাইকে বলে জলফই বা জলপই। মেয়েটার বলা অই নতুন শব্দ আমি অবশ্য কিছুদিন পরেই শিখে নিয়েছিলাম।
অগ্রগামীতে ভর্তি হওয়ার পরে আমি ইশকুলে যাতায়াত করছিলাম বাসে করে। একদার টকটকে লালরঙ ম্লান-হয়ে-যাওয়া একটা ইশকুলবাস। অনেকটা পুরনো-হয়ে-যাওয়া শুকনো মরিচের গুঁড়োর মতো রঙ। আব্বাই আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিল বাসটা। বলে দিয়েছিল —
‘ভোরবেলায় তোমার বাস আসবে। বাস এলেই তুমি উঠে পড়ো কিন্তু।’
আমি আব্বার কথামতো মেস থেকে খানিকটা পথ হেঁটে রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বাসটা থেমেই তড়িঘড়ি হর্ন বাজাত। খুব বিদঘুটে ছিল সেই হর্ন। যেন কোনো পথভোলা রাজহাঁস ঘ্যাসঘ্যাসে স্বরে ডেকে চলেছে। যেন দ্রুত না-উঠলে এক্ষুনি সে হারিয়ে যাবে। হারিয়ে চলে যাবে অন্য কোনো বিলে বা নদীর মোহনায়। ফলে আমি পড়িমরি করে দৌড়ে যেতাম। আব্বা আমাকে একটা ক্রিম রঙের বকলেস লাগানো ব্যাগ কিনে দিয়েছিল বইখাতা নেবার জন্য। বইয়ের ভারে কয়দিনেই ব্যাগটা ছিঁড়ে যাবে যাবে ভাব হয়ে গিয়েছিল। সেই ব্যাগ কাঁধে ফেলে আমি দৌড়ে বাসের পেটে ঢুকে পড়তাম। প্রায় দিনই বসার জায়গা পেতাম না। পেলেও একেবারে পেছনের সিট। পেছনে বসতে আমার একটুও ভালো লাগত না। কারণ আমি বাসের জানালা দিয়ে রাস্তার দৃশ্যাবলি দেখতে ভালোবাসতাম। অজস্র মানুষের চলাচল, রিকশা, গাড়ি, সাইকেলের বহর।
চলন্ত বাসের বাইরের দৃশ্য ছাড়া ইশকুলে আমার ভালো লাগার তেমন কিছুই ছিল না। তাও যেতাম প্রতিদিনই। আমি তখুনি জানতাম বাসায় থাকার চাইতে ইশকুল ঢের বেশি আনন্দের।
একেবারে অচেনা শহর, অচেনা মানুষ আর অচেনা ভাষার ভিড়ে আমি একজন বন্ধু খুঁজে পেলাম। সে অবশ্য আমার সেকশনে পড়ত না। সে বসত ‘এ’ সেকশনে। তার নাম পান্না। সে আমার মতোই ‘বেঙ্গলি ভাষায়’ কথা বলত। ক্রমে আলাপ করে জেনেছিলাম ওদের আসল বাড়ি ঢাকায়, ধামরাইয়ে। ধামরাই আমার নানার বাড়ি। সেই সূত্রে ওকে আমার খুব আপন মনে হতো। মনে হতো আর যা-ই হোক ও আমায় কোনোদিন বুলিয়িং করবে না। পান্না ওইটুকু বয়সেই অনেক গয়নাগাটি পরে আসত। ওদের সোনার গয়না বানানোর দোকান ছিল। পান্নার মুখটা দেখতে ভারি মিষ্টি ছিল। মিষ্টি চেহারায় নাকফুল পরে আসত ও। ঠোঁটের ঠিক ওপরে যেখানে নোলক পরে সেখানেও ও গয়না পরত। খুব সম্ভবত নাকঠাসা ওই গয়নার নাম। ওর নাকের ছিদ্রপথে স্বর্ণের ঝিলিক দেখা যেত। আমি ওর নাকের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। টিনের স্যুটকেসে করে পান্না ইশকুলের খাতাবই নিয়ে আসত। আর আমি টিফিনের ঘণ্টা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। কারণ টিফিনের ছুটি হলে আমি ‘বি’ সেকশনে যেতে পারব। পান্নার সাথে দেখা করতে পারব। দুজনে নিজেদের মতো করে ‘বেঙ্গলি ভাষায়’ অনর্গল কথা বলতে পারব।
চলবে
- সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান - July 8, 2020
- সুরমাসায়র ১১ || পাপড়ি রহমান - July 2, 2020
- সুরমাসায়র ১০ || পাপড়ি রহমান - June 23, 2020
COMMENTS